((১৮+ সতর্কতা)
ব্লাউজের হুক আস্তে আস্তে লাগিয়ে বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় মিম। খেয়াল করে ঠোঁটের লিপস্টিক মুখের বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেপ্টে আছে। ঠোঁটে লেপ্টে যাওয়া লিপস্টিক টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে বিছানার দিকে তাকায় মিম । উলট পালট বিছানায় এখনো অসভ্যতার চিহ্ন বিদ্যমান। মারুফ তখনো বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিমের দিকে তাকিয়ে হাসে, আজ কি একটু বেশি হয়ে গেলো ?
মিম কিঞ্চিত লজ্জ্বায় লাল হয়, আজকাল একটু বেশি অসভ্য হয়ে গেছো তুমি। এত পাগল হয়ে যাও বিছানায়। রোজ বউয়ের সাথে থেকেও আমার কাছে আসো । তারপর ও এত এনার্জি আসে কই থেকে ?
মারুফ কিছু বলার আগে মিমের ফোন বেজে উঠে।
বেজে যাওয়া মোবাইল ফোন রিসিভ করেই বেশ শান্ত গলায় বলে, মামুন আমি রেহানা ভাবীর বাসায় ড্রেসটা সেলাই করতে দিতে এসেছিলাম। তারপর বাচ্চাটাকে স্কুল থেকে নিয়েই ফিরছি।
ফোন রাখতেই মারুফ হেসে উঠে। কী সুন্দর মিথ্যা বলতে পারো তুমি।
তোমার জন্যই তো বলতে হয়। আচ্ছা আমি যাই।
বউ থাকার পর ও কেন তোমাকে বার বার ডাকি, সে উত্তরটা শুনে যাবে না মিম।
এখন না, পরে ফোনে শোনবো। এখন গেলাম ।
আচ্ছা।
মিম লিপস্টিক মুছে কপালের টিপ ঠিক করতে করতে বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, যাক বাবা মিথ্যা কথা বলে মামুনের কাছে থেকে এবারের মত বেঁচে গেলাম। মারুফ যখন তখন ডাকে, কি যে পাগলামি করে। ইদানিং তার পাগলামিটা বেড়ে গেছে। এই অনৈতিক সম্পর্কে থেকে কতবার বেরিয়ে যেতে চেয়েও পারেনি, কী একটা নিষিদ্ধ নেশায় পেয়ে বসছে। হাজার বার যাব না বলে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর মারুফের ফাইনাল কল সে আর আগ্রাহ্য করতে পারে না। নিজের সমস্ত অস্তিত্ব তাকে বিলিয়ে দিলেই মনে হয় সুখ। আদৌ কি সেটা সুখ মিম তা জানে না। স্বামী হিসেবে মামুন যতই তাকে অসম্মান করুক, যতোটা তাকে একাকিত্বে রাখুক তবু মামুনকে ঠকানো কি তার উচিৎ হচ্ছে।
তাও সে জানে না। সাময়িক সুখের পরশের জন্য তার সামনের ভবিষ্যৎ আস্তে আস্তে ক্রমশ ধসূর বর্ণ হচ্ছে, হবে এটা নিয়ে সে আর সন্ধিহান না। আজ হোক কাল হোক মামুন তা জানবে। তখন হয়ত জীবনের শেষ ঝড় আসবে। তা থেকে নিজের ঘর বাঁচানো কি কঠিন হবে ?
কিছুই আর ভাবতে পারে না। মারুফের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে নেমে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। ঝুম ঝুম বৃষ্টি নামে। এক জীবনে মামুনের সমস্ত অবহেলার জবাব দিতে গিয়ে সে জড়িয়ে পড়েছিল তার ছেলের স্কুলের অন্য এক বাচ্চার বাবার সাথে। লোকটার নাম মারুফ। তাদের সম্পর্কের বয়স তিন বছর। তারা দুজনই নিজেদের সংসারে একাকিত্ব ফিল করত, অনেক না পাওয়া তাদের ছিল। সেই থেকে দুজন বন্ধু তারপর গল্পে গল্পে কাছে আসা।
কিন্তু এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পরিণাম ভেবে মিম বেশ অশান্ত হয়, বার বার চিন্তিত হয়। তবে কিসের নেশায় যেনো বেরিয়ে আসতে চাইলেও পারছে না।
রিক্সা ডাকে যতক্ষণে ততক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে যায়। মনে হয় এ এক অন্যরকম প্রশান্তি। রিক্সায় উঠতে যাবে তখনি একটা প্রাইভেট কার থামে তার সামনে। গাড়ির গ্লাস খুলে মামুন বলে, গাড়ীতে উঠো ..
ভয়ে, লজ্জ্বায় কেমন যেন কুকড়ে যায় মিম। তবুও দরজা খোলে মামুনের পাশে বসে। আমি রেহানা ভাবীর বাসা থেকে ফেরার পথে সিনএনজি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। তাই রিক্সা খুঁজছিলাম।
আমি তোমাকে কোন প্রশ্ন করিনি মিম। তাছাড়া এই জায়গায় কিংবা আশে পাশে রেহানা ভাবীর বাসা না। স্কুল আজ জলদি ছুটি হয়ে গিয়েছিলো, তোমাকে স্কুল থেকে ফোন দিয়েছিল, কিন্তু তোমার ফোন অফ থাকায় স্কুল থেকে আমাকে ফোন দিয়েছিলো।
মিম কি বলবে বুঝতে পারছে না। মারুফের সাথে চুড়ান্ত মুহুর্তে ফোন আসছে দেখে মারুফ অফ করে দিয়েছিলো। পরে অন করেছিলো, কিন্তু আর নোটিফিকেশন দেখা হয়নি।
না মানে…
মিম স্কুল থেকে ফোন দেয়ার পাঁচ মিনিট পরে রেহানা ভাবী আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, তোমাকে না পেয়ে। বাচ্চাটা অনেকক্ষণ উনার কাছে ছিলো। আমি ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে কবেই বাসায় ফিরেছি, দেখলাম তুমি বাসায় নেই। আমি জানি তুমি কই থাকবে তাই এখানে আসা। কাছাকাছি এসেই তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম, তুমি বললে রেহানা ভাবীর বাসায়। অথচ তুমি এইখানে অন্য আরেকজনের ফ্ল্যাটে। মারুফ সাহেব যে ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন সেটা আমার বন্ধু রাকিবের। তাই এখান থেকে তথ্য পাওয়াটা আমার জন্য কষ্টসাধ্য না।
মিম কেবল শুনে যাচ্ছে। ভয়ে সে কেঁপে উঠছে বার বার। যা আশংকা করেছিল তাই হতে যাচ্ছে।
মামুন বলেই যাচ্ছে, গত ছয় মাস থেকে আমি তোমাকে প্রতি মুহুর্ত ফলো করে যাচ্ছি। হুট করে তো সিদ্ধান্তে যেতে পারি না। হ্যা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসতাম কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে কয়েকটা বছর আমি বিপর্যস্ত ছিলাম সেখানে তোমার সাপোর্ট দরকার ছিল। তোমাকে আমি সব বলেছিলাম। অনেক সময় তোমার উপর অন্যায় করেছিলাম। ঝগড়া মারামারি অল্প স্বল্প হয়েছে। কিন্তু লাইফের সাত বছরে যদি এক বছর দুই বছর অন্যায় করি আর বাকী পাঁচ বছর ভালবাসি তোমাকে তবে কি তার হিসেব তোমার কাছে ছিল না। একটু অপেক্ষা করতে তো পারতে। করো নি। জড়িয়ে গেছো পরকীয়ায়। হয়ত আমাকে আর ভাল লাগেনি। এটা স্বাভাবিক। আমার কাছে যথেষ্ট তত্ত্ব প্রমান আছে। তোমার উপর আমার ক্ষোভ , রাগ নেই। যা ভাল মনে করেছো তাই করেছো।
মিমের চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। হাউ মাউ করে কাঁদছে। তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর এমন হবে না।
আমি এই তিন বছরে অনেকবার তোমাকে সুযোগ দিয়েছি। নানা রকম ভাবে ইনডাইরেক্ট তোমাকে বুঝিয়েছি। তুমি বুঝনি। ভেবেছো, আমি বোকা, সহজ সরল।
এর মধ্যে কথা বলতে বলতে গাড়ী থামায় মামুন। মিম অবাক হয়, এতো তার বাবার বাসার সামনে এসে গাড়ী থেমেছে। এখানে কেন মামুন ?
এটা নিজের বাবার বাসা, তাও চিনতে পারছো না। কি করে চিনবে, তোমার চোখে এখন রঙিন চশমা।
আমি সেটা বলিনি মামুন। এখানে কেন আসছো হঠাৎ।
মিম শোনো, আর যাই হোক, কোন বিশ্বাস ঘাতকের সাথে সংসার করা যায় না। আমি আমার সন্দিহান মন নিয়ে তোমাকে আর ভালবাসতে পারব না। আর ভালবাসাহীন একজন নিয়ে সংসার করা যায় না।
তুমি কি আমাদের বাচ্চার কথা ভাববে না।
তার জন্য আমি আছি। আমাদের দুজনের কাছেই থাকবে। আর আমি নিজে আর বিয়ে করছি না। তবে তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও। মারুফরা জাস্ট ইউজ করবে, বিয়ে করবে না। তালাকনামা রেডি হয়ে গেলে পৌছে যাবে। যাও এবার নেমে পড়ো। তোমার বাবা মাকে কিছুই বলিনি। তোমাকে তাদের কাছে ছোট করব না। তুমি দরকার হলে আমার নামে কিছু মিথ্যা বলে দিও। যাও নামো।
প্লিজ আমার কথা শোনো। একটা সুযোগ দাও।
সরি মিম। টাইম শেষ হয়ে গেছে। এই সিদ্ধান্ত একদিনে নেইনি। অতএব পৃথিবীর কোন শক্তি আমাকে আর ফেরাতে পারবে না। তুমি নেমে যাও। তোমার সমস্ত কাপড় চোপড় আমি কাল পাঠিয়ে দিব। আর যখন ইচ্ছে আমাদের বাচ্চাকে দেখতে খবর পাঠিও , নিয়ে আসিও। আমার কোন সমস্যা নেই। ভাল থেকো। বিদায় মিম। সাত বছরে অনেক কষ্ট দিয়েছি ক্ষমা করে দিও।
মিম গাড়ী থেকে নেমে যায়। ততক্ষণে মামুন গাড়ী নিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। বাসার দরজায় কলিং বেল দিয়ে নীচে বসে পড়ে। আজ তার সব শেষ হয়ে গেলো। মানুষটাকে বুঝতে পারলো না। এত বড় অন্যায় সে করে ফেললো।
দরজা খুলে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় মিম। কি হয়েছে তুই কাঁদছিস ক্যান ?
মা আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি নিজের হাতে সব শেষ করে ফেললাম। আমি আর বাঁচতে চাই না বলেই মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায় মিম। মায়ের চিৎকারে এগিয়ে আসে বাবাসহ অনেকে।
মিমকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।
#কিছু ভুলের মাশুল হয় না।
#প্রথম পর্ব।
#নিলয় আহমেদ।
(১৮+ সতর্কতা )
মিম আশে পাশে তাকিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা আলতো টেলে ভেতরে ঢুকতেই মারুফ দরজা একেবারে বন্ধ করে দিলো। তারপর হ্যাচকা টানে মিমকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করতেই মিম তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাঁধা দিলো….
— কী করছো তুমি মারুফ !
— প্রতিদিন যা যা করি সেটাই। নতুন কি? তুমি কি সাধু সন্নাসী দলে নাম লিখিয়েছো ইদানিং। নাকি পতিভক্তি রমনী হয়ে গেলে।
মিম নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে আসে।
— মারুফ আমি তোমাকে সব বলেছি। আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করেছে। গত তিনদিন থেকে আমি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছি। সব জানার পর কোথায় তুমি আমাকে ভরসা দেবে তা না, উল্টো আমার ফোন ধরছো না। আমাকে এড়িয়ে চলছো। কেন করছো এমন ?
— দেখো, আমি ব্যবসা করি। আমার অনেক কাজ থাকে। সব সময় ফোন ধরা সম্ভব হয় না।
— অজুহাত বাদ দাও। আগেও ব্যবসা ছিল তোমার। আমি এসেছি কিছু সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে। তারপর আমি চলে যাব।
— সিরিয়াস বিষয় না হয় পরে বলো। আসো আগে একটু আদর করে নেই। মারুফ ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মিমের দিকে। মিম দেয়াল ঘেষে দাঁড়ানোর কারণে আর দূরে যেতে পারে না। মারুফ হ্যাচকা টানে মিমের শাড়ীটা বুক থেকে সরিয়ে দেয়। তারপর অনেকটা পাঁজাকোলা করে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। দুহাতে শক্ত করে ধরে ঠোঁটের পর ঠোঁট ছুয়ে দেবার চেষ্টা করতে বেশ ধ্বস্তাধস্তি হয় মিমের সাথে। ধ্বস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ফুল হাতা ব্লাউজের খানিকটা অংশ ছিড়ে যায়। মিমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে দেখে বেশ ঘাবড়ে যায় মারুফ। তক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে আসে। আচ্ছা তুমি যাও আজ।
মিম নিজের কাপড় ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়।
— মারুফ আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি। এই তিন বছরে আমি এতোটাই দূরে এসে গেছি যে সেখান থেকে ফেরা বেশ কঠিন। একদিকে আমার স্বামী আমাকে ফেলে চলে গেছে। আর তুমি যদি এমন করো, তখন মরা ছাড়া আমার কোন পথ থাকবে না।
— কী বলবে স্পষ্ট করে বলো মিম। আমাকে যেতে হবে। মিটিং আছে ক্লাইন্টের সাথে।
— আমাকে তুমি অনেকবার সারাজীবনের জন্য পেতে চেয়েছো। বলেছো রাজ রাণী করে রাখবে। তুমি বলেছো আমার মত এজীবনে কেউ তোমাকে ভালবাসে না। এখন সময় এসেছে কথা রাখার। মারুফ তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে।
— কী বলছো তুমি।। পাগল হলে। তুমি জানো আমি বিবাহিত। আমার দুটি বাচ্চা আছে।
— না না, ওদের ছাড়তে হবে না। তোমার বউ থাকুক। আমাকে শুধু স্বীকৃতি দাও। যখন তোমার মন চাইবে আমার কাছে আসবে। আমি কিচ্ছু বলব না। বাবা মা যদি জানে, আমার ভুলের জন্য স্বামী আমাকে তালাক দিচ্ছে। তবে আমাকে বাসায় রাখবে না। প্লিজ মারুফ তুমি আমাকে বিয়ে করো। আমাকে বাঁচতে দাও। নাহলে হয়ত আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।
— দেখো মিম, এটা সম্ভব না। আমি একটা সমাজে বসবাস করি। ব্যবসার জন্য সমাজে অনেকের সাথে আমার উঠাবসা। আমার যা সম্মান আছে সেটা শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার বউ মিতু কিছুটা টের পেয়ে গেছে। এই অল্পতে তার যা রিয়েকশন, শেষ পর্যন্ত কেলেংকারী হয়ে যাবে। আমি এটা করতে পারব না।
— তাহলে এতোদিন যা ছিল সব ভুল ছিলো। কেন তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছো ? এত ভালবাসার অভিনয় কেন করলে ? শুধু আমাকে ভোগ করার জন্য তুমি দিনের পর দিন আমার শরীর নিয়ে খেলেছো। তুমি শুধু শরীরটাই বুঝলে।
— প্রথম দেখাতেই তোমাকে ভাল লেগেছিল। তুমি যথেষ্ট সুন্দরী। কিছু ভাল লাগলে সেটা পাওয়াটা আমার নেশা। এক জীবনে আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। তবে একা আমি কেবল সুখ পাইনি। তুমিও নিজের প্রয়োজন আমার কাছে মিটিয়েছো। একই পাপে তুমিও পাপী মিম।
— হ্যা হ্যা আমি পাপী। আমি আমার স্বামীর সাথে পাপ করেছি। বাচ্চাদের সাথে পাপ করেছি। বাবা মায়ের সাথে পাপ করেছি। তোমাকে ভালবেসে পাপ করেছি। অনেক অনেক পাপ করেছি। চিৎকার করে কথাগুলো বলতে বলতে হু হু করে কাঁদে মিম।
— দেখো মিম। বাড়াবাড়ি করো না। যা সম্ভব না তা নিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করো না। আমি এখন চলে যাচ্ছি। আর শোন আজকের পর থেকে আমাদের সম্পর্ক শেষ। আমাকে আর কোনদিন ফোন দিবা না। এমনকি দেখা করার চেষ্টাও করবা না।
—বাহ ! বাহ ! শেষ পর্যন্ত মুখোশ খুলে ফেললে। আমার এত ভাল একটা স্বামী থেকে আমাকে ছিনিয়ে ভেবেছো তুমি ভাল থাকবে। আমি তোমার বউক মিতুকে সব বলে দেবো। একেবারে ছবি পর্যন্ত দেবো।
— এটা কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি মিম। আমি ছিনিয়ে আনিনি। নিজের ইচ্ছেতে এসেছো। যা যা করেছো তোমার ইচ্ছায়। আমি জোর করিনি কিছু।
— বাড়াবাড়ির কি দেখছো ! তুমি আমাকে ইমোশনালি ফাঁদে ফেলেছিলে। আমি তখন বুঝিনি। তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। এটা অন্যায় ছিল। আর এখন আমার সব শেষ করে তুমি হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে । তোমার তো মেয়ের অভাব নেই। তোমার সেই লাবনী, কনিকা , আরো কে কে যেনো। অহ ! শান্তা। আমিতো তোমার কাছে ইউজ হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছি। এখন উল্টো ঝামেলা রাখবে না, তাই না। তোমাকেও আমি ভাল থাকতে দেব না।
— এতক্ষণ ভদ্র ভাষায় বলছি, কানে নিচ্ছো না। আমার আসল রুপ তুমি দেখোনি মিম। এতদিন তোমাকে ইউজ করেছি এটা সত্য। তোমার মত আমার অনেকে আছে এটাও সত্য। আমি জানি তোমার মত বিশ্বাসঘাতক নারীরা একদিন ব্ল্যাকমেইল করবে। যে স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, সে সবার সাথে করবে। এটা জানা কথা। তাই আগেই সব ভিডিও করে রেখেছি। সব এডিট করে আমার চেহারা ঢেকে দিয়ে তোমাকে সুন্দর করে তুলে রেখেছি। এসব ভিডিও, ছবি সব তোমার অসুস্থ বাবা মা, পাড়া পড়শী সবার কাছে যাবে। অনলাইনে ভাইরাল হবে এসব ভিডিও। এটা কি দেখতে চাও তুমি ?
— ছিঃ ছিঃ এত্তটা নীচ তুমি !
একটা পশুকে আমি এতদিন ভালবাসছিলাম। তুমি মানুষ নামের অযোগ্য। আমি কল্পনা করিনি, তুমি এতটাই খারাপ। লজ্জা হচ্ছে আমার।
— শোন মিম, তুমি আমার বিন্দু পরিমান ক্ষতি করলে, আমি কি করতে পারি তা আশা করি বুঝে গেছো। চুপচাপ বাসায় যাও। আর কোনদিন দেখা, ফোন কোনকিছুই করবে না। মন থেকে সব মুছে দিও। আর পারলে জামাই কাছে মাফ চেয়ে তার কাছে ফিরে যাও।
— প্লিজ মারুফ তুমি একটু সদয় হও। আমার যাবার জায়গা নেই। আমি সত্যি মরে যাব।
আর কোন কথা না মিম । আর হ্যা শোন বড়লোকের এমন অনেক মিম থাকে । এত স্বপ্ন তাদের দেখতে নেই। একদম চুপ হয়ে থাকো। আমি গেলাম এখন। কাল আমার সিংগাপুর যেতে হবে ব্যবসার জন্য। আমার ফোন নাম্বার ডিলিট করে দিও। একদিন যদি আর ফোন দিয়েছো, তাহলে ভাল হবে না।
কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়নি মারুফ। হন হন করে বেরিয়ে গেছে। দাঁড়ানো অবস্থায় থাকা মিম ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। ভাবতে পারে না, কী করে একটা অমানুষকে এতদিন ভালবেসে তার ফেরেশতার মত স্বামীকে ধোঁকা দিলো।
এই মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই তার জন্য অনেক কঠিন। কেন সে সাময়িক সুখের জন্য চিরস্থায়ী সুখটা বিসর্জন দিলো।
তার ভুলের কি কোন ক্ষমা নেই।
শরীরের শক্তিটুকু আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে। মনে হচ্ছে কয়েক মণ পাথর কেউ শরীরের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে। তার হাত পা কাঁপছে। কেন যেন হাত পা ঠান্ডা অবশ হয়ে আসছে। কোন রকমে উঠে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবু দেয়াল ধরে ধরে মারুফের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে আসে। এক দুবার সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলো। সিঁড়ির হাতল ধরে কোন রকম নিজেকে সামলেছে।
আস্তে আস্তে বড় রাস্তার মোড়ে কোন রকম আসলো। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে তার এই মুহুর্তে। মাথা ঘুরতে লাগলো। সমস্ত মানসিক যন্ত্রণা তাকে বিধ্বস্ত করে যাচ্ছিলো। বার বার পড়ে যাচ্ছিলো । শরীর ক্রমশ অবেচেতন হয়ে আসছে। একটা মানসিক বিধ্বস্ত মানুষের এমন হতে পারে তখন পর্যন্ত সে বুঝতে পারছে না। সমস্ত চিন্তা ভাবনা তাকে ঘিরে রেখেছে। চিন্তা করতে করতে কখন যে বড় রাস্তার একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় চলে আসছিল খেয়াল করেনি। রাস্তাটা এমনিতে প্রচন্ড ব্যস্ত। শোঁ শোঁ করে গাড়ী চলে দু প্রান্ত থেকে।
খেয়াল করেনি, পেছন থেকে অনবরত গাড়ী হরণ দিয়ে যাচ্ছে। ঘুরে তাকায়। দ্রুতবেগে আসা একটা বাসকে সাইড দিতে গিয়ে একটু অন্য পাশে সরে যেতেই হুট করে ধাক্কা লাগে বিপরীত দিকে আসা আরেকটা গাড়ীর সাথে। সাথে সাথে ছিটকে পড়ে যায়। বিপরিত দিক থেকে আসা ট্রাকটি ততক্ষণে জোরে ব্রেক কষে ,আবার দ্রুতবেগে স্থান ত্যাগ করে। ট্রাকের সাথে মিমের ধাক্কা লাগার পর, তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ে মিম। ততক্ষনে জ্ঞান হারায়। এবারের মত পর পর দুদিন জ্ঞান হারায়। মাথায় সম্ভবত প্রচন্ড আঘাত পেয়ে রাস্তার এক পাশে পড়ে থাকে নিথর দেহ। বেশ কয়েক জায়গা থেতলে গেছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে কয়েক জায়গা থেকে। স্থানীয় মানুষজন দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে পালিয়ে যায় ট্রাক।
()
রাত বারোটার কাছাকাছি নিজের বাসায় ঢুকে মারুফ। মিতুর চোখে চোখাচোখি হতেই খানিকটা স্মিত হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই মিতু খেঁকিয়ে উঠে, এত রাতে বাসায় ফিরে অভিনয় করা লাগবে না। তার চেয়ে বরং তোমার ঐ মিমের কাছে যাও।
–তুমি কি পাগল হলে মিতু।
–ও হা, মিমের চ্যাপ্টার তো আজ শেষ করে আসছো। হয়ত নতুন কেউ পেয়ে গেছো। বিয়ের পর থেকে তোমার এই চরিত্র আমার বেশ জানা আছে। আচ্ছা আরো কে কে জানি তোমার রক্ষিতা আছে। তোমার তো এসবের অভাব নাই। টিয়া ময়না কতজন আছে।
–তুমি কোনদিন তো এমন করে কথা বলোনি মিতু। এত বেয়াদব কবে থেকে হলে !
–মেয়েরা মুখে মুখে সত্য বললেই বেয়াদব। বাঙ্গালী রমনীদের চুপ করিয়ে রাখার মাঝে তোমাদের বেশ স্বার্থকতা। তবে দিন বদলেছে। আর কোনদিন বলিনি বলে কি আজ বলতে পারব না, এটা তো না। দেয়ালে পিঠ লেগে গেলে কিছুই করার থাকে না মারুফ সাহেব।
–শুনো তোমার সাথে আমার আজাইরা প্যাচালের সময় নাই। আমি এখন ঘুমাবো। ভোরে আমার ফ্লাইট সিংগাপুরের।
–বাহ ! তো- জনাব এবার কাকে নিয়ে যাচ্ছেন। কোন মিডিয়া সেলিব্রেটি নাকি টিয়া-ময়না নতুন কেউ পেলে।
–মুখ সামলে কথা বলো। এত রাতে সিনক্রিয়েট করো না প্লিজ। মুখের লাগাম দাও মিতু।
–তোমার কি ধারণা, আগের সেই বউদের মত সব জ্বি জ্বি করব। তোমার সমস্ত অনিয়ম দিনের পর দিন মেনে যাব। তুমি ধমক দেবে আর আমি আগের মত চুপ হয়ে যাব। এতদিন কথা বলিনি। যা বলেছো মেনে নিয়েছি। ভেবেছি বাচ্চা কাচ্চা বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কৈ তোমার তো ঠিক হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।
–এত অদ্ভুদ খবর তোমাকে কে দেয় ? কে তোমাকে এসব লাগিয়ে বেড়ায় ?
–কেন? বিশিষ্ট শিল্পপতি মারুফ সাহেবের গোয়েন্দা থাকতে পারলে তার স্ত্রীর এক দুজন কেন থাকবে না।
–বিয়ের এতদিন পর আজ নতুন রুপে তোমাকে দেখছি। ব্যাপার কি ? এত শক্তি কই থেকে আসলো আজ। তুমি কোনদিন এমন তো ছিলে না মিতু।
–নারীরা মমতাময়ী। ভাল হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, হওনি। বরং তোমার নষ্টামি দিন দিন বেড়েছে। আমাকে কি বাচ্চা দেখার জন্য রেখেছো। কয়দিন আমার সাথে ভাল করে কথা বলেছো। কয়দিন আমরা একসাথে বিছানায় গেছি ভাল করে। শেষ কবে আমাদের ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছিল, মনে পড়ে তোমার। তবুও একটা মেয়ে শুধু ফিজিক্যাল রিলেশন চায় না। চায় স্বামী তাকে সম্মান করুক, গুরুত্ব দিক, ভালবাসুক। এক বেলা খেলেও সমস্যা নাই।
— প্লিজ স্টপ। এত রাতে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না মিতু।
ভাল লাগলে থাকো, না লাগলে দরজা খোলা আছে। চলে যেও। আমি যেমন আছি তেমন থাকব।
–বাহ ! তোমার মত পুরুষ আর কি বলতে পারে। তাদের ধারণা এই কথা বললে, বউয়েরা ভয় পেয়ে চুপ থাকে। হ্যা আমিও চুপ করে যেতাম। কারণ মেয়েদের যাওয়ার জায়গা কম। নিজের ফ্যামিলি যখন বলে মানিয়ে নাও, মেনে নাও তখন একটা মেয়ে ধৈর্য ধরে পড়ে থাকে দিনের পর দিন এই আশায় যে, একদিন স্বামী ঠিক হবে। কিন্তু স্বামী নামক সে বস্তু আর বদলায় না।
–আচ্ছা তুমি কি করতে চাও। কাপড় চেঞ্জ করতে করতে মারুফ বলে।
–অন্য মেয়ে হলেও আমিও তোমার কথায় ভয় পেয়ে চুপসে যেতাম। এতদিন মানসিক নির্যাতন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, আমার বাবা মাকে গালাগালি, আমাকে শারিরিক হেনস্থা কি করোনি তুমি! তবুও পথ চেয়ে ছিলাম তুমি ঠিক হবে। হওনি যখন এখানেই ইতি টানবো।
–মানে…কি চাও তুমি?
–মারুফ বিয়ের পর তুমি আমার জবটা ছাড়তে বাধ্য করেছিলে। আসলে প্রত্যেক মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো থাকলে এমন পর্যায়ে অসহায় হয়ে পড়ত না। এটাও জেনে রেখো , সব মেয়ে টাকার লোভে পড়ে থাকে না। দরকার হলে না খেয়ে থাকবে তবু নিজেকে অন্যায়ের কাছে দিনের পর দিন বিসর্জন সব মেয়ে দেয় না। আমি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ঠিক হলে না।
–বাহ মিতু, ইদানিং তোমার মুখে কথার খৈ ফুঁটেছে। নতুন করে কারো প্রেমে পড়নি তো। মেয়েরা যখন ভরসা খুঁজে পায়, তখন মুখে কথার খৈ ফুটে।
–মারুফ , তুমি নষ্ট বলে সবাই নষ্ট হবে, এটা ভাবতে যেও না। এমনকি তোমার চরিত্রের সাথে সবাইকে মিলাতে যেও না। এতদিন বাবা মা বলেছিলো, মানিয়ে নাও। এখন আলহামদুলিল্লাহ্ তোমার কর্মকান্ড দেখে তারাই বলছে চলে আয়। তাই বাচ্চাদের আগে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর শুনো, বাবা মা না বললেও, আমি আর থাকতাম না। কষ্ট করতাম, একা থাকতাম তবুও তোমার সাথে আর থাকার প্রশ্নই আসে না।
–কি বলতে চাচ্ছো তুমি মিতু?
–একদম সিম্পল কথা…যথেষ্ট হয়েছে। আর না। আর শুনো, তোমাকে এসব বলার জন্য আমার এতক্ষণ ধরে এই বাসায় থাকা। পরে বলবে, পালিয়ে গেছি। তোমাদের তো আবার সমাজের কাছে আমাদের উল্টো দোষী বানাতে চাইবা। তাই সত্য উন্মোচন করে যাচ্ছি। সকাল হওয়ার আগেই যাচ্ছি অবশ্য।
–মিতু আমার বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার তোমার এত সাহস হল কি করে ?
–এতদিন বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ ভেবে চুপ ছিলাম। এখন দেখলাম উল্টো তোমার কারণে বাচ্চারা নষ্ট হবে। আমার জীবনের কথা আর কি ভাববো। বাচ্চাদের কথা ভেবে সাহস করেছি। আমি নিজেই পড়ালেখা জানা মেয়ে। অতএব এদের ভরণ পোষণ অসম্ভব না। এই বাচ্চা তুমি কখনোই পাবে না। এতদিন কাস্টডির কাগজ রেডি করেছি। তোমার কিছু বলার থাকলে আদালতে বলো। বাদ বাকী কথা আদালতে হোক। আদালত যদি মনে করে,তোমার যা প্রাপ্য, আই ক্যান ডু ইট।
–দুদিন পর বুঝবে। যখন পাশে কেউ থাকবে না। টাকার অভাব বুঝো ? এতদিন তো বুঝোনি। এবার বুঝবে ?
–তুমি কি করে বুঝবে ? বিয়ের কয়েকদিন পর থেকে তোমার এসব কর্মকান্ড শুনে আসছি। শুরুর দিকে বিশ্বাস করিনি। এরই মধ্যে দু বাচ্চার মা হয়ে গেলাম। আর খেয়াল করা হয়নি, যে তুমি দিন দিন এতটাই দূরে সরে যাচ্ছো। যখন জানলাম ততক্ষণে তোমাকে ফেরানোর কম চেষ্টা করিনি। ফলাফল কি হলো, উল্টো মানসিক নির্যাতন সইতে হতো । তোমার বাবা মা তোমাকে মানুষ করতে পারেনি আর আমি কি করে করব?
আর টাকার কথা বলছো, সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না মারুফ।
–বাহ ! অনেক চালাক হয়ে গেছো। টাকা ও ম্যানেজ আছে।
–আমার মানসিক অবস্থা কেমন ছিল সেটা তোমাকে বলে লাভ নেই। অসংখ্য দিন কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি। কেউ দেখেনি। গত এক বছর থেকে নিজেকে সামলেছি। আস্তে আস্তে নিজেকে ভালবাসতে শুরু করেছি। মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছি। চাকরীর ব্যবস্থা করেছি। যাতে তোমাকে ছেড়ে গেলে অসুবিধা না হয়। প্রত্যেক মেয়ের এভাবেই করা উচিত। আফসোস অনেক মেয়ে তা পারে না। আমি আমার পরিবারকে কাছে পেয়েছি তাই সহজ হয়েছে।
চুপ করো তোমার লেকচার বন্ধ করো প্লিজ। মাথা অনেক ধরেছে। যাও ঘুমাও। কাল এ নিয়ে কথা বলা যাবে।
তোমাদের মেয়েদের কথার ঠিক নেই। কাল দেখবে মন বদলে গেছে।
সব মেয়েদের দূর্বল ভাবা ঠিক না। একটা মেয়ের যখন নিজের পরিবার পাশে থাকে, বাবা মা পাশে থাকে, ভাই বোন থাকে তখন সে দূর্বল হয় না। আর হ্যা নেক্সট সপ্তাহ থেকে আমি চাকরীতে জয়েন করছি। সব পাক্কা করে এতদিন রেখেছি। বলতে পারো ডির্ভোসের আয়োজন এতদিন থেকে করে আসছি। ফাইনালি সেটা করতে পারছি বলে শান্তি লাগছে । একটা চরিত্রহীন ভালবাসাহীন কাপুরুষের সাথে সংসার করার চেয়ে একা থাকা ঢের শ্রেয়।
মারুফ কিছুটা চিৎকার করে..মিতু আমি ভাবতে পারছি না , তোমার এত সাহস হবে। কি করে এতটা বদলে গেলো। এমন তো তুমি ছিলে না। পাগলামি বাদ দাও। ঘুমাতে যাও। কাল এ নিয়ে আমরা কথা বলব মিতু।
আমার কথা বলা শেষ । তুমি ঘুমাতে যাও। আমি হয়ত রাতেই চলে যেতে পারি। কাজের মেয়েকে সব গুছিয়ে বলে দেয়া আছে। আর কেয়ার টেকার রহিম ভাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার অসুবিধা হবে না। টিয়া-ময়নাকে নিয়ে থাকো। আর হ্যা মেয়েদের দূর্বল ভেব না। সব মেয়ে ছাড় দেয় না। আর আরেকটা শেষ কথা বলি, আল্লাহ সবাইকে ছাড় দেয় কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেয় না। সাবধান হয়ে যাও।
কথাগুলো বলেই রুম থেকে বের হয়ে অন্য রুমে চলে যায় মিতু।
ঘরের মধ্যে অস্থির পায়চারী করছে মারুফ।মিতুর এমন রক্তচক্ষু সে এর আগে কোনদিন দেখেনি। এতদিন সে যা যা বলেছে,বিনা বাক্যে মিতু মেনে নিয়েছে। হুট করে এত সাহসী হল কি করে সেটা ভাবতেই পারছে না মারুফ। যা সে কোনদিন ধারণা করেনি সেটা হচ্ছে। আজকের পুরো দিনটা খারাপ করেছে মিম আর রাতটা খারাপ করছে মিতু। শালার মেয়েগুলো এত ইমোশনাল।
মারুফের চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। সম্মানহানী হবে সব জানাজানি হলে। মিতুর যা অবস্থা ওকে ফেরানো এখন যাবে না। বাচ্চাদের যদি ফিরে না পায় তাহলে তার থাকাটা বেশ কষ্টের। দুটো বাচ্চাকে সে পাগলের মত ভালবাসে। মিতু তাকে বাচ্চাদের থেকে সরিয়ে কষ্ট দিতে চায়। মারুফ ভাবতে পারে না।
মারুফ ভাবতে থাকে, ধুর যত্তসব পাগল ছাগল মেয়েদের সাথে এতদিন সে ছিল। সবাই তাকে মানসিক পাগল করে ছাড়বে দেখছি। ক্লান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দেয়। রাজ্যের ঘুম থাকলেও এখন আর তার ঘুম আসে না। মানুষ কখনো কখনো চারপাশ থেকে খুব একা হয়ে যায়। আপাতত মারুফ সেরকম একা।
#কিছু ভুলের মাশুল হয় না।
#দ্বিতীয় পর্ব।
#নিলয় আহমেদ।
( ১৮+ সতর্কতা )
মিমকে উদ্ধার করে যতক্ষণ হাসপাতালে নেয়া হয় ততক্ষণে অবস্থার বেশ অবনতি হয়। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে গেছে সে। মাথায় আঘাত পাওয়ার পর একটা দীর্ঘ সময় অজ্ঞান থাকলে যা যা হয় তার সবকিছুর আশংকা করছেন ডাক্তার রা। খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে আসেন মিমের বাবা মা। এমনকি স্বামী মামুন তার ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আসে।
ডাক্তাররা অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকায় অস্ত্রোপাচার করেন। ক্ষতস্থানগুলোতে ব্যান্ডেজ করেন। চব্বিশ ঘন্টা না গেলে কিছু বলা মুস্কিল। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তাররা কোন আশ্বাস দিতে পারছেন না। এতোটা সময় কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ছাড়া বিকল্প আর কোন পথ খোলা ছিল না মিমের স্বজনদের হাতে।
প্রার্থনারত সবাই যখন হাসপাতালের বারান্দার অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন তখন ডিউটি ডাক্তার জানান, হঠাৎ করে জ্ঞান ফিরেছে মিমের। ইশারায় সে কারো সাথে দেখা করার আবদার করছে বার বার। রোগীর কন্ডিশন বিবেচনায় ডাক্তার নিষেধ করলেও মিমের বার বার আবদারের ফলে মামুন কে দেখা করার অনুমতি মিলে ।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে চব্বিশ ঘন্টার অনেক আগেই চোখ মেলে তাকায় মিম। তার দু চোখ খুঁজছে দুজন মানুষকে। একজন তার ছেলে অন্যজন স্বামী।
জ্ঞান ফেরার পর হাসপাতালের আইসিউ বেডে মামুন তার ছেলেকে নিয়ে যায়। তাদের দেখে চোখ দিয়ে খানিকটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলার চেষ্টা করে মিম। মামুন থামিয়ে দেয়, এখন কিছু বলতে হবে না, আগে তুমি সুস্থ হয়ে নাও। তখন ইচ্ছেমতো কথা বলো।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় মিম বলে, নাহ মামুন আমার সময় বোধহয় বেশি নেই। আমি যা পাপ করেছি, এটা অবধারিত শাস্তি। শেষ বেলায় এটুকু স্বান্তনা পাবো, তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। শেষ বেলায় তোমার বউ হয়েই মরে যেতে চাই। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিম। এতোটাই ভেঙ্গে পড়ে যে উপস্থিত বাবা ছেলের চোখেও জল আসে।
প্লিজ এমন কথা থাক মিম। আগে সুস্থ হও। এভ্রিথিং উইল বি ওকে। জাস্ট নিজেকে কন্ট্রোল করো। সুস্থ হও জলদি। আমরা পাশে আছি তোমার।
তোমার মনে আছে মামুন, তুমি বিয়ের পর কথা দিয়েছিলে। আমি কখনো কোন ভুল করলে তুমি আমাকে শুধরে দেবে। কখনো তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না। মনে আছে তোমার মামুন?
প্লিজ এসব থাক মিম। এখন এতসব বলার সময় না। তুমি সুস্থ হও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
না তুমি বলো, আমাকে ক্ষমা করেছো। প্লিজ বলো প্লিজ। খুব কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে, তবু বলছি। প্লিজ বলো। ভাঙ্গা গলায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে মিম।
সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকে। তারপর ছেলেকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, প্লিজ মামুন বলো তুমি…আমাকে ক্ষমা করেছো। আমি পাপী। আমার যা শাস্তি হওয়ার তা হচ্ছে। এখন তুমি ক্ষমা করো প্লিজ।
তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো। সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি মিম। আমরা আবার একসাথে থাকবো।
স্মিত হাসি দেয় মিম। যাক এবার মরতে ও শান্তি পাব। সান্ত্বনার বাণী হোক আর যাই হোক তুমি বলেছো এতেই শান্তি। একসাথে থাকতে না পারি, মৃত্যুর আগে তো তোমার ক্ষমা পেয়েছি। ছেলেটাকে শেষবার অনেক আদর করে। ইশারায় হাত উচিয়ে স্বামীর হাতটা ধরার আবদার করে মিম।
মামুনের চোখ দিয়ে খানিকটা জল আসে। সে হাত বাঁড়িয়ে দেয় । একদিন যে মেয়েটিকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলো আজ তার কঠিন মুহুর্তে মামুনকে বেশ বিচলিত করে তুলে। ভেতর থেকে সে খানিকটা ভেঙ্গে পড়ে। যতোই যাই হোক , সে তার বাচ্চার মা। এই মানুষটাকে সে ভালোবেসে ছিলো , সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে।
মিম অস্পষ্ট গলায় বলতে থাকে…মামুন তোমার হাত ধরে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করতে চাই । এটাই আমার শেষ চাওয়া। মিম আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে নেয়। মিমের শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত নীচে নামতে থাকে। গলার গোঙানী শোনা যায়।
মামুন কিছু বলতে পারে না। কেবল মিমের হাত ধরে ফ্যাল ফ্যাল করে মিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার সবাইকে সরে যেতে বলেন দ্রুত। মিমের কন্ডিশন হঠাৎ করে ভয়ংকর রকম খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তাররা চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। মিমের মাথার শিয়রে থাকা মনিটর তখন ডাক্তারদের বার্তা দিচ্ছে, মিম খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে সবার থেকে।
কিছুক্ষণ সবার পিনপিতন নীরবতা। ডাক্তারদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে মিম চলে যায়। ডাক্তাররা চিরাচরিত বাক্যে মামুনকে জানান, মিম আর নেই। তাদের এখন করার আর কিছুই নেই। এতোটাই রক্তক্ষরণ হয়েছে যে, বাঁচানো সম্ভব ছিল না। তবুও অলৌকিক ভাবে একটু আগে সে কিছুক্ষণ বেশ ভালো ছিল।
মামুনের ধারণা, হয়ত ক্ষমা চাইবার জন্য সে সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে সময় চেয়ে নিয়েছিলো।
বাঁধ ভাঙ্গা জল এসে মামুনকে জানান দেয়, তার বুকের ভেতরটা সত্যি খালি লাগছে। এমন হবার কথা ছিল না। মামুনের ছেলে বাবাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাইরে বাবা মা অঝোর ধারায় কাঁদেন। মামুন ভাবতে থাকে, এতকিছুর পেছনে নিশ্চয় তার অনেক ভুল ছিল, অবহেলা ছিল। ঠিকমত খেয়াল করেনি। নাহলে মিম এত ভুল করতে পারত না।
আজ মিম মৃত্যু দিয়ে সব প্রশ্ন আরো উগরে দিলো। মামুন চুপচাপ সামনের চেয়ারে বসে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে।
হাসপাতালের কার্যকম শেষ করে বাসায় নিয়ে আসা হয় মিমকে। শেষ বিদায় দিতে গিয়ে ছেলেটা ভেঙ্গে পড়ছিল বার বার। মামুন তাকে বুকে জড়িয়ে রাখে। কোন কোন ভুলের মাশুল যে এভাবে দিতে হয় তা কে জানতো।
মামুন মিমকে কবরে শুইয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সে আত্ম উপলব্ধি করতে থাকে, কোথাও কি তার ভুল ছিল? যাকে সে ছেড়েই দিয়েছিল তার প্রতি হঠাৎ এত মায়া এল কোথা থেকে। তবে কি সে মারা গেছে বলেই কেবল মায়া জন্মেছে। বেঁচে থাকলে কি সে ক্ষমা করতো? হয়ত কখনই করতো না। ছেলেরা হাজার ভুল করলেও ক্ষমা পায়। কিন্তু একটা মেয়ে কি তা পায়? নিশ্চয় পায় না।
মামুন ভাবতে থাকে। হারানো প্রেম খুঁজে ফেরা মানুষ রা কেমন হয় ? যে প্রেম হৃদয়ে বার বার জানান দেয় । যে প্রেমে এত স্বাদ তা এসে শিখিয়েছিল অষ্টাদশী এক তরুণী মিম কোন একদিন। তাকে একদিন না পেলে , শূন্য মনে হত চারপাশ। মনে হয় পৃথিবী মোহ যেন ফুরিয়ে গেছে । অথচ তাকে কিছু ভুলের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। একবার কি ক্ষমা করা যেতো না তাকে? তা না করে তাকে কাচের মত ভেঙ্গে খান খান করে দিলো।
()
মিমের মৃত্যুর খবর তার বিশ্বস্ত কারো মাধ্যমে মারুফের কাছে একসময় খবর পৌছে। কিন্তু তার চেহারায় খুব একটা চিন্তার রেখা দেখা যায় না। বিষণ্ণতার যত সব লক্ষণ তা সব বউ চলে যাবার কারণে। আলাদা করে মিমের জন্য তার মনের কোন অবস্থার পরিবর্তন হয় না। কেন যেন তার কাছে মনে হয় বরং উটকো ঝামেলা গেলো। মন মানসিকতা ভালো না থাকায় সিংগাপুর যাওয়াটা আরো কয়েকদিন পিছিয়ে দেয় মারুফ ।
মিতু স্বামীর বাসায় আর থাকেনি। সকাল হতে না হতেই লাগেজ নিয়ে বাবার বাসায় চলে যায়। একটা চরিত্রহীন স্বামীর সংসারে থাকা সম্ভব না বলে, একটা অনিশ্চিত জীবনে সে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কলেজ লাইফে এক সময়ের তুমুল প্রেম ছেড়ে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করে মামুনকে। মারুফের সাথে যখন মিতুর বিয়ের প্রস্তাব আসে তার কাছে। তখন তার হাতে কোন অপশন ছিলো না। লিমনকে সে ভালোবাসতো ঠিক। কিন্তু লিমন শুরুতে এত খেয়ালী ছিল না। নেশাখোর ছিল। অনেক চেষ্টা করেছিলো মিতু ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পারেনি। লিমন ব্যাপারটা পাত্তাই দিতো না।
এজন্য চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে মিতুকে বেগ পেতে হয়নি। একটা নেশাখোরের সাথে জীবন কাটানোর কোন মানে হয় না। এদিকে বাবা মায়ের ধারণা ছিলো, বড়লোক ছেলে নিশ্চয় তাকে সুখী করবে। কিন্তু সুখ যে কোথায় থাকে, তা কেউ জানে না। সাত বছরের প্রেম ছিলো তার সহপাঠী লিমনের সাথে। কিন্তু লিমন সম্পর্কে কখনই সিরিয়াস ছিল না। মিতুর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর কিছুটা টনক নড়ে। ততোদিনে সময় শেষ। লিমন অনেক চেষ্টা করেও কাউকে মানাতে পারেনি। সেই দুঃখে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায় সে। নেশা তাকে অবশ্য আর ছাড়েনি। এমনিতে রাজনৈতিক দল করতো। নেতাদের পিছু পিছু থাকতো। কিন্তু গুন্ডামি বাদ দিতে পারেনি কোনদিন। বিয়ের অনেকদিন পর পর্যন্ত লিমনের কোন খবর পায়নি। আসলে সে খবর নেবার চেষ্টা ও করেনি।
লিমনকে ছাড়াযে মিতুর কষ্ট হয়নি তা না। বাবা মা, পরিবারের দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যাবার বৃথা চেষ্টা করে। কিছুদিন পর লিমনের পাগলামি বেড়ে যায়। হুমকি দিতে থাকে। অনেকবার লিমন যোগাযোগ করতে চেয়েছে। ছেড়ে আসতে বলেছে স্বামীকে। সব সামাল দিয়েছে নিজ হাতে মিতু। তবু সে অন্যায় করেনি। অন্যায়কে লালন করেবি। স্বামীকে ভালবেসে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পতিব্রতা সংসারী হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে। এজন্য লিমনকে বিন্দু পরিমান প্রশ্রয় দেয়নি। বরং লিমনকে বার বার তাড়িয়ে দিয়েছে বিয়ের পর। নিজের সত্ত্বা সে কখনই বিসর্জন দেয়নি ।
মিতু স্বামীর সংসার ত্যাগ করে বাবার বাড়িতে নতুন করে সব মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এদিকে মারুফ অনেকবার গিয়েছে মিতুর বাসায়। অনেকবার চেষ্টা করে মিতুকে ফেরাতে পারেনি। এমনকি মিতুর সাথে দেখা করতে পারেনি। হুমকি ধামকি কোন কিছুতেই মিম কর্ণপাত করেনি। বরং আদালতে যাওয়ার কথা শুনিয়েছে। ডির্ভোস অবধারিত জেনে বেশ চুপসে গেছে মারুফ। জীবন এত উলট পালট হবে ভাবতে পারিনি। কত সহজেই তার সমস্ত শক্তি খর্ব হতে লাগলো। তা ভাবলেই সে শিউরে উঠে।
মারুফ ডির্ভোস লেটার পেলো ঠিক এক সপ্তাহ পর মিতুর কাছে থেকে। ভাবতে পারছে না, মেয়েটা এত কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে।
এখন আর তাকে ফেরানোর পথ নেই। মিতু পুরোটাই বদলে গেছে। এক বদলে যাওয়া মিতুকে সে আবিষ্কার করে এতদিন পর। সে জানে মিতু আর ফিরবে না। দীর্ঘ আয়োজন শেষে বেশ শান্ত মাথায় যারা বাসা ছেড়ে যায় । তারা যাই হোক আর ফিরবে না । সেটা সে জানে। তার চারপাশ জুড়ে একদিনের ব্যবধানে সব একাকিত্ব এসে ভীড় করেছে। বেঁচে থাকাটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। সব শুনে তার বাবা মা তিরস্কার করছে এখন। বরং মিতুকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। চারপাশ থেকে আপন মানুষ খুব দ্রুত সরে যাচ্ছে। যা এতদিন সে কল্পনা করেনি। মানসিক ভাবে সে ভেঙ্গে পড়েছে খানিকটা।
সেদিন আইনজীবীর সাথে পরামর্শের জন্য বাসা থেকে বের হয় মারুফ। যেভাবে হোক বাচ্চাদের ফেরত পাওয়ার আইনি লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে। বাচ্চাদের কাস্টডি তাকে পেতেই হবে। মিতুকে তাহলে একটা উচিত শিক্ষা দেয়া হবে।
বাইরের আকাশটা আজ অন্যরকম। মারুফের মনের মত উলট পালট হচ্ছে। এক জীবনে এত সত্যের মুখোমুখি হওয়া লাগবে, গতকাল ও তার কল্পনায় ছিল না। কত সহজেই বদলে গেলো সব। ঘর দুয়ার ওদের ছাড়া সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মানসিক যন্ত্রণা তাকে পেয়ে বসছে। এতদিন এসব কিছুই টের পায়নি। কিন্তু এখন দিন দিন অস্থিতিশীলতা তাকে পেয়ে বসছে। জানি না সে কী করবে এখন। নিজের গাড়ী নিয়ে ছুটে চলে আইনজীবী তার বন্ধু রহমানের চেম্বারের দিকে।
()
ঠিক এক সপ্তাহ পর হঠাৎ করে পুলিশ আসে মামুনের বাসায়। মামুন তখন বিকেলে বারান্দার তার এক বন্ধু শায়লার সাথে গল্প করছিলো মুলত মিমকে নিয়ে। অনেকটা স্মৃতিচারণ মুলক কথা। শায়লা গত মাসে দীর্ঘদিন পর ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছে । বন্ধুর এ অবস্থা শুনে দ্রুত আসে মামুনের সাথে দেখা করতে।
হঠাৎ পুলিশকে দেখে বেশ অবাক হয় তারা দুজনেই। ওসি শহিদুল এর নেতৃত্বে তিনজন পুলিশ সদস্য এসেছেন। তাদের বসতে দিয়ে মামুন জিজ্ঞেস করে , ওসি সাহেব আপনি হঠাৎ কী মনে করে ?
সরি অসময়ে আপনাকে বেশ ডিস্টার্ব করার জন্য, ওসি শহিদুল আড় চোখে শায়লাকে দেখে দেখে বলেন।
না না ঠিক আছে বলুন।
ইনি কে হোন আপনার মিঃ মামুন। শায়লাকে ইশারা করে বলেন ওসি।
ও আমার ছোট বেলার বন্ধু শায়লা। দীর্ঘদিন পর দেশে এসেছে। তাই দেখা করতে এসেছে।
ওহ আচ্ছা। হাই মিস শায়লা ? কেমন আছেন ?
জ্বি বেশ ভালো। আপনি ?
আমি আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছি। আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি মিস শায়লা ?
জ্বি অবশ্যই করুন, কিছুটা ঘাবড়ে যায় শায়লা। এমন পরিস্থিতিতে সে বাংলাদেশে কখনো পড়েনি।
আপনার স্বামী কোথায় আছেন ? প্রশ্নটা একান্ত ব্যক্তিগত তবু করে ফেললাম।
জ্বি ও ইংল্যান্ডে থাকে। যদিও আমি সিংগেল মাদার। এক কথায় ডির্ভোসি। আমাদের চার মাস আগে ডির্ভোস হয়ে গেছে।
ওহ সরি। থ্যানক ইউ মিস শায়লা। মামুন সাহেব আপনাকে কিছু বিষয় জানাতে আসলাম।
জ্বি বলুন ওসি সাহেব।
নিহতের বাবার পরিবার থেকে ধারণা করা হচ্ছে এটা একটা হত্যা। কেউ এক্সিডেন্টের নাম করে হত্যা করেছে। আপনার কি এমন ধারণা হয় ?
কার ধারণা এমন ওসি সাহেব? আর কেনই বা এমন ধারণা?
গতকাল নিহত মিমের আপন ভাই সুমন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরত এসেছেন । উনি এক্সিডেন্টের জায়গায় স্থানীয় কিছু মানুষের সাথে কথা বলেছেন। তখন অনেকে উনাকে জানিয়েছে যে, যে ট্রাকে উনার এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেটা নাকি একটু অদূরে দীর্ঘক্ষণ থেকে অপেক্ষামান ছিল। উনি রোডে আসার সময় তীব্র গতিতে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা অবশ্য ট্রাক সনাক্ত করেছি। ড্রাইভার পলাতক। অদূরে এক বাসার সিসি টিভিতে সে কথার সত্যতা প্রমাণ পেয়েছি। তাই আমাদের ইনভেস্টিগেশন করাই লাগবে। আর কেস ফাইল হয়ে গেছে।
ওহ মাই গড। সুমন আমাকে তো কিছুই জানায়নি।
আমরাই তাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম। আপনার স্ত্রীর সাথে এক্সিডেন্টের আগের দিন রাতে সুমন সাহেবের সাথে ফোনে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়েছে । তখন উনি নাকি বিপদের আশংকার কথা ভাইকে জানিয়েছিলেন।
আমি তো কিছুই জানি না।
আস্তে আস্তে সব জানবেন মামুন সাহেব। যেহেতু মামলা হয়েছে। কিছু সত্য মিথ্যা প্রকাশ তো পাবে।
মানে কী ? সুমন মামলা করেছে।।
জ্বি মামলা হয়েছে। তবে কাউকে আসামী করা হয়নি। আমরা আশে পাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখছি। তদন্তের স্বার্থে খুব বেশি কিছু জানাতে পারব না। তবে কিছুটা আলামত পেয়েছি। আপনাকে আমাদেরকে কোঅপারেট করতে হবে মামুন সাহেব।
জ্বি অবশ্যই।
আপনার সাথে দাম্পত্যকলহ ছিল উনার। আপনি তাকে মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাবার বাসায় রেখে এসেছিলেন। কেন রেখে এসেছিলেন তাও আমরা জেনেছি। আপনি অবশ্য আপনার জায়গা থেকে একশ পারসেন্ট রাইট ছিলেন। আমরা এও জেনেছি যে,বিশিষ্ট শিল্পপতি মারুফ সাহেবের সাথে উনার ফিজিক্যাল সম্পর্ক ছিলো। এক্সিডেন্টের অদূরে একটা ফ্ল্যাটে মিমের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। যেটা মারুফ সাহেব রেন্ট নিয়েছিলেন। আর সে বাসাটা আপনার বন্ধু রকিবের।
জ্বি যা শুনেছেন সব সত্য।
ইতিমধ্যে আমরা ছয় থেকে সাতটা মোবাইলের কল লিস্ট চেক করছি। বেশ কিছু অসামাঞ্জস্যতা মিলেছে। আপাতত কিছু বলছি না। তদন্তের স্বার্থে আপনারা অনেকেই আমাদের সন্দেহের তালিকায়।
কি বলছেন এসব। আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন?
জ্বি করছি। যদিও আপনার শ্বশুরবাড়ী থেকে আপনার অনেক প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তদন্তের স্বার্থে কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। আপাতত আপনি শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমরা কেউ সিউর না এটা হত্যা। তবে মামলা হয়েছে তাই দেখতে হচ্ছে। হয়ত প্রয়োজনে কবর থেকে লাশ তুলতে হতে পারে তবে সেটা আমাদের প্রাথমিক তদন্তের পর যদি কিছু প্রমাণ পাই। আদালতের অনুমতি নিয়েই বাদ বাকী কাজ করব। মিমকে চিকিৎসা দেয়া কর্তব্যরত ডাক্তারদের সাথে আমরা আলাপ করব এই নিয়ে।
আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আমিও চাই যদি হত্যা হয়, তবে আমরা যেন ন্যায় বিচার পাই।
আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন ?
জ্বি না।
একদম না মামুন সাহেব ?
সন্দেহ করলে একজনকেই করা যায়। একমাত্র লোক ঐ যে মারুফ সাহেব। যে আমার সংসার তছনছ করে দিয়েছে ওসি সাহেব।
উনি মামলা হওয়ার পর থেকে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না খুব একটা। আমরা উনার উপর কড়া নজর রাখছি। দেখা যাক, কি হয়?
তাহলে আর কি প্রমাণ লাগে ? কিছু যদি হয়েও থাকে তবে উনিই করেছেন।
মামুন সাহেব আপনি কি করে সিউর হলেন ..উনি করেছেন ।
না, এছাড়া আর কে হতে পারে?
অনেকেই হতে পারে। আমরা যেহেতু ইনভেস্টিগেশন করছি। নিশ্চয় সত্য মিথ্যা বের হয়ে আসবে।
আচ্ছা ওসি সাহেব। আপনারা আপনাদের কাজ করুন। সহযোগিতা যতটুকু লাগে আমরা করবো।
আচ্ছা মামুন সাহেব…..আপনার বন্ধু রাকিব সাহেব যে আপনার স্ত্রীকে উত্যক্ত করতেন, ফিজিক্যাল এটাচের জন্য চাপ দিতেন। এমনকি কথা না শুনলে উনি মারুফ সাহেবের কথা আপনাকে জানিয়ে দেবেন বলে হুমকি দিতেন। এসব কি জানতেন আপনি মামুন সাহেব? এ নিয়ে মারুফ সাহেব আর রাকিব সাহেব দুজন বেশ ঝগড়া করেছেন। সে খবর আমরা পেয়েছি। রাকিব সাহেবের গতিবিধি সব সময় সন্দেহজনক ছিল। এমনকি আপনার বাসার আগের কাজের ছেলে মিল্টন আমাদের সন্দেহ তালিকায়। যাকে তিন মাস আগে চাকরিচ্যুত করেছিলেন তুচ্ছ কারণে আপনার স্ত্রী।
কী বলেন এসব। আমি এসবের কিছুই জানি না। তবে হ্যা রাকিবের কাছে থেকে তার ফ্ল্যাটে যাতায়াতের কথা শুনেছি। তার মাধ্যমে শুনেছি মারুফের সাথে মিমের সম্পর্কের কথা। মিল্টন প্রায় সময় চুরি করত বলে জেনেছি মিমের কাছে থেকে। সেজন্য সে চাকরীচ্যুত করেছিল।
অথচ ঘটনা ভিন্ন ছিল মামুন সাহেব। আপনি হয়ত সেসব জানেন না। অন্য কিছু লুকাতে মিল্টনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আপাতত আমরা আপনাকে তা বলছি না। আর রাকিব অনেক জ্বালিয়েও পাত্তা না পেয়ে আপনাকে জানিয়েছে। মিম তার কথায় রাজি হয়নি। আপনি নাকি সেই বাসার কেয়ারটেকার কে টাকা দিয়েছিলেন মিমের আসা যাওয়ার খবর জানাতে।
হ্যা দিয়েছিলাম। একজন স্ত্রীর খবর নিতে এটুকু দেয়া কি পাপ ?
না না উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমি পাপের কথা বলিনি। জাস্ট জানতে চাওয়া। আমরা সুমন সাহেবের মাধ্যমে আপনার স্ত্রীর মোবাইল জব্দ তালিকায় নিয়েছি। যাচাই বাছাই করছি। দেখি কি হয়?
ওকে ওসি সাহেব, দেখেন….. !
আচ্ছা মামুন সাহেব আমি যাই আজ। অন্যদিন প্রয়োজন হলে আসব অথবা আপনাকে ডেকে পাঠাবো। আশা করছি আপনার সহযোগীতা পাব।
জ্বি নিশ্চয়।
শায়লার দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান ওসি । তারপর স্মিত হেসে শায়লার উদ্দেশ্যে বলেন….আবার হয়তো দেখা হবে ।
শায়লা মাথা নাড়ায় না বুঝেই। ওসির কথায় যেন অপার রহস্য।
ওসি শহিদুল এক কদম সামনে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলেন, মিস শায়লা আপাতত আপনিও এই শহর ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
শায়লার মেজাজ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়, আপনার কি মাথা খারাপ ওসি সাহেব ! যা তা বলছেন। আমি এসেছি বন্ধুর বিপদে সহমর্মিতা জানাতে। উল্টো আপনারা আমাকে ফাসাচ্ছেন। এ কেমন এ দেশের আইন?
দেখেন মিস শায়লা উত্তেজিত হবেন না প্লিজ। আপনাকে আমরা সন্দেহ করছি না। শুধুমাত্র একটু সহযোগিতা কথা বলছি। এটুকু করুন প্লিজ। আর শুনুন…. সব ওসির এসব কেসে মাথা খারাপই থাকে। আশেপাশে যাকে দেখে তাকেই সন্দেহ করে। আপনিও আমাদের সন্দেহের তালিকায় নাহলেও সুষ্ট তদন্তের স্বার্থে এটুকু সহযোগিতা আপনার থেকে আশা করছি। নিশ্চয় করবেন।
ওসি শহিদুল কথা শেষ করে দ্রুত বেগে চলে যান বাসার বারান্দা থেকে।
ঝিম মেরে বসে থাকে মামুন। ভাবতেই পারছে না কি হচ্ছে এসব। সুমনের সাথে কথা বলা দরকার। সুমন তো তাকে বলতে পারত।
শায়লা বেশ ঘাবড়ে গেছে যদিও। এসব কি মামুন ?
আমি এসে কি একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম। এমন জানলে আসতাম ই না।
আরে এত ভেব না। যা সত্যি তা পরিষ্কার। এসব নিয়ে মাথা ব্যথা বাড়িও না। দেখা যাক কি হয় ? আর আমিতো আছি। পুলিশ দেখুক তার মতো করে।
আচ্ছা আমি যাই রে। পরে কথা হবে।
বেশি ভেবো না প্লিজ। আমি কাল আইনজীবী সাথে কথা বলবো। দ্যান তুমি ফিরে যেও দ্রুত।
আচ্ছা মামুন দেখা যাক। ভালো থাকিস। নিজের খেয়াল নিস।
শায়লা চলে যায়। মামুন তখনো বারান্দার বসে থাকে। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত নেমে এসেছে। আজ শুক্লা পঞ্চমীর চাঁদ উঠেছে মেঘমুক্ত আকাশের পিঠে। ওদিকে তাকিয়ে বেনসন হেজেসের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছাড়ে আর ভাবনার জগতে হারিয়ে যায়, যেখানে তার আশেপাশে জুড়ে ছিল কেবল মিম। সেই মিম হারিয়ে গেছে বেঁচে থাকতেই।
আজ কেন জানি সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে। আসলে কি মিমকে হত্যা করা হয়েছে। আপাতত এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই।
তবে আজ মামুন নিজেই স্ত্রী হত্যার সন্দেহভাজন। মামুনের কাছে সবকিছু কেমন রহস্য রহস্য লাগছে। মানুষের জীবন গল্পগুলো কী এমন রহস্যময় হয়। একটা রহস্যের আঁচ লাগিয়ে কী কারো কারো জীবনের যবনিকাপাত হয়। তাও আরেক রহস্য। আসলে প্রত্যেকটা মৃত্যু এক একটা রহস্য। এই রহস্য সবাই ভেদ করতে পারে না।
এর মাঝে পুলিশের নানাবিধ দৌড়ঝাঁপ এর মাঝে আবাসিক এলাকার মারুফের সেই ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাট থেকে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।। স্থানীয় ওসি শহিদুল জানান, যে ফ্ল্যাট থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে সেখানে তিনি একা থাকতেন তার স্ত্রী ছেড়ে যাবার পর। ওই ফ্ল্যাটের মেঝেতে তার লাশ পড়ে ছিল। আত্মহত্যা নাকি খুন.. পুলিশ কোন কিছুই প্রাথমিকভাবে সুরাহা করতে পারেনি। পুলিশ ময়না তদন্তের জন্য লাশটা হাসপাতালে পাঠিয়েছে। মরদেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ এও জানিয়েছে যে, তার অফিস থেকে খোঁজ খবর নিয়েছেন, গত সাত দিন ধরে মারুফ তার অফিসে যায়নি। দীর্ঘদিন বাসা থেকে বের হতে না দেখে, বাসার মালিকের সন্দেহ হলে পুলিশে খবর দেন তিনি।
এই কয়দিনে মারুফ কারো সাথে কথা বলেনি। আত্মীয় স্বজন , বাবা মা কারো কল সাথে খুব একটা কথা বলেনি। অফিসের প্রয়োজনে কেবল ম্যানেজার রাব্বির সাথে কথা বলতো, তাও খুব কম। নিজেকে এই কয়দিনে বেশ আলাদা করে ফেলেছিলো। এদিকে মিমের মৃত্যুর পর পুলিশের ইনভেস্টিগেশন, নজরদারি বেড়েছে। সব মিলিয়ে প্রচন্ড ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছিলো। ব্যবসায়িক ভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এর মাঝে। সব মিলিয়ে একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো সে।
শেষবারের মতো মিতু তার বাচ্চাদের নিয়ে আসে মারুফকে দেখতে। পুলিশের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে, তাদের দেখতে দেয়। মিতুর অভিব্যক্তির খুব বদল হয় না। সে কাঁদতে পারে না। চোখে অশ্রু অবশিষ্ট নেই যে, সে কাঁদবে। কার জন্য সে কাঁদবে। বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদে। তাদের স্বান্তনা দিতে দিতে নিজের গোপন কষ্ট সে গোপনেই রাখে। । যতোই হোক, সে বাচ্চাদের বাবা। এটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। কিছু কিছু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত যে ,এত বিরাট আকারে হয়, তা কারো জানা ছিলো না। পরকিয়া একটা পরিবারকে তছনছ করে দেয়। কোথাও শান্তি থাকে না। না ইহকালে, না পরকালে। মাঝখানে বাচ্চাদের জীবনে নেমে আসে দূর্বিষহ ।
মিতু বাসায় যখন ফিরে তখন রাত। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে ঘরের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। বার বার মারুফের স্মৃতিগুলো মনে হচ্ছে। এমন তো হবার কথা ছিল না। সে সুখী হতেই নেশাখোর লিমনকে ছেড়ে মারুফের হাত ধরেছিলো। কিন্তু সুখ কোথায়? এসব ভাবতে ভাবতে মিতুর বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু যতোই কান্না আসুক আর সে কাঁদবে না। আর কিছুতেই কাঁদবে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় মিতু। এক দুখী রাজকন্যার চোখের অশ্রুর মতো বৃষ্টি হচ্ছে আকাশ জুড়ে। আজ বৃষ্টিতে ভিজবে সে। সমস্ত কষ্ট ধুয়ে মুছে নতুন করে সব শুরু করবে। মারুফের মৃত্যু রহস্যের পর যদিও পুলিশ কয়েকদিন শান্তিতে থাকতে দেবে না সে জানে। । যাক দেখা যাবে পরে।
বৃষ্টিতে ভেজার আলাদা একটা সুবিধা আছে। বৃষ্টির পানিতে চোখের পানি দেখা যায় না। তাই সে আজ ভিজবে। ব্যালকনি ছেড়ে অন্ধকার ঘরে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার ঘরে মিতুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কেবল।
পূর্ণশ্চঃ
মারুফের মৃত্যু অনেকটা মিমের মৃত্যুর মতো অমিমাংসিত এবং রহস্যময়। যদিও পুলিশ দুটো কেস নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।
#কিছু ভুলের মাশুল হয় না।
#তৃতীয় পর্ব।
#নিলয় আহমেদ।
#কিছু ভুলের মাশুল হয় না।
#চতুর্থ পর্ব।
#নিলয় আহমেদ।
(১৮+ সর্তকতা )
অনেকটা ইচ্ছে না-থাকা সত্ত্বেও একটু দেরীতে বিছানা ছাড়লো মিতু। কাল রাত একেবারেই ঘুম হয়নি। খানিকটা ঘুম আসে ফজর নামাজের পর। তারপর একটু পর পর পর অজানা আশংকায় বার বার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো তার। সারারাত দুচোখের উপর দিয়ে খুব ধকল গেছে সেটা যে কেউ তাকে দেখলেই বুঝবে। এক রাতেই চোখের নীচে কালশেটে দাগ দেখা যাচ্ছে। চোখের পাতা দুটো ফুলে গেছে অনেকটা। মায়ের ডাকেই মিতুর ঘুম ভাঙ্গলো।
কেউ একজন এই ভর দুপুরে তার সাথে দেখা করতে বাসায় এসেছে । কে হতে পারে? ভাবতে ভাবতে সে ওয়াশরুমে গেলো।
খানিকক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে সে অবাক না হয়ে পারলো না। লিমনকে দেখে তার যতোটুকু চমকাবার কথা, তার চেয়ে ঢের বেশি চমকে গেছে এতোদিন পর। তবুও নিজেকে সংবরণ করে এগিয়ে আসে সোফার দিকে। অনেকদিন পর এই মানুষটাকে দেখে মিতুর চেহারায় অভিব্যক্তির তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই মিতুকে আসতে দেখে লিমন উঠে দাঁড়ায়।
মিতু কোন ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্ন করে …তুমি এতোদিন পর এখানে কেন এসেছো লিমন?
মিতুর মুখে তার নিজের নাম শুনে লিমনের বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে গেল। কত দিন, কত মাস, কত বছর পরে প্রিয় মানুষটার মুখে তার নাম শুনলো। এতদিন কেউ এমন মধুর স্বরে তাকে ডাকেনি। হয়তো ভেবেছে মিতু তাকে কবেই ভুলে গেছে। লিমনের মনটা হঠাৎ ভীষণ সাহসী হয়ে উঠল। স্পষ্ট উত্তর দিলো �” হ্যা, মিতু। আমি তোমার এই ভয়ংকর বিপদের সময় দূরে থাকতে পারি না। তুমি সব সময় আমার কাছেই আছো। এক মুহুর্তের জন্য তোমাকে ভুলিনি। আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি মিতু।
মিতু চেহারায় গম্ভীর ভাব এনে উত্তর দেয়, আমি এখন প্রেম করার মুডে নেই লিমন। প্লিজ এসব কথা বলার দরকার নেই। কেন এসেছো সেটাই বলো।
এমন করে কেন বলছো? বিয়ের পর আমাকে তুমি একদম পর করে দিয়েছো। কতোবার তোমাকে দেখার যেনো অস্থির ছিলাম। কতোবার চেষ্টা করেছি তোমাকে দেখার জন্য। কিন্তু তুমি সুযোগ দাওনি মিতু। আমার প্রেম তো মিথ্যে ছিলো না।
দেখো লিমন, এই মুহুর্তে এসব কথা শুনতে কিংবা তোমাকে রুঢ় কিছু বলতে মন সায় দিচ্ছে না। তুমি আমার পরিস্থিতি চিন্তা করো। মাত্র কয়দিন আগে আমি বাচ্চাদের বাবাকে হারিয়েছি। তোমার সাথে এই মুহুর্তে দেখা করাই তো অনুচিত। তবুও এলাম।
তুমি তো তাকে ডির্ভোস দিয়েই দিছো। সে তো তোমার স্বামী না এখন মিতু।
বাহ..সব খবর রাখো দেখি।
অবশ্যই রাখি। তোমার প্রতিটা মুহুর্তের খবর আমি রাখি।
প্লিজ আমি এই অনাধিকার চর্চা চাচ্ছি না। আর শুনো ডির্ভোস হয়ে গেছে এটা ঠিক আছে। কিন্তু এটা জেনে রেখো, ও আমার বাচ্চাদের বাবা। এটা চিরন্তন সত্য। ওর কোন অমঙ্গল আমি কখনোই চাইনি। তবুও আজ বাচ্চারা তাদের বাবাহারা। এই মানুষটার সাথে আমি দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। মারুফের বাসা থেকে ফিরে আসার পর নিজেকে সামলানোর সময় ও পাইনি লিমন। এর মধ্যে সে মারা গেলো। পুলিশি ঝামেলা তো আছেই। প্লিজ তুমি চলে যাও। আমি কোন কিছু বলার মুডে নেই।
মিতু তুমি এত দ্রুত সবকিছু ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি। রেহানার কাছে থেকে তোমার প্রত্যেক মুহুর্তের খবর আমি নিতাম। আমি তোমাকে সেই আগের মতোই আজ ও ভালোবাসি।
প্লিজ লিমন প্লিজ। আর না। তুমি প্লিজ চলে যাও।
কথা শেষ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মিতু।
ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। তবে আমি আবার আসবো। বার বার আসবো।
না কখনোই আসবে না।
কেন?
আমার কোন পুরুষকে বিশ্বাস নেই। অল আর ইকুয়াল তোমরা?
মানে….
লিমন তোমার বউ আছে। একটা বাচ্চা আছে। তাদের ঠকিও না প্লিজ। একটা মেয়ের স্বামী ছাড়া থাকার জায়গা খুব কম। অনেক স্বপ্ন নিয়ে একটা মেয়ে স্বামীর সংসারে আসে। বউ বাচ্চাদের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করো না। যাও তাদের কাছে ফিরে যাও।
ওহ তোমাকে এসব খবর রেহানা বলেছে।
হ্যা বলেছে। এটা মিথ্যা না।
কিন্তু রেহানা তোমাকে এটা বলেনি যে, আমি এই বিয়ে করতে চাইনি। বাবা মা জোর করে দিয়েছে। আর এখন তার সাথে আমার মনের সম্পর্ক খুব কম। আমি তোমাকেই ভালোবাসি।
তোমরা পুরুষরা এমন কেন? কাউকে ভাল লাগে না। আবার বিয়ে ও করবে। বাচ্চা ও আনবে। বাচ্চা তো আর এমনি এমনি আসেনি।
কি বলছো এসব তুমি মিতু?
তোমাদের কিছু পুরুষদের কারেক্টারই এমন। কিন্তু সব মেয়ে এমন না। বিশেষ করে আমিতো নই। তুমি আর কোনদিন আমার সামনে এসো না। আমি চাই না তোমাকে। বউ বাচ্চাদের সময় দাও। আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।
মিতু এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে নীচের দিকে তাকিয়ে সামনের সোফায় বসে পড়লো।
লিমন কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে এক মনে মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখভরে সে দেখে নিচ্ছিল তার প্রথম তারুণ্যের প্রেম মিতুকে। না, খুব একটা বদলায়নি মিতু, শুধু দীর্ঘ ঘন কালো চুলগুলো আর আগের মতো নেই। খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে, নিচের দিকে কিছুটা ছেঁটেও ফেলেছে বোধহয়। আগে কোমর পর্যন্ত ছিল, এখন পিঠ পর্যন্ত। আগে লম্বা ছিপছিপে গড়ন ছিল তার, ভার্সিটিতে পড়ার সময়ও কিশোরীদের মতো লাগত, এখন স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়েছে। ঠিক ভালো না বলে বলা যায় বেশ স্বাস্থ্যবতী। না, বাঙালি মেয়েরা যেমন বিয়ের পরে মুটিয়ে যায়, সন্তান জন্মের পরে তাদের শরীর যেমন নেতিয়ে পড়ে, ওর ওরকম না ।
তবুও এখনো যৌবনের সেই তোলপাড় করা সুন্দরী লাগছে মিতুকে। শাড়ির আঁচল ভেদ করে তার ভরাট বুকও আন্দাজ করা যাচ্ছে। বয়স তো আর বেশি হবার কথা না ? তারা তো সহপাঠী। মানে পয়ত্রিশ এর একটু বেশি । তবে আগের চেয়ে বেশ মলিন হয়েছে চেহারা। চোখের নীচের কালশেটে দাগ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কতোদিন যেন উপোস ছিলো। তবুও সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে তাকে চোখের দিকে। হ্যা মিতুর চোখ দুটোও আগের মতো তেমনই গভীর-মায়াময়। অথচ সামান্য অবহেলায় কি বেহাল হয়েছে ও। ওর চোখেমুখে সর্বদাই একটা অদ্ভুত মায়া লেপ্টে থাকত, আসলে সেই মায়ারই প্রেমে পড়েছিল একদিন লিমন।
নীরবতা ভাঙ্গে মিতু, প্লিজ লিমন তুমি আর এসো না। কোনদিন না।
কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া ভালো নেই মিতু। আর এখন আমাকে তোমার প্রয়োজন। ঐ কালপ্রিট স্বামী তো তোমাকে বুঝেনি। পরকিয়ায় মত্ত ছিলো। তার জন্য মায়া কেন?
স্টপ লিমন। একদম স্টপ। ওর অসম্মান হোক আমি চাই না। আর এত খবর পাও কি করে?
যেভাবে হোক পাই। কিন্তু কথা তো সত্য।
প্লিজ তুমি যাও। সে আর তুমি খুব ব্যবধান না। ঘরে বউ রেখে এসে আমাকে মায়া দেখিও না। বউ বাচ্চাদের সময় দাও। তাহলে ভাল হবে। আর মারুফকে অসম্মান করে কোনদিন আমাকে কিছু বলবে না।
যে ব্যক্তি সব ভুলে সুইসাইড করতে পারে। তার জন্য এত সম্মান কেন?
ওয়েট ওয়েট লিমন। তুমি কি করে সিউর সে সুইসাইড করেছে।
তাহলে আর কি? কেউ কি হত্যা করেছে?
আচ্ছা এসবের পেছনে তুমি না তো? তুমি যে ধরণের তোমার পক্ষে তো সবই সম্ভব।
আস্তাগফিরুল্লাহ । কি বলো তুমি মিতু? আমি এতো খারাপ নই।
আচ্ছা থাক। প্লিজ তুমি যাও। আর শুনো এটাই আমাদের শেষ দেখা। তুমি আর কোনদিন এসো না।
লিমন আর একটা বাক্য ব্যয় করেনি। চুপচাপ ড্রয়িং রুমে পেরিয়ে সদর দরজা অভিমুখে রওয়ানা দেয়। মিতু তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ঘন নি:শ্বাস ফেলে। অতীত কিছু স্মৃতি তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। মিতু সেই ভার্সিটি লাইফের লিমনের সাথে কাটানো দিনগুলোতে ফিরে গেলো।
মিতু পড়াশুনায় মাঝারি রকমের ছিলো। দেখতে অসম্ভব সুন্দরী কিন্তু প্রচন্ড জেদী মিতুকে অনেকেই প্রপোজ করলেও সে কাউকে পাত্তা দিতো না। গ্রাম থেকে উঠে আসা এক তরুণ সবেমাত্র ভর্তি হয়েছে ভার্সিটিতে। মিতু প্রথম দেখাতেই লিমনকে ভালো লেগে যায়। যেখানে পুরুষরাই আগে প্রপোজ করে বেশিরভাগ সময়, সেখানে সে মেয়ে হয়ে লিমনকে প্রপোজ করবে। সে কথা ভাবতেই বার বার শিউরে উঠে। সে যেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো লিমনকে প্রপোজ করবে, সেদিন যেন সময় আর কিছুতেই কাটতে চাইছিলো না। মনে হচ্ছিলো, শ্যামলা বরণ এই তরুণ হ্যান্ডসাম পুরুষটার জন্য তার আজন্ম অপেক্ষা।
সেদিন সকাল থেকেই ঝরঝর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। লিমন মিতুর সহপাঠী তবে খুব ভালো যে বন্ধুত্ব তা কিন্তু না। অনেকটা শুরুর দিকে একা একাই থাকতো লিমন।
মিতুর ভালোলাগার ব্যাপারটা জানতো তারই সহপাঠী একমাত্র রেহানা। ঝির ঝির বৃষ্টি মুখর সময়টুকু লিমনের ভালো লাগতো না। বরং এসব সময়ে তার মন খারাপ লাগতো। মিতু ঝির ঝির বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়েই ভার্সিটিতে আসে। কিন্তু লিমনের মন খারাপ দেখে সে তার কোন কথাই গুছিয়ে বলতে পারেনি। এমনিতে মিতু বেশ সাহসী। নিজের যে কোন কথা সে অকপটে কাউকে বলতে দ্বিধা করে না। তবে সেদিন খানিকটা নার্ভাস ছিলো সে। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের লিমনকে সেদিন কোন কিছুই ঠিকঠাক বলতে পারেনি।
মিতু কতোটা ভালোবেসে ফেলেছিলো লিমনকে সেদিন সে বুঝেছিলো। লিমনের দিকে চেয়ে চোখের জল ফেলেছিল। উপস্থিত এই কান্ডে লিমন বিব্রতবোধ করলেও চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলো, কি হয়েছে মিতু? আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় সব বলতে পারো!
সুযোগ হাত ছাড়া করেনি সেদিন মিতু। লিমনকে বলে বসেছিলো যে তাকে সে কত তীব্রভাবে, কত ভীষণভাবে চায়! পুরো ব্যপারটাই এতো আচমকা ঘটে গিয়েছিলো যে- লিমন ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেও খুব অবাক হয়েছিলো। তবে সুন্দরী, ভরাট নিতম্বের , মেয়েটার প্রপোজে সাড়া দেবে কীনা তা নিয়ে লিমন দ্বিধায় ছিলো।
আসলেই কি মিতু সিরিয়াস ভালোবাসে নাকি ক্ষণিকের মোহ এটা। এই ভাবনা লিমনকে বিষণ্ণ করে তোলে।
সেদিন মিতুর কথা শুনে লিমন শুধু নরম গলায় বলেছিলো- ‘মিতু, তুমি আরো সপ্তাখানেক সময় নাও। ততদিনে তুমি নিজেও একটু বুঝবে সত্যটা….! আবেগ না মোহ নাকি সিরিয়াস নিজেই বুঝতে পারবে।
�’আমি অনেক ভেবেছি লিমন! ভেবে চিন্তেই কথাগুলো তোমাকে বললাম।�
এরপর থেকেই লিমনের সাথে আস্তে আস্তে মিতুর সম্পর্কটা হয়েই গেলো। তবে তাদের দুজনের পছন্দের ব্যাপারে বেশ অমিল ছিলো। মিতু পছন্দ করতো অরণ্যে। আর লিমন পছন্দ করতো উত্তাল সাগর। তবে একটা জিনিস দুজনের পছন্দ ছিলো, কবিতা। দুজনই কবিতা পছন্দ ছিলো।
সম্পর্কের বয়স আস্তে আস্তে অনেক দিন পেরিয়ে গেলো। এরই মধ্যে লিমন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িয়ে পড়ে। আগে থেকেই যে জড়িত ছিলো সেটা এতোটা সিরিয়াস পর্যায় ছিল না। কিন্তু একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে দ্রুত বদলে যেতে থাকবে তা বুঝেনি মিতু। আজ এই মিটিং, কাল এই মিছিল। অদ্ভুত ভাবে সে নিজেকে পাল্টাতে শুরু করলো। সেমিষ্টার পরীক্ষাগুলো তে খারাপ করা শুরু করলো। যে ছেলে সিগারেট মুখে নিতো না। খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সে আস্তে আস্তে নেশায় আসক্ত হতে লাগলো।
এর জন্য দায়ী তারই কিছু বন্ধু আর দলের নেতাগুলো। যাদের কথায় সে ওঠাবসা করতো। মিতুকে সময় দেয়া আস্তে আস্তে কমিয়ে দিতে থাকলো। যেদিন তার সাথে দেখা করতো লিমন সেদিন তার আচরণ বদলে যেতো। শারিরীক নেশায় তাকে পেয়ে বসতো। যখন তখন জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকতো। মিতুর সেটা ভাল লাগতো না। কিন্তু ভালবাসার মানুষ বিধায় অনেক সময় কিছু বলতো না। সাহস পেয়ে যখন তখন শরিরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতো লিমন। মিতুকে চাপ দিতো সে নেশায় শরিক হতে। মিতু এড়িয়ে যেতো নানা বাহানায়। লিমন তখন পুরোটাই নেশার জগতে ঢুকে যায়। তার ফিরে আসার পথ সে নিজেই রুদ্ধ করে দেয়। তার কাছে মিতুর চেয়ে নেশাটাই আগে দরকার। আস্তে আস্তে তার আচরণ চেঞ্জ হতে থাকে।
মিতু সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু লিমন তাকে কথা দিয়েও আবার বেঁকে বসে। অনেকটা ডিপ্রেশনে পড়ে যায় মিতু। যাকে এতো ভালবাসে সেই মানুষটার এই চেঞ্জ মেনে নিতে পারছে না। লিমন আজকাল ফোন ধরা কমিয়ে দিয়েছে। দেখা করতেও চায় না। মিতু সিদ্ধান্ত নেয়, যথেষ্ট হয়েছে আর না। এখানেই ইতি টানতে হবে। মারুফের সাথে তখনই বিয়ের প্রপোজাল আসে। সিদ্ধান্ত নেয়া মিতুর জন্য সহজ হয়ে যায়। বিয়েটা হয়ে গেলে হয়ত লিমন কে ভুলে যাওয়া খানিকটা সহজ হবে।
বাবা মা কে হ্যা বলে দিয়ে লিমনের মুখোমুখি হয় সে…..
সব জানার পর লিমন উত্তেজিত হয়…এসব কি বলছো তুমি মিতু?
যা শুনছো। ঠিক শুনছো। এবং আমি সিরিয়াস এখন।
আমিতো সব নেশা ছেড়ে দেব বলছি।
এই কথা দুইশবার শুনেছি। তাছাড়া এখন আর সময় নেই।
তুমি আমাকে আগে জানালে না কেন মিতু?
কি হতো তোমাকে জানালে?
অনেক কিছু হতো।
মিতু চোখ মুখ শক্ত করে বলেছিলো, আমি আমাদের সম্পর্কের ইতি এখানেই টানছি লিমন। এটাই আমাদের শেষ দেখা। এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ নেই। শুধু শুধু টেনে কি লাভ?
লিমনের মনে হলো, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কিছু না বলে শুধু বিস্ফোরিত চোখে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে লিমন বললো, তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে তো?
মিতু সে প্রশ্নের উত্তর দিলো না। চোখ মুছতে মুছতে শুধু পরিচিত রেষ্টুরেন্টের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। �সেদিন অন্ধকার নেমে আসা রাতের আলো ঝলমলে রেষ্টুরেন্ট পেরিয়ে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে চলে আসে সব ছেড়ে নিজের ঘরে।
মায়ের ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে মিতু।
কী রে তোর হয়েছে টা কী? কী এতসব ভাবছিস? তোর পাশে যে এতক্ষণ ধরে ফোন বাজতেছে, সে খেয়াল আছে মিতু?
সে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করতেই…পুরুষালি কন্ঠ শুনে জিজ্ঞেস করে… হ্যালো কে বলছেন?
আপনি কি মিস মিতু? আমি ওসি শহিদুল বলছি।
জি স্যার বলুন।
আপনার সাথে আমার দেখা করা দরকার মিস মিতু। আপনি কি বাসায় আছেন?
জি বাসায় আছি।
আচ্ছা আমি কিছুক্ষণ পর আসছি। তার আগে একটু বলুন প্লিজ, মিস মিম হত্যার দিন আপনি কেন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখান থেকে হত্যা স্পট খুব কাছে।
মানে কি অফিসার?
প্লিজ আন্সার দিন যা জিজ্ঞেস করছি। মিস মিতু আপনি ভাল করেই জানেন, কেন বলছি। আপনি হত্যা স্পটে কেন গিয়েছিলেন সেদিন। পাশের বাসার সিসিটিভি ফুটেছে আপনাকে স্পষ্ট দেখাচ্ছে।
মিতু আমতা আমতা করে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
অফিসার শহিদুল আবারও বলেন, কিছু গোপন করবেন না প্লিজ। আমরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু মোটিভ উদ্ধার করেছি। আমাদের কো অপারেটিভ করুন, তাতে আপনারই লাভ।
দেখুন অফিসার, মারুফের সাথে ইতিমধ্যে আমার ডির্ভোসের সব রেডি ছিলো। একটা নষ্ট চরিত্রের লোকের সাথে এতদিন সংসার করেছি তাও ধৈর্য ছিল বলে। কিন্তু আর কত?
তাই বলে হত্যা করতে হবে একজনকে ?
আমি হত্যা করিনি অফিসার।
তাহলে কেন গিয়েছিলেন?
আমি সেদিন গিয়েছিলাম রাব্বীর কথায়। সে আমাকে প্রমাণ দেখাতে চেয়েছিলো মারুফ আর মিমের কর্মকান্ডের।
রাব্বী মানে আপনার স্বামীর বন্ধু কাম ম্যানেজার।
জ্বি সেই….কিন্তু আমি যাবার আগেই মিম বেরিয়ে আসে। তাই আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে আসি।
আচ্ছা কি যেন নাম বললেন, রাব্বী। উনার ভালো নাম জানেন মিস মিতু?
জ্বি অফিসার। উনি আমাদের পারিবারিক ভাবে পরিচিত। মারুফের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। একেবারে শৈশব থেকেই।
উনার ভাল নাম যেন কি?
ওর নাম…মোরশেদুল ইসলাম রাব্বী । কিন্তু কেন অফিসার?
নাহ…এমনি জানতে চাইলাম। আর একটা ক্রস ম্যাচিং এর ব্যাপারে জানার আগ্রহ হলো। এনিওয়ে আপাতত রাখছি মিস মিতু। বাদ বাকী সাক্ষাৎ এ আলাপ হবে। তবে একটা কথা বলি, আমরা বোধহয় দুটি হত্যা মামলা ক্লোজের খুব কাছে আছি। ও হ্যা আরেকটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি…আপনার বাসা থেকে কিছুক্ষণ আগে যে ছেলেটি বেরিয়ে গেলো, সে কি লিমন? আপনার সেই সহপাঠী? সে কেন এসেছিলো?
দেখা করতে এসেছিলো অফিসার। আর আপনারা জানলেন কিভাবে? আমাদের বাসায় কি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন? আমরা ও কি সন্দেহ তালিকায়।
না না আমি এমন কিছু ভাবিনি। তবে তদন্তের খাতিরে আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হয়। বিভিন্ন জায়গায় সোর্স রাখতে হয়। ব্যাস এটুকুই। ছেলেটা গত মাস থেকে এই শহরে আছে। তা কি জানেন?
কী বলেন এসব? সে তো সব ছেড়ে শুনেছি তার মফস্বল শহরে সেটেল্ড হয়েছে।
কিন্তু সে গত মাস থেকে এই শহরে আছে। আমরা এটাই জেনেছি। বাদ বাকি দেখা হলে কথা বলবো মিস মিতু।
আপনারা কি লিমনকে সন্দেহ করছেন?
কিছুটা করছি । কারণ তাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা তাকে চোখে চোখে রাখছি। বাদ বাকি সময় বলে দেবে। এই হত্যাগুলোর সাথে তারাই জড়িত যারা হত্যা পরবর্তীতে বেনিফিটেড হবে।
ওহ আচ্ছা। একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় মিতু।
আচ্ছা তাহলে দেখা হচ্ছে কিছুক্ষণ পর মিস মিতু।
সে নিশ্চুপ থাকে। অফিসার ফোন রেখে দিলে মিতু বেশ ঘাবড়ে যায়। না চাইতেও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এসে পড়লো। ভাবনায় ডুবে যায় সে। ঘাড়ে কারো হাতের স্পর্শে শিউরে উঠে সে। পেছন ফিরে দেখে তার মা দাঁড়িয়ে আছেন।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মা জিজ্ঞেস করেন, সব ঠিক আছে তো মিতু? কে ফোন করেছিলো? তুই এতো ঘাবড়ে কেন গেলি?
মিতু জবাব দেয় না। ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের কোলে। কাঁদতে থাকে অনবরত। কান্না গলায় বলে….আম্মু প্লিজ আমাকে একটু শক্ত করে ধরো সেই ছোটবেলার মতো। আমি কতোদিন ভালো করে ঘুমাই না। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও আম্মু। মিতুর মা মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে তার চোখের অশ্রু মুছবার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে উনার বুকের কাপড় সে জলে ভিজে যায়।
#কিছু ভুলের মাশুল হয় না ।
#পঞ্চম এবং শেষ পর্ব।
#নিলয় আহমেদ ।
((১৮+ সতর্কতা )
রাতটা কোন রকম পার করলো মিতু। ভোর হতেই দরজা খুলে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ কিছুটা জ্বালাপোড়া করছে। ঘুম হয়নি ভালো করে তাই মাথা বেশ ভার। গায়ে এসে লাগছে স্নিগ্ধ ভোরের বাতাস, সামনে সারি সারি রকমারি গাছের পাতা, পেয়ারা আর কলার সবুজ পাতা বাতাসে দোল খাচ্ছে। ঠিক তার পেছনে সূর্যোদয় হয়েছে। কিন্তু তার জীবনে সূর্য যেনো সেই বিকেলের মতো আস্তে আস্তে অস্ত যাচ্ছে। বিষণ্ণ মন নিয়ে সে বারান্দায় পায়চারি করতে থাকে।
বারান্দার একেবারে শেষের দিকে থাকা চেয়ারটায় বসে নিজের কথা ভাবতে ভাবতে মিতুর বেশ কান্না পেলো। হাতের উপর মাথা রেখে ফুঁফিয়ে কান্না করতে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর কারো ভালোবাসার মমতার হাত মাথার উপর আসতেই চোখ মেলে তাকালো সে। এই হাতের মাঝে সে যেন ফিরে পেলো জাগতিক শান্তি, বিশ্বাস আর নির্ভরতা। আর তার সহজ সরল বাবা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, এত ভেঙ্গে পড়তে নেই মা। জীবনে এমন উপর নীচ ধাপ থাকেই। সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করতে হয়। তুই তো আমার বাহাদুর মেয়ে। তুই ছোট বেলা থেকেই সাহসী। কেন এখন ভেঙ্গে পড়ছিস। একটা কথা মনে রাখিস, আল্লাহর ইশারা ছাড়া কিছুই হয় না। এর মধ্যে নিশ্চয় তোর জন্য কোন কল্যাণ আছে।
বাবার কথায় খানিকটা শান্ত হয় মিতু। কত সহজে তার বাবা বুকটা অল্পটা হলে খালি করে দিলো। মিতু বাবার দিক স্মিত হেসে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। রুমে ঢুকতেই দেখে মোবাইলে আলো জ্বলছে। চার চারটা মিসকল এসেছে ওসি শহিদুল এর মোবাইল থেকে। তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করে সে…
ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই মিতু বললো, সরি অফিসার আমি বাইরে ছিলাম তাই ফোন পিক করতে পারিনি।
ইটস ওকে মিস মিতু। আমি নিজেই সরি, এত সকাল সকাল আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু কি করবো বলেন? আমাদের দায়িত্বটা এমন যে, আমাদের সময়ক্ষণ নেই।
না না ঠিক আছে অফিসার। আপনি বলুন কি বলবেন?
আমি দু:খিত কিছু কাজ থাকায় আমি আপনাকে বলেও আসতে পারিনি।
ঠিক আছে অফিসার।
মিস মিতু আমরা একজনকে আটক করেছি সন্দেহভাজন হিসেবে গতকাল রাতে। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোন কথা তার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। রাতভর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি কিন্তু লাভ হয়নি। সকালে কিছুটা আশার আলো পেয়েছি।
কি সেটা অফিসার?
একমাত্র আপনি এলে সে মুখ খুলবে। আপনার সামনে সে তার সবকিছু বলবে। তাই প্লিজ আপনি নাস্তা করেই আমাদের থানায় একবার আসুন। কথা দিচ্ছি, আপনাকে সসম্মানে আমি নিজে আবার বাসায় পৌছে দেব।
না না অফিসার। সমস্যা নেই। আপনি কাকে আটক করেছেন? কে সে?
আপাতত নাম বলছি না। আমি আগে থানায় আসুন। বাদ বাকি এখানে এসে দেখবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে অফিসার। আমি কাপড় চেঞ্জ করে দ্রুত আসছি।
থ্যাংক ইউ মিস মিতু।
মিতু ফোন রেখে দেয়। ভাবনার সাগরে ডুবে যায়। হুট করে কাকে আটক করলেন ওসি। কে হতে পারে? সে না গেলে কথা বলবে না? লিমন না তো?
ঠিক আধ ঘন্টার মতো সময় নেয় রেডি হতে। তার কিছুক্ষণ পর দোদুল্যমান মন নিয়ে সে থানায় উপস্থিত হয়। থানায় ওসির রুমে গিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে। অল্পকিছু সময় পর ওসি শহিদুল আসেন।
সরি মিতু আপনাকে সকাল সকাল আসতে হলো। আসলে উপায় ছিল না।
না না অফিসার। ঠিক আছে। এটা আপনার দায়িত্ব।
কনস্টেবল কিছুক্ষণ পর একজন লোককে নিয়ে সামনে আসে। মিতু ঘাড় ঘুরিয়ে লিমনকে দেখে বেশ অবাক হয় না। তার ধারণা তাহলে সত্যি। লিমন কে আটক করেছে পুলিশ।
ওসি শহিদুল মিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, উনাকে আমরা শুরু থেকে সন্দেহ করছি। মারুফ সাহেবের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের আশেপাশে উনি বেশ কয়েকদিন থেকে ঘুর ঘুর করছেন। তাই আশেপাশের সব কয়টি সিসিটিভি ফুটেছে উনাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। উপায় ছিল না,উনাকে আটক না করে। কিন্তু উনি কেন সেখানে ঘুরছিলেন। তার কোন উত্তর দিচ্ছেন না। এজন্য আপনাকে কল করে আনা।
মিতু লিমনকে ভালো করে দেখে। তার চেহারায় ভয়ের কোন চিহ্ন নেই। যেনো সে একেবারে বিন্দাস আছে। মিতু চেয়ার চেয়ে উঠে দাঁড়ায়..আচ্ছা লিমন গত এক মাস থেকে শুনলাম তুমি ঢাকায় ! আসলেই কি সত্য?
হ্যা সত্য মিতু।
কেন এসেছিলে তুমি?
আমার কি ঢাকায় আসা মানা? ঢাকায় কি আমার কাজ থাকতে পারে না। আর আমিতো রাজনীতি করি। আমার দলের প্রয়োজনেও আসতে হয়।
তাহলে কেন তুমি মারুফের ফ্ল্যাটের আশে পাশে ঘুর ঘুর করছিলে?
আমি রেহানার থেকে শুনেছি, মারুফের পরকীয়ার কথা। তাই কয়েকদিন তাকে একটু নজরে রাখছিলাম যেনো তার কুকর্ম আমি ভিডিও করে তোমাকে দেখাতে পারি। এসব দেখে যেনো তুমি তাকে ডির্ভোস করে আমার কাছে আসো।
ওহ মাই গড বলেই চেয়ারে বসে পড়ে মিতু। তুমি কী পরিমাণ স্বার্থপর । আমি চিন্তা ও করতে পারছি না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি মিতু। লিমনের কন্ঠে বেশ দৃঢ়তা।
ওসি শহিদুল কেবল তাকিয়ে তাদের কথোপকথন শুনছেন।
মিতুর চেহারা খানিকটা লাল হয়ে আসে। কী উত্তর দেবে ভাবতে পারছে না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে লিমনের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি করে ভাবলে , তোমার মত একটা নেশাখোরের কাছে আমি আবার যাবো। যার বউ বাচ্চা আছে তার কাছে আমি ফিরে যাব। তোমার লজ্জা করে না লিমন। ভেবেছিলাম তুমি ভাল হয়ে গেছো। কিন্তু তুমি যেই সেই। চিৎকার করে মিতু। প্লিজ অফিসার ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান।
ওসি শহিদুল কনেস্টবেলকে ইশারা করেন, লিমনকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। মিতু ইতিমধ্যে ঘামতে শুরু করেছে। নীচের দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারের রুমে চেয়ারে চুপ করে বসে আছে। অফিসার রহমান এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলেন, পানিটা পান করুন। আপনি বেশ নার্ভাস।
মিতু পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এক ঢোগ পান করে রেখে দেয়। অফিসার এবার নিজের চেয়ার ছেড়ে মিতুর দিকে এগিয়ে এলেন , মিস মিতু আমরা শুরুর দিকে মামুন সাহেব কে খুব সন্দেহ করেছিলাম। বেশ কয়েকদিন থেকে উনাকে আমরা ফলো করছিলাম। বাট এমন কিছু সন্দেহজনক পাচ্ছি না। সিসিটিভি ফুটেজে এরকম কিছু নেই। কিন্তু লিমনকে সন্দেহ হচ্ছে বেশ। কিন্তু মুখ খুলছে না। আমরা ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেলে ব্যাপারটা একদম ক্লিয়ার হয়ে যাব। যদি রিপোর্ট এ হত্যার ব্যাপার বুঝা যায়, তখন আমরা হয়ত লিমনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালত থেকে রিমান্ড আনবো।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনো আসেনি অফিসার।
না আসেনি। আশা করছি খুব দ্রুত চলে আসবে। রিপোর্ট পেলে কাজগুলো সহজ হয়ে যাবে। এর আগে কিছুই করতে পারব না।
আমি কি যেতে পারি অফিসার?
ওসি যেনো সে কথা কানে নিলেন না। বরং আবার বলতে শুরু করলেন, জানেন মিস মিতু আমরা কনফার্ম হয়েছি, মিমকে হত্যা করা হয়েছে।
কীভাবে কনফার্ম হলেন অফিসার?
ফরেন্সিক রিপোর্ট, সিসিটিভির ফুটেজ, সব আলামত বিশ্লেষন করে কনফার্ম হয়েছি, এই এক্সিডেন্টের আড়ালে মিমকে হত্যা করা হয়েছে।
কথাগুলো বলে মিতুর দিকে তাকালেন তদন্তকারী কর্মকর্তা শহিদুল।
আমাকে কেন এসব বলছেন অফিসার? আমাকে উল্টো সন্দেহ করছেন না তো।
না না আপনাকে করছি না। বলতে ইচ্ছে হলো তাই বললাম। আচ্ছা আপনাদের ব্যবসা মানে মারুফ সাহেবের ব্যবসা নিয়ে আমরা কিছু জানতে চাই। গতকাল আমরা একবার অফিসে গিয়েছিলাম। আজকে আবার যাবো। আপনি কি আমাদের অফিস সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারবেন।
কী রকম তথ্য চান অফিসার? আপনি জিজ্ঞেস করুন। আমি যা জানি বলবো।
রহিম নামে আপনাদের একজন অফিসে কাজ করতো। তাকে চেনেন?
দু একবার অফিসে দেখেছি। তাকে তো বেশ আগেই চুরির জন্য চাকরিচ্যুত করা হয়েছিলো।
সেটা কি মারুফ সাহেব করেছিলেন?
জ্বি উনি ছাড়া আর কে করবে?
মোরশেদুল ইসলাম রাব্বি মানে অফিসের ম্যানেজার লোকটা কেমন?
উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু বলা যায়। মারুফের একেবারে শৈশবের ফ্রেন্ড। কখনোই খারাপ কিছু দেখিনি কোনদিন। বরং উনি আমাকে হেল্প করেছেন বোনের মতো। উনি আমাকে বোন ডাকতেন।
হেল্প মানে মারুফ সাহেবের পরকিয়ার ব্যাপারটা উনি জানিয়েছেন এইতো।
ঠিক তা না।
তাহলে কী? একটু জানাবেন মিস মিতু ।
একটা আননোন নাম্বার থেকে আমার হোয়াটস আপে একটা ভিডিও আসে।
কি ছিল ভিডিওতে?
মারুফ এবং মিমের ঘনিষ্ট মুহুর্তের ভিডিও..অফিসার।
এটা দেখে আপনার রাগ উঠেনি? ইচ্ছে করেনি তাকে কিছু বলতে?
অফিসার যে কারো রাগ উঠবে। আমারও উঠেছিলো।
আপনি তখন কি করেছিলেন?
মারুফের সাথে কথা বলেছি। শুরুতে অস্বীকার করলেও পরে ভিডিও কথা বলায় স্বীকার করেছে। আর এমন হবে না ওয়াদা করেছিলো।
আপনিও মেনে নিয়েছেন মিতু।
না নেইনি। আমি অনুরোধ করি রাব্বি ভাইকে যেনো, আমাকে মারুফের দৈনন্দিন খবরটা জানায়। ও কোথায় যায়, কার কাছে যায়।
উনি রাজী হলেন?
শুরুতে হয়নি। কিন্তু আমি কান্নাকাটি করার পর উনি রাজি হয়েছে। উনি নিয়মিত আমাকে আপডেট দিতো।
আচ্ছা আপনার হোয়াটসঅ্যাপ যে নাম্বার থেকে ভিডিও এসেছিলো, আপনি সে নাম্বারে কল দেননি।
দিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ ধরেনি অফিসার।
আচ্ছা আমাকে কি ঐ নাম্বার দেয়া যায়?
জ্বি দিচ্ছি। মিতু মোবাইল বের করে একটা কাগজে সেই নাম্বারটি লিখে দেয়। তারপর ওসির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার কথা বলে শেষ হলে আমি কি যেতে পারি?
জি কথা বলা শেষ। আপনাকে আমি পৌছে দিচ্ছি।
না না অফিসার লাগবে না। আমি একাই যেতে পারব। আমার পথ আমাকে একাই চলতে হবে।
ওসি শহিদুল এক্ষেত্রে নীরবতা পালন করেন। মিতু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, যাবার আগে বলে যাই, আপনাদের যখন দরকার মামলার প্রয়োজনে, আমাকে প্রয়োজন হলে ডাকবেন। আমি আসবো। আর একটি কথা, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এ যদি মারুফকে হত্যার আলামত আসে তবে আপনাদের কাছে যদি আমার বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ থাকে। আপনারা আসবেন। আমি তৈরি থাকবো। তবে অনুরোধ করবো, যদি তা না থাকে তবে দয়া করে আমাকে একা থাকতে দেবেন। আমি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত। আসি অফিসার।
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে থানা থেকে বেরিয়ে যায় মিতু। ওসি শহিদুল সে চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে খানিকটা কিছু নিয়ে ভাবেন। তারপর কনস্টেবল কে ডাক দেন।
()
এর মধ্যে পনেরো দিন অতিবাহিত হয়ে গেছো। দুটো মামলার কোন আপডেট পাওয়া যায়নি। বলা যায় পুলিশ নিজেরাই কাউকে আপডেট দিতে রাজী ছিলো না। তারা তাদের মতো কাজ করছিলো। মামুনের একাকিত্ব ক্রমশ বেড়েছে। শায়লা এর মাঝে পুলিশের অনুমতি নিয়েই দেশ ছেড়েছে। মামুনের মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে আর না। মিম কে বিয়ে করে সে বিন্দু পরিমান সুখী ছিলো না। এবার সে নিজের জন্য সুখের পরশ খুঁজবে। আজ থেকে সে আর কারো অপেক্ষা করবে না। একটা সঙ্গী তার দরকার। বাচ্চাদের একজন মা দরকার। সব মিলিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে বিয়ে করবে। তার সামনে এখন অন্তহীন জীবন পড়ে আছে। একাকিত্ব শূণ্যতায় সে জীবন সে হেলায় হারাতে চায় না।
আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই চেয়েছে, বিয়ে হোক। তবে কিছুদিন পর। কিন্তু মামুন খুব একটা দেরী করতে রাজী না হওয়ায় আগামী শুক্রবার তার বিয়ে ঠিক হয়েছে তারই কাজিন শম্পার সাথে। শম্পা নিঃসন্তান ডির্ভোসী। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে ঠিক হয় দ্রুত। বিয়ের ঠিক আগের দিন হঠাৎ করে মামুনের বাসায় এসে উপস্থিত হোন ওসি শহিদুল।
এই ভর দুপুরে ওসিকে দেখে কিছুটা বিচলিত হয় মারুফ। কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে অফিসারকে জিজ্ঞেস করে কী মনে করে হঠাৎ ?
শুনলাম মামুন সাহেব আপনি বিয়ে করছেন? দাওয়াত দিলেন না যে!
বিয়ে তো করতেই হতো অফিসার। আজ বা কাল।
কিন্তু আরো কয়েকদিন পর করলে তো হতোই। কয়েকদিন আগে মাত্র আপনার স্ত্রী খুন হলেন। জানেন ও না , কে খুন করেছে? তার আগেই নিজেই আরেকজন সঙ্গী যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এতে কি গোনাহ হয় অফিসার?
আমি তা বলিনি। কিন্তু জানেন, একজন স্ত্রী মারা যাবার অল্প দিন আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। সাথে সাথে আরেকজন নিয়ে আসি। অথচ মেয়েরা এক বাচ্চা নিয়েও সারাজীবন একা কাটিয়ে দেয়। সেক্রিফাইস মেয়েরাই তো বেশি করছে মামুন সাহেব।
অফিসার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা বাদ দেন। কি বলতে এসেছেন বলুন।
আচ্ছা বাদ দিলাম। যা বলতে এসেছিলাম। মারুফ সাহেবের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আমরা একটু পর পাবো। তাহলে বুঝতে পারবো উনি খুন হয়েছেন কীনা। দ্বিতীয় কথা হলো, আমরা আপনার স্ত্রীর এক্সিডেন্টের সেই ট্রাকের ড্রাইভারকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। সে ভারত পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো। বর্ডারের খুব কাছে থেকে তাকে ধরা হয়েছে। একটু পর আমরা আদালতে তুলে রিমান্ড চাইবো। আপনি কি বিয়েটা আরো দুদিন বা সপ্তাহখানেক পিছিয়ে দিতে পারবেন?
আমার বিয়ের সাথে এসবের কী সম্পর্ক অফিসার?
আছে অনেক কিছুই। আমি অনুরোধ করে গেলাম। বাদ বাকি আপনার ইচ্ছে। আমি যাচ্ছি তবে।
ওসি শহিদুল আর একটা বাক্য ব্যয় না করে হন হন করে চলে গেলেন। মামুন স্থির চিত্রে তাকিয়ে থাকলো সে চলে যাওয়া পথের দিকে দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে। এখন তার কি করা উচিত? বুঝতে পারছে না।
()
আমাকে আবার কেন ডেকেছেন অফিসার? নিশ্চয় এবার ভালো কিছু সংবাদ দিতে পারবেন? কথাগুলো বলতে বলতে ওসি শহিদুল সাহেবের কক্ষের সামনের চেয়ারটায় বসলো মিতু।
জি বেশ কিছু ভালো সংবাদ দেয়ার জন্য আপনাকে ডেকেছি মিস মিতু।
তাহলে বলুন।
ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে। সেটার কথা আগে বলি। মারুফ সাহেব খুন হননি। উনি নিজে সুইসাইড করেছেন ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে।
এই রিপোর্ট আসতে এতোদিন কেন লাগলো অফিসার?
যিনি ময়নাতদন্ত করেন সাধারণত। উনার কিছু সমস্যার কারণে খানিকটা দেরী হয়। তবে খুব বেশি দেরী হয়নি।
আচ্ছা। তারপর…
দ্বিতীয় কথা হলো, তাকে সুইসাইডে বাধ্য করা হয়েছে।
কে করেছে? বেশ অবাক হয়ে প্রশ্নটা করে মিতু।
সেটা বলছি ধীরে ধীরে। তার আগে একটু সেল থেকে ঘুরে আসুন। দেখেন লোকটাকে চেনেন কীনা?
মিতু চেয়ার ছেড়ে উঠে সেলের দিকে এগোয়। অনেকক্ষণ লোকটাকে দেখে কিন্তু চিনতে পারে না। আবার নিজের জায়গায় এসে বসে।
না অফিসার আমি চিনতে পারিনি। উনি কে?
মিতু যাকে এক্সিডেন্টের নাম করে হত্যা করা হয়েছে। সেই এক্সিডেন্টের ট্রাকের ড্রাইভার। আমরা তার জবানবন্দি নিয়েছি আগেই। সে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তবে মাস্টার মাইন্ড আরেকজন। সে মাত্র তিন লাখ টাকার চুক্তিতে এক্সিডেন্ট করতে রাজী হয়েছিলো। মাষ্টার মাইন্ড কথা দিয়েছিলো ড্রাইভারের কিছুই হবে না। তাই সে রাজী হয়েছিলো। তাকে আমরা গ্রেফতার করেছি ভারত বর্ডার থেকে।
আচ্ছা অফিসার মাষ্টার মাইন্ডটা কে? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ সে মাষ্টার মাইন্ডকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। তবে কিছুক্ষণ পর সে থানায় আসবে। সেও ভারত পালিয়ে যাবার চেষ্টার সময় গোপন জায়গা থেকে আমরা তাকে গ্রেফতার করেছি।
তার নাম কী অফিসার?
রহিম মিয়া। মারুফ সাহেবের অফিসের কর্মচারী। যে চাকরিচ্যুত হয়েছিলো মারুফ সাহেবের হাতেই। সেই হচ্ছে এখন পর্যন্ত মুল আসামী। আরেকটা বিস্ময়ের তথ্য দেই, আপনাকে যে নাম্বার থেকে ভিডিও পাঠানো হয়েছিলো, সেটা সেই রহিম মিয়ার আলাদা একটা নাম্বার থেকে। যে নাম্বার তার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
অহ মাই গড। আমি বুঝতে পারছি না। মিতু হত্যার সাথে রহিম মিয়া কিভাবে ইনভলব হলো। তার স্বার্থ বা কী?
সেটাই আমরা ভেবেছি। সম্ভাব্য কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছি। আমরা আরেকজন কে গ্রেফতার করতে যাবো খুব জলদি। সে আমাদের সীমানার ভেতরে আছে। পালিয়ে যেতে না পারে তাই সমস্ত ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে।
আমি কি তার নাম জানতে পারি অফিসার?
অবশ্যই না। এখন বলা যাবে না মিস মিতু। আপনি বাসায় চলে যান। আমরা রহিম মিয়াকে আদালতে তুলবো। রিমান্ড চাইবো। আশা করছি ২/১দিনের মধ্যে সবকিছু ক্লিয়ার করতে পারবো। আপনি নিশ্চিন্ত বাসায় যান। আমি আপনাকে ডেকে পাঠাবো।
আচ্ছা বলে মিতু উঠতে যাবে তখন ওসি শহিদুল আবার বললেন, লিমন কে আমরা গতকাল ছেড়ে দিয়েছি। এই কেসের সাথে উনি কোনভাবেই জড়িত নন।
কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো মিতু। অফিসারের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় উদ্দেশ্য রিক্সায় উঠে রওয়ানা দেয় মিতু। পথের মধ্যে তার ভাবনা বেড়ে যায়। রহিম মিয়া কেনই বা হত্যা করবে মিতুকে?
মারুফ কেনই বা সুইসাইড করবে? আর মারুফকে কে সুইসাইডে বাধ্য করেছে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মিতু। কিন্তু কোন উত্তর খোঁজে পায় না।
()
মামুন বিয়ের ডেট পিছিয়েছে সপ্তাহখানেক। আপাতত নির্ভার সে। তবে ইদানিং থানায় আসা যাওয়া করছে খুব মিতুর কেসের আপডেট জানার জন্য। ওসি শহিদুল কিছুটা বিস্মিত । হুট করে এই তৎপরতা বেড়ে যাওয়া অবশ্য অন্য কোন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। কারণ ইতিমধ্যে ওসি শহিদুল মুল আসামীসহ তিনজন কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি তাদের জবানবন্দি নিয়েছেন।
আজ সোমবার। অন্যান্য দিন থেকে অনেকটা পার্থক্য। কারণ আজকে ওসি শহিদুল সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন থানায়। কারণ মিতু এবং মারুফের কেসটা মোটামুটি সলভ হয়ে গেছে। এখন স্বজনদের জানিয়ে দেয়ার জন্য আয়োজন। ওসি শহিদুলের কক্ষে উৎকন্ঠা নিয়ে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছেন, মিমের স্বামী মামুন, মিমের ভাই সুমন, মিতু এবং মিতুর বাবা মা।
শহিদুল ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করেন…. শুরুটা করি মিমের কেস দিয়ে। আমরা যে কোন একটা কেস আগে সলভ করার চেষ্টা করেছিলাম শুরুতে। তার কারণ আমাদের বিশ্বাস ছিলো, দুটো কেস একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। হতে পারে একই ব্যক্তি। সে অনুযায়ী আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু পরে ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা গেলো, মারুফ সাহেব সুইসাইড করেছেন। তখন আমাদের কাজ কিছুটা গতি হারায়। কেসে গতিপথ চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কিছুটা স্লো হয়ে যাই। তবে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে খুব সময় লাগেনি।
মিস মিতু আপনার হোয়াটসঅ্যাপ যে নাম্বার থেকে ভিডিও এসেছিলো। সেই একই নাম্বার থেকে মারুফ সাহেবের ফোনে বেশ কয়েকটা ব্ল্যাকমেইলিং এর ভিডিও আসে। মারুফ সাহেব বেশ কয়েকদিন ভয়ানক হুমকি ধামকির মধ্যে দিয়ে অস্থির সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু এত সেন্সসেটিভ ভিডিও ছিলো যে, উনি কাউকে বলতে পারেননি। এমনকি পুলিশের সহায়তা নিতে পারেননি। একা একা নিজেই হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করতে থাকেন। একসময় নিজের উপর বিরক্ত আর ক্লান্ত হয়ে যান।
এর পেছনে কে ছিল অফিসার? মিতু অশ্রু চোখে অফিসার কে জিজ্ঞেস করে।
ওসি শহিদুল ইশারায় মিতুকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, একটু আপনারা নীরব থাকুন। আপাতত কোন প্রশ্ন করবেন না। আমি আপনাদের সব বলছি।
হ্যাঁ এই হুমকি, ভিডিও সবই আসতো রহিম মিয়ার আলাদা ফোন থেকে। এসবের বিনিময়ে রহিম মিয়া প্রায় দশ লাখ টাকা পান। সেই টাকা দিয়েছেন, মিস মিতু আপনাদের ম্যানেজার কাম আপনাদের পারিবারিক বন্ধু মি: মোরশেদুল ইসলাম রাব্বি। সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন মি: রাব্বী। ভয়ংকর একজন ক্রিমিনাল, কিন্তু সবার সামনে মুখোশ পরে এতোদিন ছিলেন।
অস্ফুট স্বরে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো মিতু। কেন রাব্বী ভাই এই কাজটা করলো?
ওয়েট বলছি। শুরুতেই রাব্বীকে আমাদের সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু জোরালো কোন প্রমাণ ছিলো না। এক্ষেত্রে মি: সুমন আমাদের বেশ সাহায্য করেছেন। উনি তথ্য দিয়েছেন রাব্বী উনাদের গ্রামের ছেলে। এবং কলেজ থাকাকালীন অবস্থায় উনার বোনকে প্রায় ডিস্টার্ব করতেন। তার মানে উনি মিমের পূর্ব পরিচিত। যা শুরুতে আমাদের জানা থাকলে আরো আগেই কেস সলভ হয়ে যেতো।
রাব্বীকে আমরা গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছিলাম। রহিম মিয়া গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর উনি বিদেশে যাবার চেষ্টায় ছিলেন। পাসপোর্ট এ আগে থেকেই উনার দুবাই ভিসা করা ছিলো। উনি সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন যেনো, বিপদ মনে হলে পালাবেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য উনার এর আগেই উনাকে আমরা গ্রেফতার করেছিলাম।
উনি আমাদের রিমান্ডে খুব সহজেই জবানবন্দি দিয়েছেন যে, এই দুটি হত্যার মাষ্টার মাইন্ড সে নিজেই। রহিম মিয়াকে দশ লাখ টাকার বিনিময়ে রাজী করিয়েছিলো। রহিম মিয়া এমনিতে মারুফ সাহেবের উপর ক্ষোভ ছিলো। কারণ একেবারে বিনা দোষে তাকে চাকরিচ্যুত করেছিলেন মারুফ সাহেব। যে অন্যায়ের জন্য রহিম মিয়াকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, সেটা মুলত রাব্বী নিজে করে ফাসায় রহিম কে। কিন্তু রহিম কে আবার উল্টো লাগায় মারুফের ব্যাপারে। রহিম চাকরি যাবার পর খুব কষ্টে দিনযাপন করছিল। বিনা চিকিৎসায় তার ছোট মেয়েটি মারা যায়। সেই ক্ষতস্থানে প্রলেপ লাগায় রাব্বী।
রহিম মিয়াকে ফুসলিয়ে রাজী করায় এতসব কর্মকান্ডে। শুরুতে মিমকে হত্যা করার কোন পরিকল্পনা রাব্বীর ছিল না। রাব্বী সেই কলেজ লাইফ থেকে মিমকে ভালোবাসতো। একদম পাগলের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু মিম তাকে পাত্তা দিতো না। সেই থেকে তার ক্ষোভ জন্মেছে। রাব্বী আজ পর্যন্ত মিমের জন্য বিয়ে করেনি। মিম যখন মামুনের সাথে বিয়ে হয়, তারপর ও সে তার পিছু ছাড়েনি। নানান সময় হুমকি ডামকি দিতো। কিন্তু কোন কিছুই মিম কাউকে বলতো না। তার জীবন হুমকির মুখে এটা সে তার ভাই সুমনকে বলতো। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তাদের নাম বলতো না।
এর মাঝে মিম জড়িয়ে যায় মারুফ সাহেবের সাথে। যেটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলো না। যার জন্য সে বিয়েই করেনি সে কীনা তাকে ছেড়ে বিয়ে করলো। আবার পরকিয়া করছে তারই বন্ধু কাম বসের সাথে। এটা সে বরদাশত করতে কষ্ট হচ্ছিলো। এর মাঝে সে মিম আর মারুফের ভিডিও ধারণ করে রহিম মিয়াকে দিয়ে। মিম কে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। এমনকি বাধ্য করে তার সাথে সময় কাটাতে। মিম তখন পাগলের মতো ছিলো। রাব্বীর পাগলামি এর চেয়ে প্রকট হতে থাকে। ব্ল্যাকমেইলিং বেড়ে যাচ্ছে দেখে মিম সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশে সব জানাবে।
ঘটনার দিন মারুফের ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে মারুফের সাথে রাগারাগি করে বের হয় মিম । বড় রাস্তায় উঠার আগেই রহিম মিয়ার নাম্বার থেকে ফোন আসে মিমের ফোনে। রহিম মিয়া হুমকি দেয়, এখনি যেন রাব্বীর ফ্ল্যাটে যায়। নাহলে আজকে তার শেষ দিন হবে। মিম তখন বলে, যা হয় হোক। আজকে আমি পুলিশে যাচ্ছি। মারুফ এবং রাব্বী দুজনের কথাই সব পুলিশকে বলব। একজন তাকে ইউজ করেছে দিনের পর দিন। অন্যজন ব্ল্যাকমেইলিং ।
গাড়ীর জন্য যখন অপেক্ষা করছিলো তখনই অদূরে ট্রাকে বসে অপেক্ষারত রহিম মিয়া আর ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে এসে দ্রুত চাপা দিয়ে চলে যায়।
মিমের মৃত্যু এবং মিতুর চলে যাওয়ার পর মারুফ অনেকটা ডিপ্রেশনে পড়ে যায়। নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে। নিয়মিত অফিসে আসছিল কয়েকদিন। এই সুযোগে একটা বড় প্রজেক্টের কিছু অর্থ হাতিয়ে নেয় রাব্বী। যেটা ধরা পড়ে যায় মারুফের কাছে। মারুফ সে অর্থ ফেরত দিতে তাকে তিনদিন সময় দেয়। এবং চাকরী ছেড়ে দিতে বলে। এরপর রাব্বী তার মুখোশ খুলে। রহিম মিয়াকে দিয়ে আগে রেকর্ডকৃত চারটা ভিডিও তার ফোনে পাঠায়। সবগুলোই মারুফের বিভিন্ন মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কের ভিডিও। ঘনিষ্ট মুহুর্তের ভিডিও। এসব ভিডিও ভাইরাল না হওয়ার জন্য রাব্বীর কথায় রহিম মিয়া এক কোটি টাকা চায়।
মারুফ সম্মত হয় বাধ্য হয়ে। কিন্তু এত টাকা দেয়ার অঙ্গিকার পর ও তারা আরো টাকা দাবী করে। বার বার ফোনে কল দিতে থাকে। একের পর একে রেকর্ডকৃত ভিডিও পাঠায়। মারুফ সাহেব নিজের ঘরে একা হয়ে যায়। ভয়ানক ডিপ্রেশন আর মান সম্মানের ভয়ে উনি এক রাতে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেন। রাব্বীর কাছে মারুফের বাসার ডুপ্লিকেট চাবী ছিলো। একদিন মারুফের খবর না পেয়ে রহিম মিয়া বাসায় গিয়ে দেখে মৃত মারুফ পড়ে আছেন। সে তখন মোবাইল সাথে করে নিয়ে চলে আসে। যা আমরা উদ্ধার করেছি তাকে গ্রেফতারের পর।
এতক্ষণ বলে থামলেন ওসি শহিদুল। টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে বললেন, আপনাদের কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে পারেন।
দু একটা প্রশ্ন করে অশ্রু মুছতে মুছতে যে যার মত চলে যায়। মিতু বের হয় সবার শেষে। অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাবা মা কে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে সে।
কীভাবে যে তিনদিন কেটে যায়। আজ মামুন সাহেবের বিয়ের রাত। কত সহজে মামুন নিজেকে বদলে ফেলে। অথচ মিতু পারে না। অনেকগুলো স্মৃতি, ভবিষ্যৎ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। রাত বারো বেজে দশ মিনিট। ক্লান্ত চোখে বিন্দু পরিমাণ তার ঘুম নেই। ছোটখাটো একটা দ্বিতল বাড়ি মিতুদের। দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে কয়েকটা নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশের আকাশ থেকে উঁকি মারছে এক ফালি চাঁদ। দোতলারা বারান্দায় রেলিং ধরে অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে মিতু। বাচ্চারা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সম্ভবত পুরো শহরের মানুষজন ঘুমাচ্ছে। শুধু তার চোখে ঘুম নেই। চাঁদ দেখতে দেখতে সে টের পায় বুকের শূণ্যতা ক্রমশ বাড়তে আছে। চোখ থেকে নরম গাল বেয়ে চিবুক হয়ে হয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রুকণা।
তার জীবন যে এভাবে বদলে যাবে। সে কল্পনা করতে পারেনি। অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় জমায় তার মনে। মানুষ কেন পরকিয়া করে? কিসের এত নেশা ওখানটায়? নাকি তার কোন ভালোবাসার কমতি ছিলো, যার জন্য মারুফ অন্যখানে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়েছিলো । নাকি মারুফরা এমনই হয়। উত্তরগুলো সে নিজেও জানে না।
(সমাপ্ত)