রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২৮
#লেখিকা — নৌশিন আহমেদ রোদেলা
_________________
চারদিকে বন্যার হাঁকডাক পড়তেই বন্যা দেখতে ছুঁটে গেলাম আম্মুর নানু বাড়ি। সেই হিসেবে আমার আর শুভ্র ভাইয়ের দু’জনেরই নানু বাড়ি। আম্মুর নানু বাড়ি ময়মনসিংহ থেকে বেশ খানিকটা দূরে ব্রহ্মপুত্র নদের ধারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। নদীর বদৌলতে সেই গ্রামে বন্যার পানি যেন ফুলে ফেঁপে ওঠে ডুবিয়ে দিতে চাইছে ঘর-বাড়িসহ সব। শহরবাসী মানুষ হিসেবে নৌকার প্রতি সহজাত এক টান আছে আমার। সেই টানে মত্ত হয়েই লাফালাফি করে চলেছিলাম পুরোটা পথ।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে নৌকা পথে পাড়ি জমালাম আমরা। প্রায় একঘন্টা পথ নৌকা যুগে যেতে হয়েছিলো আমাদের। নৌকা দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেও বসতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো আমার। নৌকার ভেজা পাটাতনে পা ছড়িয়ে বসা মানেই জামা নষ্ট, এখন উপায়? আম্মু পাশে থাকলে আম্মুর আঁচল ধরে কিছুক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে এই অযাচিত সমস্যার কিছু একটা সমাধান পাওয়া যেত কিন্তু সেই উপায়টাও নেই।
মামু,মামানি, ছোট ফুপি, ফুপা,জারিফ,আদিবা, আব্বু, আম্মু, ভাইয়া, আপুসহ সবাই এসেছি ঘুরতে। মানুষের ঘনত্ব অনুযায়ী ভাড়া করা হয়েছে দুই নৌকা। তার মধ্যে থেকে অপেক্ষাকৃত বড় নৌকাটাই ওঠেছে মা-বাবাসহ বড়রা। আর ছোট নৌকায় ভাই-বোন মিলে আমরা ক’জন। আমার এই দূরাবস্তা দেখেই হয়তো মাঝিকে উদ্দেশ্য করে হাঁক ছাঁড়লেন শুভ্র ভাই,
—” চাচা? নৌকার ডালিতে বসলে কি সমস্যা হবে?নয়তো বসার উপায় নেই।”
মাঝবয়স্ক মাঝি শুভ্র ভাইয়ের “ডালি” শব্দের অর্থটা বুঝতে না পারলেও তার ইশারা করা হাতের দিকে তাকিয়ে আঁচ করে নিলেন। বাঁশের লম্বা লগি ঠেলে দিয়ে বললেন,
—” না, চাচা। নৌকার নালে বসলে নৌকা ঠিক থাকবো না। ছোডু নৌকা তো…তারমধ্যে মানুষ বেশি। আপনারা তাড়াতাড়ি বইয়া পড়েন। তাড়াতাড়ি যাওয়ন লাগবো।”
বলতে বলতেই নৌকা ঠেলে নামিয়ে দিলেন স্রোতে। হঠাৎ ধাক্কাটা সামলে উঠতে না পেরে পড়ে যেতে নিলেই একহাতে ধরে ফেললেন শুভ্র ভাই। পায়ের জুতো জুড়ো খুলে মৃদু গলায় বললেন,
—“জুতোর ওপর বসে পড়।”
সাথে সাথেই পাশ থেকে একরকম হুংকার দিয়ে বলে উঠলো ভাইয়া,
—” আরে চাচা? বসার আগেই নৌকা ছুটাচ্ছেন কেন? এখনই তো পড়ে যেত। এতো কিসের তাড়াহুড়ো? আমরা কি ভাড়া দিবো না আপনাকে?”
মাঝি ক্ষিপ্র হাতে লগি ঠেলতে ঠেলতে বললো,
—” ভাড়ার কথা না চাচামিয়া। আন্নেরা ভাড়া না দিলেও নিয়া যাইতাম। এই আপদের দিনে ভাড়ার কথা ভাবলে চলবো? যে জায়গাটা এহন পাড় হইতাছি এইডা হইলো মাটির রাস্তা। অটো, ভ্যান সবই চলতো কিন্তু এই বন্যার লাগি নৌকা ছাড়া কিছু চলে না। এই পুরা গেরামে আমরা মাত্র তিনজন নৌকা চালাই। এই তিনডা নৌকা দিয়াই আপদ-বিপদে এনে ওনে যায় সবাই। আপনা গো দিয়া আইতে আইতেই দেখুম কতো মানুষ নৌকার লাইগা খাড়ায় আছে। হের লাইগাই এতো তাড়াহুড়া।”
ভাইয়া আর কিছু বললো না। আমিও আড়চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম উনার খুলে রাখা জুতোর উপর। আমার পাশে বসেছে আপু আর আমাদের মুখোমুখি বসেছে আর শুভ্রভাই আর ভাইয়া। মাঝ বরাবর জারিফ আর আদিবা। দু’জনেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে সিটিয়ে আছে আমার গায়ে। ওদের এই ছোট্ট জীবনে এটাই প্রথম নৌকাভ্রমণ। আদিবা আর জারিফ থেকে কিছুটা দূরে মাঝির কাছাকাছি পাটাতনে পা গুটিয়ে বসে আছেন একজন বোরকা পরহিতা মহিলা আর একজন বৃদ্ধগোছের লোক। লোকটির টাকপড়া মাথার বাঁধবাকি চুলগুলো ধবধবে সাদা। কালো কুচকুচে শরীরের চামড়াগুলো কুঁচকে গিয়েছে প্রায়।
আধ ময়লা লুঙ্গিটাও উঠে আছে হাঁটু অব্দি। দাঁতগুলো জর্দা আর পান খেয়ে কালচিটে রূপ নিয়েছে সেই অনেক বছর। লোকটির পাশে বড়সড় বেতের খাঁচা। চোখদুটোতে উদাসভাব নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন উনি। কিছুটা পথ যেতেই চোখে পড়লো আধ ডোবা পুঁইশাকের ক্ষেত । পানির নিচ থেকে প্রাণপণে মাথা উঁচু করে রেখেছে কিছু সবুজ লতা। সেই ক্ষেতকে উদ্দেশ্য করেই বলে উঠলেন সেই বৃদ্ধ,
—” বুঝলা মোফাজ্জল? এই পুঁইশাকের টালে না হইলেও পঞ্চাশটার নাহাল সাপ পাওন যাইবো।”
বৃদ্ধর কথার জবাবে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন মাঝি। হাতের পেশী ফুলিয়ে লগি ঠেলতে ঠেলতে বললেন,
—” হ, মজিবর চাচা। সাপ গুলান তো এহন খালি প্রাণ বাঁচাইতাছে। কয়দিন পর যখন পানি ঘাটবো তখন দেখবান সাপ কারে কয়। এইবারের মাইচ্চা সাপগুলানেরও বিষ আছে চাচা। মতিনের পোলা ফজল আছে না? ওইটাও তো সাপের কামড়ে মইরা গেলো। সবাই কইতাছে মাইচ্চা সাপই নাহি কামড়াইছে।”
মাঝির কথা শুনে কৌতূহলী গলায় বলে উঠলো আদিবা,
—” রোদাপি? মইরা গিয়ে কি মারা যায়?”
শুভ্র ভাই পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। আদিবার কথা কানে যেতেই আদিবার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। সন্দিহান চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আদিবার মাথায় চাটি মেরে মজার ছলে বললেন,
—” না। মারা গিয়ে মইরা যায়।”
আদিবা ব্যাপারটা না বুঝে চোখ পিটপিট করে তাকালো। জারিফ পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে বললো,
—” তুই কি গাধী আদিবুড়ি। মারা আর মইরা একই কথা। ওরা “মারা” উচ্চারণ করতে পারে না বলে “মইরা” বলে।”
ওদের দু’জনের কথা শুনে মুচকি হেসে পানির দিকে চোখ রাখলাম আমি। চারপাশে অথৈ পানি তার মাঝে দু’একটা বাড়ি আর গাছ যেন দ্বীপের মতো মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের গর্ব প্রকাশ করতে ব্যস্ত। পানির ঢেউগুলোও যেন অদ্ভুত এক নিয়মে বন্ধী। সেই নিয়মের তালে তালেই মাতালের মতো হেলেদুলে খেলে উঠছে তারা। তাদের কোনো তাড়া নেই না আছে কোনো ব্যস্ততা। এই সুন্দর, স্নিগ্ধ ঢেউগুলো ছুঁয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে বামহাতটা নৌকার বাইরে হেলিয়ে দিতেই বাঁধ সাধলেন শুভ্র ভাই। বললেন,
—” ছি! এই পানি ছুবি তুই?গ্রামের বেশিরভাগ টয়লেটগুলোই ডুবে গেছে রোদ। আর তা মিক্সড হয়েছে এই বন্যার পানিতে। আমার তো ভাবতেই ঘৃণায় বমি আসছে। আর তুই কিনা এই পানিতে হাবুডুবু খাওয়ার চিন্তা করছিস?ছিঃ”
উনার কথার যুক্তিসংগততা বুঝতে পেরে নিজের মনকে সংযত করে নিলাম আমি। হাত গুটিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম হাজারো ঢেউয়ের মেলা। প্রায় একঘন্টার মাথায় নৌকা এসে থামলো নানুবাড়ির উঠোনের কিনারায়। উঠোনের পাশের বাঁশঝাড়গুলো নুইয়ে এসে ছায়াময় করে তুলেছে চারপাশ। গোলা পানিতে বাঁশ পাতার ছায়া আর লগি টানার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মুগ্ধ হয়েই নৌকা থেকে নামলাম আমরা।
________________
নানু বাড়িতে পৌঁছানোর পর পরই শুরু হলো দুনিয়া অন্ধকার করা বৃষ্টি। শহরে থাকতে থাকতে সবার মধ্যে যে আলসেমি ভাব তৈরি হয়েছিলো তা যেন মুহূর্তেই দৌঁড়ে পালালো। নানু বাড়িতে থাকা কাজিনরাসহ আমরাও নেমে এলাম উঠোনে। উঠোনের শেষ ভাগে একটা মস্ত কদম গাছ। কদম গাছটা যেন হলুদ-সাদা চাঁদরে ছেয়ে আছে। বৃষ্টির পানিগুলো সেই হলুদে গা ভাসিয়ে বেয়ে পড়ছে আমাদের চোখে-মুখে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গে। কদম গাছের গোড়ায় বাঁধা ছোট্ট ডিঙি। সেই ডিঙিতেই হৈ-হুল্লুড় করে ওঠে বসলো সবাই। উদ্দেশ্য পরিষ্কার বন্যার পানিতে গোসল করা। কয়েকজন ওঠার পর আমি উঠতে গেলেই বাঁধ সাধলেন শুভ্র ভাই। গম্ভীর গলায় বললেন,
—” তোকে নেওয়া হবে না। ঘরে গিয়ে গোসল কর। যা.. “
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
—” কেন? আমাকে নেওয়া হবে না কেন?”
—” সেটা তোকে বলতে হবে? নিবো না মানে নিবো না। সর..ভাগ। ”
আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,
—” বললেই হলো? আমি যাবো মানে যাবো।ব্যস!”
নৌকার গলুইয়ের কাছে লগি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো রনি। আমি ওকে ধমকে উঠতেই আমাকে উঠার জন্য জায়গা ছেড়ে দিলো রনি। সাথে সাথেই পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে হাঁক ছাড়লেন শুভ্র ভাই,
—” রনি!”
রনির নামটা উচ্চারিত হতেই অসহায় মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকালো রনি। শুভ্র ভাই আমাকে পাশ কাটিয়ে লাফিয়ে নৌকায় উঠতেই নৌকা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো রনি,
—” তোমাকে পড়ে ঘুরতে নিয়ে যাবো রোদাপু। তুমি মন খারাপ করো না। এখন নিলে শুভ্র ভাই মারবে তো মারবে নৌকাই উল্টিয়ে দিবে।”
শুভ্র ভাই রনির হাত থেকে লগিটা ছিনিয়ে নিয়ে নৌকা চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুটা দূরে গিয়েই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
—” চার ইঞ্চি মানুষদের পানিতে ডুবে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। আগে বড় হ তারপর পানিতে নামিস।”
উনাদের নৌকাটা বাঁশঝাড়ের আবছায়ায় হারিয়ে যেতেই চোখদুটো ঘোলা হয়ে এলো আমার। উনার বলা প্রতিটি কথা তীক্ষ্ণ অপমানের মতো বিঁধলো আমার মনে। রাগ, অভিমান,লজ্জা, অপমান সবকিছুই যেন আত্মপ্রকাশ করলো গাল বেয়ে পড়া সাদা জলে।
সেই নুনতা জলগুলোও গালে নেমেই হারিয়ে যাচ্ছিলো একঝাঁক আষাঢ়ে বৃষ্টির অন্তরালে। লাল চোখ আর কম্পনরত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম আমি। ড্রেসটা কোনরকম চেঞ্জ করেই নিরিবিলি জায়গা দেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম অনেকক্ষন। ভেজাচুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে থাকায় ভিজে চুপচুপে হলো বিছানা । সেই সাথে চুপচুপে হলো আমার দুই গাল। রাগ,অভিমান আর এক শ্রাবণ চোখের জল নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
দুপুরে খাওয়া হলো না। খাওয়া হলো না রাতেও। পুরাতন জায়গায় পুরাতন মানুষগুলোকে আবারও নতুন করে পেয়ে আমার কথা হয়তো মাথাতেই এলো না আম্মুর। রাত নয়টার দিকে খুঁজে খুঁজে আমার পর্যন্ত পৌঁছোলেন আম্মু। আম্মুকে উল্টো বকুনী দিয়ে কাঁথায় মুখ ঢেকে পড়ে রইলাম আমি। আম্মুও আর জোড়াজুড়ি করলেন না। তাতে যেন অভিমানটা আরো বহুগুণ বেড়ে গেলো আমার। সবসময় জোড়াজুড়ি করে তাহলে আজ কেন করলো না?
নিশ্চয় আর ভালোবাসে না আমায়। কেউ ভালোবাসে না। কেউ না। এসব ভেবে নিজের উপরই বিরক্ত হচ্ছিলাম আমি। নেটওয়ার্ক প্রবলেমের জন্য বিরক্তিটা বেড়ে যাচ্ছিলো আরো বহুগুণ। এভাবেই বিরক্তিতে খিটমিট করতে করতে ঘড়ির কাটা বারোর ঘরে পৌঁছালো। সাথে সাথেই দরজা থেকে ডেকে উঠলো স্নিগ্ধা আপু। আম্মুকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললো,
—” ফুপি? রোদ আজ আমার সাথে থাকুক? এই গরমে চারজন এক বিছানায় থাকবেন কিভাবে? আমি আজ একা শুয়েছি ও বরং আমার সাথেই ঘুমুক।”
আমার মন তখন কালবৈশাখীর কালো মেঘে ঢাকা। চোখে-মুখও অভিমানের ঝড়ে ক্লান্ত। তাই কোনো বনিতা না করেই বললাম,
—” আমি এখানেই ঠিক আছি স্নিগ্ধা আপু। তুমি শুয়ে পড়ো। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
স্নিগ্ধা আপু নাছোড়বান্দা গলায় বললেন,
—” সমস্যা না হলেও আমার সাথে চল। আমি একা। কেমন যেন ভয় লাগছে আমার। চল না প্লিজ…কাল তো চলেই যাবি।”
আম্মুও দ্বিধান্বিত চোখে তাকালেন। রাতের বেলা মেয়েকে নিজের থেকে দূরে রাখতে একদমই রাজি নয় সে তবুও স্নিগ্ধা আপুর জোড়াজুড়িতে রাজি হলেন তিনি। মৃদু গলায় বললেন,
—” আচ্ছা যা। স্নিগ্ধার সাথেই শুয়ে পড় না হয়।”
আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসলাম। স্নিগ্ধা আপুর সাথে ঘর থেকে বেরুতেই উনি জানালেন উনি ওয়াশরুমে যাবেন। উনাদের ওয়াশরুমটা ঘরের বাইরে বিশাল একটা আমড়া গাছের তলায়। উনি আমাকে সেই আমড়া গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন। আমি মনোযোগ দিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছি। মূলত, ভয় থেকে বাঁচতেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি। এমন সময় নারিকেল গাছের ছায়া থেকে ঢেকে উঠলো কেউ। মুহূর্তেই চমকে উঠে সেদিকে তাকালাম আমি। লম্বা করে কোনো পুরুষদেহি ছায়া দেখে চোখ বড়বড় করে তাকাতেই আবারও ডেকে উঠলো ছায়াটি,
—” রোদাপু? আমি রনি।”
“রনি” নামটা শুনে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। কিন্তু সন্দেহটা গুচলো না পুরোপুরি। নারিকেল গাছের ছায়া থেকে সরে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি সন্দেহী চোখে তাকালাম। মাথাটা খানিক পিছিয়ে নিয়ে বললাম,
—” তুই সত্যিই রনি না ভূত?”
আমার কথায় হেসে ফেললো রনি। মাথার একঝাঁক লালটে চুল হেলিয়ে দুলিয়ে বললো,
—” তুমি ভয় পাচ্ছো রোদাপু? আমি সত্যিই রনি।”
আমি সন্দেহী গলায় বললাম,
—” কালিমা বল তো। নয়তো “আল্লাহ” বল।”
রনি এবার মুখ চেপে হাসতে লাগলো। ওর হাসির মাঝে ফোন বেজে উঠতেই বললো,
—” এই দেখো আমার ফোন। ভূতের কি ফোন থাকে?”
আমি কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললাম,
—” তো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলি কেন? যা ফুট…তোর সাথে আমার কথা নেই। শুভ্র ভাইয়ের চামচা কোথাকার।”
রনি এবার অপরাধী গলায় বললো,
—” রাগ করো কেন? শুভ্র ভাইয়ের কথা না শুনলে শুভ্র ভাই মারতো।”
আমি ওর দিকে তেড়ে গিয়ে ওর বাহুতে একটা চড় দিয়ে বললাম,
—” আমিও মারতে পারি। ডাফার কোথাকার…যা তোর শুভ্র ভাইয়ের কাছে। খবরদার আমার আশেপাশে আসবি না। বেদ্দপ।”
রনি মাথা চুলকে বললো।
—” উঠনোর ওই কোণায় ,ঘাটে চলো।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—” কেন? এতো রাতে ওখানে যাবো কেন আমি?”
—” একটা জিনিস দেখাবো।”
আমি আবারও সন্দেহী চোখে তাকালাম,
—” ওই হারামি? তুই সত্যিই মানুষ নাকি ভূত? সত্যি করে বল। আমাকে পানির কাছে নিয়ে মেরে ফেলতে চাস? স্নিগ্ধা আপু? স্নিগ্ধা আপু তাড়াতাড়ি বের হও…. ”
রনি তাড়াহুড়ো করে বললো,
—” আল্লাহ্। চিৎকার করো না রোদাপু। শুভ্র ভাই তোমাকে ডাকছে। কসম।”
আমি সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললাম,
—” একদম মিথ্যা বলবি না। উনি এতো রাতে আমায় কেন ডাকবে? আর ডাকলেও যাবো না। যা ভাগ…”
রনি ব্যর্থ হয়ে কাউকে ফোন লাগালো। ফোনটা রিসিভ হতেই বললো,
—” রোদাপু যেতে চাচ্ছে না শুভ্র ভাই। কি করবো? আচ্ছা….আচ্ছা ঠিক আছে।”
এটুকু বলে থামলো রনি। আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
—” ভাই কথা বলবে।”
আমি মুখ ভেঙিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। রনি উনাকে জানালো আমি কথা বলতে চাইছি না। শুভ্র ভাই কি বললেন না বুঝলেও ফোনটা লাউডে করে আমার সাথে ধরলো রনি। শুভ্র ভাই শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
—” তোর কান ধরে উঠবস করার ভিডিওটা এখনও আছে আমার কাছে। ইচ্ছে না করলে আসিস না। আমি ওই ভিডিও কাল সবাইকে দেখাবো। ফেসবুকেও আপলোড করবো। আর যদি আসিস তো তাড়াতাড়ি আয়…তোর জন্য স্নিগ্ধা ওয়াশরুম থেকে বের হতে পারছে না। তুই এলেই ও বের হবে নয়তো ভেতরেই বসে থাকবে।”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললাম,
—” এটা সম্পূর্ণটাই আপনার প্ল্যান ছিলো? মীরজাফর একটা।”
শুভ্র ভাই রাগী গলায় বললেন,
—” কি বললি? আচ্ছা, যা বলেছিস বলেছিস মাফ করে দিলাম। বাচ্চা মানুষ বলে কথা। এবার জলদি আয়।”
আমি মুখ ফুলিয়ে রনির পেছন পেছন উঠোনের কোণে বিরাট কদম গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওখানে নৌকার গলুইয়ের ওপর বসে ছিলেন শুভ্র ভাই। চাঁদের আলোতে পানিগুলো চিকচিক করছে সেই সাথে আবছামৃদু সৌন্দর্যে ঢেকে গেছে পুরো বাঁশ ঝাড়। উনি আমাকে দেখে হালকা হাসলেন। উনার ইশারা অনুযায়ী নৌকায় উঠতেই রনিও ঝটপট ওঠে এলো নৌকায়। লগি ঠেলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েই সামনের গলুইয়ের উপর বসে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাই আমার হাত টেনে পাশে বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
—” রোদপাখি কি রেগে আছে? মাঝরাতে নৌকায় জ্যোস্না স্নানের সাথে সাথে মন খারাপভাবটাকেও কি ভাসিয়ে দেওয়া যায় না? শুভ্র অনেকগুলো সরি।”
উনার কথায় মন খারাপভাবটা ধরে রাখার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। হঠাৎ করেই প্রচন্ড লজ্জা করতে লাগলো আমার। উনার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাঁটুতে মাথা রেখে মুখ আড়াল করে বসে রইলাম। চারপাশের ঝিঝি পোকা আর নৌকার ঢেউের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাপিয়ে নৌকার ওপাশ থেকে কথা বলে উঠলো রনি,
—“কোন দিকে যাবো শুভ্র ভাই?”
—” তোদের গ্রাম। আমি চিনি নাকি? বিল আছে আশেপাশে? থাকলে সেদিকে যা।”
—” আচ্ছা।”
এবার আমি মাথা তুলে তাকালাম। উপরে বিরাট আকাশটাই আধখানা চাঁদের সাথে ছোট ছোট হাজার তারার মেলা। আর চারদিকে জ্যোস্না মাখা অসংখ্য ঢেউ। আকাশের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে…এ যেন এক তারার রাজ্য। হাজারও মায়াবী ঢেউ পাড়ি দিয়ে সেই রাজ্যেই যেন ডুবতে যাচ্ছি আমি। আমার মুগ্ধ চাহনীর মাঝেই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—” তোর পাশে হলুদ রঙের একটা শপিং ব্যাগ আছে। দেখ..”
আমি উনার দিকে জিগ্যেসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশে তাকালাম। হলুদ রঙের শপিং ব্যাগটা তুলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। ভেতরে দুটো কেকের প্যাকেট, দুটো সুমোচা, দুটো পাকা আম আর একটা পানির বোতল। আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,
—” এগুলো কেন?”
—” ফেলে দেওয়ার জন্য।”
—” মানে?”
শুভ্র ভাই বিরক্তি নিয়ে বললেন,
—” জীবনেও মূর্খ থেকে শিক্ষিত হবি না তুই। এগুলো কি ফেলে দেওয়ার জিনিস? তোর জন্য এগুলো বসে বসে খা।”
আমি রাগ নিয়ে শপিং ব্যাগটা পাশে রেখে শক্ত গলায় বললাম,
—” খাবো না। আপনার জিনিস আপনি খান।”
উনি হেসে বললেন,
—” আমার জিনিস হলেও কি আর সবকিছু সবসময় খাওয়া যায়?”
আমি ভ্রু বাকিয়ে তাকাতেই ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন উনি,
—” দুপুরে বা রাতে একবেলাও তো খেতে দেখলাম না। আসলেই খেয়েছিস নাকি ডায়েটিং করছিস?আদর করে বলছি, চুপচাপ সামনে বসে খা। নয়তো বন্যার পানিতে ফেলে দিবো। সাঁতার তো পারিস না। দুই তিনবার হাবুডুবু খেয়ে এই পঁচা পানিতে পেট ভরাবি তারপর তুলে আনবো। কি হলো, খা!”
আমি মুখ কালো করে বসে রইলাম। উনি আবারও খেতে বলায় তেজ নিয়ে বলে উঠলাম,
—“আপনি আসলেই অনেক খারাপ। সবসময় এতো ধমকা ধমকি কেন করেন? ভালো লাগে না আমার। এই রনি? নৌকা ঘুরা যাব না আমি কোথাও। লাগবে না নৌকাভ্রমণ। ঘুরা বলছি।”
আমার কথায় রনির তেমন ভাবাবেগ হলো না। শুভ্র ভাই আমার পাশে নৌকার পাটাতনে পা গুটিয়ে বসে বললেন,
—“আচ্ছা বাবা, সরি! শুভ্র খুব খারাপ। এবার তো খা..প্লিজ।”
আমি উনার দিকে আড়চোখে তাকালাম। উনাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলাম। পেটের মাঝে ক্ষুধা নামক কীটটাও একটু নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। তুমুল উৎসাহ নিয়ে কেকের প্যাকেটটা ছিঁড়ে একটা কামড় বসিয়ে উনার দিকে তাকালাম,
—” কেউ কি খাবে?”
উনি হেসে বললেন,
—” জ্বি না, ম্যাডাম। রোদপাখি যার কথা বলছে সে খাবে না। এই রনি? কেক খাবি?”
কথাটা বলেই একটা কেকের প্যাকেট ছুঁড়ে মারলেন উনি। রনি ডানহাতে প্যাকেটটা ক্যাচ করতেই মাথা ঘুরিয়ে কেকে কামড় বসালাম আমি। সাথে সাথেই একহাতে আমার চোখ চেপে ধরলেন। আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম,
—” কি হচ্ছে? “
—” অপেক্ষা। জাস্ট কয়েক মিনিট।”
আমি অধৈর্য গলায় বললাম,
—” কিন্তু কেনো?”
—” চুপ করো না রে বাবা। আছে একটা কিছু। এই রনি? এদিকে একটু কম কম তাকা…বড়দের দিকে তাকাতে নেই।”
রনির হাসির শব্দ কানে এলো। তারপর আবারও নীরবতা। আচ্ছা? এটা কি ঝিঁঝি পোকার শব্দ? নাকি পানিতে থাকা কোনো জলজ কীট? কয়েক মিনিট পর যথারীতি আমার চোখদুটো ছেড়ে দিলেন উনি। আমি চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাতেই নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বসা অবস্থায় লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠলাম। সাথে সাথেই কাত হয়ে গেলো নৌকা। শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে আমাকে সামলে নিয়ে বললেন,
—” পাগলী। এখুনি ডুবতো নৌকাটা।”
আমি উত্তেজনায় মুখ চেপে ধরে বললাম,
—” এতো শাপলা?”
রনি হেসে বললো,
—” এর থেকেও বেশি থাকতো। বিকেলেই সালামরা তুলে নিয়ে গেলো। শাপলার ডাটা তো রান্না করে খায়।”
রনির কথাটা আমার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছালো না। শুভ্রতামাখা জ্যোস্নায় সাদা শাপলাগুলো যেন রূপের বন্যায় ভাসতে ভাসতে ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত। চাঁদের আলোয় চকচকে পানিতে সাদা শাপলাগুলো যেন এক একটা রূপের তারা। আমি বিস্মিত হয়ে মৃদু কন্ঠে বলে উঠলাম,
—” এতো সুন্দর কেন ফুলগুলো?”
ডান কানে হালকা “ফু” দিয়ে আমায় কাপিয়ে তুলে, পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—” আমার রোদপাখি দেখছে যে তাই।”
আমার মুগ্ধতা ভরা আবেগে উনার কথাটা যেন ভেসে গেলো ওই বহু দূরে। শুভ্র ভাই বেশ কিছু শপলা তুলে নিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবারও ঝুঁকে পড়লেন শাপলা তুলতে। আমি মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চারপাশটা আজ কেমন শুভ্রতায় ঘেরা। চারপাশে শুভ্র জল, শুভ্র শাপলা, আকাশে শুভ্র চাঁদ-তারা আর আমার পাশে শুভ্র নামক জীবন্ত এক অসুখ। ভয়ানক অসুখ। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি। দুটো শাপলা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
—” এই? তুই কি এভাবে তাকিয়ে থেকে আমাকে প্রেমের জালে ফেলতে চাচ্ছিস? খবরদার…একদম তাকাবি না। আমি অলরেডি এনগেজড, বুঝলি? ওয়ানপিস শুভ্রর জন্য ওয়ানপিস রোদপাখি আছে। সেখানে তোদের মতো বাচ্চা মেয়েদের খাওয়া নেই। এখনো তাকিয়ে আছিস? মাই গড! কাল থেকে নজর ফোঁটা দিতে হবে। নয়তো, তার আমানতগুলো তোরা তাকিয়ে তাকিয়েই নষ্ট করে দিবি।”
উনার কথায় ঝংকার তুলে হেসে উঠলাম আমি। উনি বুকে হাত দিয়ে বললেন,
—“এটাও তোর ষড়যন্ত্র। বুঝি তো আমি।”
আমি আবারও হেসে উঠলাম। আমার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে উনিও মুচকি হাসলেন। তার সেই হাসিতেই একঝাঁক শুভ্রতামাখা মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা শুধুই তার রোদপাখির জন্য….শুধু এবং শুধুই তার রোদপাখির জন্য।
#রোদবালিকা…
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/