১.প্রতিশোধ নিয়ে স্ট্যাটাস
প্রায় ৬ মাস আগে আমার সামনের ফ্ল্যাটের নতুন প্রতিবেশী ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ড চাইলো। দিয়েও দিলাম, কারণ আমার তো আর অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে না; এছাড়া নতুন প্রতিবেশীর সাথে একটু খাতিরও হলো।
গতকাল বাসায় ফিরছিলাম। উনাকে দরজার সামনে দেখে কুশল বিনিময় ও হাল্কা আলাপের মাঝে জানালেন যে সম্প্রতি উনি নেটফ্লিক্স এ সাবস্ক্রাইব করেছেন এবং নতুন নতুন ম্যুভি দেখে সময়টা ভালোই কাটছে। মজা করে বললাম -” ভাই সারাদিন এতো ব্যস্ত থাকি যে টিভি দেখার সময়ই পাই না। আপনার নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ডটা দিলে আমিও মাঝে মাঝে দুই-একটা সিরিয়াল দেখতাম।”
উনার ঘরের দরজা খোলা ছিল। ভিতর থেকে উনার গিন্নি প্রায় বেশ জোরে বলে উঠলেন-“পাসওয়ার্ড দিতে পারবো না। আমরা পয়সা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করেছি, পাসওয়ার্ড কেনো দিবো?”
কয়েক মুহূর্তের নিরবতা ভদ্রলোক ভাংলেন অপ্রস্তুত হাসি আর টুকটাক আলাপ শুরু করে। আমিও পালটা হাসি দিয়ে- “আরে কোন সমস্যা না” বলে নিজের বাসায় ঢুকে গেলাম।
কিছুক্ষন পর ভদ্রলোক আর তার গিন্নি হন্তদন্ত হয়ে বেল বাজালেন- দরজা খুলতেই জানালেন যে ওয়াইফাই কাজ করছে না, পাসওয়ার্ডও নিচ্ছে না, আর নেটফ্লিক্সও চালাতে পারছেন না।
এবার মুচকি হাসি দিয়ে বললাম- জি, পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়েছি। ইন্টারনেট বিলটা যেহেতু আমিই দিচ্ছি তাই পাসওয়ার্ড শেয়ার করবোনা ঠিক করেছি। মুখ শুকনা করে তারা ফিরে গেলেন। এর পর আর তাদের সাথে আন্তরিকতার দেখানোর প্রয়োজন অনুভব করিনি।”
লেখাটি একটা ইংরেজি লেখার অনুবাদ। তবে এর থেকে কিছু শিক্ষা অবশ্যই নেওয়া যায়-
বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা, আন্তরিকতা, সন্মান এই সব কিছুই হওয়া উচিৎ পারস্পরিক।
নিরবতার বদলে নিরবতা, শুন্যতার বদলে শুন্যতা, মায়ার বদলে মায়া, অনুভূতির বদলে অনুভূতি, আনুগত্যর বদলে আনুগত্য, সন্মানের বদলে সন্মান- এভাবে চলতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব। এতে জীবনটা অনেক অনেক শান্তিময় হবে।
(সংগৃহীত) DM for the credit
২.সম্মান নিয়ে উক্তি
তিতলি প্রতিদিনের মতো আজ বিকেলেও শাশুড়ির রুমে চা দিতে এসেছিল।আসর নামাজের পর প্রতিদিন চা খাওয়ার অভ্যাস তিতলির শাশুড়ি আফরোজা খানের।বাড়ি ভর্তি কাজের লোক থাকলেও বিকেলের চা নিয়ম করে তিতলি কেই দিতে হয় শাশুড়িকে।
শুধু চা কেন ?
রান্না ঘরের কাজ হতে শুরু করে ঘরের অধিকাংশ কাজ তিতলি কেই করতে হয়।বাড়িতে আরও দুইজন বউ থাকলেও তিতলি কেই ঘরের কাজ গুলো চাপিয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি।
আজকে চা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে শাশুড়ি পেছন থেকে ডাক দিয়ে তিতলিকে দাঁড়াতে বললেন।তিতলি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে শাশুড়ির কাছে দাঁড়ালে শাশুড়ির কথা শুনে বেশ চমকে উঠলো।
আফরোজা খান বেশ ঝাঁঝালো স্বরেই বললেন বউমা আমার সংসারে টাকার গাছ লাগাইনি যে যাকে তাকে টাকা বিলিয়ে বেড়াবে।আর এই যে কি এক চাকরির বাহানা দিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলে পরে থাকো কই কখনো তো আমার সংসারে দুই পয়সা খরচ করতে দেখলাম না অথচ বাবার বাড়িতে ঠিকই টাকা পয়সা চালান করো।আমার ছেলে কষ্ট করে রোজগার করে সেই টাকায় নিজে ফূর্তি আমোদ করো আবার বাবার বাড়িতে টাকা পাঠাও।
তোমার বাবার তো চাঁদ কপাল এতবড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন বিনে পয়সায়।আমরা কিছু চাইনি বলে একেবারে ফকিরের মতো মেয়েকে গছিয়ে দিলেন?
আমার বড় দুইটা ছেলেকে বিয়ে করিয়েছি ঘরভর্তি করে জিনিস পত্র দিয়েছে গত দেড় বছর ধরে তো নিজের চোখেই দেখছো বড় দুই বৌমার বাবার বাড়ি থেকে মেয়েদের শ্বশুর বাড়িতে আদর আপ্যায়ন কিভাবে করতে হয়।
এসব দেখেও তোমার বাবা মা আর তোমার আক্কেল জ্ঞান হয় না?
তিতলি এই খান বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে দেড় বছর। বিয়ের পর থেকেই তিতলি দেখে আসছে শাশুড়ি আফরোজা খান তিতলিকে পছন্দ করেন না।সময়ে অসময়ে বাবার বাড়ি নিয়ে খোঁচা দিয়ে কথা বলেন।
অথচ তিতলির বড় দুই জায়ের সাথে শাশুড়ি কখনোই এটা করে না। তিতলি নাকি মধ্যবিত্ত পরিবারের মফস্বলের মেয়ে।তিতলির হাই ক্লাস শ্বশুর বাড়ির পরিবারের সাথে তিতলির মতো সাধারণ পরিবারের মেয়ে মানানসই না।বিয়ের পর থেকেই এরকম বৈষম্য আচরন দেখে আসলেও চুপচাপ শান্ত স্বভাবের তিতলি কখনোই প্রতিবাদ করেনি শাশুড়ির কথার।
আজ সকালে তিতলির ছোট ভাই এসেছিল তিতলিকে দেখতে তার সাথে পর্যন্ত শাশুড়ি দেখা করেননি।ছোট ভাই একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।ভাইকে জোর করেই হাত খরচের জন্য কিছু টাকা দিয়েছে তিতলি আর সেটাই হয়তো কোন ভাবে শাশুড়ি মায়ের কানে গেছে।
তিতলির বাবার বাড়ি থেকে সচরাচর কেউ আসে না।বিয়ের পর পর তিতলির বাবা দুই তিন বার এসেছিলেন কিন্তু সেরকম কোন আদর আপ্যায়ন করা হয়নি তারপর থেকে বাবা যখনই তিতলিকে দেখতে আসেন ঘন্টা খানেকের বেশি দেরি করেন না।আর তিতলির বাবার বাড়ি ঢাকার বাইরে তাই ঘন ঘন দেখতে আসার উপায় নেই।
ছোট ভাইকে বিদায় দিয়ে তিতলির এমনিতেই মন খারাপ বাবা মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তার উপর শাশুড়ির কথা গুলো শুনে হঠাৎ করেই শান্ত তিতলির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
অনেক কষ্টে নিজের রাগ সংবরন করে তিতলি শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললো……
মা আমার বাবার বাড়ি আপনাদের মতো এত বিত্তশালী না হলেও এতটা শোচনীয় অবস্থা না যে আপনার বাড়ির টাকা গোপনে বাবার বাড়িতে পাঠাবো।
আর ছোট ভাইকে এই প্রথম আমি কিছু টাকা দিয়েছি সেটা আমার নিজের উপার্জনের টাকা আপনার ছেলের কিংবা আপনার পরিবারের টাকা নয়।আর এই টাকা আমি গোপনে দেইনি আপনার ছেলেও জানে টাকার কথা।
আমার বাবার যতটুকু সামর্থ্য ততটুকু খরচ করেছেন বিয়ের সময় এরচেয়ে বেশি কিছু করার সাধ্য আমার বাবার নেই সেটা আপনারাও জানেন। তারপরও প্রতিদিন এসব বলে আমাকে কেন ছোট করেন ?
গত দেড় বছরে যেই মেয়ে কখনো চোখ তুলে মুখ ফুটে কোন শব্দ উচ্চারণ করেনি আজ সেই মেয়ের মুখ থেকে এক সাথে এত কথা শুনে আফরোজা খানের মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো।
আফরোজা খানের রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। তিতলির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন……..
এই বাড়িতে আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো হয় না আর তুমি সেদিন এসেই মুখে মুখে তর্ক করা শুরু করে দিয়েছো ?
তুমি আমাকে টাকার গরম দেখাও ?
বাবার বাড়ির অবস্থা এতটা ভালো হলে কই বড় দুই বৌমার বাপের বাড়ির মতো কখনো কিছু পাঠাতে দেখলাম না। আজ বাসায় আসুক অরন্য এর একটা বিহিত হবে।
তিতলি মুখ ফসকে রাগের মাথায় শাশুড়িকে কথা গুলো বলে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা উচিত হয়নি।
ভয়ে ভয়ে শাশুড়ির রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।নিজের রুমে ঢুকে দপ করে বিছানায় বসে ভাবতে লাগলো কাজটা ঠিক হয়নি।
তিতলির একসাথে রাগ ,জিদ ও অনুতপ্ত লাগছে।কি দরকার ছিল শাশুড়ির কথার প্রতিবাদ করার?
সত্যিই তো তার বড় দুই জায়ের বাবার বাড়ির সাথে তিতলির মধ্যবিত্ত বাবার তুলনা হয় না।
বড় ভাবী তার বাবার একমাত্র মেয়ে।ভাবীর বাবার বড় বিজন্যাস ঢাকা শহরে নিজেদের বাড়ি, গাড়ি আলিশান অবস্থা। মেঝো ভাবীর বাবার বাড়ির অবস্থা বড় ভাবীদের মতো এত এলাহি না হলেও ভালো পজিশনে আছে।মেঝো ভাবীর দুই ভাই লন্ডন থাকে, বোনদের অবস্থাও ভালো।আর ভাবী নিজেও ভালো জব করেন।
তিতলির বর অরন্যরা তিন ভাই ,অরন্য সবার ছোট।
যদিও তিতলির সাথে অরন্যের এরেন্জ ম্যারেজ কিন্তু তিতলির পারিবারিক অবস্থার কারণে শাশুড়ি মায়ের এই বিয়েতে বেশি মত ছিল না।তিতলির ফুফাতো ভাই রাকিব ভাইয়ার ঘনিষ্ট বন্ধু অরন্য।রাকিব ভাইদের বাড়িতে তিতলিকে দেখেই অরন্যের খুব পছন্দ হয়েছিল কারন অরন্যের জন্য তখন চারদিকে পাত্রী দেখা হচ্ছে আর সেই পছন্দ থেকেই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব।
মূলত অরন্যের জেদের কাছে হার মেনেই শাশুড়ি মত দিয়েছিলেন বিয়েতে।অরন্যদের মতো এত বড়লোক পরিবারে থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে তিতলির বাবা রফিক সাহেব প্রথমে অমত করেছিলেন।
রফিক সাহেব ছোট সরকারি চাকরি জীবি।দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে মোটামুটি মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করেন।সারা জীবন নিজে হিসেবের মধ্যে চলেছেন সেই সাথে তিন সন্তান কেও সেভাবেই গড়ে তুলেছেন সীমিত আয়ে চলার।বড় মেয়ে তিতলি মাস্টার্সে পড়ছে তার মাঝেই এই বিয়ের প্রস্তাব।রফিক সাহেব প্রথমে অমত করলেও অরন্য আর অরন্যের পরিবার যখন তিতলিকে দেখতে আসলো সব দেখেশুনে রফিক সাহেবের খুব পছন্দ হয়ে গেলো।
রফিক সাহেব তার সাধ্যনুযায়ী বড় মেয়ের বিয়েতে ধার দেনা করে খরচ করেছেন।এত বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সম্মান রাখতে গিয়ে অনেক টাকা লোন করেছেন।তিতলি বার বার নিষেধ করা সত্বেও রফিক সাহেব বিয়ের মধ্যে খরচের কমতি রাখেননি মেয়েকে বলেছেন……
মারে মেয়ের বিয়েতে এটুকু বাবা মাকে করতেই হয়। নয়তো শ্বশুর বাড়িতে যে আমার মেয়ের মান সম্মান থাকবে না।
তিতলি বিয়ের পর পরই বুঝতে পেরেছে তার বাবার এত কষ্টের রক্ত পানি করা টাকা খরচের কোন মূল্যায়ন তার শাশুড়ির কাছে হয়নি।বরং বিয়ের পর থেকে প্রতিনিয়ত এই সামান্য খরচের জন্য তিতলিকে কথা শুনতে হচ্ছে শাশুড়ির কাছ থেকে।
তিতলি বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে শাশুড়ি মা যেকোনো ছুঁতোয় তিতলিকে এবং তার পরিবার নিয়ে অপদস্থ করে। তিতলির বাবা বিয়ের সময় ব্র্যান্ডের ফার্নিচার দেয়নি, তিতলিকে গা ভর্তি গয়না দেয়নি অরন্যকে জামাই সম্মান ঠিক মতো করেনি এসব নিয়ে আক্ষেপ আর আপসোস করতে থাকেন।
একটু সুযোগ পেলেই তিতলিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকেন……..
আমার ছোট ছেলের কপাল মন্দ মনের মতো শ্বশুর বাড়ি পেলো না, ভালো দুই চার জন আত্মীয় স্বজন নিয়ে যে শ্বশুর বাড়িতে যাবে সে উপায়ও নেই।আমার কোল পোঁচা আদরের ছোট ছেলে কত ইচ্ছে ছিল বড় ঘরে বিয়ে করাবো অথচ বিয়ে করলো গিয়ে এমন জায়গায় আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না।
বাবার বড় মেয়ে তিতলি ছোট বেলা থেকেই চুপচাপ শান্ত স্বভাবের। সবচেয়ে বড় কথা বাবা মায়ের শিক্ষা কখনো গুরুজনদের মুখে মুখে তর্ক করো না, বড়দের সম্মান করো , চুপ থাকলে মানুষ ছোট হয়ে যায় না।
সেই শিক্ষা থেকে তিতলি গত দেড় বছরে কখনো শাশুড়ির কোন কথার প্রতিবাদ করেনি এমনকি বর অরন্যের কাছে পর্যন্ত কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেনি শাশুড়ির সম্পর্কে।
বড় দুই জায়ের চেয়ে তিতলির বাবার বাড়ি গরীব ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে তিতলির পরিবার এমন না যে সমাজে পরিচয় দিতে পারবে না তারচেয়ে বড় কথা তিতলি রুপ ,গুন, পড়াশোনা কোনদিক দিয়ে ফেলনা নয় বরং বড় দুই জায়ের চেয়ে তিতলি দেখতে সুন্দর, স্মার্ট, কাজে পটু।
গত সাত আট মাস আগে তিতলির মাস্টার্স কমপ্লিট হয়েছে।কয়েক জায়গায় চাকরির জন্য এপ্লাই করেছে এর মাঝেই একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি হয়েছে গত চার মাস আগে।এই চাকরি নিয়েও শাশুড়ি ঘোর আপত্তি।চাকরি করলে সংসারে মনোযোগ থাকবে না। তাদের কি টাকা পয়সার অভাব আছে নাকি তাহলে চাকরি করবে কেন?
তখন অরন্য তার মাকে সোজা উওর দিয়েছে চাকরি কি শুধু টাকার অভাবের জন্য করে তাহলে মেঝো ভাবী চাকরি করছে কেন ?
তিতলির শ্বশুর আর অরন্যের সিদ্ধান্তের কাছে শেষ পর্যন্ত শাশুড়িকে হার মানতে হয়েছিল।সেই সাথে শাশুড়ি জিদ করেই যেনো সংসারে কাজের দায়িত্বটা চাপিয়ে দিয়েছেন বেশি করে তিতলির কাঁধে।
তিতলি খেয়াল করেছে তার শাশুড়ি কখনোই তার শ্বশুর কিংবা অরন্যর সামনে এসব কথা বলেন না।
তিতলির ভাবতেই অবাক লাগে অরন্যদের টাকা পয়সার কোন অভাব নেই।তিতলির শ্বশুরের ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটা দোকান আছে সেই সাথে বাড়ী ভাড়া পায় বেশ ভালো।বড় ভাসুর আলাদা বিজন্যাস করেন।মেঝো ভাসুর ব্যাংকের ম্যানেজার আর তিতলির বর অরন্য একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে আছে জব করে খুব ভালো পজিশনে।
এত টাকা পয়সার ছড়াছড়ি অথচ শাশুড়ি উঠতে বসতে বার বার তিতলির বাবার বাড়ি নিয়ে খোঁটা দিবে অথচ তিনি খুব ভালো করেই জানেন তিতলির পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন।তিতলির ছোট ভাইটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আর ছোট বোনটা এইচএসসি পরীক্ষা দিবে।ভাই বোনের পড়াশোনার খরচ ,বাসা ভাড়া, সংসার খরচ সব মিলিয়ে খুব সীমিত ভাবে চলতে হয় তিতলির বাবা মাকে।
বিয়ের পর থেকে তিতলি চুপচাপ হজম করেছে শাশুড়ির সমস্ত কথা এই ভেবে যে হয়তো একটা সময় তিতলির ব্যবহার, কাজ আর গুন দিয়ে শাশুড়ির মন জয় করতে পারবে কিন্তু তিতলির ধারনা ভুল।দিন দিন শাশুড়ির কটু কথা বাড়ছেই।
সব কিছু মিলিয়ে তিতলির খুব অস্থির লাগছে শাশুড়ি মা অরন্যের কাছে নালিশ করলে অরন্যই বা কি ভাববে তিতলিকে ?
অরন্যের সাথে তিতলির বোঝাপড়াটা চমৎকার কিন্তু শাশুড়ি এই অভিযোগে কি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এই চমৎকার বোঝাপড়াটা থাকবে ?
তিতলির নিজের উপরই প্রচন্ড রাগ লাগছে। আর একটু সহ্য করলে কি হতো ?
শাশুড়ি তো ভুল কিছু বলেননি। তিতলির বাবার বাড়ি থেকে কিছু দেওয়ার যেহেতু ক্ষমতা নেই তাই চুপ করে থাকাই ভালো ছিল তিতলির জন্য।
সংসারে অশান্তিকে বড্ড পায় তিতলি।ছোটবেলা থেকেই কখনো নিজের পরিবারে অশান্তি কিংবা ঝগড়া দেখেনি।অরন্য কি ভাববে এই ভেবে তিতলির হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।অরন্যের অফিস সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। বাসায় ফিরে রাত আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ।
অন্য দিন ঘড়ির কাঁটা নড়তেই চায় না আজ যেনো পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটছে ঘড়ির কাঁটা।
অরন্য অফিস থেকে ফিরে তিতলিকে দেখেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো……
কি হয়েছে তোমার?
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু নিয়ে খুব টেনশনে আছো।
তিতলি ঘাবড়ে গিয়ে বললো……
আমার কি হবে?
কিছু হয়নি ,তুমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি তোমার কফি নিয়ে আসি এই বলে তিতলি দ্রুত সরে গেল অরন্যের সামনে থেকে।
তিতলির শ্বশুর বাড়িতে রাতের খাবার সবাই একত্রে খায়।ডিনার রেডি করতে গিয়ে তিতলি এতটাই আনমনা হয়ে ছিল যে হাত ফসকে গ্লাস পরে ভেঙে গেল। সত্যি বলতে তিতলি শাশুড়ির মতিগতি বুঝতে পারছে না।
তিতলি খুব টেনশনে আছে শাশুড়ি মা যদি সবার সামনে এসব কথা বলেন তাহলে তিতলি ভয়ঙ্কর লজ্জায় পরবে সবার সামনে।একই বাড়িতে থাকলেও তিতলির ভাসুর এবং জায়েদের সাথে একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব রয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া বড় দুই ভাবীর সাথে তিতলির তেমন কথা হয় না।
সবাই খেতে বসেছে তিতলি আর মেঝো ভাবী খাবার সার্ভ করছে।সবার খাওয়া মোটামুটি শেষ পর্যায়ে তখনই শাশুড়ি মুখ খুললেন অরন্যের দিকে তাকিয়ে বললেন……..
বিয়ে করতে হয় জাত কুল ,বংশ দেখে।দুই দিন হয়েছে বিয়ে করেছিস এখনি তোর বউ আমার মুখে মুখে তর্ক করে। এত সাহস সে পায় কোথা থেকে?
তিতলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো অরন্য খাওয়া থামিয়ে দিয়েছে। অরন্যের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে।
সে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো…….
তিতলি তোমার সাথে কি তর্ক করেছে?
শাশুড়ি যেনো এই প্রশ্নটার অপেক্ষায় ছিলেন।তিতলি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওনার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।তিতলির প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। টেবিলে শ্বশুর সহ দুই ভাসুর উপস্থিত। বড় ভাবী, মেঝো ভাবীও আছেন।শাশুড়ি বিকেলের পুরো ঘটনা বললেন শুধু কৌশলে নিজের বলা কথা গুলো এড়িয়ে গেলেন।
তিতলির লজ্জায় মাথা বুকের সাথে মিশে গেছে। অরন্য তিতলির দিকে তাকিয়ে বললো তুমি কি মাকে সত্যিই এইসব কথা বলেছো ?
কি বলেছো মাকে ?
তিতলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে দেখলো অরন্যের চোখ মুখ শক্ত হয়ে মুখের পেশী গুলো টান টান হয়ে আছে সেই সাথে চোখ দুটোও লাল হয়ে গেছে।
তিতলির মনে মনে চিন্তা করলো যা হবার হবে অরন্য যদি তাকে ভুল বুঝে বুঝবে। তারপরও সবাই যখন উপস্থিত আছে এখানে সত্যি কথা বলাটাই শ্রেয়।সত্যি বলার অপরাধে যদি তিতলির জন্য এ বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে যাবে।
তিতলি একে একে সব কথা বললো বিয়ের পর থেকেই শাশুড়ির সময়ে অসময়ে তিতলিকে ও তার পরিবার নিয়ে সারাক্ষণ হেনস্থা করা, এটা দেয়নি, ওটা দেয়নি বলে তিতলিকে দোষারোপ করা হতে শুরু করে আজ তিতলির ভাইকে টাকা দেওয়া সমস্ত কথা এক নাগাড়ে বলে গেলো তিতলি।
তিতলির কথা শেষ হতেই অরন্য আগের মতোই রাগী ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললো……..
আমি হাত ধুয়ে আসছি।তোমরা সবাই ড্রয়িং রুমে আসো।তিতলির ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে অরন্য প্রচন্ড রেগে গেছে। শ্বশুরের মুখ থমথমে হয়ে আছে।
ড্রয়িং রুমে এসে সবাই বসেছে। তিতলি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল অরন্য তিতলিকে ডেকে তার পাশে বসতে বললো।অরন্যের চেহারা আগের মতোই কঠিন হয়ে আছে।অরন্য সরাসরি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো……
তিতলি তার ভাইকে টাকা দিয়েছে সেটা কি খুব বেশি অন্যায় হয়ে গিয়েছে?
সে বড় বোন হিসেবে তার ছোট ভাইকে কিছু দিতে পারে না?
পুরো রুমে নিস্তব্ধতা। অরন্য তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার বললো আমি তিতলি কে বিয়ে করেছি দেড় বছর। বড় ভাইয়া আর মেঝো ভাইয়া বিয়ে করেছে আরো বেশ কয়েক বছর হয়েছে। তুমি কি কখনো বড় ভাবী কিংবা মেঝো ভাবীর নামে এমন নালিশ করেছো সবার সামনে?
বিয়ের পর থেকেই আমি দেখে আসছি তুমি তিতলিকে পছন্দ করো না। অপছন্দ করার কারন কি তিতলির বাবার অজস্র ধন সম্পদ নেই তাই ?
গত দেড় বছর ধরে আমি সব সময় খেয়াল করেছি তুমি তিতলিকে কতটা অবহেলা করো।বাসা ভর্তি কাজের লোক তারপরও তিতলি চাকরি করলে তোমার সমস্যা, তিতলিকে রান্নাঘরের কাজ করতে হবে, ঘরের অন্যান্য কাজ করতে হবে।
তুমি আজ তিতলির ব্যাপারে আমার কাছে নালিশ করেছো ঘরভর্তি সবার সামনে এতে তিতলিকে অপমান করার পাশাপাশি আমাকেও তুমি সবার কাছে ছোট করলে।
বিয়ের পর থেকেই তুমি যে সব সময় তিতলিকে এসব বলে এসেছো কই তিতলি তো কখনো তোমার ব্যাপারে আমার কাছে নালিশ করেনি।
তিতলি জব করে মাত্র চার মাস সে প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমাকে দিতে চেয়েছে আমি নিজেই ওকে বলেছি এই টাকা ওর কাছে থাকবে তার যা ইচ্ছা তাই করবে এসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই।আর তুমি যে বললে তিতলি আমার টাকায় ফূর্তি আমোদ করে তিতলি আমার বিবাহিত স্ত্রী তার যাবতীয় খরচ বহন করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমার সবকিছু স্বাধীন ভাবে ভোগ করার অধিকার আমার স্ত্রীর আছে কিন্তু তারপরও তিতলি কখনোই বেহিসেবি চলেনি। তিতলির পারিবারিক অবস্থা দেখেই আমি তিতলিকে বিয়ে করেছি।
এতদিন চুপ করে ছিলাম ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে তিতলির প্রতি তোমার মায়া বা আন্তরিকতা জন্মাবে কিন্তু আমার ধারনা ভুল। আমার স্ত্রী তিতলির চেয়ে তার বাবার বাড়ির টাকা পয়সার মূল্য বেশি তোমার কাছে।যেই বাড়িতে আমার স্ত্রীকে সারাক্ষণ অপমান আর অপদস্থ হতে হয় তার কোন সম্মান নেই ,সবার সামনে তার জন্য নালিশ করতে হয় সেই বাড়িতে তাহলে আমিও অবহেলিত আমার কোন মূল্য নেই। আর নিজের আত্মসম্মান যেখানে থাকবে না সেটা নিজের বাড়ি হলেও সেখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেহেতু তোমার এত সমস্যা আমি কাল সকালেই তিতলিকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো।এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।আজ তুমি তিতলির নামে নালিশ করোনি বরং সবার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকেই অপমান করেছো এই বলে অরন্য মায়ের দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিলো।
বড় দুই ভাই চুপচাপ কথা শুনলেও অরন্যের বাসা ছেড়ে যাওয়ার কথা শুনে দুই ভাই আৎকে উঠে বললেন……….
তুই পাগলের মতো এসব কি বলছিস ?
এত সামান্য কারনে তুই বাসা ছেড়ে চলে যাবি ?
সংসারে টুকটাক ঝগড়া বিবাদ হয় তাই বলে নিজের বাসা ছেড়ে চলে যাবি?
এটা কোন সমাধান হলো?
অরন্য বললো…….
তোমাদের কাছে ব্যাপারটা সামান্য মনে হচ্ছে কারন ঘটনা গুলো তোমাদের সাথে ঘটেনি তাই কিন্তু আমার কাছে এটা সামান্য ব্যাপার না। মায়ের দৃষ্টিতে এধরনের বৈষম্য কোন সন্তানই মেনে নিতে পারে না।
অরন্যর বাবা শরীফ উদ্দিন খান চুপ করে এতক্ষণ স্ত্রী সন্তানদের কথা শুনেছিলেন।অরন্যের কথা শেষ হওয়ার পর তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন………..
আমি সারাজীবন অনেক টাকা রোজগার করেছি।আল্লাহ্ র রহমতে আমার টাকা পয়সার কোন অভাব নেই।জীবনের শুরু থেকে উপার্জিত সব টাকা সব সময় তোমার হাতে তুলে দিয়েছি।তোমার নামে ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা ফিক্সড করা আছে।ছেলেদের জন্যও আলাদা আলাদা বাড়ি করা আছে।
আমার ছেলেরা নিজেরাও ভালো বিজন্যাস ও জব করে। সব কিছু মিলিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ সম্পদ সৃষ্টিকর্তা আমাদের দিয়েছেন তারপরও ছেলে বিয়ে করিয়ে তাদের শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাদের যৌতুক নিতে হবে কেন ?আর যদি আমার এত অর্থ সম্পদ নাও থাকতো তারপরও আমি অন্যের বাড়ির যৌতুক কখনোই সমর্থন করি না।বড় দুই বৌমা তাদের বাবার বাড়ি থেকে এটা সেটা আনে যা আমার অপছন্দ এমনকি আমার অপছন্দের কথা আমি তোমাকে জানিয়েছি।
আমাদের মেয়ে নেই ছেলেদের বিয়ে করিয়েছি ছেলের বউরা আমাদের মেয়ের মতো।তুমি হয়তো ভুলে গেছো তোমার বাবার বাড়ির অবস্থা খুব নাজুক ছিল।আমি তো কখনোই তোমার বাবার বাড়ি থেকে কিছু আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করিনি এমনকি আমার বাবা মা যে গ্রামের অল্প শিক্ষিত মানুষ ছিলেন তাঁরাও কোনদিন তোমার বাবার বাড়ির মানুষকে এতটা অবহেলা করেনি কিংবা ছেলের বউ হিসেবে তোমাকে এসব বলে কখনোই মানসিক ভাবে টর্চার করেনি তাহলে তুমি কেন এই আধুনিক যুগে এসে তোমার ছেলের বউয়ের সাথে এমন আচরণ করছো ?
অরন্যের সিদ্ধান্তের সাথে আমি একমত যেখানে তার স্ত্রীর সম্মান নেই সেখানে তার থাকার কোন মানে হয়না। সে তার স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকুক সেটাই ভালো। আমার ছেলের সেই যোগ্যতা ও ক্ষমতা আছে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকার।সত্যি বলতে তোমরা মেয়েরাই মেয়েদের বড় শক্র।
স্বামী সন্তানের কথা শুনে আফরোজা খানের অপমানে চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেলো।
তিনি রাগের স্বরেই বললেন……..
যার যেখানে খুশি যাক আমার কোন আপত্তি নেই।
শরীফ সাহেব অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন তার স্ত্রীর মধ্যে বিন্দু পরিমাণ অনুতাপ নেই।তিনি মনে মনে ভাবলেন অরন্যের সিদ্ধান্তই সঠিক।একসাথে থেকে তিক্ততা বাড়ানোর চেয়ে দূরে থাকাই উত্তম।
শরীফ সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন…….
আফরোজা নিজের স্বভাব ও আচরণ শোধরানোর চেষ্টা করো নয়তো ভবিষ্যতে এর জন্য তোমাকে অনেক অনুতপ্ত হতে হবে এই বলে তিনি ড্রয়িং রুম ছেড়ে চলে গেলেন।
অরন্যও উঠে গেলো মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো…….
আমি তোমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মান করি সেই সাথে তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। তিতলিও তোমাকে অনেক সম্মান করে তার যদি তোমার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান না থাকতো তাহলে সে গত দেড় বছর ধরে চুপচাপ তোমার কথা হজম করতো না। তুমি আমার মা তোমাকে যেমন ভালোবাসি ও সম্মান করি তেমনি তিতলি আমার স্ত্রী তার প্রতি আমার ভালোবাসা ও সম্মান কোন অংশেই কম নয় বলে অরন্য ড্রয়িং রুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
একে একে সবাই ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আফরোজা খান ড্রয়িং রুম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তিতলির দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেলেন। তিতলির দিকে তাকিয়ে আফরোজা খান রাগের স্বরে বললেন……..
কাজটা তুমি ঠিক করলে না।
তিতলি তার শাশুড়ির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো।
সে মনে মনে এতক্ষণ ভেবে রেখেছে শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে যাই হোক শাশুড়ি গুরুজন আর সেই সাথে অরন্যকেও বুঝিয়ে বলবে রাগের মাথায় বাবা মাকে ছেড়ে আলাদা বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। সেতো মানিয়ে নিচ্ছে তার কোন সমস্যা হবে না।
কিন্তু শাশুড়ির শেষ কথা শুনে তিতলি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চাইবে না কারন যিনি ক্ষমা চাওয়া ও চুপ করে থাকাকে তার দূর্বলতা মনে করে তার কাছে নিজের আত্মসম্মান ছোট করে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
তিতলি ধীরে ধীরে নিজের রুমে এগিয়ে গেলো। রুমে ঢুকে দেখলো পুরো রুম অন্ধকার লাইট অফ।এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো অরন্য বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।
তিতলি অনেকটা দ্বিধা আর জড়তা নিয়ে অরন্যের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।তিতলিকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও অরন্য চুপচাপ। শেষ পর্যন্ত সাহস করে তিতলি বলেই ফেললো……..
অরন্য আজকের পুরো ঘটনার জন্য আমি সত্যিই সরি। আমি মায়ের সাথে তর্ক করতে চাইনি সব সহ্য করলেও মা যখন বললেন…..
প্রতিমাসে বাবা হাত পেতে টাকা নেয় তাই সহ্য হয়নি জবাব দিয়ে ফেলেছি।
অরন্য তার ডান হাত দিয়ে তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বললো আমাকে তোমার সরি বলার দরকার নেই আর আজকের ঘটনায় আমি তোমার সাথে রাগ করিনি। তবে তোমার প্রতি আমার অভিমান হচ্ছে তুমি আমাকে এসব কথা আরো আগে জানাওনি সেই কারনে।
আমি তোমার স্বামী তারচেয়েও বড় কথা আমি তোমাকে প্রথম দিনেই বলেছি তিতলি তোমার আমার সম্পর্কটা হবে শ্রদ্ধা, সম্মান ও বন্ধুত্বের। তুমি মায়ের এসব কথা আমাকে আরো আগেই জানানো প্রয়োজন ছিল।কারন এসব বলে মা শুধু তোমাকেই ছোট করেনি ভাই ভাবীদের সামনে আমাকেও ছোট করেছেন।
অরন্য আবার বললো……..
আমরা কাল এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো।একটা কথা মনে রেখো তিতলি নিজের আত্মসম্মান কোন জায়গায় ক্ষুন্ন হয়ে গেলে মানুষ নিজের কাছেই নিজেকেই তখন অনেক ছোট মনে হয় আর চুপ থাকা ভালো তবে সব পরিস্থিতিতে নয় মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতে হয় নয়তো তোমার চুপ করে থাকাটাকে অপরপক্ষ তোমার দূর্বলতা ভেবে প্রতিনিয়ত আঘাত করতে থাকবে।
তোমার মেধা ,শিক্ষাগত যোগ্যতা, তোমার ভদ্রতা কোন দিক দিয়ে তুমি ফেলনা নও তাহলে পরিবারের কাছে আমার স্ত্রীকে আমার সামনে ছোট হতে হবে কেন ?
তিতলি অরন্যের বুকে মাথা রেখে অরন্যকে জড়িয়ে ধরে বললো আর কখনো এমন ভুল হবে না। তুমি কষ্ট পেয়ো না প্লিজ।অরন্য তিতলির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো আমি কষ্ট পাইনি। যাও প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নেও কাল সকালে ইনশাল্লাহ্ আমরা চলে যাবো।
তিতলি বললো……..
হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছো আর একটু ভেবে দেখলে হয় না?
অরন্য তিতলির দিকে তাকিয়ে বললো…….
পরিবার ছেড়ে একা থাকতে আমার নিজের কাছেও খারাপ লাগবে তবে তারচেয়েও বেশি খারাপ লাগবে তোমার আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এই মূহুর্তে এই বাড়িতে থাকাটা। আশা করি আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝতে পারছো। তিতলি মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো অরন্যের সিদ্ধান্তে তার পরিপূর্ণ আস্থা।
আত্মসম্মান
#রুবীনা আক্তার রুবী
৩.ব্যক্তিত্ব নিয়ে উক্তি
# আত্মসম্মান #
রিয়াজের কথাটায় দিয়ার মনে হল কেউ তার গালে জোরে একটা থাপ্পড় মারল। সাথে সাথে ওর চোখে পানি চলে এলো। দিয়া প্রাণপণে তা আড়াল করার চেষ্টা করছে। বাবা -মার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছেলে-মেয়েরা তাদের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রিয়াজ বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আর দিয়া নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ওর দু’চোখ জলে ভরে উঠছে।
দিয়া ও রিয়াজের বিবাহিত জীবন ষোল বছরের। দুই সন্তানের মা দিয়া। ছেলে ক্লাস সেভেনে পরে। আর মেয়ে ফাইভে। সাজানো গুছানো সংসার। প্রতিটি সংসারেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি হয়। তাই বলে সব কথার একটা লিমিট থাকা চাই। আজ সব লিমিট ছাড়িয়ে গেছে। আজ ঝগড়া ঝাটির এক পর্যায়ে রিয়াজ দিয়াকে বলেছে” আমার টাকায় খাচ্ছো, আমার টাকায় পরছো আবার আমার সাথেই ঝগড়া করছো।”
দিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। গলার চেইন, কানের দুল, হাতের চুড়ি সব খুলে আলমারির ড্রয়ারে রেখে দিল সে। এগুলো আর পড়ে থাকতে ভাল লাগছে না ওর। মনে হচ্ছে বিয়ের এতো বছর পরও এমন একটা কথা শুনতে হলো ওকে। অপমানে, ঘৃনায় নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে।
বিয়ের পর চাকরি করার খুব একটা ইচ্ছে জাগেনি ওর। রিয়াজের ইনকাম ভাল। ঘর সংসারই ভাল লাগত। তারপর বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাত। কখনো মনে হয়নি চাকরির কথা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা। আজ মনে হচ্ছে বড় ভুল করেছে সে। মেয়েদের যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার আজ তা হারে হারে টের পাচ্ছে।
দিয়া আলমারি খুলে খুঁজতে লাগল মার বাসা থেকে প্রতি ইদে যে শাড়িটা মা দিয়াকে দেয় সেগুলো থেকে একটা বের করে পরনের শাড়িটা বদলে মার দেয়া একটা শাড়ি পড়ল। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিল। তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। বাইরে থেকে ছেলে-মেয়েরা খাবার জন্য ডাকাডাকি করলেও দিয়া দরজা খুলল না।
শুয়ে শুয়ে দিয়া ভাবতে লাগল কিভাবে রিয়াজের টাকা ছাড়া ওর নিজের খরচ ও যোগাবে। দিয়া খেয়াল করে দেখল এই ফ্ল্যাটটা রিয়াজের নামে। রিয়াজ কাউকে ফোনে বাসায় আসতে বললে বলত-“আমার বাসায় এসো।” কখনও বলে না আমাদের বাসা।
সারারাত দিয়ার ঘুম এলো না। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠে জায়নামাজে বসে অনেক কাঁদল সে। কেন যেন আজ এতো বছর পর জীবনটাকে বড় অর্থহীন মনে হচ্ছে ওর। মনে হচ্ছে এতগুলো বছর এই সংসার আর ছেলে মেয়েদের কথা ভেবে কাটিয়ে দিল সে। তাতে কি পেল। রিয়াজ এখনো ভাবেনি যে ওর টাকায় দিয়ারও অধিকার আছে। তাহলে ছেলেরা মেয়েদের কি ভাবে সংসারে? শুধু কাজ আর দায়িত্ব পালন করা ছাড়া আর কিছু না সে? এসব ভাবনা দিয়ার মনটা ভারাক্রান্ত করে দিল।
দিয়া ঠিক করল যেভাবেই হোক রিয়াজের টাকায় আর খাবে না সে। তাকে একটা কিছু করতেই হবে। এটা ওর আত্মস্মমানের লড়াই। কিন্তু এই বয়সে কী করবে সে?
রান্নাঘরে ছেলে মেয়ের জন্য নাস্তা বানাতে গেল সে। রাতের সব খাবার পরে আছে। কেউ খায়নি কিছু। বুয়া আসল কাজে। দিয়া স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। যেন বুয়া কিছু বুঝতে না পারে।
দিয়া টেবিলে নাস্তা রেডি করে ছেলেমেয়েদের ডেকে তুলল। ওরা স্কুলের জন্য রেডি হয়ে নিল। রিয়াজও অফিসের জন্য রেডি হয়ে টেবিলে আসল। রিয়াজ এমন ভাবে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি। ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলছে। দিয়াকে একবার নাস্তা খেতে বলল। রিয়া কিছু বলল না। ছেলে-মেয়েরা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে নাস্তা করে নিল। রিয়াজ চা খেয়ে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে।
দিয়া কিছুতেই খেতে পারবে না। রিয়াজের কথাটাযে ওর বড় লেগেছে।
দিয়া ঠিক করেছে স্কুলগুলোতে গিয়ে সি.ভি দিবে চাকরির জন্য। যেভাবেই হোক তাকে একটা কিছু করে নিজের খরচ যোগাতে হবে। দেখা যাক চেষ্টা করে। চেষ্টা আর মনের জোড় থাকলে একটা কিছু হবেই।
দিয়া মাস খরচের টাকাগুলো রিয়াজের আলমারিতে তুলে রাখল। সে ভাবল না খেয়ে থাকলেত অসুস্থ হয়ে পরবে। ছেলে মেয়েকে নানান সময়ে জন্ম দিন’ ঈদে নানা -মামাদের দেওয়া কিছু টাকা দিয়া জমিয়ে রেখেছিল। সেগুলো থেকে কিছু টাকা নিয়ে দিয়া বাজারে গেল। দিয়া চাকরি পেলে এই টাকাগুলো আবার জমিয়ে রাখবে। নিজের খাবার সে আজ থেকে আলাদা খাবে। ডাল ভাত। তাও আত্মসম্মানের।
রাতে খাবার টেবিলে আলাদা আয়োজন দেখে রিয়াজ তাচ্ছিল্য করে বলছিল তোদের মায়ের এসব ঢং বেশিক্ষণ থাকবে না। দিয়া কিছু বলল না। নিজের ভেতরে আরও যেন নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। ছেলে মেয়েরা অবশ্য মন খারাপ করে খেয়ে নিল।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দিয়া ওর সি.ভি রেডি করতে বসল। এতো দিন দিয়া যেন ভুলেই গিয়েছিল সে মাষ্টার্স করেছিল।
পরের দিন ছেলে মেয়েরা স্কুলে চলে গেলে আর রিয়াজ অফিসে চলে গেলে দিয়া বেরিয়ে পরে। এলাকার যতগুলো স্কুল আছে দিয়া ঠিক করেছে সবগুলোতে যাবে আস্তে আস্তে। কোথাও না কোথাও একটা কিছু হবে নিশ্চয়ই। সেটা যেমনই হোক।
এক মাস পর…..
দিয়ার একটা স্কুলে চাকরি হয়। খুব বড় স্কুল না হলেও মোটামোটি চলে যাবে। আগে শুরুত করা যাক। এই এক মাস দিয়া রিয়াজের টাকায় কিচ্ছু খায়নি, পরেনি। এখন থেকে দিয়া ঠিক করেছে ওর বেতনের টাকায় ও চলবে। আর যা সামান্য পারে পরিবারের জন্য খরচ করবে। আজ ওর বড় হালকা লাগছে নিজের ভিতর।
দিয়া আজ প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। আজ সকালটা ওর অন্য রকম লাগছে। নিজেকে কেমন ভারমুক্ত লাগছে। দিয়া ভাবছে মেয়েরাও মানুষ। বিয়ে হয়েছে বলেই, হাউস ওয়াইফ বলেই মেয়েদের অপমান করা, মেয়েদের কোন দাম নেই এমন ভাবনা স্বামীদের ঠিক না।। দিয়া ঠিক করেছে নিজের মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় না করিয়ে কিছুতেই বিয়ে দিবে না।
দিয়া বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে স্কুলে গেল।
সমাপ্ত।।