পৃথিবীতে হাজারো মত প্রচলিত থাকলেও একটি ব্যাপারে সবাই একমত যে-আইজ্যাক নিউটন ( Isaac Newton) ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের উল্সথর্পে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবার নামও ছিলো আইজ্যাক নিউটন। নিউটনের জন্মের তিন মাস আগে মারা যান তিনি।
নিউটনের যখন দু’বছর বয়স, তখন তাঁর মা হেনা পুনরায় বিয়ে করেন বার্নাবাস স্মিথ নামে এক ধর্মযাজককে। খুবই দয়ালু ছিলেন বার্নাবাস। স্ব-ইচ্ছেয় তিনি কিছুটা জমি লিখে দিয়েছিলেন নিউটনের নামে। তবে নিউটনের মামারা নিউটনকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানেই তাঁর ছেলেবেলা কাটে। ছ-বছর বয়সে প্রথম স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় নিউটনকে। অখ্যাত সেই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করার পর ১৬৫৪ সালে নিউটন ভর্তি হন গ্র্যান্টহাম শহরে অবস্থিত কিংস স্কুলে। মামাবাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে অবস্থিত এই স্কুলটিতে প্রথম প্রথম হেঁটেই যেতে হতো নিউটনকে। পরে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় গ্র্যান্টহামে বসবাসকারী ক্লার্ক নামে এক ওষুধ বিক্রেতার বাড়িতে। ভদ্রলোকের স্ত্রী ছিলেন নিউটনের মায়ের বান্ধবী, সেই সুবাদে এ ব্যবস্থা।
মাত্র বারো বছর সংসার করার পর পুনরায় বিধবা হন নিউটনের মা। তিনি তখন দু’মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন উল্সথর্পে নিউটনদের আদি বাড়িতে। সাংসারিক কাজে সাহায্য করার জন্য নিউটনকেও নিয়ে আসা হয় সেখানে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর লেখাপড়া।
ছেলেবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি অসীম কৌতুহল ছিলো নিউটনের তাছাড়া হাতুড়ি-বাটালি আর স্কু ড্রাইভার নিয়ে নানা জিনিস বানাতেও খুব ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসতেন বিজ্ঞান বিষয়ক বই পড়তে।এসব বই সংগ্রহ করতেন স্থানীয় গির্জার পাঠাগার ও মিস্টার ক্লার্কের কাছ থেকে।
বই পড়ার প্রতি নিউটনের এমনই ঝোক ছিলো যে, তাঁর মা যখন তাঁকে খেত-খোলার তদারকিতে পাঠাতেন, তখনো তিনি একগাদা বই সঙ্গে নিয়ে যেতেন! ফলে খেত-খোলার কাজের দিকে মনোযোগ দেয়ার মতো সময়ই হতো না তাঁর। এ অভ্যাসটি এমনই বেড়ে যায় যে, একদিন তাঁর মা রেগে গিয়ে আবার গ্র্যান্টহেম শহরের সেই কিংস স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেন।
এবারো নিউটনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় ক্লার্ক সাহেবের বাড়িতে। স্কুলে ফিরে আসতে পেরে মনে মনে প্রচণ্ড খুশি হন নিউটন। আবার পূর্ণ উদ্যমে পড়ালেখায় মন দেন তিনি।স্কুল জীবন শেষ করে ১৬৬১ সালে ট্রিনিটি কলেজ এবং ১৯৬৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন নিউটন। এ সময় নানা জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে তাঁর মাঝে। বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে অভাবনীয় দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হন তিনি। ফলে শিক্ষকদের মনোযোগ আকর্ষণে খুব একটা বেগ পেতে হয় না তাঁকে।
সে সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ডক্টর আইজ্যাক ব্যারো। নিউটন সম্পর্কে ছিলো তাঁর উচ্চ ধারণা।
নিউটনের মেধা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “গণিত ভালো জানি বলে ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাস ছিলো। কিন্তু সত্যি কথা হলো, এ বিষয়েনিউটনের কাছে আমি এক অবোধ শিশুমাত্র।“
১৬৬৫ সালের প্রথম দিকে ইংল্যান্ড জুড়ে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে Newton ফিরে আসেন তাঁর মায়ের কাছে। এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অফুরন্ত অবসর পান তিনি। একের পর এক পড়ে চলেন বিজ্ঞানের নানা বই। অভাবনীয় দ্রুততার সাথে বেড়ে চলে তাঁর জ্ঞানের পরিধি। বিশেষ করে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর এমন কতোগুলো সূত্র উদ্ভাবনে সক্ষম হন নিউটন, যেগুলো প্রমাণ করার কাজেই লেগে যায় তাঁর সারাটা জীবন।
গ্রামের বাড়িতে নিউটনের ছিলো ফলের বাগান। একদিন একটি আপেল গাছের নিচে বসেছিলেন নিউটন। হঠাৎ গাছ থেকে ঝরে পড়ে একটি টুকটুকে লাল আপেল। এটি ছিলো খুবই সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু সেই সাধারণ দৃশ্যটি দেখেই সেদিন চমকে ওঠেন নিউটন। তিনি ভাবেন, গাছ থেকে আপেলটি নিচে পড়লো কেনো? এটা তো উপর দিকেও উঠে যেতে পারতো ! তবে কি কোনো অদৃশ্য শক্তি ওটাকে টেনে নামিয়েছে?
এই উদ্ভট প্রশ্নটি তোলপড়া করে তোলে নিউটনকে। কোন কিছু উপর থেকে কেনো নিচে পড়ে-এ নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে যান তিনি। শুধু আপেলই নয়, চাদ তারা গ্রহ নক্ষত্রের কথাও মনে আসে তাঁর। অবশেষে নিউটন বুঝতে পারেন, প্রতিটি জিনিসই অপর জিনিসকে তার নিজের দিকে আকর্ষণ করে চলেছে। এই আকর্ষণ শক্তির পরিমাণ যার বেশি, তার পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে অপর জিনিসটিকে নিজের দিকে টেনে নেয়া। পৃথিবীর আকর্ষণের কারণেই আপেলটি মাটিতে এসে পড়েছে। নইলে ওটা উঠে যেতো সোজা আকাশে।
একটানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৬৮ সালে খুলে দেয়া হয় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উল্সথর্প থেকে নিউটন ফিরে আসেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য তার আগেই বিজ্ঞানের তিনটি সূত্র উদ্ভাবনে সক্ষম হন তিনি। প্রথম সূত্রে নিউটন প্রকাশ করেন গণিতশাস্ত্রের ফ্ল্যাক্সিয়ন নীতি।
সমস্ত গণিতবিদ্যাই এই নীতির ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য নিউটনের প্রধানতম উদ্ভাবনটি ছিলো ইন্টিগ্যাল ক্যালকুলাস। এটি উদ্ভাবন করা না হলে বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন যে অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হতো, সে কথা সত্যি। নিউটনের দ্বিতীয় উদ্ভাবন ছিলো আলোর গঠন সম্পর্কীত মূলনীতি। আর তৃতীয় উদ্ভাবন মাধ্যাকর্ষণের মূলনীতি। এসব চিন্তাধারার সূত্রপাত হয়।১৯৬৫ থেকে ১৬৬৭ সালের মাঝামাঝি। কিন্তু সে চিন্তাধারাকে মতবাদ হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যয় হয়ে যায় তাঁর সারাটা জীবন!
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর সেখানে ফেলো পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৬৬৭ সালে মাইনর ফেলো পদে নির্বাচিত হন Newton. এর মাত্র চার মাস পর সিনিয়র ফেলো পদে উন্নীত করা হয় তাঁকে। এ বছরই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাস করেন তিনি।
গণিতশাস্ত্রের প্রসারের জন্য নিউকাসিয়ান নামে একটি পদ রয়েছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন নিউটনের শিক্ষক ডক্টর ব্যারো। ১৬৬৯ সালে এ পদ থেকে পদত্যাগ করেন ব্যারো।
সে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এক পত্রে লিখেন, “আমার পর এ পদের
জন্য সমগ্র ইংল্যান্ডের মধ্যে একমাত্র নিউটনকে ছাড়া অন্য কাউকেই
উপযুক্ত মনে করি না।“
ব্যারোর এই সুপারিশ ছিলো নিউটনের প্রতি তাঁর শিক্ষকের স্বীকৃতিরই নামান্তর। যা হোক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্তে নিউটনকে মনোনীত করেন নিউকাসিয়ান পদের জন্য।
এটি ছিলো একটি অতি সম্মানজনক পদ। তা ছাড়া এ পদে কাজ ছিলো যেমন কম বেতন ছিলো তেমনি বেশি। মাসে মাত্র তিন-চারটি বক্তিতা দিতে হতো নিউটনকে। কোনো কোনো মাসে উপযুক্ত শ্রোতা পাওয়া না গেলে বসে বসে সময় কাটাতে হতো তাঁকে। ফলে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার মতো প্রচুর সময় এসে যায় নিউটনের হাতে। তিনি কাজেও লাগান সেই সময়কে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ সময় তিনি আবিষ্কার করেন এক বিশেষ ধরনের দূরবীন। ছইঞ্চি লম্বা ও এক ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট এ দূরবীনটি প্রতিফলনী দূরবীন নামে পরিচিতি লাভ করে। বিজ্ঞানী মহলে এটা এতোটাই সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় যে, এ জন্য নিউটনকে রয়েল সোসাইটির সদস্য করে নেয়া হয়।
১৬৮৬ সালে নিউটন প্রথম প্রতিবিম্বিত টেলিস্কোপের ধারণা লাভ করেন। সে যুগের তুলনায় এটি ছিলো একটি অতি অগ্রসরমান প্রযুক্তির উদ্ভাবন। বর্তমানকালের মানমন্দির গুলোতেও নিউটন উদ্ভাবিত টেলিস্কোপের সমপর্যায়ের টেলিস্কোপই ব্যবহৃত হচ্ছে।
Newton ছিলেন প্রচার বিমুখ মানুষ। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মৌলিক সূত্রগুলো ১৬৬৯ সালের ভেতর উদ্ভাবন করে ফেললেও তা প্রকাশে আগ্রহ দেখা যায় না তার মাঝে। এ কারণে গবেষণালব্ধ অনেক ফলাফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে বলেও আশঙ্কা করা হয়।
নিউটনের প্রথম নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৬৭২ সালে। আলোক সম্পর্কীত প্রবন্ধে নিউটন উল্লেখ করেন, সাদা আলো হিসেবে আমরা যে আলোকে দেখতে পাই তার ভেতর রয়েছে সাতটি রঙের অস্তিত্ব। সাদা রঙ লাল, নীল, আকাশি, হলুদ, বেগুনি, সবুজ ও কমলা রঙের সংমিশ্রণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ নিবন্ধটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে সাড়া পড়ে যায় বিজ্ঞানীদের মাঝে। প্রশংসা ও সমালোচনায় মুখরিত হন অনেকেই। বিরুদ্ধবাদীদের বিরোধিতার জবাবে Newton খুব সফলভাবেই প্রমাণ করেন তাঁর মতবাদের সত্যতা।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর নিউটনের জ্ঞান ছিলো প্রশংসা করার মতো। এ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণাও করেন তিনি। তাই অনেক জ্যোতির্বিদই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন নিউটনের সাথে। সে সূত্র ধরে বিখ্যাত বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি ১৬৮৪ সালে নিউটনের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
কেপলারের মতবাদ নিয়ে আলাপ করার সময় হ্যালি জানতে পারেন, Newton নিজেই গ্রহদের গতিবিধির কারণ আবিষ্কার করেছেন। বর্তমানে এ গতিবিধির গাণিতিক ব্যাখ্যা রচনা করে যাচ্ছেন তিনি। সে সময় হ্যালি ছিলেন নিতান্তই এক তরুণ বিজ্ঞানী। কিন্তু নিউটনের কথা শুনে তিনি বুঝতে পারেন, নিউটন এমন কাজ করেছেন, অন্য বিজ্ঞানীর পক্ষে যা করা সম্ভব হয়নি। হ্যালি নিউটনকে অনুরোধ করেন তাঁর মতবাদ ও উদ্ভাবনকে বিশদভাবে লিখে একটি বই প্রকাশ করার জন্য।
Newton মাথা পেতে নেন হ্যালির অনুরোধ। প্রায় দু’বছরের চেষ্টায় রচনা করেন তিন খণ্ডে বিভক্ত একটি বিশাল গ্রন্থ। ১৮৮৬ সালের জুন মাসে নিউটন সেই পাণ্ডূ লিপিটি রয়েল সোসাইটিতে ছেপে দেয়ার জন্য জমা দেন। কিন্তু সে সময় আর্থিক সমস্যা বিরাজ করছিলো বলে রয়েল সোসাইটি বইটি ছাপতে অপারগতা প্রকাশ করে।
এ সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন আবার সেই এডম্ড হ্যালি। তার আর্থিক সাহায্য ও তত্ত্বাবধানে ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ “ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিজম প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা।“ ল্যাটিন ভাষায় লিখিত তিন খণ্ডে সমাপ্ত এ বইটি অবশ্য প্রিন্সিপিয়া নামেই পরিচিত।
প্রিন্সিপিয়ার প্রথম খণ্ডে গতির সূত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন Newton. পদার্থবিদ্যার শুরুতে এসব সূত্র ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যন্ত সফলতার সাথে।এগুলো নিউটনস ল নামে খ্যাত। নিউটন তাঁর প্রথম সূত্রে বলেন, যে বস্তু স্থির থাকে তাকে বল প্রয়োগেগতিশীল করে তোলা না পর্যন্ত সে স্থিরই থাকে। গতিশীল বস্তু একই
গতিতে অনবরত একই দিকে চলতে থাকবে। আর বস্তুর মাঝে গতি সৃষ্টির জন্য অবশ্যই একটা শক্তির অস্তিত্ব থাকতে হবে।
গতি পরিবর্তনের হারের মাধ্যমে শক্তির পরিমাণ পরিমাপ করা সম্ভব-এ ছিলো নিউটন উদ্ভাবিত গতির দ্বিতীয় সূত্র।গতির তৃতীয় সূত্রে নিউটন বলেন, প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অর্থাৎ ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমানুপাতিক এবং বিপরীতমুখী। একে নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগানো সম্ভব।
মাধ্যাকর্ষণের সূত্র হলো এই যে, প্রতিটি বস্তুর প্রতিটি কণা অপর বস্তুর প্রতিটি কণাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। পৃথিবী যেমন চাদকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে-চাদও তেমনি পৃথিবীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। বস্তুর নিহিত শক্তি বস্তুর আকার ও পারস্পরিক দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল।
প্রিন্সিপিয়ার দ্বিতীয় খণ্ডটি আসলে প্রথম খণ্ডেরই বিশদ ব্যাখ্যা। এতে প্যাণ্ডূলামের দোলন থেকে শুরু করে গতির রূপ এবং তরল পদার্থের ভর সম্পর্কে নির্ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এ খণ্ডে গতির প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে।
প্রিন্সিপিয়ার তৃতীয় খণ্ড নিউটনের বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর হিসেবে আজও সমাদৃত। এ খণ্ডে নিউটন পৃথিবী মুখীন বস্তুসমূহের গতি এবং মাধ্যাকর্ষণের নীতি সমূহের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। তাছাড়া গ্রহের আবর্তনকে কেন্দ্র করে কিভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে এবং ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর কিভাবে গ্রহসমূহ প্রভাব বিস্তার করে, এ খণ্ডে নিউটন তা প্রকাশ করেছেন।
প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হবার সাথে সাথে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে নিউটনের নাম। এ সম্পর্কে বিখ্যাত ফরাসী বিজ্ঞানী লাপ্লাসের মন্তব্যটি ছিলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রিন্সিপিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, মানব প্রতিভার যে কোন সৃষ্টির চেয়ে প্রিন্সিপিয়া অনেক গুণে উৎকৃষ্ট।
শুধু বিজ্ঞানী হিসেবেই নন, রাজনীতিক হিসেবেও Newton ছিলেন সফল ব্যক্তি। তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতি আস্থা দেখিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয় তাকে। ১৬৯০ সালে পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ করে নতুনভাবে গবেষণায় আত্মনিইয়োগ করেন Newton. এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ক্রমে ভেঙ্গে পড়ে তাঁর স্বাস্থ্য।
১৬৯২ সালে নিউটনের জীবনে নেমে আসে দুঃসহ অনিদ্রা রোগ। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা তাঁকে বিশ্রাম নেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। সুতরাং বিজ্ঞানের অঙ্গন থেকে সরে দাঁড়াবার ইচ্ছে নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি। ১৬৯৬ সালে জাতীয় টাকশালের নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে তাঁকে মাস্টার অব মিন্ট পদে উন্নীত করা
টাকশালে চাকরি পাবার পর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নিউটনকে চলে যেতে হয় লন্ডনে। ফলে রয়েল সোসাইটির সাথে নিউটনের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয় । ১৬৯৯ সালে নিউটনকে ফরাসী বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ দেয়া হয়। এটি ছিলো বিদেশী হিসেবে নিউটনের জন্য এক বিরল সম্মান। তবে এর চেয়েও বড়ো সম্মান তিনি অর্জন করেন ১৭০৩ সালে। সে বছর তাকে রয়েল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সাতাশ বছর এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তিনি। ১৭০৪ সালে আলোক বিজ্ঞানের ওপর একটি বই লিখেন Newton. আলোর গঠন, প্রকৃতি, গতি এবং অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ এই বইটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের মাঝে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বইটি ফরাসী ও ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয়। একই বছর সাতটি কাচের সমন্বয়ে একটি লেন্স উদ্ভাবন করেন নিউটন । প্রচণ্ড শক্তিধর এ লেন্সটি এতোটাই কার্যকর ছিলো যে, অদৃম অণুকেও বহুগুণে বড়ো করে দেখা যেতো এতে। তাছাড়া ধাতব পদার্থকেও গলিয়ে দেয়া সম্ভব হতো সেই লেন্সটির সাহায্যে । Newton লেন্সটি উপহার দেন রয়েল সোসাইটিকে । এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৭৫৫ সালে নিউটনকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় । বিজ্ঞানের উন্নয়নে অভাবনীয় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ রানী এ্যান তাঁকে এ সম্মানে ভূষিত করেন। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে কোনো বিজ্ঞানীকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করার সেটিই ছিলো প্রথম ঘটনা । অতিরিক্ত খাটুনি ও অধিক বয়সের কারণে এ সময় থেকে দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে নিউটনের। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিনিময়ে আবার সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এভাবে কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর। এদিকে ১৭২২ সালে পাথুরে রোগে আক্রান্ত হন Newton. ১৭২৪ সালে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। পরিপূর্ণ বিশ্রামের প্রত্যাশায় শুভাকাতক্ষীরা নিউটনকে পাঠিয়ে দেন কেনসিংটনের এক গ্রামে । Newton ছিলেন কর্মপাগল মানুষ। তাই কিছুটা সুস্থ বোধ করলেই লন্ডনে ফিরে এসে কাজের মাঝে ডুবে যেতেন তিনি। শরীর ভেঙ্গে পড়লে আবার ফিরে যেতেন কেনসিংটনের সেই গ্রামে । এভাবে তিনটি বছর কাটাবার পর ১৭২৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রয়েল সোসাইটির অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য লন্ডনে ফিরে আসেন নিউটন।
অনুষ্ঠান শেষ হবার পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ডাক্তারদের পরামর্শে আবার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় কেনসিংটনে। সেখানে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন Newton. সে রাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তখন তাঁর বয়স হয়েছিলো পঁচাশি বছর তিন মাস দু’দিন। মৃত্যুর প্রায় দশ দিন পর ১৭২৭ সালের ২৭ মার্চ লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার এ্যাবিতে সমাহিত করা হয় ইংল্যান্ডের এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বিজ্ঞানীদের মাঝে তাকেই প্রথম সমাহিত করা হয় সেখানে | নিউটনের ছিলো এক সর্ব ব্যাপী প্রতিভা । থার্মোডাইনামিক্স (তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে যন্ত্র চালনবিদ্যা) ও শব্দ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও মূল্যবান অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। গণিতশাস্ত্রের দ্বিরাশিক উপপাদ্যের (Binomiol theorem) তিনিই ছিলেন উদ্ভাবক। সত্য কথা হলো, এমন ছোট আয়তনের লেখায় নিউটনের মতো আকাশছোঁয়া প্রতিভার বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বলা যায়, সেদিন যদি নিউটনের জন্ম না হতো, আজ তবে বিজ্ঞান এতোটা পথ এগোতে পারতো না। অথচ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে চিরকুমার আত্মভোলা এ বিজ্ঞানী বলেছিলেন, “অগ্রজ বিজ্ঞানীদের সফলতার ওপর নির্ভর করেই আমি এ যাবত অগ্রসর হয়েছি। নিজের সম্পর্কে ভাবতে গেলে মনে হয়,
“একটি অবোধ শিশুর মতো সাগর তীরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু নুড়িই কুড়িয়ে গেলাম। এ বিশাল জ্ঞানসমুদ্র আমার কাছে অজানাই থেকে গেলো!”
কিয়ানু রিভার্স বেস্ট হলিউড এক্টর জীবনি
আমদের গল্প যদি আপনাদের ভাললাগে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন এবং বেশি বেশি বন্ধু দের সাথে শেয়ার করে আমাদের উৎসাহ দিবেন যেন আমরা আপনাদের জন্য নতুন নতুন গল্প নিয়ে আসতে পারি।