পদার্থের ঘনত্ব নিরূপক সূত্র উদ্ভাবক আর্কিমিডিস ছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের স্থপতি। বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন তিনি। বিজ্ঞানের অসীম শক্তিকে কি করে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করা যায়, তাই ছিলো তাঁর একমাত্র সাধনা।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের দুশো সাতাশি বছর আগে সিসিলির সিরাকিউজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন আর্কিমিডিস(Archimedes)। সে সময় সিসিলি ছিলো গ্রীসের অধীনস্ত একটি ক্ষুদ্র রাজ্য। এ রাজ্যের রাজার নাম ছিলো হিরো। আর্কিমিডিসের বাবা ফিডিয়াস ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি।জ্যোতির্বিদ হিসেবে বেশ খ্যাতি ছিলো তার। রাজা হিরোর সাথে ছিলো তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
আর্কিমিডিস এর লেখাপড়া
ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী ছিলেন আর্কিমিডিস।তাঁর বাবা খুব যত্ন করে অংক আর জ্যামিতিতে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন তাকে। সম্ভবত সে কারণেই অংক ও জ্যামিতির প্রতি আমৃত্যু তীব্র আকর্ষণ অনুভব করে গেছেন আর্কিমিডিস।প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হলে ফিডিয়াস আর্কিমিডিসকে আলেকজান্ডারিয়া।শহরে পাঠিয়ে দেন। সেকালে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিখ্যাত ছিলো মিশরের এশহরটি। সেখানে গিয়ে আর্কিমিডিস শিক্ষা গ্রহণ করেন মহাজ্ঞানী কেননের কাছে। এ কেনন ছিলেন বিশ্বখ্যাত গণিতজ্ঞ ইউক্লিডের ছাত্র।ছেলেবেলা থেকেই মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে সময় কাটাতেন আর্কিমিডিস। মানুষের সমস্যা বিচলিত করে তুললো তাঁকে। সব সময় তিনি খুঁজে ফিরতেন বিজ্ঞানকে মানব কল্যাণে লাগানোর বিভিন্ন উপায়।দীঘ তিন বছর আলেকজান্ডারিয়ায় কাটিয়ে আবার একদিন সিরাকিউজে ফিরে আসেন আর্কিমিডিস। এর কিছুদিনের ভেতর চারদিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। রাজা হিরোও তাই খুব স্নেহের চোখে দেখেন তাঁকে।
সে যুগে প্রমাণসিদ্ধ বিজ্ঞান বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিলো না।মানুষ শিক্ষিত লোকদের মুখে যা শুনতো তাই বিশ্বাস করতো অকাট্য সত্য বলে। কিন্তু আর্কিমিডিস পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বিজ্ঞান সম্পর্কীত কোনো কথাকেই বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না। এ কারণে প্রচলিত অনেক মতবাদের সাথেই দ্বিমত পোষন করতে দেখা যেতো তাকে। তবে সবাই এ কথাও স্বীকার করতো, তাঁর মতো মহাবিজ্ঞানী দ্বিতীয় কেউ নেই-সুতরাং প্রচলিত মতবাদের সাথে তাঁর দ্বিমত থাকতেই পারে।
একবার যুদ্ধ জয় শেষে রাজা হিরো সিদ্ধান্ত নেন দেবতার মন্দিরে।একটি সোনার মুকুট উপহার দেবেন। সিসিলির সবচেয়ে বিখ্যাত।স্বর্ণকারকে ডেকে রাজা খুলে জানান তার মনের কথা। ক’দিন পর স্বর্ণকার।অপূর্ব সুন্দর একটি মুকুট বানিয়ে রাজার কাছে নিয়ে আসে স্বর্ণকারকে।রাজা জিজ্ঞেস করেন, এই মুকুটের সোনার সাথে কোনো খাদ মিশিয়েছো
কি?
স্বর্ণকার জবাব দেয়, জ্বি না। এ একেবারে খাটি সোনার গড়া।একবিন্দুও খাদ মেশানো হয়নি এতে।স্বর্ণকারের জবাব শুনেও সন্দেহ যায় না রাজার। তিনি সিদ্ধান্ত নেন।ব্যাপারটা যাচাই করে দেখবেন। কিন্তু কিভাবে দেখবেন? এতো সুন্দর করে বানানো মুকুটটিকে না গলিয়ে তো আর খাদ আছে কিনা তা যাচাই করা যাবে না। অথচ মুকুটটিকে গলাতেও ইচ্ছে হয় না তার। কি করে এ সমস্যার সমাধান করবেন তিনি?
কোনো সমস্যার সমাধান করার প্রয়োজন হলেই রাজা হিরোর সবচেয়ে আগে মনে পড়তো আর্কিমিডিসের কথা।
এবারো তার ব্যতিক্রম হলো না।রাজা আর্কিমিডিসকে ডেকে বললেন, এ মুকুটটিতে খাটি সোনার সাথে খাদ মেশানো হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে বলতে হবে তোমাকে। তবেমুকুটটি ভাঙ্গা চলবে না। এটিকে অটুট রেখেই তোমাকে সমাধানে পৌছতে হবে।রাজার কথা শুনে আর্কিমিডিস পড়েন মহা ভাবনায়। মুকুটটি না ভেঙে এ সমস্যার সমাধান করবেন তিনি কেমন করে? এও কি সম্ভব? অথচ সমাধান তাকে পেতেই হবে। নইলে রাজার কাছে অপদস্থই হবেন না।শুধু নিজের কাছেও খুব ছোট মনে হবে তাঁকে।
এমনি সব ভাবনা মাথায় নিয়ে একদিন আর্কিমিডিস গেছেন গোসল করার জন্য। পানি ভর্তি হাউসে নেমে গোসল করা ছিলো তাঁর প্রতিদিনের অভ্যাস। আজও হাউসের ভেতর নেমে যান তিনি। আর অমনি হাউসের কিনারা উপচে কিছুটা পানি পড়ে যায় বাইরে। এমন তো প্রতিদিনই ঘটে।কিন্তু সেদিন এ ঘটনাটি ঘটতেই চমকে ওঠেন আর্কিমিডিস। চকিতে একটি প্রশ্ন উকি দেয় তার মনে।তিনি ভাবেন,গোসল করার জন্য হাউসে নামলে হাউসের পানির আয়তন বেড়ে যায় কেনো?তবে কি এটা সম্ভবত হচ্ছে একটি পদার্থের সাথে অন্য একটি পদার্থ মিশে গিয়ে তার পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়ার কারণে। তাহলে তো যে পানিটুকু পড়ে যায় সেটুকুই অতিরিক্ত পদার্থের ওজন।
আর্কিমিডিস তার ধারণার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য রাজার দেয়া সেই মুকুটটি এনে ছেড়ে দেন হাউসের মাঝে।ফলে কিছুটা পানি উপচে পড়ে হাউস থেকে। দ্বিতীয় বার মুকুটটির সমপরিমাণ খাঁটি সোনা হাউসে ডুবে দেখতে পান; এবার অপসারিত হয়েছে আগের তুলনায় কম পানি।এটি হয়েছে খাঁটি সোনা এবং খাঁদ মেশানো সোনার ওজনের তারতম্যের কারণে।
শোনা যায়, এই আবিষ্কার আর্কিমিডিস কে এতোটাই আত্মহারা করে তুলেছিল যে
দিক বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে ইউরেকা ইউরেকা বলে নগ্নদেহে পথে বেড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি! গ্রিক ভাষায় ইউরেকা শব্দের অর্থ ‘পেয়েছি’।
পদার্থের ঘনত্ব পরিমাপের সূত্র খুঁজে পেয়ে এমন দিশেহারা অবস্থা হয়েছিলো তাঁর।
যা হোক, আর্কিমিডিসের অভিযোগ শুনে রাজা ডেকে পাঠান স্বর্ণকারকে। উপায় না দেখে স্বর্ণার স্বীকার করে তার অপরাধ । সত্যি সত্যিই যে সে কিছুটা খাদ মিশিয়েছিলো মুকুটটি বানাবার সময়। তা স্বীকার না করে উপায়ও ছিলো না তার। স্বর্ণকারের স্বীকারোক্তির সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার। এটি আর্কিমিডিসের পদার্থের ঘনত্ব নিরূপক সূত্র নামে খ্যাত। এটিকে আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ণয়ের তত্ত্বও বলা হয়।পদার্থের ঘনত্ব নিরূপক সূত্র আবিষ্কারের আগেও আরেকটি আবিষ্কারকরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন আর্কিমিডিস। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য আর্কিমিডিস যখন আলেকজান্ডারিয়া গিয়েছিলেন, তখনই তিনিদেখেছিলেন পানির অভাবে মিসরীয় কৃষকদের সীমাহীন কষ্ট।
তখন থেকেই আর্কিমিডিস খুঁজে ফিরেছেন নদী থেকে সহজ উপায়ে পানি সরবরাহের পথ।অবশেষে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পেঁচওয়ালা একটি ধাতব যন্ত্র বানাতে সক্ষম হন তিনি। এ যন্ত্রটির এক মুখ নদীতে ডুবিয়ে হাতল ধরে ঘোরাতে থাকলে খুব সহজেই নদী থেকে পানি তোলা যেতো।সেকালে এ যন্ত্রটি মরুভূমি এলাকায় কৃষিবিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলো। আর্কিমিডিসের স্কু’ নামে এ যন্ত্রটি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।
যান্ত্রিক কোনো কিছু আবিষ্কারের চেয়ে অংক আর জ্যামিতি নিয়ে সময় কাটাতেই বেশি ভালোবাসতেন আর্কিমিডিস।
রাতদিন অংক আর জ্যামিতির আঁকিবুকি নিয়েই পড়ে থাকতেন তিনি। আর্কিমিডিস বিশ্বাস করতেন, যে জিনিস অংক কষে প্রমাণ করা যায়, তার চেয়ে নির্ভুল প্রমাণ আর কোনো ভাবেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
এভাবে অংক কষে কষে বিখ্যাত একটি আবিষ্কারের সূত্র পেয়ে যান আর্কিমিডিস।তখন তিনি রাজাকে গিয়ে বলেন, মহামান্য রাজা।কেউ যদি আমাকে পৃথিবীর বাইরে দাঁড়াবার মতো একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারে,তবে আমি সামান্য বল প্রয়োগ করে এ পৃথিবীকে উল্টে দিতে পারব।
রাজা হিরো খুব স্নেহ করতেন আর্কিমিডিসকে। তাই এই অদ্ভত কথা শুনে রেগে না গিয়ে মুচকি হেসে তিনি বলেন, পৃথিবীর বাইরে দাঁড়াতে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি বরং সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়াবার ব্যবস্থা করে দিই। মাল ভরতি একটি জাহাজকে টেনে তুলে তুমি তোমার আবিষ্কারের মহাত্ম দেখাও।
অবশেষে তাই করা হয়। বিশাল একটি জাহাজে রাজ্যের মালপত্তর তুলে তার সাথে বাঁধা হয় একটি লম্বা রশি। আর্কিমিডিস সেই রশিটির একপ্রান্ত বাঁধেন তার আবিষ্কৃত কপিকলের সাথে। তারপর কপিকল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একাকীই মাল বোঝাই সেই জাহাজটিকে টেনে তোলেন সমুদ্রের তীরে। আর্কিমিডিসের সেই সামান্য যন্ত্রটির অসামান্য ক্ষমতা দেখে অভিভূত হন রাজা; বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় বিশ্ববাসী।
যোদ্ধা আর্কিমিডিস
যীশু খ্রিষ্টের জন্মের ২১৫ বছর আগে পরাক্রমশালী রোম আচমকা আক্রমণ করে ক্ষুদ্র রাজ্য সিসিলি। সিসিলির রাজা হিরো শত্রুসৈন্যের হাত থেকে আত্মরক্ষার উপায় খুঁজে বের করার জন্য অনুরোধ করেন আর্কিমিডিসকে। অংক আর জ্যামিতির খাতা বন্ধ রেখে আর্কিমিডিসও লেগে পড়েন যুদ্ধাস্ত্র বানানোর কাজে। অবশেষে আতশী কাচ ব্যবহার করে তৈরি করেন এমন এক যুদ্ধাস্ত্র। যার সাহায্যে সূর্যের আলোকে বহু গুণে প্রতিফলিত করে আগুন লাগিয়ে দেয়া সম্ভব হয় রোমানীয় সৈন্য বোঝা জাহাজে।
সেবার আর্কিমিডিসের এই আতশী কামানের সাহায্যেই আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন রাজা হিরো। রোমের হাত থেকে রক্ষা পায় সিসিলি ।এরপর অবশ্য স্প্রীংকে কাজে লাগিয়ে ‘ক্যাটাপাল্ট’ নামে এক ধরনের পাথর ছোড়ার কামানও আবিষ্কার করেন আর্কিমিডিস।
রোমকদের সেনাপতির নাম ছিলো মার্সেলাস। খুব বীর ও জ্ঞানী লোক ছিলেন তিনি। আর্কিমিডিসকে শ্রদ্ধা করতেন মার্সেলাস। খ্রিস্টপূর্ব ২১৫সালে সিসিলি বাসীর হাতে পরাজিত হবার পর আবার তিনি আক্রমণ করেন সিসিলি । ততোদিনে রাজা হিরো মারা যাওয়ায় সিসিলির সিংহাসনেবসেছিলেন তারই পুত্র গ্যালো।তিনি পিতার মতো ততোটা সাহসী ছিলেন না।সুতরাং রোমকদের কাছে একসময় পরাজয় বরণে বাধ্য হন তিনি।
সেনাপতি মার্সেলাস কিন্তু তার সৈন্যদের বলে দিয়েছিলেন; আর্কিমিডিসের গায়ে ফুলের টোকাটি না দেয়ার জন্য। কিন্তু মৃত্যু যদি লেখা থাকে কপালে, তো কে রক্ষা করবে আর্কিমিডিসকে?
যেদিন সিরাকিউজ শহরের পতন হয় সেদিন পাঠাগারে বসে; আর্কিমিডিস এঁকে চলছিলেন জ্যামিতির সব দুর্বোধ্য আঁকিবুকি।
সৈন্যরা তাঁর সামনে গিয়ে বলে, আমাদের সেনাপতি এক্ষুনি ডেকে পাঠিয়েছেন আপনাকে।চলুন আমাদের সাথে ।আর্কিমিডিস জবাব দেন, তার সাথে তো আমার কোনো প্রয়োজন নেই । ঠিক আছে তাকে গিয়ে বলো, এই জ্যামিতিটা শেষ করেই আমি যাবো দেখা করার জন্য।
আর্কিমিডিসের জবাব শুনে রেগে যায় সৈন্যরা।
এতো সাহস পরাজিত দেশের এই বৃদ্ধ লোকটির! একে মেরে ফেললে কি বা ক্ষতি হবে তাদের!এ কথা ভেবে এক সৈনিক আর্কিমিডিসের ওপর বসিয়ে দেয় তলোয়ারের এক কোপ। আর অমনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মহাবিজ্ঞানী আর্কিমিডিস। যীশু খ্রিস্টের জন্মের দুশো বারো বছর আগে বর্বর রোমান সৈনিকদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
সেনাপতি মার্সেলাস কিন্তু খুব ব্যথা পান আর্কিমিডিসের মৃত্যুর কথা শুনে। কারণ সত্যি সত্যিই তিনি মনেপ্রাণে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন সর্বকালের সেরা এই বিজ্ঞানীকে। মার্সেলিস সম্মানের সাথে আর্কিমিডিসের দেহ কবর দেয়ার ব্যবস্থা করেন।আর্কিমিডিসকে হত্যা করার অপরাধে হত্যাকারী সেই রোমানীয় সৈনিকের ক্ষতি হয়েছিলো কিনা জানা যায়নি, কিন্তু বিশ্ববাসীর ক্ষতি হয়েছিলো অপূরণীয়।
স্যার আইজ্যাক নিউটন এর জীবনি।