লোভের দেবতা হাস্তার
আজ আমরা আপনাদের সামনে যে সিনেমার গল্প নিয়ে এসেছি, তার সাথে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু এ প্রবাদ বাক্যের মিল রয়েছে।আমরা ছোট বেলা থেকেই সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গল্পে শুনে আসছি।এই সিনেমার গল্পতে এই বিষয়ই ফুটে উঠেছে।কিন্তু গল্প যতো সহজ মনে হচ্ছে সিনেমাটি ততোই জটিল।এই সিনেমাটি যদি মাঝ রাতে দেখেন তবে একসাথে যতো জনই থাকুন না কেন ভয়ে জড়সড়ো হয়ে যাবেন সবাই, আপনাদের অন্তর আত্মা হয়ে যাবে খাঁচা ছাড়া।তাই আগেই বলে রাখছি যারা ভুতে ভয় পান তারা মোটেই এই সিনেমা দেখবেন না, আর যাদের সাহস খুব বেশি তারা রাতে পানি একটু কম খেয়ে সিনেমাটি দেখতে বসুন।কি ভাবছেন পানি কম খেতে বললাম কেন? কারণ মুভি দেখার পর যদি প্রসব চাপ দেয় তবে আপনি সাহস করে বেড় হতে পারবেন না চাপ সাড়ার জন্য। আর তখন আপনার প্রসব রুপ নিবে গর্ভবতী মেয়েদের মতো প্রসব যন্ত্রণায়।আর আলোচনা না বাড়িয়ে মুল গল্পে ফিরছি-
কতটা ভয়ঙ্কর এই সিনেমা তা বুঝাতে একটা তথ্য দিয়ে রাখি, প্রায় ছয় বছর ধরে এই সিনেমার সুটিং করা হয়।আর যেখানে সুটিং করা হয় সেখানে প্রায় গতো একশ বছর কোন মানুষ পা রাখেনি।বুঝতে পারছেন কতটা ভুতুরে বাস্তবিক ঘটনা এটা।
২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমার নাম Tumbbar. এই সিনেমায় তিনটা আলাদা আলাদা সময় ও তিনটা আলাদা আলাদা প্রজন্মকে দেখানো হয়েছে। মহারাষ্ট্রের ক্ষুদ্র এক গ্রাম তুম্বারকে কেন্দ্র করে এই সিনেমার গল্প।
তবে এই গল্পের শুরু আরো অনেক অনেক আগে। বিশ্ব ভ্রমান্ড যখন সৃষ্টি হয় তখন দেবী ষোল কোটি দেব-দেবি সৃষ্টি করেন তাদের আলাদা আলাদা ক্ষমতা দিয়ে। আর এই দেবীর প্রিয় সন্তান ছিল প্রথম সন্তান হাস্তার।কিন্তু এই হাস্তার ছিল প্রচুর লোভী ও সুযোগ সন্ধানী। সে দেবীর সব স্বর্ণ আর খাদ্য নিজের দখলে নিতে চাইল। অন্য দেব-দেবী তখন হাস্তারের উপর খেপে উঠলো এবং তারা হাস্তারকে খুন করতে চাইল। নিরুপায় দেবি তখন প্রিয় সন্তানকে বাচাতে স্থান দিল তার নিজের গর্ভে। শর্ত একটাই কেউ হাস্তারের পূজা করতে পারবেনা। হাস্তার থাকবে নিষিদ্ধ এক দেবতা হয়ে।
এভাবেই হাজার হাজার বছর কেটে গেল, হাস্তার বন্দী হয়ে রইল দেবীর গর্ভে।কিন্তু আচমকা একদিন তুম্বারের লোকজন স্বর্ণের লোভে শুরু করলো দেবতা হাস্তারের উপাসনা। এতে ক্ষিপ্ত হলো অন্য দেব-দেবীরা। সবাই মিলে না উপদ্রব ও শুরু করল ওই গ্রামের উপর।
তুম্বারের এক লোভি নারী নেমেছিল ওই কুয়াই যেখানে হাস্তার বন্দী রয়েছে বহুদিন।কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতো তার শরীরে আগুন লেগে যায় এবং সে পরিনত হয় জম্বির মতো মানুষে।যাকে রাক্ষস বললেও আসলে ভূল হয়না।তাকে বেঁধে রাখা হয় বাড়িতে, জীবন মৃত্যুর মাঝে ঝুলন্ত এক অসহ্য যন্ত্রণায় কাটতে থাকে তার দিন। আর পুড়ে যাওয়া এই মহিলাটিই ছিল সিনেমার কেন্দ্রিয় চরিত্র বিনায়কের দাদি।
১৯১৮ সালের ঘটনা
এখানে আমরা দেখতে পাই বিনায়ক এবং সদাশিন দুই ভাই থাকে তুম্বার গ্রামে তার মায়ের সঙ্গে।তাদের মা কাজ করেন ওই গ্রামের সরকার নামের এক লোকের বাড়িতে। সরকার নামের এই লোকটি বিনায়কের মায়ের অভাবের সুযোগ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করেন।তবুও বিনায়কের মা মুখ বুঝে সব সহ্য করে।কেননা তিনি জানেন এই প্রাসাদের কোথাও হাস্তারের গুপ্তধন লুকানো আছে,আর কোন ভাবে যুদি সেটা একবার হাতে আসে তাহলে আর এই গরিবি জীবন কাটাতে হবেনা।
এরই মধ্য আচমকা সরকারের মৃত্যু হয়।তখন বিনায়কের মা সিদ্ধান্ত নিলেন পূণে চলে যাবার। পূণে বড় শহর, কোন কাজ অবশ্যই পাওয়া যাবে আর তা দিয়ে খেয়ে পড়ে বাঁচা যাবে।কিন্তু বিনায়ক এতে রাজি হয়না,সে সরকারের প্রাসাদে গিয়ে খুঁজতে থাকে হাস্তারের সম্পদ। ঘটে গেল আরেক দূর্ঘটনা,গাছ থেকে পড়ে গিয়ে গুরুত্বর আহত হলো বিনয়কের ছোট ভাই। ছোট ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হয় বিনয়কের মা।যাবার সময় বিনয়ককে বলে যায় তার দাদিকে খাবার দিতে, আর দাদি যদি পাগলামি করে তবে যেন চিৎকার করে বলে, ঘুমিয়ে পড় দাদি হাস্তার এলো।না হলে তার হাত থেকে নিস্তার নেই।
রাত গভীর হয়, বিনায়ক তার দাদির কাছে খাবার নিয়ে যায়। দাদি স্বর্ণের কথায় ভুলিয়ে আটকে ফেলে বিনয়ককে।রক্ত পিপাসা মেটাতে খুন করতে যায় নিজের নাতিকে। ছোট্র বিনয়ক এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা, সে ভুলে যায় মায়ের শিখে দেওয়া কথা। দাদি তাকে মেরেই ফেলবে ঠিক এমন সময় তার মনে পড়ে যায় কথাটি।সে চিৎকার করে বলে ওঠে, ঘুমিয়ে পড় দাদি না হলে হাস্তার আসবে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যায় বুড়ি।
এদিকে গভীর রাতে বাসায় ফেরে বিনয়কের মা, কোলে নিথর সাদাসিধে দেহ।মারা গেছে বিনয়কের ছোট ভাই, বাঁচানো যায়নি তাকে। বিনয়ককে নিয়ে মা চলে যেতে চাইলেন শহরে কিন্তু রাজি হলোনা বিনায়ক গুপ্তধনের লোভে। কিন্তু এবার মা নাছোড় বান্দা, সে আর কাউকে হারাতে চায়না এই অভিশপ্ত সম্পদের লোভে। মা এবার বিনয়ক কে শপথ করালেন, সে যেন কোনদিন ফিরে না আসে তুম্বার গ্রামে।মনোক্ষুণ্য বিনয়ক শহরে চলে গেলো মায়ের সাথে।
এরপর কেটে গেল অনেকটা বছর,
১৯৪৭ সাল ভারত তখন স্বাধীন হয়েছে।বিনয়ক এখন তাগড়া জোয়ান।মা মারা গেছে অনেক আগে, সেই সাথে মায়ের কাছে করা প্রতিশ্রুতিও।বিনয়ক ফিরে আসে তুম্বার গ্রামে। পুড়নো সে বাড়িতে এসে বিনয়কের চোখে পড়ে তার দাদি। এই বৃদ্ধা মহিলাকে তারা ফেলে রেখে গিয়েছিল অনেক আগে,কিন্তু এখনো সে মরেনি। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে অনেক কিছু, কিন্তু হাস্তারের অভিশাপ হারিয়ে যেতে দেয়নি এই বৃদ্ধ মহিলাকে।জীবন মৃত্যুর মাঝে ঝুলন্ত অবস্থায় অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছে সে। তার শরীর পরিণত হয়েছে গাছেড় শিকড় বাকড়ে হয়ে রাক্ষসের জীবন যাপন করছে বুড়ি।
দাদির সাথে বিনায়কের চুক্তি হলো, দাদি তাকে বলবেন কোথায় হাস্তারের স্বর্ণ,রৌপ্য লুকানো আছে।বিনিময়ে বিনয়ক দাদিকে মেরে ফেলে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দিবেন।দাদি বিনয়ককে শতর্ক করে দিল যে, হাস্তার যদি কোন ভাবে তাকে ছুতে পারে তবে সেও এরকম অবস্থায় পতিত হবে।দাদির অনুরোধ মতো বিনায়ক তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল,চির বিদায় নিলেন বৃদ্ধা।
এবার শুরু হলো বিনায়কের মিশন, সে খুঁজে বেড় করল কূয়াটা। দাদি মারা যাবার আগে তাকে আরো কিছু কৌশলও শিখিয়েছিলেন।দড়ি দিয়ে কুয়াই নেমে একটা একটা করে স্বর্ণ মুদ্রা তুলে আনতে থাকে বিনায়ক।সেই স্বর্ণ বিক্রি করে টাকাও কামাই করতে থাকে সে।যখনি তার টাকার দরকার হয় সে চলে আসে তুম্বারে।এরই মধ্য বিনায়কের পিছু করে হাস্তারের গুপ্তধনের সন্ধান পায় রাঘব নামের এক ব্যক্তি।বিনয়ক কূয়া থেকে উঠে গেলে সে পৌছায় কূয়ার কাছ।সেখানে গিয়ে সে একটি বাটিতে ময়দার তৈরি পুতুল দেখতে পায়।সে মনে করে এই পুতুলটার নিশ্চয় অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে, তাই সে পুতুলটি নিয়ে নেমে যায় কুয়ায় যেখানে হাস্তার বন্দি আছে হাজার হাজার বছর ধরে। রাঘব কূয়ার ভিতর নামতেই তাকে আক্রমন করে বসলো হাস্তার, তার অবস্থাও হলো বিনায়কের দাদির মতো।এমন অবস্থায় তাকে কূয়ার ভিতরেই বন্দী করে রাখলো লোভের দেবতা হাস্তার।
টাকার দরকার হওয়াই আবার তুম্বারে এলো বিনায়ক।পরিচালক প্রথম বারের মতো এবার দেখালেন বিনায়ক কিভাবে হাস্তারের সম্পদ চুরি করে।আগেই আমরা জেনেছি লোভের দেবতা হাস্তার দেবীর সকল স্বর্ণ আর খাবার নিজের দখলে নিতে চেয়েছিল।স্বর্ণ নিজের দখলে নিতে পারলেও খাবার নিতে পারেনি নিজের দখলে। তাই অভুক্ত অবস্থায় যেতে হয়েছিল দেবীর পেটের ভিতর অর্থ্যাৎ কুয়ার ভিতর।
এই ঘটনা বিনায়কের দাদি তাকে বলে গিয়েছিল,তাই বিনায়ক যখন কূয়ার ভিতর যেতো তখন সঙ্গ করে ময়দার পুতুল নিয়ে যেতো। ক্ষুধার্ত হাস্তারের দিকে সে ময়দার পুতুল ছুড়ে মারলে সেটা খাওয়াই ব্যাস্ত হয়ে পরতো হাস্তার, আর এই সুযোগে তার থলে থেকে স্বর্ণ মুদ্রা সড়িয়ে রাখত বিনয়ক।আর হাস্তার যেন আক্রমন করতে না পারে সে জন্য কুয়ার ভিতরে একটি চক্র বানিয়ে সেটার ভিতর অবস্থান করতো বিনয়ক। এ চক্রের মধ্যে প্রবেশের ক্ষমতা ছিলনা হাস্তারের।এসব তত্ব রাঘব জানতো না,তাই সে হাস্তারের শিকারে পরিণত হয়েছে।বিনয়ক অবশ্য তাকেও দাদির মতোই পুড়িয়ে মেরেছিল।এভাবেই চলতে চলতে কেটে গেলো আরো পনের বছির।
বিনয়কের বয়স হচ্ছে,
এভাবে চলতে চলতে সে বুড় হয়ে যাবে।কিন্তু তার পরের প্রজন্মকে তো হাস্তারের গুপ্তধনের সন্ধান দিতে হবে। বিনয়ক তার ছেলে পাণ্ডরামকে এবিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয় কিভাবে কুয়াই নেমে হাস্তারকে বোকা বানিয়ে তার সম্পদ তুলে আনতে হবে।
প্রশিক্ষণ শেষে সে তার ছেলেকে নিয়ে যায় তার গ্রাম তুম্বারে, শেখালো কিভাবে ময়দার পুতুল বানাতে হয় এবং সতর্ক করে দিল সেদিন যেন পুতুল সঙ্গে করে নিয়ে না নামে।কিন্তু পাণ্ডরামের তো বুদ্ধির শেষ নেই,সে ঠিকই বাবাকে না বলে একটা পুতুল নিজের সাথে নিয়ে বাবার সাথে নিচে নামলো। নিচে নামতেই আচমকা তাদের উপর হামলা করলো হাস্তার।কোন মতো প্রাণ বাঁচিয়ে দুজনে উপরে উঠিয়ে এলো। উপরে উঠেই ছেলেকে আচ্ছা মতো পেটালো বিনয়ক,কেন সে তাকে না বলে নিজের সাথে পুতুল এনেছে।
মার খেয়ে পাণ্ডরাম উল্টো বাবাকে দোষারোপ করলো,কেন তার বাবা ২/৩ স্বর্ণ মুদ্রা চুরি করে বারবার।চাইলেই তো একবারে পূরো স্বর্ণের ঝোলাটা সরিয়ে নেয়া যায়। বোঝাই যাচ্ছে বিনায়কের ছেলে তার তুলনায় কয়েকশত গুণ বেশি লোভী। ছেলের আইডিয়াটা মনে ধরলো বিনায়কের, বাব-বেটা মিলে অনেকগুলো ময়দার পুতুল বানালো এবার উদ্দেশ্য একবার অনেকগুলো স্বর্ণ মুদ্রা তুলে আনবে তারা।
কিন্তু কুয়ার ভিতর যে অবিশ্বাস্য ঘটনা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা তারা।প্রতিটি ময়দার পুতুল খাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা হাস্তার তৈরি হলো সেখানে মূহুর্তের মধ্যেই।আমাদের লোভ যেভাবে বাড়তে থাকে সর্বনাশ ও যে ততো বাড়তে থাকে এটাই তার প্রমাণ।হাস্তারের এতোগুলো রুপ দেখে ঘবড়ে গেলে বাপ-বেটা। জীবন সংশয় বুঝতে পারল বিনয়ক।নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সন্তানকে বাচাতে চেষ্টা করল,দড়ির উপর দিকে ছেলেকে রেখে, এরপর নিজের শরীরের সাথে ময়দার পুতুল বেঁধে উপরে উঠার চেষ্টা করলো সে।একে একে তাকে আক্রমণ করতে এলো অনেকগুলো হাস্তার কিন্তু ময়দার চক্রে এসে ধ্বংস হয়ে গেল সে সব।তবে হাস্তার ধ্বংস হবার আগে বিনয়কের অবস্থাও শেষ করে দিয়েছে সে।বিনয়কের অবস্থাও হয়েছে তার দাদির মতো, সেও জম্বিতে পরিণত হয়েছে।
সবগুল হাস্তার মারা যাবার পর নিরাপদে কূয়ার বাহিরে আসলো পাণ্ডরাম।সে তার বাবাকে পেলো অর্ধমৃত জম্বি অবস্তায়। যে লোভের বলি হয়েছিল তার দাদি,রাঘব সেই লোভেরই বলি হতে হলো বিনায়ককে। বিনায়ক তার হাতে থাকা একটা স্বর্ণের থলে তার ছেলেকে দিতে চাইল, কিন্তু তার ছেলে তা নিল না। লোভের কারণে তার বাবার করুণ পরিণতি দেখে নিজের লোভ সংবরণ করলো সে।বিনায়কের অনুরোধে তার ছেলে আগুন ধরিয়ে দিলে তার গায়ে।মৃত্যুর সময় বিনায়কের মুখে হাসির ছোয়া।যে লোভে তাকে গ্রাস করেছে,তার দাদিকে গ্রাস করেছে, সেই লোভ থেকে মুক্তি পেয়েছে তার ছেলে।
দেবতা/দেবতা/দেবতা
শয়তান দেবতা যে কিতাবের উপর আমল করে।