ফ্রিজ পর্ব ৬
জানালার কাচঁ দিয়ে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখলাম। কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছি? আমার মনে পড়ল এই ছেলে তো আব্বাস! সেদিন আমাদের বাড়িতে উপহার নিয়ে এসেছিল।
আমার কেমন সন্দেহ হতে লাগল। তাহলে আমাদের ট্রেনের টিকিট কি লিটন মামাকে দিয়েছে! এমনটা হলে লিটন জানে আমরা কোন কামরায় আছি। লিটন কি এই ট্রেনে আছে? কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে! খবরটা আপাকে কি বলব? না থাক কি দরকার আপার চিন্তা বাড়ানোর। মামাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। আপার সামনে জিজ্ঞেস করা যাবে না।
আপাকে দারুণ খুশি লাগছে! এখন আপাকে আর বেশি সুন্দর লাগছে! আপাটা কেন যে এত সুন্দর হলো! এত সুন্দর না হলে এত সব বিপদ হতো না। কালো মেয়েদের নিয়ে এত ঝামেলা হয় না। ওদের ঝামেলা শুধু একটাই বিয়ে দেয়া যায় না।
আপা বলল, “রুনু বাইরে যাবি।”
আমি মাথা দুলিয়ে না বললাম। আমার মামার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ব্যাপারটা জানা দরকার।
আপা দরজা খুলে বাইরে গেল।
আমি জানালার পাশ থেকে মামার পাশে এসে বসলাম।
“কী রে মা কেমন লাগছে? “
“ভালোই লাগছে মামা।”
আমি মামার গা ঘেঁষে বসলাম। মামা আমাকে কাছে টেনে নিল। “মামা তুমি এমন একটা কামরা জোগাড় করলা কেমনে বলো তো?”
“আর বলিস না রে মা। সব আল্লাহর ইচ্ছে। না হলে এমনটা পাওয়া যায় না।”
“কী ঘটেছিলো বলো তো মামা?”
তোদের বসিয়ে রেখে গেলাম টিকেট কাটতে। প্রথমে কাউন্টারে গেলাম সেখানে কোনো সীট নেই। স্টেশনে সবসময় এক ধরনের দালাল থাকে এদের কাছে টিকিট পাওয়া যায়। আজ কোথাও টিকিট পাচ্ছিলাম না। দুয়েকটা দালালের কাছে একটা করে টিকিট আছে। এক বগিতে তিনটা টিকিট মিলছিল না! অনেকটা হতাশ হয়ে যখন ফিরে আসব ভাবছি আচমকা একটা ছেলে এসে বলল, “রাজশাহী যাবেন?”
“হ্যাঁ”
“আমার কাছে টিকিট আছে। আসলে আমার এক আত্মীয় যাওয়ার কথাছিল। ঘন্টাখানিক আগে বলল যাবে না। ভাবলাম টিকিটটা কাউ কে দিয়ে আসি। আপনি নিন।”
“কত দিতে হবে?”
“বুঝতে পারছি টাকা না নিলে আপনার খারাপ লাগবে আপানার যা ইচ্ছে দিন এমনিতে এ টিকিটের দাম কিছু সময় পর শুন্য হবে।”
“আমি লোকটা একহাজার টাকা দিলাম। এত টাকা নিতে চাচ্ছিল না! “
আমি বুঝতে পারছি এ সব লিটনের কাজ। আব্বাস কে দিয়ে টিকিট পাঠিয়েছে। আব্বাস বুঝতে পারছে টাকা না নিলে মামা টিকিট নিবে না তাই মামার কাজ থেকে টাকা নিয়েছে। নাকি এসব কিছুই হয়নি। আব্বাস হয়ত অন্য কারো সাথে স্টেশনে এসেছে। মামা কে সত্যি অন্য কেউ টিকিট দিয়েছে। এমন মানুষ আজকাল হয়? তবুও আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে!
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম আপা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচের ভিতর দিয়ে শহরটা দেখা যাচ্ছে। আপা ডাকল, “এই রেনু এ দিকে আয়।”
আমি আপার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। জায়গাটা খুব বেশি বড়ো না। অনেকটা চিপা রাস্তা। এসি বাথের যাত্রীদের চলাচলের জন্য। এখানে মনে হয় কোনো হকার টকার আসে না।
“আপা চলো ভিতরে গিয়ে বসি।”
“আরেকটু দাঁড়াই, দ্যাখ শহরটা দেখতে কী সুন্দর লাগছে এখন।”
আমি আপার সাথে কাঁচের মধ্যে দিয়ে শহরটা দেখছি। ট্রেনটা এখন বনানী এলাকা অতিক্রম করছে। বিমানবন্দর স্টেশন ধরবে। এখান থেকে অনেক যাত্রী উঠবে। আপা বলল, “চল ভিতরে যাই।”
“কী রে তোরা কোথায়ছিলি?”
“বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম মামা।”
নিচের সোফাসেটটাতে আমরা বসলাম। দরজায় টুকা পড়ল। আমার কেমন ভয় লাগছে! কেন লাগছে জানি না? মামা দরজা খুলল, “স্যার চিপস লাগবে?”
” দুইটা চিপস দাও না তিনটাই দাও।”
আপা বলল,” মামা তুমি এ সব কি কিনেছ বলো তো? আমরা কি এখনো ছোটো বাচ্চা যে বসে বসে চিপস খাবো।”
“মামা একটু হেসে বলল, তোরা অনেক বড়ো হয়ে গেছিস বুঝি? “
আমি চিপসের প্যাকেটটা নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। ঝাপসা দেখা যাচ্ছে বাইরে। ছুটন্ত ট্রেন থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগছে! এখন মনে হয় ট্রেনটা গাজীপুরে আছে। দোকানের সাইনবোর্ডে গাজীপুর লেখা দেখলাম।
ট্রেনের সাদা সাদা চিপস খেতে বেশ ভালো লাগছে! আপাও জানালার পাশে এসে বসেছে।
আমি আর আপা উপরের সীটে উঠেছি। কেমন ভয় ভয় লাগছে! মনে হয় সীটটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। এখানে মানুষ কী করে ঘুমায় কে জানে? আমার তো শুতেই ভয় লাগছে!
এখান থেকে বাইরের দৃশ্য ভালো দেখা যায় না। মামা বলল, “তোরা রাতে কী খাবি?”
আপা বলল, “মামা তুমি এত চিন্তা করো না তো। একটা রাত না খেলে কী হবে?”
“শোন মেয়ের কথা। না খেয়ে কেন থাকবি রে মা! রাতে না খেয়ে থাকতে হয় না। ট্রেনে বেশ মজার খাবার পাওয়া যায়।”
ট্রেনের খাবার খেতে সত্যি ভালো লাগছে! মুরগী আর স্যান্ডউচ খেলাম আমরা। সাথে গরম গরম কফি।
মামা উপরের সীটে উঠে গেল আমরা নীচের সীটে ঘুমালাম।
এখন অবশ্য আমার ভয়টা কেটেছে। মনে হয় না লিটন ট্রেনে এসেছে।
ভোরে আমাদের ট্রেন রাজশাহী স্টেশনে এসে থামল। মামা আমাদের ঘুম থেকে তুললেন। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
স্টেশন থেকে মামা বাড়ি খুব একটা দূরে না। আগে শহরে অটোরিকশা ছিল না। এখন অটোরিকশা ভরে গেছে শহর। স্টেশন থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম আব্বাস কে! দূর থেকে ঠিক আব্বাসের মতোই মনে হলো। আমি ভুল দেখলাম কি-না জানি না। মনের মধ্যে কেমন কেমন করতে লাগল!
ইচ্ছে করছে আপাকে বলি। আবার বলতেও ইচ্ছে করছে না। মনে হয় আমি ভুলই দেখেছি। আব্বাস ছেলেটা কেন এখানে আসবে?
অটোরিকশা চড়ে বসলাম। আমি চারিদিকে খুঁজে দেখছি ওই ছেলেটা কে দেখা যায় কি না? না কোথায় দেখতে পাচ্ছি না।
দূর থেকে মামা বাড়ির গাছটা দেখা যাচ্ছে। আমার যে কী ভালো লাগছে! সব কিছু কেমন আপন মনে হচ্ছে। রাস্তাঘাট অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিছু কিছু বাড়িঘর মনে হয় আগের মতোই আছে। কত ছোটো ছোটো স্মৃতি মনে আসছে।
মামা বাড়ির সামনে এসে কী যে ভালো লাগছে! একটু খারাপও লাগছে নানির জন্য। আগেরবার নানি ছিলো। গতবার যাওয়ার সময় বাড়ির সামনের এই রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো! আজ নানি নাই! কোথায় যে সবাই হারিয়ে যায়!
বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম মামি ছুটে আসল। কী সুন্দর একট হাসি দিয়ে বলল, “কী রে কেমন আছিস তোরা?”
আপা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “ভালো। তুমি কেমন আছ?”
“খুব ভালো আছি রে। আয় ভিতরে আয়।”
মামাতো ভাইটা এখনো ঘুমিয়ে আছে নানির খাটে। এটা বোধহয় এখন ওর খাট। দেয়াল ঘেরা একটা টিনসেড বাড়ি মামার। মোট চারটা ঘর। সামনে একটা সিঁড়ি আছে এখানে বসা যায়। এটা মূলত বসার জন্যই করা হয়েছে।
মামি বলল,” তোরা হাতমুখ ধুয়ে আয় আমি নাস্তা দিচ্ছি। “
মামা বলল,” একবারে গোসল করে ফেলল তো মা। লম্বা জার্নি করেছিস গোসল করলে শরীরটা হালকা হয়ে যাবে।”
আমাদের কথায় মামাতো সামিনের ঘুম ভেঙে গেছে। মামি বলল, “দ্যাখ কারা এসেছে। “
ঘুমঘুম চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
আমি কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “কী রে কেমন আছিস? “
উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। “তুমি কেমন আছ আপু?”
“ভালো।”
আমাদের দেখে পাশের বাড়ির একজন মহিলা আসল। মনে হয় মামার দূর সম্পর্কের বোন হবে। মামি কে বলল, “নুর জানের মেয়ে না?”
“হ্যাঁ আপা।”
“কত বড়ো হয়ে গেছে! তোর নাম কি রে?”
আপা বলল,” আমি মিলি আর ও রুনু।”
“মাশাল্লাহ দেখতে কী সুন্দর হয়েছে!”
আপা একটু হাসল।
“খুব ভালো হয়েছে আইছোস। কতদিন তোদের দেখি না। তা তোর মা আইল না ক্যান?”
আমরা সামিনের সাথে বের হয়েছি গ্রাম দেখতে। আপা গোসল করে মাটি রংয়ের একটা থ্রি পিস পরেছে। গোসল করায় আপাকে এখন কী যে সুন্দর লাগছে!
সামিন এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে। পড়াশোনায় ও খুব ভালো। কথা বলে সুন্দর করে। এই ছেলে এত সুন্দর করে কথা বলা কোথায় শিখল কে জানে?
আমরা এখন আছি ওদের আম বাগানে। আম বাগানটা বেশ বড়ো। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন এত বড়ো ছিল না।
এ বছর আম বিক্রি করে মামা ভালো টাকাই আয় করেছে।
সামিন বলল,” আপা তোমরা আমের সিজনে আসলে কত মজা হতো। জানো আমাদের বাগানের আম খুব মিষ্টি হয়।”
আম বাগানে বসতে বেশ ভালো লাগছে! একটা শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগছে। সামিন ওর স্কুলের গল্প করছে। কোন স্যার কেমন? সবাই ওকে নাকি খুব আদর করে।
আম বাগানে অনেকটা সময় বসে রইলাম। সামিন বলল,” আপা চলো বাড়ি যাই।”
বাড়িতে আসার সময় একটা ছেলেকে দেখলাম বাইক চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখে বাইক থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আপার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আমার খুব খারাপ লাগল! গ্রামের ছেলেগুলো এমন খারাপ হলো কবে?
আমি সামিন কে জিজ্ঞেস করলাম,” কে রে ওটা?”
“আমাদের চেয়ারম্যান চাচার ছেলে। চলো তো বাড়ি যাই এই ছেলেটা খুব বাজে!”
আমরা দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ