পর্ব : পাঁচ
মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী।
এদের কৌতূহলের শুরু আছে শেষ নেই। কৌতূহলে কেউ কেউ নীল হয়, কেউ হয় লাল। কেউ আবার সবুজ। এদের বদলে যাওয়া রং আবার খালি চোখে দেখা যায় না। কল্পনার রঙিন চশমা নাকের ডগায় রেখে দিলে তবেই দেখা যায়। যাহোক, যা বলতে চাচ্ছিলাম, সব মানুষের মতো আমিও কৌতূহলী। এবং এতটাই কৌতূহলী যে একবার কোনো রহস্যে আটকে গেলে সেটার সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই। এবার বলবেন, এরকমটা তো সবার ক্ষেত্রেই৷ কিন্তু না। সবার সমান না। আমার বেলায় একটু বেশিই। চলুন উদাহারণ দেওয়া যাক!
আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। সঠিক মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে, তখন বয়স পাঁচ বছর পেরিয়ে ছয় ছুঁইছুঁই। আমি আর মা আমাদের এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। তারা আবদার করে বসল বিয়ে শেষে চলে আসলে হবে না। ওঁদের বাসায় ক’টা দিন থাকতে হয়। আমার মা অমায়িক মানুষ। তিনি বিনয়ের সাথে তাদের আবদার রাখলেন। আমরা বিয়ের পর ক’টা দিন বিয়ে বাড়িতে থাকব। সে নাহয় হলো। এবার মূল ঘটনায় আসা যাক!
দুপুর নাগাদ। তখন কনভেনশন সেন্টারে মানুষ গিজগিজ করছে। আমি আর মা চেয়ারে বসে আছি৷ তখনও খাবার দেওয়া হয়নি। মা বললেন, “খোকা, তুই একটু বোস। আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি। এই যাব এই আসব। দু’মিনিট লাগবে। তুই এখানে বসে থাকিস। কোথাও যাস না যেন। গেলে আর কখনো আমাকে পাবি না।”
বলে মা চলে গেলেন। আমি বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ বসে রইলাম। আর তখন কোত্থেকে যেন একদল মেয়ে আমাকে ঘিরে ফেলল। একজন বলল, “ওলেলে, ছেলেটা কী কিউট। একদম হাবলা মার্কা।” বলেই হেসে ফেলল। অন্য একটা মেয়ে বলল, “কী বাবু? বিয়ে খেতে এসেছো? বিয়ের পর বাসর রাতে কী হয় তুমি জানো?”
অন্য একটা মেয়ে ধমক দিয়ে বলল, “কীসব বলছিস তোরা! এই বাচ্চা ছেলেটাকে এসব শেখাচ্ছিস! লজ্জাশরম কিছু আছে নাকি তোদের?”
মেয়েটা হেসে কুটিকুটি করে বলল, “তাতে কী! দেখছিস না বেচারার চোখদু’টো কেমন বড়ো বড়ো হয়ে গেছে? ভয় পেয়েছে মনে হয়।” বলে মুখ টিপে হাসল। আরো কী কী যেন বলেছিল সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই। তবে প্রথম কথাগুলো আমার এখনো মনে আছে। আমি সত্যি সত্যি ভাবতে বসে গিয়েছিলাম। আসলেই তো! বিয়ের পর কী হয়? আবারও বলে রাখি, আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। সেদিন রাতে যখন বাসরঘর সাজানো হচ্ছিল আমি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। সুযোগ বুঝে আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম৷ খানিক বাদে, যখন বাসরঘর সাজিয়ে সবাই বেরিয়ে গেছে তখন হৈচৈ শুরু হলো। গোলমালটা আমাকে নিয়েই। পুরো বাড়ি খুঁজে আমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কেউ জানে না, আমি বাসরঘরে টেবিলের নিচে চেয়ারের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছি।
আমাকে না পেয়ে মা কেঁদেই ফেলবেন তা আমি জানতাম। এজন্য আমার খারাপ লাগছিল। তবে রাতে কী হবে এ-নিয়ে আমার ভেতরে যে কৌতূহল জমেছিল তার সমাধান না হওয়া অবধি আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। যার ফলে চুপ করে টেবিলের নিচেই বসে রইলাম। তখন ঘরটায় দু’টো মানুষ। আমি আর সদ্য বিবাহিত নতুন বউ। মেয়েটা লম্বা ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে ছিল। কিছুক্ষণ পরপর ঘোমটা সরিয়ে চোখের জল মুছছিল। আমার একটু মায়া হলো। আহারে মেয়েটা!
রাত দশটা নাগাদ। না আরো বেশি হবে। বোধহয় এগারোটা। তখন ধড়াক করে দরজা খুলে গেল। বর দ্রুত এসে দরজা বন্ধ করে গায়ের শেরওয়ানি খুলতে খুলতে বিরক্ত গলায় বলল, “কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বলো তো! কই বিয়ে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় হবে। আনন্দ ফূর্তি হবে। তা না উল্টো কান্নাকাটি গন্ডগোল আর শোক চলছে। ডিসগাস্টিং। যত্তসব ফালতু ঝামেলা।”
নতুন বউ ঘোমটার আড়াল থেকেই বলল, “কী হয়েছে?”
“আর বোলো না। এক আত্মীয়ের ছেলেকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোও না! যত্তসব ত্যাঁদড়। গিয়ে দ্যাখো কোথায় গিয়ে বসে আছে। আর এদিকে ছেলের মা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ।”
“এজন্য এত শোরগোল শোনা যাচ্ছে?”
“নয়তো কী! ছেলেটাকে যদি একবার হাতের কাছে পাই তবে মাথার উপর তুলে এমন আছাড় মারব না। যে আর জীবনে তার মা’কে না বলে কোথাও যাবে না। যত্তসব ফালতু ঝামেলা। এখন বাসরের কথা ভুলে গিয়ে ছেলেটাতে খুঁজতে বেরোতে হবে। মরার কপাল!” বলে নিজের কপালে চাপড় মারল লোকটা।
নতুন বউ আলতো হেসে বলল, “খুঁজতে হবে না। ওই তো টেবিলের নিচে বসে আছে। নিয়ে যান।”
সেদিন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, “আর কখনো আমাকে না জানিয়ে কোথাও যাস না খোকা। তুই ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার।” মায়ের বলা কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে। দেখুন ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আমাকে দূরে যেতে মানা করে মা নিজেই আমাকে রেখে হারিয়ে গেছেন। বাস্তবতা কী কঠিন! কী নির্মম!
একবার ভাবুন তো, সেই কৌতূহলী আমি আজ ক’টা দিন যাবৎ অমিশা ভিলা’র রহস্যে আটকে আছি। যদিও কিছু রহস্য উদঘাটন হয়েছে। তেমনিভাবে আবার নতুন নতুন রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে এসেছে। যার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই।
বিকেলের পর এখনও সন্ধ্যে হয়নি। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। রেবা বেগম মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন। তার পরনের গোলাপি নতুন শাড়িটায় এখনও ভাঁজ পরেনি। বাঁ হাতটা বোধহয় তিনি ইচ্ছে করেই সামনে ঝুঁকিয়ে রেখেছেন। যাতে করে নতুন ব্রেসলেটটা আমার নজরে পড়ে। বাঙালী মেয়েরা অনেকটা এরকমই। কিছু একটা কিনবে অথচ লোক দেখাবে না তা কোনোভাবেই মানতে পারে না তারা।
টেবিলের উপরে রাখা চায়ের কাঁপ থেকে সাদা ধোঁয়া উড়ে উড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। রেবা বেগম একটু চিন্তিত। তিনি বিচলিত গলায় বললেন, “আমরা এখনও বিয়ে করিনি।”
“তবুও একসঙ্গে থাকছেন? ইসলামে এরকম সম্পর্ক হারাম।” আমি বললাম।
রেবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিয়ের কথা কি বলিনি ওঁকে? বহুবার বলেছি। তার দিক থেকে এ-ব্যাপারে কোনো রকম উদ্যোগ নেই।” খানিক চুপ থেকে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “মানুষটাকে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। সে কখন কী ভাবে আর কখন কী করে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না।”
“ক’দিনের সম্পর্ক আপনাদের?”
“অনেক বছর হয়ে গেছে। এখন আর হিসেব করি না। হিসেব করতে ভয় হয়। বয়স বাড়ছে। আমার প্রথম স্বামী মারা যাবার পর কখনো ভাবতেও পারিনি আর কোনো পুরুষ আমার জীবনে আসবে। কিন্তু কী করে যে কী হয়ে গেল…” বলতে বলতে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
“আপনার হাজবেন্ড। না মানে আপনার হবু হাজবেন্ড বা আপনার প্রেমিক। যার কথা আমরা বলছিলাম। তার নাম কি মোতালেব?”
রেবা বেগম আমার দিকে তাকালেন। চিন্তিত গলায় বললেন, “হ্যাঁ। আপনি জানলেন কীভাবে?”
জবাব না দিয়ে ফের প্রশ্ন করলাম, “আপনি বলেছিলেন অমিশার বাবা দূরে কোথাও চলে গেছেন। তা হলে উনি কে?”
মুহূর্তেই রেবা বেগমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি ইতস্তত করে বললেন, “আ-আমার কিছু কাজ আছে। একটু আসছি। আপনি চা’টা খেয়ে যাবেন কিন্তু। আর হ্যাঁ, দু’টো বিস্কিটও নেবেন।” বলে তিনি দায়সারাভাবে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আমি চায়ের কাপে দু’বার চুমুক দিয়ে পকেট থেকে একটি সাদা কাগজ বের করলাম। সাথে একটি কলম। কাগজে লিখলাম, মিস রেবা বেগম, জানি আপনি আমার থেকে অনেক কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে একটুও ভালো ঠেকছে না। সত্য লুকিয়ে রাখা আপনার জন্য শোভনীয় হবে না। তা ছাড়া আপনি হয়তো জানেন, সত্য কখনো চাপা থাকে না। তাই অনুরোধ রইল, লুকিয়ে না রেখে সব সত্য আমাকে বলবেন। আমি আপনাদের ভালো চাই। তাই আবার আসব। আর হ্যাঁ, আপনার হাতের চায়ের স্বাদ সত্যিই খুব অসাধারণ। ইতি, অমিশা ভিলার ভাড়াটিয়া।
চিঠিটা টেবিলে রেখে বেরিয়ে এলাম। আকাশ পরিষ্কার। তবে অন্ধকার নেমে যাচ্ছে। বাঁ পাশের মুদি দোকানে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাত হতে বেশি দেরি নেই।
চলবে…..