| পর্ব : তেরো
অমিশা একটি মেয়ের নাম।
তার সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম কাহিনীর কথা শুনে একদিন আমি অজান্তেই চোখের জল ফেলেছিলাম। কেঁদেছিলাম অনেক্ষণ। সেদিন আমার খারাপ লেগেছিল ঠিকই তবে আজকের মতো নয়। আজ যখন আমারই সামনে আমার স্ত্রী’র গায়ে হাত দিলো, তখন আমার পুরো শরীর কেমন যেন রি-রি করে উঠল। একটা চাপা আর্তনাদ কাঁদিয়ে তুলল আমায়। আমি কাঁদলাম। তবে চোখে এক ফোঁটা জল এল না। ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। এই ধরুন, অমিশার কথাগুলো যখন শুনেছিলাম তখন আমি আবেগে কেঁদেছিলাম বটে তবে ব্যাপারটা অতো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। আমার মনে হয়, এসব বিষয় কোনো মানুষই তার পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উপলব্ধি করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনাটা তার সাথে কিংবা তার অতি আপন কারোর সাথে ঘটছে।
এবার যখন ঘটনাটা আমার অতি আপনজন আমার স্ত্রী দিজার সাথে ঘটল তখন আমার দু’চোখে অন্ধকার নেমে এল। চিৎকার দিয়ে বলে ফেললাম, আমি ওঁদেরকে সব প্রমাণ দিয়ে দেব। ভাবার বিষয় হচ্ছে, আমার কাছে তো কোনো প্রকার প্রমাণ নেই। এবার আমি ওদেরকে দেবটা কী? ওরা তো আর আমার মুখের কথায় বিশ্বাস করবে না! একবার যখন বলেছি প্রমাণ দেব তখন আবার কথা ফিরিয়ে নিলে বিপদ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। বলা তো যায় না, তিনগুণও হতে পারে! তাই একটু সতর্ক হয়ে রইলাম। যাতে করে আমি যে একটা “ডাহা মিথ্যা” বলেছি সেটা ওই লোকগুলো আন্দাজ করতে না পারে।
রিটায়ার অফিসার বশির এবার আস্তে করে চেয়ার টেনে আমার সামনে বসল। বসার ভঙ্গিটা এমন, যেন আমি ক্রিমিন্যাল আর উনি আমাকে জেরা করতে এসেছেন। যাকগে, আমি তার ভাবটা আরো বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করেই আসামির মতো মাথা নিচু করে বসে রইলাম। বশির পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল, “প্রমাণ কোথায় আছে?”
আমি খানিক ভেবে নিলাম। মিথ্যেই তো বলব! একটু ভেবেই বলি। ধরা পড়ে গেলে আবার নতুন বিপদ তৈরি হবে। কিন্তু অনেক্ষণ ভেবেও কোনো কুল কিনারা পেলাম না। এদিকে লোকটা প্রমাণের হদিস পাওয়ার জন্য অতি আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অবশেষে বিড়বিড় করে বললাম, “অমিশা ভিলা’য় লুকিয়ে রেখেছি।”
“কোথায়? অমিশা ভিলার কোথায়? কোন ফ্লোরে? না কি মাটির নিচে?” লোকটা ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করতে লাগল।
আমি ঢোক গিলে বললাম, “সেটা মুখে বললে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমাকে নিয়ে যান, দেখিয়ে দিচ্ছি।”
লোকটা ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। তারপর আমার সামনে থেকে উঠে গেল। খানিক পায়চারি করে আবার এসে বসে বলল, “ওকে ফাইন। তা-ই হবে। কিন্তু কোনো প্রকার চালাকি করলে আপনি এবং আপনার স্ত্রী দু’জনেই মারা পড়বেন।”
বললাম ঠিক আছে। তা-ই হবে। মরব নাহয় আমরা।
আমার স্বাভাবিক ভঙ্গি দেখে লোকটা আর সন্দেহ করার অবকাশ পেল না। বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়াল। তারপর কী কী করবে তা আমার সামনেই প্ল্যান করতে লাগল। এবং সেখান থেকে যতটুকু ধারণা জন্মাল, এইসব ক্রিমিন্যালরা স্বভাবতই অতি চালাক প্রকৃতির হয়। আর এই অতি চালাকি করতে গিয়েই শেষে ধরা খায়।
দেখুন, ওরা যা প্ল্যান করলো তা হলো, যদি আমাদেরকে ধরে বেঁধে গাড়ি করে অমিশা ভিলায় নিয়ে যায় তবে লোকজন সন্দেহ করতে পারে। তাই কারোর সন্দেহের তালিকায় না আসার জন্য ওরা প্ল্যান করল রাতে আমাদেরকে অমিশা ভিলায় নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়ে যদি কোনো রকম চালাকি আমি কিংবা দিজা করেছি তো আমাদের দু’জনকেই গুলি করে দেবে। মাঝখান দিয়ে আমিও ওদের প্ল্যানিংয়ে সামিল হলাম। বললাম, “সন্ধ্যের পর নিয়ে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। ওদিকটায় রাত বারোটা অবধি মানুষের আনাগোনা থাকে। এরচে’ গভীর রাতে গেলেই ভালো হবে। কারণ তখন তো আর কেউ থাকবে না।”
একজন ধমক দিলো। বলল, “চুপ কর। তোর বুদ্ধি আমাদের লাগবে না।” ঠিক তখনই বশির হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “কথাটা মন্দ নয়। আমরা মাঝরাতেই যাব। আপাতত বন্দি করে রাখো ওদের।”
তালাবদ্ধ ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখা হলো আমাদের। তবে মুখ বাঁধা নয়। আশপাশে দূর দূর পর্যন্ত লোকজন নেই বলেই হয়তো ওঁরা আমাদের মুখ বাঁধেনি। কারণ এমনিতেও এখানে সারাদিন চেঁচালে কেউ শুনতে আসবে না। এমন অবস্থায় কী করা উচিৎ তা তো আমি জানি না। তবে এতটুকু মনে হলো যে, এই মুহূর্তে দিজার পাশে গিয়ে বসা উচিৎ। কষ্টের ব্যাপার হলো আমরা দু’জন ঘরের দুই কোণে। সুতরাং দিজার কাছে যেতে অনেক কষ্ট পোহাতে হলো। মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অবশেষে দিয়ার গা ঘেঁষে বসতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি অসহায় ভঙ্গিতে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। একসময় দিজার কান্না থামল। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “এখন কী হবে? প্রমাণ কোত্থেকে পাবে তুমি?”
আমি বললাম, “জানো তো, যার কেউ নেই তার উপরওয়ালা আছেন। তিনি আমাদের বাঁচিয়ে দেবেন।”
“বি প্র্যাকটিক্যাল আরজু! উপরওয়ালা কি আমাদেরকে বলেছিলেন সেধে সেধে বিপদ ডেকে আনার জন্য?”
তখন চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে নিচু আওয়াজে বললাম, “আস্তে বলো। ওরা শুনতে পাবে তো!”
“কিন্তু এখন আমাদের কী হবে?” দিজা করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করল। আমি হেসে বললাম, “ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে।” এরপর দিজাও হাসল। বলল, “তুমি খুব পাজি লোক। তোমার সাথে থাকলে মরার সময়ও হাসতে হবে।”
আমি আহ্লাদী গলায় বললাম, “এত সহজে তোমায় মরতে দিচ্ছি না প্রিয়তমা।” দিজা ভ্রু কুঁচকে বলল, “কী চলছে তোমার মনে? এই মুহূর্তে তুমি এতটা কুল কীভাবে?”
আমি তখনও জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগলাম। দিজা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তার একজোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি পুনঃপুন পরখ করতে লাগল আমাকে। আমি তখনও মিটিমিটি হাসছি। আর ভাবছি, হাঁদারামগুলো স্বেচ্ছায় বিপদে পড়ছে যাচ্ছে। একবার রাত হোক তারপর বুঝবে।
বিকেলের পর এক নার্স এসেছে আমাদের সেবা করার জন্য। সে অতি যত্ন সহকারে আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আরো যেখানে যেখানে চোট লেগেছে সেখানে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। দিয়ার দিকটাও দেখল। খানিক বাদেই একটা লোক খাবার দিয়ে গেল। অনেক্ষণ না খাওয়া অবস্থায় থাকতে থাকতে এখন খাবার চোখের পড়তেই জিভে জল এল ঠিকই তবে খাবার খাওয়ার যে শর্ত বেঁধে দেওয়া হলো তা শুনে গলা শুকিয়ে গেল। শর্তটা এমন, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় খাবার খেতে হবে। মানে ওই নার্স মেয়েটা মুখে তুলে খাইয়ে দেবে আর আমরা খাব। কী মুশকিল বলুন তো! নিজের বউয়ের সামনে অন্য একজন খাইয়ে দিচ্ছে সে খাবার হজম করি কীভাবে? তাছাড়া এমন দৃশ্য দেখে দিজা যেভাবে বিষিয়ে বিষিয়ে উঠছিল তা দেখে তো আরো অবস্থা খারাপ। তার মুখ দেখে মনে হয় পারলে এখনি আমায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
আমাকে খাইয়ে দেবার পর নার্স দিজাকেও খাইয়ে দিতে চেয়েছিল। দিজা নার্স মেয়েটাকে এমন ধমক দিলো যে নার্স দ্বিতীয়বার খাইয়ে দেওয়ার কথা মুখে আনতে পারল না। এমনিতেই বেচারিকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয়ে আছে। হয়তো লোকগুলো তাকে ভয় দেখিয়ে কিংবা কোনো প্রকার বিপদে ফেলে এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের সেবা করার জন্য। যাকগে, ছাড়ুন ওসব কথা। এগুলো আপনারা না শুনলেও চলবে। আসল কথাটা বলি।
মাঝরাতে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঝিমাচ্ছিলাম। দিজা তখন আমার কোলের উপর মাথা রেখে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো রকম চিন্তা নেই, ভয় নেই, কৌতূহল নেই। মুরগির ছোটোছোটো বাচ্চারা যেমন মায়ের কোল পেলে চিঁউ চিঁউ করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে দিজা। আমি বসে বসে ঝিমাচ্ছিলাম। গত কয়েক রাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তাছাড়া শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝড়েছে। যার ফলে…
দ্রুত ক’জন লোক ঘরে ঢুকল। আমাদেরকে টেনে নিয়ে গেল মাইক্রোবাসের দিকে। দিজা হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠেছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে সে শান্ত ভাবেই গাড়ি পর্যন্ত গেল। আমাদের দু’জনের কপালে পিস্তল ঠেকাল দু’জন। এরপর মাইক্রোবাসটা মৃদু কম্পন তুলে চলতে শুরু করল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, অমিশা ভিলার সামনে যাবার পর গেট খোলার জন্য গাড়ি থেকে নামতে হয়নি। গেটটা আপনাআপনি খুলে গেছে। যেন রাতের অন্ধকারে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃস্তব্ধ বাড়িটা সাদরে আমন্ত্রণ জানাল আমাদের। গাড়িতে বসে থাকা কিডন্যাপার মানে বুদ্ধুগুলো তখনও বুঝতে পারল না কী হতে চলেছে তাদের সঙ্গে। গেট খোলা পেয়ে নির্দিধায় ভেতরে চলে গেল। একবার পেছনে ফিরে তাকালও না। তবে আমি স্পষ্ট টের পেলাম, গাড়িটা বাড়ির ভেতরে চলে আসার পর বাড়ির গেট আবার আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর একটা কালো অন্ধকার ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। লোকগুলো এখনও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি।
চলবে…………..