# আরশিযুগল প্রেম .
# লেখনীতে — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
#পর্ব — ৪৩
পশ্চিমের জানালাটা খোলা। গাঢ় নীল আকাশে কয়েক খন্ড পেঁজা মেঘ চঞ্চলা কিশোরীর মত ছুঁটছে। ল্যাম্পপোস্টে এঁটে থাকা বিদ্যুতিক তারগুলোতে দুই একটা কাকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ ঝিম ধরে বসে আছে তো কেউ অস্থির ভঙ্গিতে স্থান পরিবর্তন করছে। জানালার ধবধবে সাদা পর্দাগুলো অলস ভঙ্গিতে উড়াউড়ি করছে। শুভ্রতার অস্থির দৃষ্টি পর্দা, কাক, আকাশ, বাতাস সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রিয় কিছু একটা খুঁজছে। সাদা দেয়ালে বাঁধানো বিশাল ওয়ালম্যাট, জায়নামাজ, তসবি সবকিছুতেই ছুটে চলেছে শুভ্রতার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। এই ঘরটাতে, এই বিছানাতেই চারদিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন দাদু।
হুট করেই হারিয়ে গিয়েছেন মৃত্যু নামক কালো গহ্বরে। শুভ্রতা কোমল হাতে বিছানায় হাত বুলাল। অনুভূতিশূন্য চোখে তাকিয়ে রইল জানালার কেঁপে ওঠা পর্দাগুলোর দিকে। আনিমুল সাহেবকে কিশোরগঞ্জের পারিবারিক কবরস্থানে, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রির পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে দোয়া-দরুদের পর্ব শেষ করে ঢাকার বাসাতেও কুলখানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুভ্রতার বড় চাচা, চাচি, চাচাতো ভাই দুটোও এসেছে আজ তিনদিন হলো। বাড়িতে এতো মানুষের সমাগম হলেও কোথায় যেন বিশদ এক শূন্যতা ঘায়েল করে চলেছে তাদের। চেষ্টা করেও কেউ হাসতে পারছে না। খেতে পারছে না।
চোখে-মুখের গভীর বিষাদ কিছুতেই মুছে ফেলা যাচ্ছে না। জীবদ্দশায় যে মানুষটাকে বড্ড অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর বলে মনে হয়েছে আজ তারজন্যই স্বাভাবিক জীবনটাতে কত শত ছন্দপতন। কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্রতা। আনিমুল সাহেবের ব্যবহারকৃত জায়নামাজে দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে রুম থেকে বের হতেই মুখোমুখি হল চরম এক বাস্তবতার। কিছুক্ষণ আগেই কুলখানির সকল কাজকর্মের সমাপ্তি ঘটেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বসার ঘরে বসেছে সবাই। চোখ-মুখে গম্ভীর্য টেনে নিয়ে আলোচনা করে চলেছে একের পর এক দূর্বোধ্য বিষয়। শুভ্রতা দরজা ঠেলে বসার ঘরে এসে পৌঁছাতেই বড় চাচার দূর্বোধ্য কথাটা কানে এলো,
—-” বাবা তাঁর মৃত্যুর আগে যে ওয়াদা করে গিয়েছেন সে অনুযায়ী শুভ্রতার বিয়েটা আজকালের মাঝেই দিয়ে দেওয়া উচিত ভাইজান। আল-কুরআনে বলা আছে,’ আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ [ সূরা বনী ইসরাঈল:৩৪] সে হিসেবে বাবার হয়ে ওয়াদাপূর্ণ করা ছেলে হিসেবে আমাদের পবিত্র কর্তব্য ভাইজান।”
শুভ্রতার বড় চাচা শহিদুজ্জামান সাহেবের কথায় কিছুক্ষণ মৌন হয়ে বসে রইলেন শাহিনুজ্জামান সাহেব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” বাবার ভালোর জন্য সর্বোত্তম কাজগুলো করব আমরা শহি। জীবদ্দশায় কম তো করেন নি আমাদের জন্য। আমাদের কথা ভেবে জীবনের অর্ধেক সময়টাই একা কাটিয়ে দিয়েছেন। আর আমরা শেষ বেলায় তার পাশেও থাকতে পারলাম না।”
কথাটুকু বলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন শাহিনুজ্জামান সাহেব। রাইসুর সাহেব এতক্ষণ নীরব দর্শক বনে থাকলেও এবার নড়েচড়ে উঠলেন। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
—-” আমি বলছিলাম কি দুলাভাই? ওবায়দুল্লাহ, ফারদিন দু’জনেই উপস্থিত আছে। তাছাড়া আপনার ভাইয়েরাও উপস্থিত আছেন। সবার উপস্থিতিতে একটা পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে ভালো হয় না?”
—-” হুম। ভালো প্রস্তাব। ওবায়দুল্লাহ সাহেব? আপনার কোনো আপত্তি আছে?”
ওবায়দুল্লাহ সাহেব এতোক্ষণ মৌন চিত্তে বসে ছিলেন। নিজের নাম কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালেন। শুকনো হেসে বললেন,
—-” না না। আমার কোনো আপত্তি নেই। বিয়ের কথাটা তো চাচা বেঁচে থাকতেই ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল। উনার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করা আমাদের দায়িত্ব। এখন তো অনুষ্ঠান করার মন-মানসিকতা কারোরই নেই। তাই বলছিলাম, একটা দিন তারিখ ঠিক করে ছেলে-মেয়ে দুটোর চারহাত এক করে দিলেই হয়। পরে নাহয় সময়-সুযোগ দেখে অনুষ্ঠান করা যাবে। আপনারা কি বলেন?”
শহিদুজ্জামান সাহেব মাথা দুলিয়ে বিজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালেন। গাঢ় গলায় বললেন,
—-” আমি আর তিন-চারদিন আছি। শুভ্রতার কাবিনটা চারদিনের মাথায় শুক্রবার বাদ মাগরিবে হলে কেমন হয়? কাবিনই যেহেতু হবে দেরি করে লাভ কি?”
বাকি কথাগুলো শুভ্রতার কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। মাথাটা ভন ভন করতে লাগল তার। বড়দের কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলিজাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। শুভ্রতা আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি করে উঠতে পারল না। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তেই কয়েক জোড়া হাত আগলে নিলে তাকে। চোখ মেলে বান্ধবীদের মুখগুলো দেখেই বড় বড় চোখদুটোতে বর্ষা নামল।
শুভ্রতার শোবার ঘরে ছন্নছাড়া হয়ে বসে আছে ওরা চারজন। অর্পন চেয়ারের হাতলে হাত রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। প্রেমা শুভ্রতার পাশে বিষণ্ণ চিত্তে কিছু একটা ভাবছে। পুষ্পি কপালে ভাঁজ ফেলে সারা ঘরময় পায়চারি করছে। বেশ কিছুক্ষণ ভিত্তিহীন বসে থেকে ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল অর্পন। শক্ত গলায় বলল,
—-” আই সয়ার। তোর বাবা-মা যদি তনুর বাবা-মার মতো কান্ড শুরু করে না? আমি সত্যি সত্যি গুন্ডা ভাড়া করে তুলে নিয়ে যাব তাদের। ফাজলামো পাইছে নাকি সবাই?”
পুষ্পি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,
—-” তনুকে রক্ষা করতে পারি নি বলে যে শুভিকে পারব না তা তো নয়। হাতে আরো চার চারটা দিন সময় আছে। দরকার হলে পাত্রকেই খুন করে ফেলব আমি। ব্যাটা অসভ্য! দুনিয়াতে আর কোনো মেয়ে খুঁজে পায় নি নাকি? সব ব্যাটাদের কি শুধু আমাদের বান্ধবীদেরই চোখে পড়ে?অসহ্য!”
প্রেমা উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
—-” আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আগে সাদাফ ভাইয়াকে জানানো উচিত। উনিও কি শুভ্রব ভাইয়ের মত ছেড়ে দেবেন? শুভি? তুই বরং ভাইয়াকে জানা ব্যাপারটা। পরে দেরি না হয়ে যায়।”
পুষ্পি-অর্পণও প্রেমার কথায় সম্মতি জানাল। শুভি অসহায় চোখ মেলে তাকাল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
—-” ও যদি রেগে যায়? আমি কিভাবে বলব কথাটা?”
অর্পণ বিরক্ত হয়ে বলল,
—-” ঢং করিস না তো। বলতে যেটা হবেই সেটা ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি? ভাইয়া কিছু না কিছু ঠিক করবে। ফোন তো দে..”
শুভ্রতাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে। শুভ্রতার ফোন নিয়ে সাদাফের নাম্বারটা ডায়াল করে শুভ্রতার হাতে ধরিয়ে দিল প্রেমা। শুভ্রতার হাত দুটো অল্প কাঁপতে লাগল। অযথায় বুকে হাতুড়ি পেটাতে লাগল। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করল সাদাফ। বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই নিশ্চুপ বসে রইল। শুভ্রতা কাঁপা গলায় বলল,
—-” হ্যালো?”
সাদাফ শান্ত গলায় বলল,
—-” হুম। বলো।”
বিয়ের কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল শুভ্রতা। কথাগুলো যেন শুভ্রতার গলায় এসে আটকে গেল। সেগুলোকে গলা থেকে মুখ পর্যন্ত আনতে বেশ বেগ পেতে হল। সাহস নিয়ে বলল,
—-” আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে…. ”
এটুকু বলে আবারও থেমে গেল শুভ্রতা। বলার মত কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। কান্নাগুলো ধলা পাকিয়ে কন্ঠনালি অবরোধ করে চলেছে। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল সাদাফ,
—-” আমি জানি।”
সাদাফের কথায় চমকে উঠল শুভ্রতা। বিস্ময় নিয়ে বলল,
—-” জানো? কিন্তু কিভাবে?”
—-” আরাফ ফোন করে বলেছে কিছুক্ষণ আগে।”
শুভ্রতা অসহায় গলায় বলল,
—-” এখন কি করব আমি? এমন কিছু হলে মরে যাব আমি। তনুর মত কোনো পরিণতি চাই না আমি, প্লিজ। কিছু একটা করো তুমি, প্লিজ, প্লিজ।”
সাদাফ নরম গলায় বলল,
—-” আমি তো আছি শুভ্রা। শুভ্রবের মত অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নই। প্রয়োজনে নিজের জিনিসটা ছিনিয়ে নিতেও জানি আমি। আর তুমি তো কোনো জিনিস নও… তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমার শরীরের অর্ধেকটা কেউ নিয়ে নিবে আর আমি চুপ করে বসে থাকব? এতোটা ভালোও নিশ্চয়ই নই আমি। তুমি আমাকে না চাইলেও আমি তোমাকে চাইই চাই। আর আমার ভাগের সুখটুকু পাওয়ার জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নিষ্ঠুর হতেও রাজি আমি। তবে, কিছু করার আগে সম্ভাব্য প্রচেষ্টাগুলো তো করায় যায়, তাই না?”
—-” কি করবে?”
—-” আমি করব না, তুমি করবে।”
শুভ্রতা চোখ কপালে তুলে বলল,
—-” আমি?”
সাদাফ শান্ত গলায় বলল,
—-” হ্যাঁ, তুমি। তোমার বাবা-মাকে গিয়ে নিজের পছন্দের কথাটা বলবে তুমি। তারা নিশ্চয় তোমার মতামতটা ফেলে দেবেন না। তারা কি বলে শুনো আগে। তারপর নাহয় অন্য কিছু ভেবে দেখা যাবে।”
শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে মৃদু গলায় বলল,
—-” আমি আমার শুভ্রাণীকে চাই শুভ্রা। এই শুভ্রাণীকে ছাড়া আমার চলবে না। আমার আমানতটা আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও বাবা-মার মুখোমুখি হতে হবে তোমায়। প্লিজ!”
শুভ্রতা কিছু বলল না। ফোনটা কেটে দিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইল। অর্পন চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে শুভ্রতার মুখোমুখি বসল। কৌতূহলী গলায় বলল,
—-” কি বলল সাদাফ ভাইয়া?”
—-” বাবা-মার সাথে কথা বলতে বলেছে।”
অর্পন কপাল কুঁচকে বলল,
—-” আজাইরা কথা-বার্তা! আংকেল- আন্টিকে বলে দিলে উনারা আরও সচেতন হয়ে যাবেন না?দেখা যাবে শুভ্রতাকে ঘরে আটকে দিল বা আরো তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল?”
পুষ্পি খানিকক্ষণ ভেবে বলল,
—-” উহু। উনারা শুভির বাবা-মা, শত্রু নয়। সাদাফ ভাই না ভেবে কোনো কথা বলেন নি। আংকেল-আন্টি তো শুভ্রতার পছন্দ সম্পর্কে জানেই না। এমনও তো হতে পারে কথাটা শুনার পর মেয়ের সুখের জন্য মত পাল্টে ফেললেন।”
অর্পণ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
—-” এগুলো বাপ-মা কম জল্লাদ বেশি কখনই মত বদলাবে না।”
—-” আমারও মনে হচ্ছে আংকেল আন্টিকে বলা উচিত। উত্তর পজিটিভ-নেগেটিভ যায় হোক এটলিস্ট পরিস্থিতিটা তো উপলব্ধি করা যাবে।”
বান্ধবীদের কথাবার্তার মাঝে ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল শুভ্রতা। এমন একটা পরিস্থিতিতে বাবা-মার সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার কথা বলাটা কি স্বার্থপরের মত দেখায় না? হয়ত দেখায়। আসলে, ভালোবাসার সাথে স্বার্থপর শব্দটা ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। এই পৃথিবীতে ভালোবাসার জন্য যারা স্বার্থপর হতে পারে, বিবেকহী, নিহৃদয় হতে পারে তাদের ভালোবাসাটাই অন্ধকার আকাশে তাড়কা রাশির মত জ্বলজ্বল করে। ভালোবাসায় মহান হতে নেই। ভালোবাসায় যারা মহত্ত্ব দেখিয়েছে তারাই হৃদয়ের দহনে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়েছে। কিন্তু শুভ্রতা জ্বলতে চায় না। পুড়ে ভস্ম হয়ে চিরতরে বিলীন হতে চায় না। কিছুতেই না।
________________
ঘড়িতে এগারোটা বাজে। রাদিবা আহমেদ টেবিল গুছাচ্ছেন। একটু আগেই রাতের খাবার শেষ করে যার যার ঘরে গিয়েছে সবাই। শুভ্রতা চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বান্ধবীরা চলে যাওয়ার পর সারাদিনের প্রচেষ্টাতেও মা-বাবাকে সাদাফের কথাটা বলতে পারে নি শুভ্রতা। বারবারই হাজার খানেক অস্বস্তি এসে ঝাপটে ধরেছে তাকে। অর্পণ, পুষ্পি বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে বকাঝকাও করেছে। শুভ্রতা চেয়ারের কোণায় নখ খুঁটতে খুঁটতে সাহস যোগাতে লাগল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে হঠাৎই বলে উঠল,
—-” আমি একজনকে পছন্দ করি মা।”
#চলবে…..