বঙ্গবন্ধুর শরীরে লেগেছিল সর্বমোট ১৮টি বুলেট
আপনারা দেখেননি,বঙ্গবন্ধুর সে বিভীষিকাময় মুহুর্ত আপনাদের চোখের সামনে নেই।আমি দেখেছি-আমি তাঁর সর্বশেষ বেদনার সাক্ষি।
বঙ্গবন্ধুর শরীরে সর্বমোট ১৮টি বুলেট লেগেছিল তবে তাঁর মুখমন্ডলে কোন বুলেটের চিহ্ন ছিলনা।তাঁর দু’পায়ের গড়ালির দুটি রগই ছিল কাঁটা। মৃত্যুর পরেও পরনের পাঞ্জাবির উপরের পকেটে ছিল চশমা, সাইডের পকেটে ছিল তাঁর প্রিয় পাইপ এবং গায়ে জড়ানো ছিল সাধারণ একটি তোয়ালে। মিলিটারিরা রক্তাক্ত কাপড়-চোপড় সহই বিনা গোছলে মুর্দাকে কবর দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সেদিন।
এই কথাগুলো শুনেছিলাম, মৌলভী শেখ আবদুল হালিম এর মুখে। তিনি বলেন, লোমহর্ষক এই সংবাদটা শুনি 15 Aug সকালে রেডিওতে। রেডিওতে ঘোষণা করা হয়, স্বৈরাচারী শাসক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। সমগ্র দেশবাসীর মতো আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই। হতভম্ব হয়ে পড়ি, মনে হল এ অবিশ্বাস্য,এ মিথ্যা অপবাদ। এ যে বিনা মেঘেই বজ্রপাত। পরদিন দুপুর ১২টার সংবাদে জানানো হলো, শেখ মুজিবের মৃত দেহ টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হবে।
16 Aug ভোরে থানার ওসি(ওফিসার ইনচার্স) আমাকে ডেকে বললেন, ১৩টা কবরের বন্দোবস্ত করতে হবে।
আমি চলে এলাম, কবর খুড়লাম। তবে তেরোটা নয়, একটা। ভাবলাম তেরোটা খুড়ে কি হবে। আগে তো একটি খুড়ি। তারপর দেখা যাবে যা হয়। ৯টা/৯.৩০টায় কবর খোড়া শুরু করি আর ভাবি আল্লাহ চায়তো এখানেই হয়তো বা বঙ্গবন্ধু চির নিদ্রায় শায়িত হবে,আর যদি তাই হয়, আমি যদি তাকে কবর দিতে পারি। তবেই আমার এ জীবন ধন্য।
দুপুর প্রায় বারটার আগেই কবর খোড়া শেষ হলো আমাদের। তার পরপরই দ্বিতীয় ঘোষণাটা শুনলাম রেডিওতে। নিশ্চিত হলাম, বঙ্গবন্ধুকে এখানেই সমাহিত করা হবে। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক গোরস্থানের প্রথমে রয়েছে তার মায়ের কবর, তারপর বাবার, বাবার কবরের পশ্চিমে সবদিকে একটু জায়গা ছেড়েই বঙ্গবন্ধুর কবর খোড়া হলো। অন্যান্যদের মধ্যে মদেল ফকির(চৌকিদার), আবদুল মান্নাফ, ইমাম উদ্দিন গাজী কবর খোড়ায় আমাকে সাহায্য করে। তারপর বেলা দেড়টার দিকে বঙ্গবন্ধুর লাশ হেলিকপ্টার যোগে টুঙ্গিপাড়া ডাক বাংলায় পৌছালো। একজন মেজরের নেতৃত্বে ১৩জন সৈনিক লাশের কফিন বয়ে এনেছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। ডাকবাংলায় অবশ্য আরো ১২/১৩ জন সৈনিক ছিল। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পাশের রাস্তায় ব্যাপক ভীর জমে গেল; কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছেনা। মেজর সাহেব স্থানীয় মৌলভীকে ডেকে আনার সংবাদ দিলে আমি সাথে সাথেই চলে আসি।
মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি এখানকার মৌলভি?”
উত্তরে বললাম, “জ্বি হ্যাঁ।”
এরপর তিনি আমাকে মুর্দার জানাজার নামাজ পড়ার নির্দেশ দিলেন।
মেজর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কার জন্য জানাজার ব্যবস্থা করবো?”
মেজর উত্তরে বললেন, “শেখ মুজিবের।”
আমি ইংরেজিতে বললাম- “ইজ দ্যা ডেড বডি অব শেখ মুজিবুর রহমান?”
উত্তর দিলো- “হ্যাঁ।”
আমি চাইছিলাম বঙ্গবন্ধুকে দেখবো তারপর মাটি দেব। কিন্তু মেজর সাহেব আমাকে বলেছিলেন কফিন সহই জানাজা পড়ে মাটি দিতে। কিন্তু আমি তা মেনে নিতে পারলাম না।
মেজর সাহেবকে আমি আবার বললাম- “আই মাস্ট ওয়ান্ট টু সি দ্যা ডেড বডি।”
মেজর সাহেব বললেন, “ডু ইউ নট বিলিভ আস?”
আমি বললাম- “আই বিলিভ ইউ, বাট ওয়ান্ট টু সি ওয়ানলি ফর মাই স্যাটিসফেকশন।”
তারপর মেজর কফিনের তালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন, ২-৩ জন্য সৈন্য এসে তালা খুলে দিতেই প্রথমেই চোখে পড়লো বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত মুখ। কফিনের বাহিরে অবশ্য কোন রক্তের দাগ ছিলো না।
তারপর আমি মেজর সাহেবকে বললাম, “মুর্দাকে তো গোসল দেয়া্নো হয়নি। বিনা গোসলে কোন মুসলমানের জানাজা পড়ানো যায়েজ নেই।”
মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, “মুসলমানের বিনা গোসলে জানাজা হয় না!”
বললাম, “হয়, কেবল মাত্র যুদ্ধে শহীদের মৃতদেহ বিনা গোসলে জানাজা করা হয়। তবে সম্ভব হলে তাকেও গোসল দেয়ান উচিত।”
তারপর মেজর লাশের গোসলের নির্দশে দিলেন। সময় দিলেন মাত্র ২ মিনিট।
আমি পুনরায় বললাম, “গোসল করানোর জন্য আমার কয়েকজন মানুষ লাগবে।“
তিনি আমাকে সর্বোচ্চ ৮ জন নেয়ার অনুমতি দিলেন।“
বেলা তখন ২টা। আমি ৮ জন লোক ডাকি। সবাই মিলে কফিন থেকে লাশ নামিয়ে রাখলাম তক্তার উপর, তক্তা যোগাড় করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ি হতেই। একটা ছেলেকে পাঠালাম টুঙ্গিপাড়া সাহেরা খাতুন হাসপাতালে, সাবান ও কাফনের কাপড় আনার জন্য। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটি একখানা ৫৭০ সাবান ও রেডক্রসের ৪ খানা সাদা পাড়ওয়ালা শাড়ী নিয়ে ফেরত আসলো দ্রুতই। পেছনের কাজ সেরে আমরা কাপড় পড়ালাম।
খালি গা উল্টেপাল্টে সব দিকই দেখছি। পেটের নীচে পিছন দিক হতে একটি বুলেট ঢুকে সামনের দিকে তলপেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ৯ টা বুলেট বাঁ বুকের নীচের দিয়ে চক্রাকারে ঢুকেছে তবে বের হয়নি।বাঁ হাতে তর্জনীতে একটি বুলেট লেগেছে এবং আঙ্গুলটি প্রায় ছিন্ন ও থেতলানো। দুই বাহুর উপরিভাগে আছে দুইটা ও আরেকটি সম্ভবত- ডান হাতের তালুতে। দুই পায়ে ৪টি, দুটি হাটুর এবং ওপরে নীচে দুট অর্থাৎ সর্বমোট ১৮টি বুলেট বঙ্গবন্ধুর শরীরে লাগে। তাছাড়া দুই পায়ের গোরালির দুটি রগই কাটা ছিল। মুখে বা বুকে কোন বুলেটের চিহ্ন ছিলো না।
মুর্দার শরীর ঢাকা ছিল একটি সাদা চাদর দিয়ে। পরনে ছিল চেক লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জী ও সাদা পাঞ্জাবী ছিল।
তারপর জানাজা পড়ে কবরে শায়িত করা হলো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর কবর পাহারা দেয়ার জন্য সে সময়ের সরকার ১০/১৫ জন পুলিশ মোতায়েন করলেন। এরা দিবা-রাত্রি পালা করে পাহারা দিত। বাড়ির লোক ছাড়া কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হতো না। বঙ্গবন্ধুর দাফনের চারদিনের দিন বাড়ির মসজিদে মিলাদ পড়তে দেয়া হয়নি; পুলিশ বাঁধা দিয়েছিল। কেবল মাত্র বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মৌলভি ডেকে মিলাদ পড়ানোর ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। টুঙ্গিপাড়ার অন্যান্য মসজিদেও মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ক্ষুদ্র পরিসরে।
নোট-ঃ
মৌলভি শেখ আব্দুল হালিম ছিলেন স্থানিয় মসজিদের ইমাম। তিনিই বঙ্গবন্ধুর লাশ নিজ চোখে দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন এবং তার অদম্য সাহসিকতা ও প্রচেষ্টার ফলেই মুর্দার গোসল সুসম্পন্ন হয়েছিল।
যে মহান নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক স্বাধিন রাষ্ট্রের জন্ম হতো না, যিনি জীবনের ১৩ টা বছর জেলখানায় কয়াদির জীবন কাটিয়েছেন জাতির অধিকার আদায় করতে, সেই জাতির জনককে গোসল দেয়ানো হয়েছিল পুকুরের নোংরা পানি আর নগন্য কাপড় কাঁচার সাবান দিয়ে। ভালো কাপড় না থাকায় তার কপালে জুটলো তারই দান করা রিলিফের কাপড় থেকে এক খন্ড কাফনের কাপড়।
৭ কোটি মানুষকে মাথা তুলে বাঁচতে শিখালেন যে নেতা। ইয়াসির আরাফাত, ফিদেল ক্যাস্ট্রোরা যাকে অনুপ্রেরনার মহান নেতা মানত, সেই মানুষটার জানাজা পড়ল মাত্র ১৬-১৭ জন। আসেনি কোন বিশ্বনেতা!
পরের দিন ভোরে লন্ডনের বিখ্যাত পত্রিকা ‘দা ডেইলি টেলিগ্রাম’ একটি জঘন্য সত্য শিরোনাম প্রকাশ করলো, “এই নির্মম মৃত্যুই যদি শেখ মুজিবের ভাগ্যে ছিল তাবে বাংলাদেশ সৃষ্টির কোনো প্রয়োজনই ছিলনা।”
সেদিন বাংলাদেশে যা ঘটেছিল,যে অপবিত্রতায় এ দেশ কলঙ্কিত হয়েছিল, তা কখনো দূর করা যাবেনা। যে মানুষটা ছিল আমাদের সকাল বেলার আলো, সেই মানুষটাকেই নির্মমতায় ঠেলে দেয়া হলো অনন্ত রাত্রির অন্ধকারে।
ফিরে তাকাই ১৯৭২-এঃ-
বাংলার মেয়েরা পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতন ও ধর্ষণের স্বীকার হওয়ার পর ঘরে ফিরে পেল অমানসিক নির্যাতন। বাপ তার মেয়েকে ঘরে নিতে অস্বীকার করল,স্বামী তার বউকে তালাক দিল। সমাজ বয়কট করল তাদের । অপমানে লজ্জায় গাছের ডালে ফাঁস দিয়ে আত্নহত্যা করছিল বাংলার শতশত বীরাঙ্গনারা। কার জন্য ইজ্জত গেল কার জন্য এত নির্যাতন সহ্য করলাম।
সে খবর গেল ধানমন্ডি-৩২ এ শেখ মুজিবুর রহমানের কানে। বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে সেদিন মুজিব বলেছিলেন, “কেউ যদি বীরাঙ্গনাদের পিতার নাম জানতে চায় তবে বলে দিও তাদের পিতা শেখ মুজিবর রহমান আর তাদের ঠিকানা্র স্থানে লিখে দিও ধানমন্ডি-৩২ নাম্বার।”
সেই কালো ফ্রেমের চশমা পড়া হিমালয় কে চিনে নিতে ভুল করো না প্রজন্ম।কাউকে লীগ করতে হবে না, দল করতে হবেনা, তবে সবাইকে ৭১ করতে হবে। মুজিবে এসেই সবাইকে থামতে হবে।
আমাদের গল্প যদি আপনার ভাল লাগে, শেখ মুজিবকে যদি আপনার ভাল লাগে তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে এই পোষ্ট শেয়ার করবেন।