26/04/2024

শিশির বিন্দু পর্ব- ৪

“শিশির বিন্দু”
পর্ব- ৪
(নূর নাফিসা)
.
.
মোটামুটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কয়েক ঘন্টা পরেই তারা সিলেটের মৌলভীবাজার শহরে চলে এলো। এক বন্ধুর সাথে কথা বলে শিশির থাকার ব্যবস্থা আগেই ঠিক করে রেখেছিলো। সে বিন্দুকে নিয়ে সেখানেই উঠলো। রুমে এসে সময় নষ্ট না করে তারা ফ্রেশ হয়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। শিশির বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
– বিন্দু, কিছু খাবে?
– উহুম।
– ক্লান্ত লাগছে?
– নাহ।
– দৃষ্টি সুধায় হ্যাঁ, ওষ্ঠ সুধায় না! এ কোন মুহুর্ত বেগম , যে শিশিরকে ফেলছে দোটানায়!
– বেগমের অজানা!
শিশির শব্দ করে হেসে উঠল৷ আর বিন্দু তার হাসিতে লজ্জিত! তার লজ্জা বাড়িয়ে দিতে শিশির বললো,
– ক্লান্তি নাশ করে দিবো?
– ঘুমাবে না?
শিশির কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
– ঘুমাতে আসিনি তো, এসেছি মধুচন্দ্রিমায়। বাইরে কি দেখোনি তুমি, জ্বলজ্বল করছে প্রকৃতি রূপালী জ্যোছনায়!
সকালে শিশিরের সিলেটি বন্ধুর সাথে দেখা করলো তারা। অত:পর বেরিয়ে পড়লো ভ্রমণে! সারি সারি পাহাড়, পাহাড়ে পাহাড়ে উঁকি দিয়ে ধেয়ে চলেছে জলধারা, সবুজ অরণ্যে ছেয়ে আছে পথঘাট! এ-ই তো অপরূপ সৌন্দর্যে সজ্জিত প্রিয় বাংলা, এ-ই তো বাংলার লন্ডন! হাজারো কবি মনীষী মাতাল হয়েছে বাংলার প্রকৃতির ঘ্রাণে, মুগ্ধ হয়েছে তার রূপে। সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য বাংলার প্রকৃতিতে আজও বহমান, সেই মাতাল ঘ্রাণ আজও মিশে আছে বাংলায় প্রবাহিত বাতাসে । শিশিরবিন্দু, একে একে মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মাধবপুর লেক ঘুরেছে। দুইএকটা বই সাথে নিলেও পড়া হয়নি। কেননা এতো অল্প সময়ের জন্য প্রকৃতির সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে বিন্দু তাই পড়াশোনা একটু বন্ধ রেখে মুহূর্তটা আনন্দের সাথে উপভোগ করলো। শ্রীমঙ্গলে চাবাগানে ঘুরার সময় শিশিরের আবেদনে বিন্দু তাকে গান শুনিয়েছে,
আমারও পরানও যাহা চায়,তুমি তাই তুমি তাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে, মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়
তুমি সুখও যদি নাহি পাও, যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
তুমি সুখও যদি নাহি পাও, যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আরও কিছু নাহি চাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়
আমি তোমারও বিরহে রহিব বিলীনও, তোমাতে করিবও বাস
দীর্ঘ দিবসও, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষও মাস
যদি আরও-কারে ভালোবাস, যদি আরও ফিরে নাহি আসও
যদি আরও-কারে ভালোবাস, যদি আরও ফিরে নাহি আসও
তবে,তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও, আমি যত দুখও পাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো
আমারও পরানও যাহা চায়
তোমা ছাড়া আর এ জগতে, মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
আমার পরানও যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো
আমার পরানও যাহা চায় …..
পরদিন বিকেলে তারা ঢাকায় হাজির! শিশির বিন্দুর কাছে কাটায় কাটায় হিসেব দিলো ভ্রমণসহ ৪৩ ঘন্টা সময় নিয়েছে সে। বাড়িতে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেই শিশির তার হাতে আবার বই ধরিয়ে দিলো। নিষেধ করা সত্যেও বিন্দুর সেবাযত্ন করতে লেগে গেলো। তার ধারণা, জার্নি করার ফলে বিন্দুর মাথা ব্যাথা করছে আর মাথা ব্যাথা নিয়ে সে পড়ায় মনযোগী হতে পারবে না! তাই ওয়েনমেন্ট লাগিয়ে সে বসে বসে মাথা মেসাজ করে দিচ্ছে।
পরদিন বিন্দুর বাবা-মা এসেছে তাদের নেওয়ার জন্য। উভয়ই চলে গেলো তাদের বাসায় সঙ্গী তাদের বই। সেখানে একদিন কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছে।
শ্বশুরবাড়িতে থেকে বিন্দু পড়াশোনায় মনযোগী। শ্বাশুড়িও কোনো কাজ করতে দেয় না। সারাক্ষণ পড় পড় আর পড়! আর অবসর সময়ে স্বামী-স্ত্রীর প্রেম, একঘেয়েমি কাটাতে একটু আধটু বাইরে ঘুরাফেরা। প্রথম পরীক্ষার দিন শিশির নিয়ে যাচ্ছে রিকশা করে। বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
– শিশিরবিন্দু?
– হুম?
– নার্ভাস?
– উহুম।
– একটা পানিতেই কি হবে, কিছু কিনে দিব?
– না।
– মন খারাপ কেন তোমার?
– কোথায়!
– এমন নিরব হয়ে আছো যে!
– এমনি। আচ্ছা, ইতালিতে কি রিকশা চলে?
শিশির একটু অবাক হয়েই বললো,
– কেন?
– কখনো চলতি রিকশায় লাফিয়ে উঠবে না।
শিশির শব্দ করে হেসে উঠলো আর বরাবর ন্যায় তার হাসিতে লজ্জা পেয়ে বিন্দু ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
– হাসির কি আছে! এভাবে লাফিয়ে উঠলে এক্সিডেন্ট হতে পারে!
শিশির বিন্দুর পেছনে হাত রেখে বললো,
– আচ্ছা, আর হাসবো না। রিকশায়ও লাফিয়ে উঠবো না।
পরীক্ষা শেষে রিজুসহ তারা ফুচকার স্বাদ উপভোগ করে বাসায় ফিরলো। দ্বিতীয় পরীক্ষা আগামী সপ্তাহে। আগের দিন শিশির চলে যাবে,। ইতালি চলে যাওয়ার আগের দিন রাতে শিশিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে বিন্দু। শিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
– শিশিরবিন্দু, আমি চলে গেলে আমাকে মিস করবে না?
বিন্দু কোনো জবাব দিলো না। ভেতরটা কাপছে তার! মাত্র কয়েকটিদিনে এতোটা আপন ও এতোটা মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে, এখন তাকে ছাড়া থাকবে কিভাবে! আগে থেকেই জানতো চলে যাবে কিন্তু সময় ঘনিয়ে আসায় এখন মন মানছে না তার! শিশির তার উন্মুক্ত বুকে ভেজা অনুভব করতেই “শিশিরবিন্দু!” বলে চমকে উঠলো! সে মাথা তুলে বিন্দুকে বালিশে নামিয়ে দিতেই বিন্দু চোখ বন্ধ করে ফেললো! শিশির বললো তাকে চোখ খুলে তাকাতে কিন্তু সে তাকাচ্ছে না! দুচোখের কোনা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু! শিশির তার ওষ্ঠ দ্বারা তা শুষে নিতে নিতে বললো,
– এই, কি শুরু করেছো এসব! এমন করলে যাবো কিভাবে আমি! শিশিরবিন্দু, স্টপ! ওপেন ইওর আইস। যাস্ট, সি ইওর শিশির। আদারওয়াইজ নাথিং হেয়ার।
বিন্দু চোখ খুলে তাকালো তার দিকে। শিশির মৃদু হেসে বললো,
– তুমি যে কতটা চালাক হয়ে গেছো সেটা কি আমি বুঝিনা! একটু বেশি বেশি আদর পাওয়ার জন্য সব বাহানা তোমার! আমি যে ধরে ফেলেছি চালাকি, এবার তোমার কি হবে!
বিন্দুর লজ্জা আজ অশ্রুর আড়ালে লুকিয়ে গেছে। শিশিরের কথায় মুখে ফুটে উঠেছে হাসি আর চোখে অশ্রু। ঘুমানোর ইচ্ছে নেই তবুও শিশিরের ঘুম পাড়ানী স্পর্শে ঘুমাতে সে বাধ্য!
সকালে ঘুম ভাঙলে পাশে শিশিরকে পেলো না৷ চোখ খুলে এপাশ ওপাশ তাকালো শিশির নেই। অন্যদিনের মতো আদর করে ডেকে তোলেনি আজ! আগে উঠে বাইরে গেছে হয়তো। শিশির আজ চলে যাবে সেটা মনে হতেই বিন্দু তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো। তার কাপড়চোপড় গুছিয়ে দিতে হবে তো! সে বিছানাপত্র গুছিয়ে ওয়াশরুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালে চোখ পড়লো কলমের নিচে রাখা কাগজের উপর! বিন্দু কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো,
“সরি, শিশিরবিন্দু!
ঘুমের মধ্যেও কাদছিলে তুমি! তাই জাগানোর সাহস হয়নি আমার। সবুজ ঘাসের বুকে জমা শিশির সূর্যের দেখা পেলে হারিয়ে যায় কিন্তু আমাকে সূর্য উদয়ের আগেই বেরিয়ে আসতে হলো। বিকেল তিনটায় না, ভোর তিনটায় ফ্লাইট ছিলো আমার। আমার বিন্দু তো রাগ করতে জানে না। আমি চাইও না সেটা কখনো জানুক। অন্ধকার ফুরিয়ে এলে তো ভুবনে আলো ফুটবেই, আবার আলো নিভে অন্ধকার ঘনিয়ে এলে তো ঘাসে শিশির জমবেই! ঠিক তেমনই করে দেখবে তোমার শিশিরও তোমার সামনে হাজির হয়ে গেছে। আমি তোমার থেকে দূরে সরে যাইনি। দেখো, তোমার কণ্ঠহাড়ে ঝুলে আছি আমি। আমার দেহ বাসা থেকে একা বের হয়নি, তোমার অশ্রু প্রেম স্পর্শ ভালোবাসা সব নিয়ে এসেছে। এমনকি সকলের দৃষ্টির অগোচরে তোমাকে ছোট্ট করে আমার হৃদে যত্ন করে রেখে সাথে এনেছি। বিভোর ভাইয়া এয়ারপোর্ট থেকে বাবার সাথে বাসায় ফিরবে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এখন থেকে ভাইয়া নিয়ে যাবে কেন্দ্রে। পড়াশোনায় মনযোগ দিয়ো। যেকোনো কিছুর প্রয়োজন হলে মায়ের কাছে বলো। আমার অজান্তে একফোঁটা অশ্রুবিন্দুও যেন মাটিতে না লুটিয়ে পড়ে! তুমি সর্বদাই শিশিরবিন্দু। তাহলে অশ্রুবিন্দু কেন হতে যাবে! ভালো থেকো, নিজের ও আশেপাশের সবার যত্ন নিয়ো। ইনশাআল্লাহ গন্তব্যে পৌছে সবার আগে তোমার ফোনে কল করবো।
ইতি,
শিশিরবিন্দুর শিশির।”