পর্ব : সাত
অমিশা।
যার কথা এতদিন ধরে বলছি আপনাদের।
যাকে নিয়ে এই পুরো গল্পটা। যাকে ঘিরে এত রহস্য। সেই অমিশা এখন আমার সামনে বসে আছে। চুপচাপ, কথা নেই। নড়াচড়া নেই। নিঃশ্বাস অবধি নিচ্ছে না। জড়ো পদার্থের মতো বিছানায় বসে আছে। আমি তার থেকে খানি দূরে দাঁড়িয়ে। হাতে ব্যাগ। ব্যাগে সব কাপড়চোপড়, পাসপোর্ট সহ অন্য সব জিনিসপত্র। কাল সকালেই রওনা দিতে হবে।
আজকের আগে মেয়েটাকে এত কাছ থেকে এত ভালো করে দেখা হয়নি। এতদিন পর আজ প্রথমবারের মতো অমিশার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছি। তার ফরসা গোলগাল চেহারা। ভেজা জবজবা চোখ। ফাটা ঠোঁট। ঠোঁটের কোণে জমে থাকা শুকনো রক্ত। ঘাড়ে আঁচড়ের দাগ। সবকিছুই নজড়ে আসছে। পুরোপুরি অন্ধকার ঘরে বসেও আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। আচ্ছা, মেয়েটার বয়স এখন কত হবে? পঁচিশ? ছাব্বিশ? কিন্তু দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না! দেখে মনে হচ্ছে সদ্য কুড়ি বসন্তে পা দিয়েছে মেয়েটা।
একফোঁটা জল অমিশার চোখ বেয়ে মেঝেতে পড়ল। সেই সাথে আমার ভেতরটাও কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। ইচ্ছে করছে কাছে গিয়ে মেয়েটার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখি। সান্ত্বনা দেই। চোখের জলটুকু মুছে দেই। কিন্তু সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয় না! আমার ইচ্ছেটাও সেরকমই। অনেক্ষণ চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটুকু অজান্তেই আমার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে গেল। আরো এক ফোঁটা জল পড়েছে অমিশার চোখ থেকে। মেয়েটা বারবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। তার ফাটা ঠোঁটদ্বয় কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। আমি কী করব ভেবে না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই একটা শব্দ ঘিরে রেখেছে আমাদের। রাত বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে অমিশার কান্নার ঢেউ।
“আ-আমি আজ আপনাকে সব বলব। তারপর, তারপর আপনার যেখানে খুশি আপনি সেখানেই চলে যাবেন। আমি বাধা দেব না।” অমিশা ভাঙা ভাঙা গলায় বলল। কথাগুলো তার গলায় বারবার আটকে যাচ্ছিল। যার ফলে টেনে টেনে বলেছে।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে ব্যাগটা মেঝেতে পড়ে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করিনি। অমিশার কান্না আমাকে এতটাই ভাবিয়ে তুলেছে যে, এখন আর কোনো কিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
অমিশা আবার ভাঙা ভাঙা স্বরে বলতে শুরু করল, “আপনি যাকে আমার বাবা মনে করেন। মানে মোতালেব নামের লোকটা। তিনি আমার আসল বাবা নন। আমার বয়স যখন চার বছর তখন বাবা মারা যান। এরপর বহু বছর মা আমাকে নিয়ে একা থেকেছেন। বাবা মারা যাওয়ার আগে যে পরিমাণ সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন তা দিয়ে আমাদের বেশ ভালোভাবেই চলছিল। একদিন মোতালেব নামক লোকটা ঝড়ের মতো আমাদের জীবনে এল। মায়ের সাথে পরিচয়। একসময় মা লোকটার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লোকটা আস্ত অকর্মা। এতটাই অকর্মা যে তার পরিবারের লোকজন তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মায়ের সাথে পরিচয়ের পর প্রায়ই আমাদের বাসায় আসত। মা তাকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। প্রথম প্রথম লোকটা দিনের বেলা আসত। গল্পটল্প করে কিছুক্ষণ পর চলে যেত। যাবার সময় মা তার হাতে টাকা গুঁজে দিতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক আরো এগিয়ে যায়। লোকটা রাতের বেলা আমাদের বাসায় আসতে থাকে। সে যেদিন আমাদের বাসায় আসত সেদিন মা আমাকে একা ঘরে ঘুম পাড়িয়ে অন্য ঘরে গিয়ে শুতেন। ওই লোকটার সঙ্গে।”
এতটুকু বলে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল অমিশা। আমি আগ্রহের সাথে বললাম, “তারপর?”
“তারপর থেকেই আমাদের জীবনে পরিবর্তন হতে শুরু করে। মা আর লোকটার ব্যাপারে লোকজন নানা কথা বলাবলি করছিল। শেষে তারা বিয়ে করে নেয়। আর বিয়ের পরই মা লোকটার আসল চেহারা দেখতে পান। লোকটা রাতের পর রাত জুয়া খেলত। টাকা পয়সা সব শেষ করে আবার মায়ের কাছে টাকা চাইত। টাকা না দিলে মা’র গায়ে হাত তুলত। এসব আমি নিজ চোখে দেখেও প্রতিবাদ করতে পারিনি। কারণ তখন আমি ছোটো ছিলাম। কিন্তু যখন বড়ো হলাম তখন…”
বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল অমিশা। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিক বাদে সে আবার বলতে শুরু করল, “লোকটার জুয়ার খরচ জোগাতে আমাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। আমার মায়ের যখন কঠিন রোগ হলো, তখন আমরা জানতেও পারলাম না রোগটা কী। চিকিৎসা তো অনেক দূর! কারণ তখন সে পরিমাণ অর্থ আমাদের ছিল না। শেষে মা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। এর সপ্তাহখানেক পরেই লোকটা আপনাদের বাসায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল আমার পড়াশোনার খরচের কথা বলে আপনার মায়ের থেকে কিছু টাকা এনে জুয়া খেলার। কিন্তু আপনার মা আমাকে পুরো বাড়িটাই লিখে দিলেন। যা লোকটা ভাবতেও পারেনি।”
“এই বাড়িটা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই কি আপনাকে খুন করেছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
অমিশা ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়াল, “না। সম্পত্তির জন্য নয়। বাড়ি পাওয়ার পর বদলে গিয়েছিল লোকটা। আমার বেশ যত্ন নিত। কয়েক বছরের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম আমি ওর সৎ মেয়ে। মা হারানোর ব্যথা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু একদিন। এক মুহূর্তের ঝড় আমার জীবনটা তোলপাড় করে দিয়ে গেল।” বলে থামল অমিশা।
ঘড়ির কাটা বরাবর তিনটায় ঠেকেছে। নিঃস্তব্ধ বাড়িটায় অমিশার গুণগুণ করে কান্নার শব্দ ভাসছে। আরো একটা শব্দ। ঘড়ির কাটার টিক টিক টিক। আমার শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। এখনি মেঝেতে ঢলে পড়ে গেলে ভালো হত। খেয়াল করলাম অমিশা আমার দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। সে চোখ মুছে মিয়ানো গলায় বলল, “আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অমিশা বিছানা থেকে নেমে এসে আমার বুকে তার মাথা আলতো করে চেপে ধরল৷ আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অমিশা ফিসফিস করে বলল, “আপনার মতো মানুষ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। কেবলমাত্র আপনাকেই আমি চোখ বুঁজে বিশ্বাস করতে পারি।”
হঠাৎ মাথা উঁচু করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, আপনি বিয়ে করেছেন? বউ আছে আপনার?”
আমি সংক্ষেপে বললাম, “হুঁ।”
সঙ্গে সঙ্গে অমিশা আমার থেকে দূরে সরে গেল। মিনমিন করে বলল, “কী নাম তার?”
“দিজা।”
“দিজা? বেশ সুন্দর নাম তো! দেখতেও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর?”
“খুব।” বলে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লাম আমি। দেশে এসেছি এতদিন হয়ে গেল তন্মধ্যে একটি বারের জন্যও দিজাকে ফোন করিনি। আমি নাহয় অমিশা ভিলার গোলকধাঁধায় ফেঁসে সবকিছু গুলিয়ে ফেলছি। কিন্তু দিজা? সে তো অন্তত একবার আমাকে ফোন করতে পারত! তার কিছু হয়ে যায়নি তো!
অমিশা ক্ষীণ গলায় বলল, “আমার বাকি কাহিনীটুকু শুনবেন না?”
আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম৷ বললাম, “হ্যাঁ, বলুন।”
অমিশা আবার বলতে শুরু করল, “দু’বছর আগের কথা। একদিন সন্ধের পর বাড়ি ফিরছিলাম। সেদিন খুব বাতাস বইছিল। সঙ্গে ভারী বর্ষণ। সঙ্গে ছাতা থাকা সত্ত্বেও সারা গা ভিজে গিয়েছিল। হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা গাড়ি আমার সামনে এসে ব্রেক কষল। সেই গাড়ি থেকে নেমে এল সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা পরা এক লোক। লোকটা আমাকে গাড়িতে উঠতে বলল। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। তার মতলব ভালো ঠেকছিল না বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে এলাম বাসায়। ঘরে প্রবেশ করে ভেজা কাপড় ছেড়ে সালোয়ার কামিজ গায়ে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেরোতেই দেখি বসার ঘরে মোতালেব মানে আমার সৎ বাবা লোকটার সাথে কথা বলছে। লোকটা বাবার বন্ধু অথচ তাকে আমি রাস্তায় অপমান করে এসেছি এই ভেবে লজ্জা পেলাম। মোতালেব কার্লপ্রিট আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, “শোন রে মা, ইনি হলেন রিটায়ার পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হাসান। বেশ ভালো মানুষ। আরো কী কী যেন বলল। তার মিষ্টি কথায় আমি ভাবতেও পারিনি সেদিন রাতে আমার জীবনে এতকিছু হয়ে যাবে।”
বলতে বলতে থেমে গেল অমিশা। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে ধরা গলায় বলল, “সেদিন রাতে মোতালেব দরজায় টুকা দিলো। আমি তখনও ভাবিনি বাবা হয়ে লোকটা আমার সাথে এমন করবে। দরজা খুলতেই কার্লপ্রিটটা ওই রিটায়ার্ড অফিসারকে ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো।”
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “আর বলবেন না প্লিজ।”
“এতটুকু শুনেই হাঁপিয়ে উঠেছেন? বাকিটা শুনবেন না?”
“না, প্লিজ।”
“আচ্ছা, শুধু এতটুকু শুনুন, একবার ধর্ষিত হওয়ার পর আমি পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। পালানোর সময় মোতালেব লোহার রড দিয়ে আমার পা ভেঙে দিলো। আমি চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। সেই বৃষ্টিভেজা রাতে কেউ শুনেনি আমার চিৎকার। কেউ এসে বাধা দেয়নি ওদের। আমি মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছিলাম। তখন অফিসার বড়ো অঙ্কের টাকা অফার করে বলল আমাকে মেরে সব প্রমাণ মিটিয়ে দিতে। আমি বেঁচে থাকলে ওর ইমেজ নষ্ট হতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় কী জানেন? আমি যাকে বাবা ভাবতাম সেই লোকটাই আমার মুখে বালিশচাপা দেয়। এরপর আমার লাশটা ওরা কী করেছে তা আমি আজও জানতে পারিনি।”
অমিশা কথা বলতে বলতে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মসজিদের মিনার থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আমার চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে। ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়ালাম। কাল কী হবে কে জানে!
চলবে……….