ফুলসজ্জা সিজন ২ পর্ব ১১
লেখিকাঃ #অনামিকা_ইসলাম “অন্তরা”
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
আবির নীলিমার নরম অধরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে নীলিমাকে একান্তভাবে পাবার ইচ্ছে জেগে উঠল মনে। বাতাসের শোঁ, শোঁ, বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম কোনো কিছুই এখন তার কানে যাচ্ছে না। এত তীব্র আকর্ষণ এর আগে আবির কোনোদিন অনুভব করে নি। কাঁধ থেকে খসে পড়ল আঁচলটা….
সকালে ব্রেকফাস্ট রেডি করছিল নীলিমা। এদিকে আবির ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ডাক দেয় নীলিমাকে। “কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি রেডি হও। সকালের খাবার আর দুপুরের খাবার একসাথে না হয় নরসিংদী গিয়েই করো।”
ব্রেকফাস্ট রেডি করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে নীলিমা। মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে রেখেছে। সেটা দেখে মৃদু হাসল আবির। ডায়াল করে শাশুড়ি মায়ের নাম। রিসিভ করে শ্যালিকা লিমা। আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে ওদের কথোপকথনগুলো নিন্মে তুলে ধরা হলো-
আবির- আসসালামু আলাইকুম, মা…
লিমা- ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া।
আবির- ওহ, লিমা? কেমন আছ?
লিমা- ভালো আর থাকলাম কোথায়?
আবির- মা কেমন আছে?
লিমা- কিছুটা ভালো। আপুকে নিয়ে কখন আসছেন?
আবির- আঁকাশ ঘোর কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে লিমা। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। তাই বলছিলাম কি তোমরা চলে আসো লিমা।
লিমা- মানে কি ভাইয়া? আপু কি…..
পুরো কথা বলতে পারেনি লিমা। তার আগেই আবির রুম থেকে সরে বারান্দায় গিয়ে ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়, বোন আমার। বেশী কথা বলো না। তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিয়ে দাও তোমরা। আমি রাস্তা থেকে তোমাদের গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসব। এখন বেশী কথা বলা যাবে না। তোমরা আগে আসো, তারপর মজার ঘটনা বলব।**নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”**
রাখলাম, বাই।
কল কেটে রুমে ফিরে আসে আবির। নীলিমা তখন কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সেটা দেখেও না দেখার ভাব করে বিছানায় ফোনটা রাখতে রাখতে আবির বলে, খিদে পেয়েছে। খাবার দাও।
নিঃশব্দে নীলিমা খাবার দিয়ে রুমে চলে আসে। খাওয়া শেষে স্টাডিরুমে তাকাতেই আবির নীলিমাকে রেডি দেখতে পায়। চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে আবির-
” সে কি? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
জবাব আসে, বাপের বাড়ি।
—- যেতে হবে না। আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তো? লিমা, আম্মাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে মনে হয়। নীলিমা আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চলে যায়।
রাত্রি ৮টায় বাসায় পৌঁছে নীলিমার বোন ও মা। যদিও দুপুর ২টায় রওয়ানা দিয়েছিল কিন্তু রাস্তায় অত্যাধিক মাত্রায় জ্যামের কারনে আসতে এত দেরী হলো। মায়ের প্রতি অভিমান কিংবা রাগ যতই থাকুক না কেন মা আসবে এ খবর পাওয়ার পর থেকে বাহারি নানা ধরনের খাবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলিমা। মা বোন বাসায় ঢুকতেই কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেসব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওরা ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই সামনে এনে দেয় ঠান্ডা পানিয় জাতীয় কিছু। বোনের এককথা,
” আপু! এখন শীতকাল। এ শরবত টরবত কেন আনছিস?”
নীলিমার পাল্টা জবাব, সারাদিন জার্নি করে এসেছিস। খেয়ে নে। ভালো লাগবে। নীলিমা যেন নাছোড়বান্দা। বাধ্য মা মেয়ে পানিয় জলটা পান করেই নেয়। তার কিছুক্ষণ পর সামনে আনে পায়েস। পায়েস খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝালমুখ করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সারাদিন ধরে রান্না করা সকল আইটেম পরিবেশনের। নীলিমা কিচেন থেকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে আর আবির দৌঁড়ে দৌঁড়ে সেগুলো নিয়ে বিছানায় শ্যালিকা এবং শাশুড়ির সামনে রাখছে। ওদের এ হেন ব্যস্ততা দেখে হেসে দেয় নীলিমার বোন লিমা। টিপ্পনী কেটে বলে,
এমন ভাবে খাবার দিচ্ছেন, মনে হচ্ছে আমাদের চেয়ে বড় খাদক পৃথিবীতে আরেকটাও নেই। ক্ষাণিক হাসে আবির।
“তোমরা শুরু করো। আমরা দুজন পরে একসাথে খাবো।”
নীলিমার মায়ের মন খারাপ।
‘এতদিন পর মেয়ের জামাইয়ের বাড়ি আসলাম আর এখনো কি না মেয়ের মুখটা’ই দেখতে পেলাম না।’
অনেকটা আক্ষেপের সাথে অভিমান মিশ্রিত করে নীলিমার মায়ের কথাটা ছিল। আবির কিচেনে গিয়ে অনেকটা রাগান্বিত স্বরে বলে, এই তোমার আদব? মেহমান বাসায় আসছে ওদেরকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করবে না? নিশ্চুপ নীলিমা মাথা নিচু করে বলে, আমি তো ভাবছিলাম পরে বলব।
“পরে নয়, এখনি বলবা। ওরা বসে আছে খাবার মুখে না দিয়ে। এখনি মাকে সালাম করে কুশল বিনিময় করবা।”
আবির একহাতে কিচেন থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে আরেক হাতে নীলিমাকে টানতে টানতে শাশুড়ি মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। নীলিমা মাথা নিচু করে মাকে সালাম দেয়,
” আসসালামু আলাইকুম, মা।”
ফিরে তাকায় নীলিমার মা। মেয়েটা কিরকম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সবই হয়েছে আমার বুঝার ভুলের জন্য। চোখে জল এসে যায় নীলিমার মায়ের। বহুকষ্টে সে জল আটকে মুখে হাসি এনে মেয়ের সালামের জবাব সরূপ বলে,
” ওয়ালাইকুম আসসালাম….”
তারপর মা মেয়ে দুজনেই চুপচাপ। আবির পাশ থেকে ধাক্কা দেয় নীলিমাকে।
“মাকে জিজ্ঞেস করো, কেমন আছে?” নীলিমা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
মা আপনার শরীর ভালো তো?
নীলিমার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন ভালোই আছি। তো দাঁড়িয়ে আসিস কেন? জামাইকে নিয়ে বসে পর। রাত তো আর কম হয়নি।”
” জ্বি, আম্মা। আমরা বসছি বলেই আবির দুইটা চেয়ার টেনে একটাতে নীলিমাকে বসিয়ে তার পাশেরটাই বসে পরে।
সবাই খাওয়া শুরু করছে। নীলিমার মা ফ্যালফ্যাল করে নীলিমার হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীলিমাও যেন একটা বিব্রতিকর অবস্থায় পড়ে গেল। মায়ের সামনে না বসে থাকতে পারছে না বাম হাতে খাবার মুখে দিতে পারছে। ব্যাপারটা আবির লক্ষ করে। বিষয়টা ধামাচাপা দেয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, তোমার না গতকাল হাত কেটে গেছে। এখন ভাত মাখবে কিভাবে? প্লেট রাখো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
………………………………..
কি হলো? হা, করো…!!!
নীলিমা কোনো কথা বাড়ায়নি। আবিরের কথা মতই হা করে। আবির নীলিমাকে খাইয়ে দিচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে নিজেও মুখে দিচ্ছে। ওদের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়েছিল নীলিমার মা। মুচকি হেসে পাশ থেকে ধাক্কা দেয় লিমা। ফিসফিসিয়ে বলে, কি হলো মা? ঐদিকে তাকিয়ে আছ কেন? খাও…..
চোখের জল মুছে নীলিমার মা খাওয়া শুরু করে।
কয়েকদিন পর সকালে____
সকালের খাবার রেডি করে সবাইকে খাইয়ে নিজেও খেতে বসছিল নীলিমা। তখনি গড়গড় করে বমি করে দেয়। পেটে এতক্ষণ ধরে যা ভাত দিয়েছিল সব বেরিয়ে আসে বমির সাথে। নীলিমা দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে আবির কলেজে যাবে বলে ফ্রেশ হচ্ছিল, নীলিমা আবিরের পায়ের উপর গড়গড় করে বমি ছেড়ে দেয়। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ভ্রু-কুঁচকে আবির পিছনের দিকে তাকায়। নীলিমাকে এ অবস্থায় দেখে সব বিরক্তি নিমিষেই উদাও হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নীলিমার কাছে গিয়ে নীলিমার মাথায় চেপে ধরে। নীলিমা বমি করতে করতে একসময় হাপিয়ে উঠে, ক্লান্ত হয়ে যায়। আবির নিজ হাত দিয়ে নীলিমার মুখ পরিষ্কার করে ডাক দেয় শ্যালিকা লিমাকে। দৌঁড়ে আসে নীলিমার ছোট বোন লিমা। আবিরের কথামতো একগ্লাস পানি এনে দেয়। নীলিমা গড় গড় করে কুলি করলে ওকে ধরে রুমে নিয়ে যায়।
” কলেজে যেতে হবে আমার। লিমা, তুমি একটু নীলিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। আর হ্যাঁ, তোমরা আজকে যেতে পারবে না। নীলিমা তোমারও আজকে চেম্বারে যাওয়ার দরকার নেই। আর তোমরা কিন্তু যাচ্ছো না। নীলিমার কি হয় না হয়। তাই তোমরা কিছুদিন থাকবে।”
আবির লিমার হাতে একহাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে কলেজে চলে যায়।
” আপা চলো তো!
ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
নীলিমা ওর বোনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিচেনে চলে যায়। সবকিছু গুছিয়ে রেডি হয়ে নেয় চেম্বারে যাওয়ার জন্য। ছুটে আসে লিমা।
” আপা, তোমায় যে ভাইয়া বলে গেছে আজকে চেম্বারে যেতে হবে না! তারপরও কেন যাচ্ছ?”
দ্যাখ, লিমা। বাঁধা দিস না। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। বমি আমার কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। আজকে হসপিটাল থেকে চেকআপ করে আসব নে। তুই একদম চিন্তা করিস না। মা নিচতলা থেকে ফিরলে মাকে পিঠা পায়েস দিস। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম। কথাগুলো বলেই নীলিমা চেম্বারে চলে যায়। বিকেলে ফেরার পথে দোকান থেকে টিউব কিনে আনে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করার জন্য। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আগে পরীক্ষা করে নেয়। তার পরদিন বিকেলে চা তৈরি করার সময় টিউবটা কিচেনের জানালা দিয়ে ফেলে দিতে গেলে পেছন থেকে হাতটা ধরে ফেলে কেউ।
” কি হলো? পজিটিভ না নেগেটিভ?”
নীলিমা ফিরে তাকায়। স্মিতহাস্যে আবির দাঁড়িয়ে পিছনে।
” কি হলো? চুপ কেন?রিপোর্ট কি বলছে?”
লজ্জায় নীল হয়ে গেছে নীলিমা। মাথা নিচু করে বলে, জানি না। স্মিতহাস্যে জবাব দেয় আবির, কিন্তু আমি জানি। চমকে উঠে আবিরের মুখের দিকে তাকায় নীলিমা। “মানে?”
একটু কাশি দিয়ে নেয় আবির। তারপর সুরে সুরে বলে, আমি টিউবটা চুরি করে নিয়ে……. ফার্মেসীতে……গিয়ে……ছিলাম। বাদল ভাই বলল……..(…….)……???
পিছন থেকে লিমা বলে উঠে, কি বলল?
আবির চোখ বড় বড় করে পিছনে তাকায়। লিমা, তোমার কি কমন সেঞ্চ বলতে কিচ্ছু নেই। এমন সময়’ই আসতে হলো তোমার?
” স্যরি, ভাইয়া। আমি সত্যিই স্যরি।”
কথাটা বলে মাথা চুলকাতে চুলকাতে সে স্থান ত্যাগ করে লিমা। নীলিমা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। আবির আবারো সুরে সুরে বলা শুরু করে, বাদল ভাই…. বলে….ছে……. আমার…..বউ….টা……(……)…..???
“আপনার বউটা মা হতে চলেছে।”
নীলিমার মুখ থেকে কথাটা শুনে আবির চোখ বড় বড় নীলিমার দিকে তাকায়। নীলিমা অন্য দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা এভাবে ঘুরিয়ে বলে লজ্জা না দিলেই কি নয়? চলে যাচ্ছিল নীলিমা, হাতটা ধরে ফেলে আবির।
” আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না নীলিমা। উফফ! আমার অনেকদিনের শখ ট্রিপল বেবির। এবার বুঝি ইচ্ছেটা পূরণ হতে চলেছে।”
কিহ?!!!
ট্রিপল বেবি মানে?
নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবির। মানে আমার তিনটা বেবি হবে।
কিহ?!!!
ট্রিপল বেবি মানে?
নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবির, মানে আমার তিনটা বেবি হবে।
নীলিমা চোখ বড় বড় করে আবিরের দিকে তাকায়। মুখটাও কেমন হা হয়ে আছে। হওয়ার কথা’ই। আবির যা বলেছে তা শুনে শুধু নীলিমা নয় পাঠকরাও ‘থ’ হয়ে গেছে।
যায় হোক, পাঠকদের কথা রেখে এখন আসা যাক ওদের প্রসঙ্গে। আবিরের গ্রামের বাড়ি থেকে কল করেছে আবিরের বাবা। সুখবরটা শুনার পর থেকেই উতলা হয়ে আছেন ওনি কখন নীলিমাকে দেখবেন আর ওকে বাসায় নিয়ে যাবেন। আবিরের বাবা এত বেশী খুশি হয়েছেন যে ওনার আর তর সইছিল না সাথে সাথেই রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে শহরের উদ্দেশ্যে। ওনি চাচ্ছেন ওনার পুত্রবধূ গ্রামের বাড়িতে ওনাদের চোখের সামনে থাকুক। হ্যা, নীলিমা হসপিটালেও যাবে, রোগী দেখবে তবে সেটা ঢাকা নয়, গ্রামের নিকতস্থ ক্লিনিকে বসে।
কথা অনুযায়ী আবিরের বাবা ঢাকায় এসে পৌঁছে। সেখানে একদিন থেকে পরদিন সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দেয় পুত্রবধূ্কে নিয়ে। নীলিমা যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু আবিরের জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো। আবির নিজে গিয়ে ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। ওদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে আসে। খুব খারাপ লাগছিল আবিরের। বাসাটাও কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। সেদিন আর কলেজে যায়নি আবির। পুরো দিনটাই কাটিয়ে দিয়েছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। কিন্তু শত ব্যস্ততার পরও আবির যখন বাসায় ফিরে আসে তখন শূন্যতারা ওকে গভীর ভাবে আকড়ে ধরে। বারান্দায় ঝুলে থাকা নীলিমার ওড়না, ড্রেসিংটেবিলের উপর পরে থাকা দুটো চুড়ি, আয়না, চিরুনি আর কাজল দেখে আবিরের ভেতরটা গুমড়ে কেঁদে উঠে।
যেদিকে তাকায়, সেদিকেই শুধু শূন্যতা। এই শূন্যতার সাথে আবির বেশী দিন লড়াই করতে পারেনি। ৫মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আবির কলেজ থেকে ছুটি নেয়। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে এবং প্রিন্সিপালের আন্তরিকতায় আবিরের দরখাস্ত মঞ্জুর হয়ে যায়।**নতুন নতুন রোমান্টিক গল্প পেতে ভিজিট করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: “নিঃস্বার্থ ভালোবাসা”** আবির ছুটি পেয়ে যায় ৬মাসের। যদিও এই ৫মাসের ভিতর আবির অনেক বার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নীলিমাকে দেখে এসেছে কিন্তু আজ কেন জানি আবিরের অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে। টানা ৪ঘন্টা জার্নি শেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আবির গ্রামের রাস্তায় পৌঁছে। নামাজ শেষে শাশুড়ির জন্য চা তৈরি করতে গিয়েছিল নীলিমা। অকস্মাৎ পেটের ভিতর কি যেন মোচড় দিয়ে উঠে। ওহ, মাগো করে পেট চেপে ধরে নীলিমা। খুব খারাপ লাগছিল নীলিমার, তাই চোখ বোজে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। পরমুহূর্তে শাশুড়ির ডাক পরাতে তাড়াতাড়ি কাপে চা ঢেলে শাশুড়ির রুমে যায়। চা দিয়ে নীলিমা ধীর পায়ে দরজার কাছেও পৌঁছাতে পারেনি, তার আগেই নীলিমা শাশুড়ির ঝারি শুনতে পায়।
” এসব কি চা নাকি অন্য কিছু?”
ভয়ে কেঁপে উঠে নীলিমা। কাঁপা গলায় বলে- মা! আসলে আমার পেটে একটু খারাপ লাগছিল তাই চা’টা একটু লেগে গেছে। ধমক দেয় শাশুড়ি। বাচ্চা আমরাও পেটে ধরেছি। কিছু না হতেই তোমার মত ওহ, আহ করিনি। বলি পেটে কয় বাচ্চা ধরেছ যে এখনি হাপিয়ে উঠেছ?
কোনো কথা বলেনি নীলিমা। নিঃশব্দে শাশুড়ির রুম থেকে বিদায় নেয়। দরজার সামনেই আবির দাঁড়িয়ে। চমকে যায় নীলিমা। আআআআআপনি?
গম্ভীর মুখে জবাব দেয় আবির, হুম আমি।
আবিরের মুখ দেখে নীলিমা বুঝতে পারে ওদের বউ শাশুড়ির কথোপকথনগুলো অন্তঃরাল থেকে শুনে নিয়েছে আবির। নীলিমা চাচ্ছে না এসব নিয়ে এখন সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হোক, মা ছেলের মধ্যে মনো-মালিন্য হোক। আর ঠিক সে কারনেই আবিরের সামনে থেকে কেটে পরার জন্য ধীরপায়ে নীলিমা সামনের দিকে এগুচ্ছে। ‘দাঁড়াও’ পিছন থেকে ডাক দেয় আবির। থেমে যায় নীলিমা। দৌঁড়ে গিয়ে ব্যাগটা রুমে রেখে এসে নীলিমার কাঁধে হাত রাখে আবির। তারপর সাবধানে নীলিমাকে নিয়ে রুমে পৌঁছে। বিছানার একপাশে নীলিমাকে বসিয়ে ব্যাগ থেকে আঙুর, আপেল বের করে। নীলিমা ক্লান্ত চোখে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। “কি হলো? নাও…..”
নীলিমা কথা বাড়ায়নি। আবিরের হাত থেকে কয়েকটা আঙুর নেয়। নীলিমা আঙুর খাচ্ছে আর আবির ফ্লোরে নীলিমার পায়ের কাছে বসে নীলিমার খাওয়া দেখছে। বড্ড খিদে পেয়েছিল নীলিমার। তাইতো হাতেরগুলো খাওয়া শেষ হলে আবিরের আর কিছু বলতে হয়নি। নীলিমা নিজে নিজেই আবিরের হাত থেকে আঙুর নিয়ে খাওয়া শুরু করে। হঠাৎ’ই আবিরের চোখের দিকে চোখ পরতেই লজ্জা পেয়ে যায় নীলিমা। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উঠতে চাইলে আবির হাত টেনে ধরে। নীলিমা আবারো বসে। তবে এবার আবিরের দিকে তাকায়নি। অন্যদিকে তাকিয়েই বলে আমি আর খাব না। আবির ধমক দেয়। একদম না করতে পারবা না। এটা খাও বলেই আবির নীলিমার হাতে একটা আপেল ধরিয়ে দেয়। তারপর ফ্রেস হতে চলে যায়। আবির ফ্রেস হয়ে আসে। ততক্ষণে নীলিমার অর্ধেক আপেল খাওয়া শেষ। আবিরকে দেখেই বিনীত ভঙ্গিতে নীলিমা বলে উঠে, আমি আর খেতে পারছি না, একদম খিদে নেই। এটা ফেলে দেই???
নীলিমা জানালা দিয়ে আপেলটা ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত উঁচু করতেই আবির হাতটা ধরে ফেলে। আপেলটা নীলিমার হাতে থাকা অবস্থাতেই আপেলে আলতো করে কামড় দেয় আবির। খেতে শুরু করে আপেল। নীলিমার হাতে রেখেই আবির নীলিমার অর্ধ খাওয়া আপেলটা খেতে শুরু করে। সবশেষের অংশটি নীলিমার একদম হাতের তালুতে চলে যায়। আবির সেটা নিয়েও খেয়ে ফেলে। নীলিমা ঢ্যাবঢ্যাব করে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে, তোমার খিদে নেই কিন্তু আমার খিদে ছিল।
তাই বলে আপনি, পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা তার আগেই থামিয়ে দেয় আবির। এটা মাকে দিয়ে আসি বলেই ফলের একটা কার্টুন নিয়ে আবির রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একটু আগে আবির শুনেছে ওর মা অত্যন্ত বাজেভাবে নীলিমার সাথে কথা বলেছে। এই জন্য আবিরের মনটা খুব খারাপ। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ওর তারপরও মা তো। মনের কষ্ট মনেই চাপা রেখে আবির ওর মাকে সালাম দিয়ে, কুশল বিনিময় করে। সবশেষে ফলের কার্টুনটা মায়ের সামনে রেখে চলে আসে।
রাতের খাবার খাওয়ার জন্য খাবার টেবিলে বসেছে আবির এবং ওর বাবা-মা। নীলিমা ধীর পায়ে সবার দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রান্না করার ফলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল নীলিমা। তাই একটু ধীর পায়েই এগুচ্ছিল শ্বশুরের দিকে। এরই মাঝে শাশুড়ির মন্তব্য, আবার কি ঘন্টাখানেক পরে তরকারী দিবা নাকি?
ক্লান্ত নীলিমা মলিন মুখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, আসছি মা।
পাশ থেকে আবির বলে উঠে, কি ব্যাপার? সবাইকে যে খাওয়াচ্ছ তুমি কখন খাবে? নীলিমার ওর শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে, আপনারা খেয়ে উঠুন। আমার এখন খিদে নেই। আমি পরে ধীরে সুস্থে খাবো। ব্যাপারটা ভালো ঠেকেনি আবিরের কাছে।
রাত্রে সবার খাওয়া শেষে নিচে মাদুর পেতে বসে নীলিমা। প্রতিদিনের মত সেদিনও নীলিমার শাশুড়ি প্লেটের মাঝখানে করে কিছু ভাত আর তরকারী এনে দিয়ে যায়। প্রচন্ড খিদে পেটে গপগপ করে খাওয়া শুরু করে নীলিমা। নিমিষেই শেষ হয়ে যায় প্লেটের সকল ভাত। ধীরে ধীরে উঁঠে দাঁড়িয়ে নীলিমা এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। কিচেনে দাঁড়িয়েই তাড়াতাড়ি করে কয়েকমুঠো ভাত মুখে পুরে দেয়। মাছের ভাজা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি নীলিমা। মাছের ভাজিটা হাতে নিয়ে খাবার টেবিলের কাছে ফিরে যাচ্ছিল নীলিমা, অমনি থমকে দাঁড়ায়। ওর চোখের সামনে শাশুড়ি অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। শাশুড়িকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম নীলিমার। আমতা আমতা করা শুরু করে নীলিমা।
” ইয়ে না মানে মা আমার খিদে….”
পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। তার আগেই হাত থেকে মাছের ভাজিটা ছিনিয়ে নেয় শাশুড়ি। গড় গড় করে বলতে থাকে।
” কত বার করে বলেছি কৈ মাছ,
টাকি মাছ এসব খাবি না। এসব খেলে বাচ্চা কালো হয়। তুই আমার কথা কানেই নিস না। নিবি কেন? তোর তো খাওয়া হলে কিচ্ছু লাগে না। না হলে আমি তোকে কতবার করে বলছি, বেশী খাবি না। বেশি খেলে সন্তান বড় হয়ে যাবে। প্রসবের সময় কষ্ট হবে। বান্দার জানের ভয়ও নাই। খালি খাই, খাই।”
মা, টাকি মাছ বলেন,কৈ মাছ বলেন এসবে গর্ভবতীর কোনো ক্ষতি হয় না। এসব গর্ভের শিশুর জন্য ভালো, পুষ্টিকর। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে ৬মাস পর্যন্ত শিশুর….. পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নেয় ওর শাশুড়ি। বেয়াদবের মতো মুখে মুখে তর্ক করবে না। বাচ্চা আমরাও প্রসব করছি। তাই কিসে বাচ্চার ভালো, কিসে মন্দ সে বিষয়ে আমরা একটু বেশীই জানি। যাও, হাত ধূয়ে ঘুমোতে যাও…..
হাতটা ধূয়ে নিঃশব্দে নিচের দিকে তাকিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে নীলিমা।
মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। প্রচন্ড খিদের জ্বালায় ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুয়া থেকে উঠে বসে নীলিমা। ড্রিমলাইটের আলোয় হাতড়ে হাতড়ে আবিরের আনা ফলের কার্টুনটা খুঁজে বের করে।
কুটকুট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। কি হলো? আলমারির কাছে কি শব্দ হচ্ছে? ইঁদুর নয়তো? হুট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় আবির। আলমারির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় আবির। আলমারির পাশেই ছোট্ট সোফায় বসে কলার খোসা ছাড়িয়ে আপনমনে কলা খাচ্ছে নীলিমা।
হেসে দেয় আবির, তুমি? ভড়কে যায় নীলিমা। তাড়াতাড়ি ফলের কার্টুনটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে।
.
চলবে____