- মেয়েদের জীবনের কষ্টের গল্প
- একটি মেয়ের জীবনের গল্প
- পারিবারিক কষ্টের গল্প
- রিলেশনের কষ্টের গল্প
- বউকে কষ্ট দেওয়ার গল্প
১.মেয়েদের জীবনের কষ্টের গল্প
মেয়েমানুষের শরীর থেকে যৌবন নামক বস্তুটা চলে গেলে শরীর হয়ে যায় হয় থলথলে নয়ত চিমসে। সালোয়ারকামিজ বা শাড়ি কোনো পোশাকেই আগের সুশ্রী ভাবটা ফুটে উঠে না । এখানে যারা হাঁটতে আসেন তাদের প্রেত্যেকের বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই। চুলে কৃত্রিম রঙ, সাজপোশাকে কেউ নিজেকে চল্লিশের কোঠায় রাখতে পছন্দ করেন।এখানে সবাই হাঁটতে আসে, হাঁটার চেয়ে কথা হয় বেশি। গলির মাথায় খাবারের দোকান।তেলে চপচপে পরোটার দিকে সাবেক কর্নেলের স্ত্রীর চোখ চকচক করে উঠে।
-বুঝলেন ভাবী, সকালে এক ঘণ্টা হাঁটার পর ভীষণ ক্ষুধা পায়।ছেলের বউ দুইটা শুকনা রুটি আর কোনোরকম ভাজি রেখে নাতি নিয়া স্কুলে ছুটে। একদিন জিজ্ঞেসও করে না দুইটা রুটিতে আমার হয় কী না।
নীচতলার নীলুফার বেগম মুখ ভেঙচে উত্তর দেয়,
-আপনার বউ তবু খাবার রেখে যায়। আর আমারটা সকালে ঠোঁট পালিশ করে অফিসে ছোটে। নিজের স্বামী-সন্তানের খবর রাখার সময় না আমি তো পরের মা।
আজমেরী হক চায়ে চুমুক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। উনি না বললেও উনার অব্যক্ত কথা সবাই বুঝে নেয়। ভদ্রমহিলার স্বামী গত হয়েছেন ১৪ বছর আগে। একটাই ছেলে স্ত্রীসহ অস্ট্রেলিয়া থাকে। দুবছর অন্তর কয়েকদিনের জন্যে নাতি-নাতনীর মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়।
এদের তুলনায় সবচেয়ে সুখী বোধহয় আমি। তাই পুত্রবধূকে দোষারোপ করার মত কারণ খুঁজে পাই না।
আট-দশটা পাত্রী দেখেশুনে নিজের পছন্দসই বউ ঘরে আনার সময় হয় নি । আমার ছেলে নাহিদ সে ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছে । বিবিএ শেষ করে একটা বেসরকারি ফার্মে জয়েন করেছে। এমবিএ তখনও রানিং। এরমাঝে গো ধরল বিয়ে করবে। ওর ক্লাসেপড়ুয়া এক মেয়ের সাথে ভাবভালোবাসা ছিল।সে মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। পুত্রধন এমেয়ে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না।
দিবা। ছোটখাট গড়নের সাথে ছোট্ট নামটা চমৎকার মানিয়ে যায়। আমার ৫ ফুট ১১ ইঞ্চির ছেলের পাশে ওকে এতটুকু লাগে। টকটকে ফর্সা রঙ।হাসলে দু’গালে লালচে আভা পড়ে। নাক-মুখ বোচা কিন্তু অল্পবয়সে যেকোন মেয়ের দেহে লাবণ্যের ছোঁয়া থাকে। আমার ছেলের ভালো লাগে ওকে। আমার পছন্দ -অপছন্দতে কী আসে যায়।
নাহিদ তখন কুঁড়ি হাজার টাকা মাইনে। ওর বাবার পেনশনের টাকা আর গ্রাম থেকে আসা কিছু তরতাজা শাকসবজিতে একরকম চলে যায়। মাস শেষে সঞ্চয় হত না আবার কারো কাছে ঋনীও হতে হত না। ভালো ছিলাম বেশ।
দিবাকে অসহ্য লাগত। রান্না করতে গেলে সবজি পুঁড়িয়ে ফেলত।ঘর ঝাড়ু দিলে কোণায় কোণায় ময়লা জমে থাকে। কি মেয়ে! বাপ মা কয়েকটা কাগজের ডিগ্রি ছাড়া কিছুই শিক্ষাদীক্ষা দেয় নি । বিরক্ত হয়ে বলতাম,
-থাক, তোমাকে কিছু করতে হবে না। ঘরে বসে থাকো ।
মেয়েটা লজ্জা পেয়ে রুমে চলে যেত।সারাদিন চুপচাপ। রাতে নাহিদ বাড়ি ফিরলে চোখমুখ উজ্জ্বল।কোনদিন দেখতাম বিকেল হতে শাড়ি-টিপ পড়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে ঘুরছে। ছুটির দিনে দুজনে ঘুরতে বের হত। বাড়ি ফিরে আমার রুমে ঢুকত।
-মা, দেখেন আপনার ছেলে কি কিনে দিয়েছে!
তাকিয়ে দেখতাম দু’হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। রিনিঝিনি শব্দে সারাবাড়ি ছুটে বেড়াত। বারান্দা থেকে গুণগুণ গান ভেসে আসত।
দু’বছর পর ছেলের প্রমোশন হয়। দিবাও কনসিভ করে। ছেলের আদিখ্যাতা দেখে আর বাঁচি না। আর কারো বউ প্রেগন্যান্ট হয় না। রাতে অফিস থেকে ফিরে খাইয়ে দিচ্ছে। বউ বাথরুমে গেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে।
-দিবা,সাবধানে পা ফেলো।মেঝে পিচ্ছিল।
কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ফর্সা রঙ, হাত-পায়ের গড়ন লম্বা।রাতের বেলা বউ নাক ডেকে ঘুমায়,বাচ্চাটা কাঁদলে বাপ উঠে কোলে নিয়ে হাঁটে।
বছর গড়ায়।প্রমোশনের সাথে ছেলের ব্যস্ততাও বাড়ে। দিবা ঘুমঘুম চোখে সকালে রুটি বানায়, ডিমপোচ করে। বরকে অফিসে পাঠিয়ে মেয়ের খিচুরী রান্না করতে বসে। দুপুরের রান্নাটা আমিই করি।
আমার স্বামী গত হয়েছেন দিবার ছেলে হবার কয়েকমাস পর। তিনি মারা যাবার পর আমার কিছুদিন পর এমেয়ের বাড়ি, ও মেয়ের বাড়ি যেতে হয়। বাবা নেই, আমি না গেলে মেয়েরা মন খারাপ করে।
আট বছর! সময়টা খুব কম নয় আবার বেশিও নয়।এই সময়টাতে দিবা তরুনীর খোলস ছেড়ে মধ্যবয়স্কা মহিলা। ভোরে নামাজ পড়তে উঠে দেখি মেয়েটা আমার আগে ঘুম থেকে উঠে গেছে।চুলায় ডাল-ভাত বসিয়ে সবজি কাটছে। দেড় বছরের ছেলে ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে। নাহিদ ডাকছে,
-দিবা, প্লিজ থামাও ওকে।শান্তিমত একটু ঘুমাতেও দিবে না।
ছেলে কাঁধে নিয়ে ঘুম পাড়ায় আর মেয়ের স্কুলের ব্যাগ গুছায়। টিফিন রেডি করে।খাবার টেবিলে কে কি খায় তা খোঁজখবর নেবার সময় ওর হয় না।মেয়েকে খাইয়ে স্কুলের জন্যে রেডি করাতে হয়। ছেলেটা একা টেবিলে নাস্তা সেরে অফিসে চলে যায়।
দু’ঘণ্টার জন্যে ছেলেকে আমার কাছে রেখে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসে। গ্যাস বিল,ইলেক্ট্রিসিটি বিল, টুকিটাকি বাজার করা দিবা অবলীলায় করে।বাড়ি ফিরে ছেলেকে খাইয়ে দুপুরের রান্নার যোগাড় করে। কোনদিন বিকেলে দেখি মা-ছেলে দু’চোখের পাতা এক করেছে অতঃপর মেহমান এসে হাজির। হাসিমুখে চা-নাস্তা বানিয়ে গল্প করে।
সন্ধ্যায় নাহিদ বাড়ি ফিরে চিৎকার করে।
-আমার তোয়ালে কই? নীল শার্ট ধুয়ে রাখতে বলছিলাম। এখানে ফেলে রাখছ।
সারাদিন কাজ করে আসছি এককাপ চা বানিয়ে দেবার লোক নাই।
দিবা তখন মেয়ের হোমওর্য়াক দেখিয়ে দিচ্ছে।ছেলের জন্যে দুধ গরম করছে। এক ফাঁক চা বানিয়ে দিয়ে আবার ছুটছে।
দিবার ৩২তম জন্মদিনে নাহিদ ডায়মন্ডের ইয়ার রিঙ গিফ্ট করেছিল। দিবা আমাকে দেখানোর প্রয়োজনবোধ করে নি। এই মেয়ে বিয়ের পর আমার পিছুপিছু ঘুরত যেকোন কাজে হাত লাগাত। এখন দিবা সারাদিনে একবার আমার ঘরে আসে না।দুপুরে খাবার টেবিল গুছিয়ে ডাক দেয়,
-মা খেতে আসেন ।
ঘুমানোর সময় দরজা থেকে বলে,
-মা কিছু লাগবে কী না?
কয়েক বছর ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ পাশে বসে গল্প করত। চুলে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিত। সময়ের সাথে সুন্দর মুহূর্তগুলো অতীত হয়।
আজমেরী হক জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-আপনার ছেলের বউ বুঝি খুব খাতিরযত্ন করে।
-একথা কেন?
-কোনদিন কিছু বললেন না।
মলিন হাসি হাসলাম।
-আট বছর আগে যখন ছেলের বউ ঘরে আনি ও হাসলে দু’গালে লালচে আভা বের হত । গালে এখন মেস্তার দাগ।
বাকি তিনজন চুপচাপ।
-ছেলের ঝামেলা সামলাচ্ছে, নাতিনাতনির ঝামেলা সামলাচ্ছে। আমি আর আমার সংসার ভিন্ন কি!
#সংসারের গল্প
হাবিবা সরকার হিলা
২. একটি মেয়ের জীবনের গল্প
ছেলেবেলায় ভারী স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম বলে আম্মা কখনোই চাইতেন না আমি কোন খেলাধুলায় অংশগ্রহন করি।ওদিকে আমার বোন প্রতিবছর খেলাধুলায় অংশগ্রহন করে পুরস্কার হাতে নিয়েই ঘরে ফিরতো।আমি ওর পুরস্কারকেই কল্পনায় নিজের ভেবেই খুশি থাকতাম। বোনের পুরস্কারের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে লাগলো আর আমার আনন্দ বাড়তে লাগলো। পঞ্চমে যখন উঠি তখন গোটা শহরের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো মিলে একটা কুইজ কুইজ প্রতিযোগিতা শুরু হয়,কেবল পড়াশোনায় নাক ডুবিয়ে থাকা আমি সে বিষয়ে একেবারেই বেখবর ছিলাম,অথচ গোটা স্কুলে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে গেছে এ নিয়ে।
কুইজ প্রতিযোগিতায় যারা অংশগ্রহন করবে আগে তাদের নাম জমা দিতে হবে,আমার বন্ধুবান্ধব মোটামুটি ক্লাসের সবাই সেখানে নাম দিয়ে দিয়েছে কেবল আমি ছাড়া।আমার স্কুলে আসার আগে থেকে পাওয়া খেলার সাথী সে তখন আমার ক্লাসমেট, আমাদের নামও ছিলো একই,আমরা চেষ্টা করতাম আমাদের সবকিছু ম্যাচিং ম্যাচিং রাখতে।তো সে এসে বলল কিরে কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিবিনা?আমি বললাম ধুর আমি ওসব পারি নাকি?তুই জানিস না আম্মা আমাকে কোনকিছুতে যেতে দেবে না, আর শুনেছি ওখানে নাকি ৪৭টা প্রশ্ন থাকবে আমি কি এত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো? বান্ধবী তখন বলল কে বলেছে ৪৭টা প্রশ্নের উত্তরই পারতে হবে?যে কয়টা পারবি উত্তর দিবি,তুই অংশগ্রহণ কর প্লিজ।ওর কথাতে জীবনে প্রথমবার কোথাও নাম দিলাম।কুইজ প্রশ্ন আমাদের যার যার বাসায় নিয়ে যেতে দেয়া হয়েছিলো কিন্ত উত্তর দেবার সময়সীমা ছিলো তিন দিন, এর মধ্যে প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখে স্কুলের ডাকবক্সে ফেলতে হবে।
আমি মোটামুটি সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম কেবল যেটা একেবারেই মাথায় আসেনি তা হল -ডাব না খেলে কি হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই আমার মাথায় এলো না।উপরন্তু, আমি ভয়াবহ রকমের চিন্তায় পড়ে গেলাম এই ভাবনায় যে হায় হায় ডাব না খেলে না জানি কোন জটিল রোগ হয়,শহরে আসার পর তো ডাব চোখেই পড়ে না আর গ্রামে অল্পকয়দিনের জন্য যাই ডাব খাওয়ার সময় কই?ডাব না খেলে কি রোগ হয় এই চিন্তায় রীতিমতো ঘুমাতে পারতাম না। শেষ অব্দি সাহস করে বান্ধবীকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম কুইজ তো জমা দিয়ে দিয়েছি তাই না?এখন তো জিজ্ঞাসা করাই যায় আচ্ছা ডাব না খেলে কি হয় রে?ও হেসে বলল ওমা কি আর হবে নারকেল হয় আমি কতক্ষন হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম,মনে মনে প্রশ্নকর্তার বুদ্ধি কে পুরস্কৃত করতে ইচ্ছে হলো এত বুদ্ধি নিয়ে তারা কিভাবে ঘুমায় সেটাই ভাবতে লাগলাম।
সেবার কয়েকটা স্কুলের মধ্যে লটারি করে কুইজ প্রতিযোগিতার বিজয়ী ঘোষনা করা হলো সেরা ১o জনকে,শুনলাম তার মধ্যে আমাদের স্কুল ও আছে আমাদের স্কুল থেকে নাকি একজন পেয়েছে।সবাই বলাবলি করছিল কি ভাগ্য তার যে পেয়েছে।
হঠাৎ এক রবিবার বিকেলে আমাদের স্কুলের একজন স্যার আমাদের বাসায় এসে হাজির স্যারকে দেখে আমি চমকে গেলাম মনে মনে ভাবছি আমি তো কিছু করিনি তবে স্যার বাসায় কেন এলেন মনে মনে ভয়ে অস্থির লাগছিলো। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি বলে উঠলেন আমাদের স্কুল থেকে যে পুরস্কারটা পেয়েছে সে নাকি আমি,আমি রীতিমতো হতভম্ব জীবনে কোনকিছুর ধারেকাছেও না যাওয়া আমি পেয়েছি পুরস্কার?নিজেকে বার কয়েক চিমটি কেটে বিশ্বাস করালাম যে ঘটনা সত্যি।
আমার এই পুরস্কারের খবর গ্রামের বাড়িতে পৌছে গেল।আমার দাদী বললেন আমার বংশের বড় পুত্নি(ছেলের মেয়ে) পুরস্কার পাইছে,এই পুরস্কার থাকবে সদর দরজার ওপরে। দাদী তাই করলো সদর দরজার ওপরেই প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত ওয়ালমেট সেখানে ঝুলিয়ে দিলো। কেউ এলেই জোরে জোরে বলে উঠতো এই দেখো আমার পুতনী পুরস্কার জিতে আনছে।
এরপর আমি মনে মনে ভাবলাম “না এবার আমাকে ভয়কে জয় করে খেলাধুলাতেই পুরস্কার জিতে আনতে হবে”।আম্মাকে না জানিয়ে দড়িলাফ খেলায় নাম দিলাম,মাঠে প্র্যাকটিস করতে গিয়ে এমন লাফ দিলাম দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গিয়েই বুঝলাম আমাকে দিয়ে দড়িলাফ খেলে পুরস্কার আনা হবে না বরং,দাঁত হারাতে হবে খেলতে গিয়ে অকালে।
তার চেয়ে গোলক নিক্ষেপ ই নিরাপদ ভেবে দিলাম তাতে নাম।দেখতে ছোট মনে হওয়াতে গোলক হাতে নিয়ে যেই ছুঁড়তে গেলাম মনে হলো আমার হাত সহ ছিঁড়ে চলে গেলো। না এটাও আমাকে দিয়ে হলো না।
একটা পুরস্কার ও আমি ঝুলিতে ভরতে পারছি না এই দু:খে রীতিমতো ভেতরে ভেতরে কোমায় অবস্থানরত অবস্থায় একদিন সেই ছোটবেলায় বান্ধবী এসে বলল,শোন সারাজীবনে কোন পুরস্কার পেলি না এই দু:খ এবার ঘোচাবার সুযোগ এসেছে, আমি এক লাফে খাট থেকে দাঁড়িয়ে চোখ গোল করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম “সত্যি বলছিস?কিন্ত,এটা কিভাবে সম্ভব?ছোটবেলায় ই পারলাম না আর এই বয়সে কলেজে এত ছেলেমেয়ের মধ্যে কি করবো?
বান্ধবি তখন বলল আরে আমরা খেলব নাকি এই বয়সে?আমি বললাম তাহলে?ও বলল চল যেমন খুশি তেমন সাজো ‘তে নাম দেই।
আমি আম্মার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম, স্বপ্নেও আম্মা আমাকে রুটি বানানো বেলন হাতে তাড়া করছে দেখে লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়তাম প্রায়দিন।বান্ধবিকে বললাম নারে আমার দ্বারা হবে না তুই ই যা প্রতিযোগিতায়।বান্ধবী বলল আরে ধুর তুই পারবি,আন্টিকে না জানালেই হলো, আমি হতমত খেয়ে বললাম আমি মিথ্যা বলতে পারি না, বন্ধবি বলল মিথ্যা কেন বলবি? ওইদিন কলেজ তো খোলা তুই সুন্দরমতো চলে আসবি,বললাম তাহলে অংশগ্রহণ করব কিভাবে?বান্ধবী বলল তুই শুধু ঘন্টা দুয়েক আগে আসবি আমার বাসায়। কিন্ত, সাজগোজ এর জন্য এক বক্স পাওডারের দায়িত্ব ছিল আমার।তো টিফিনের জমানো টাকায় এক বক্স পাওডার কিনে বান্ধবির বাসায় গিয়ে দুইজনে সাজলাম।
বান্ধবী স্ট্যাচু অব লিবার্টি সেজেছে আর আমি অনেক ভেবে ঠিক করলাম “আইন অন্ধ ” সাজবো।কাগজ দিয়ে একটা দাড়িপাল্লা বোন বানিয়ে দিয়েছিলো আগেই সেটা সযত্নে রেখেছিলাম আজ কাজে লাগাব বলে।তো সাজগোজের পর আমার চোখে কালো কাপড় বেঁধে দেয়া হল আমি বান্ধবিকে বললাম আমি তো চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, বন্ধবি বলল তুই অন্ধ সেজেছিস চোখে দেখতে পেলে আর অন্ধ হবি কিভাবে?আমি বললাম আমি কিন্ত হাটতে পারব না শাড়ি পরে যদি পড়ে যাই তুই বুঝবি।বান্ধবি বলল শোন তুই সারাক্ষন আমার হাত ধরেই থাকবি তাহলে কিছুই হবে না।
বান্ধবি খুব দক্ষতার সাথে শাড়ি সামলে সবার সাথে কথা বলছে, তার যে উচ্চতা তাকে স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূর্তির মতোই দেখতে লাগছে, আর আমি তার ঘাড়ের কাছেই পড়ে থাকি উচ্চতায়।মাঠে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে বান্ধবী সব দেখছে খুব আনন্দ হচ্ছে তার। ওদিকে এতক্ষন চোখ বন্ধ রেখে আমার পৃথিবী অন্ধকার।সবাই সেল্ফি তুলতে আসছে স্ট্যাচুর সাথে। বান্ধবি নড়েচড়ে পোজ দিচ্ছে আমি নড়তে পারছি না মনে হচ্ছে স্ট্যাচু ও নয় স্ট্যাচু যেন আমিই।
প্রতিযোগিতা শেষ হল এটুকু বুঝতে পারলাম বান্ধবী আজ একটা কিছু হবে,বান্ধবী ২য় হলো। আর আমি পেলাম বহু প্রত্যাশিত জীবনের প্রথম পুরস্কার সান্ত্বনা পুরস্কার “কলম”। বান্ধবী ভেবেছিলো আমার মন খারাপ কিন্ত, আমি জীবনে প্রথম কিছুতে এভাবে অংশ নিয়ে পুরস্কারর পেয়েই মহা আনন্দে ঘরে ফিরলাম মনে মনে কলমটাকে দেখে ভাবতে লাগলাম “এই কলম যে সে কলম নয় এই কলমকে যাদুঘরে রাখা উচিত” এটা আমার পুরস্কার।এসব ভাবতে ভাবতে বান্ধবির বাসায় গিয়ে কলেজের নিয়মিত বেশভূষায় বাসায় ফিরলাম মহা আনন্দ নিয়ে।
ওদিকে আমার ফিরতে দেরী হওয়ায় আম্মা সন্দেহের বসে ব্যাগে জমানো টাকা চেক করলো আম্মা জানতো আমি অহেতুক কোন টাকাই খরচ করি না,পাই টু পাই আম্মা আমার সবকিছুর হিসাব রাখতো, তো সেই হিসাব অনুসারে জমানো টাকার গরমিল হওয়া এবং বোনের কাগজের দাড়িপাল্লা বানিয়ে দেয়া সবটা মিলিয়ে সুন্দর একটা এল্যুমিনিয়ামের জব্দ স্কেল নিয়ে আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকলো আম্মা।বাসায় ফেরার পর সান্ত্বনা পুরষ্কার কলমের সাথে সেই স্কেল দিয়ে সান্ত্বনায় নতুন মাত্রা যোগ করলো আম্মা আমার পিঠের ওপর।
অত:পর এই বিশেষ পুরষ্কার প্রাপ্তির আনন্দে আমার আর কখনো কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করার মত দু:সাহস সঞ্চয় করা হয়ে উঠলো না।
রম্যগল্প: পুরস্কার
#নাসরীন সুলতানা
৩.পারিবারিক কষ্টের গল্প
“খবরদার তুমি আমার পরিবার তুলে কথা বলবে না!”
হঠাৎ ছেলের রুম থেকে উচ্চস্বরে কথার আওয়াজ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম।
আমি জানি কারো রুমে, কারো কথায় আড়িপাতা ভালো অভ্যাস নয়। কিন্তু কেন যেন আজ আর এড়িয়ে যেতে পারিনি।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দোতলা ঘরের উপরতলার দক্ষিণ পাশের বারান্দা লাগোয়া প্রশস্ত রুমটার দিকে। যেখানে আমার একমাত্র ছেলে আসাদ তার বউ নিয়ে থাকে।
আসাদ বিয়ে করেছে মাস দুয়েক হবে। বিয়েটা আমরা করাইনি। অথচ অনেক শখ ছিল ধুমধাম করে একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করানোর।
আমার তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড় দুই মেয়েকে আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছি।
কিছু চাহিদা ছিল আমার। যে ছেলে আমার মেয়ের বর হবে তাকে সে সে চাহিদা পুরন করতে হবে।
আলহামদুলিল্লাহ্ আমার চাহিদা অনুযায়ীই পরের ছেলেরা আমার মেয়েদের বিয়ে করে নিয়েছে। তারাও স্বামী সংসার নিয়ে বেশ সুখেই আছে।
চাহিদা কিন্তু বেশি কিছু না। শুধু নারীকে মানুষ মনে করতে হবে, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। পুরুষ বলে নিজেকে ভিন গ্রহের প্রাণি মনে করলে চলবে না।
ছেলের বউয়ের জন্য আমার তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। শুধু একটা ফুটফুটে মিষ্টি মেয়ে হলেই চলবে। যার আত্মসম্মানবোধ থাকবে,যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানবে। এর বেশি শর্ত দিয়ে বিয়ে করানোর কোনো যোগ্যতাই আমার ছেলেটার। ছিল না।
যদিও সে ইংরেজি সাহিত্য এমএ পাশ করেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভালো গান করে, টুকটাক লেখালেখি করে। দেখতে বেশ সুদর্শন। কিন্তু…
কী বলব আর নিজের ঘরের কথা! বাবার মতো মুখ খারাপ। স্বভাবও মাশাল্লাহ বাবারটাই পেয়েছে। আমি না হয় ৩৫ বছর আগে এতিম ছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে কত কিছু সহ্য করেছি মুখ বুঝে। আজকাল কার মেয়েরা কেন মানবে?
আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, বিয়ের পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হওয়ায় তিনি তার মাকে গিয়ে নালিশ করলেন
” তোমার পছন্দের নবাবের বেটি কিন্তু এখনো ঘুমায়।”
আমারর বিস্ময়ের ঘোর পরের কয়েক সপ্তাহেও কাটেনি। যার সাথে রাতে আমার ফুলশয্যা হয়েছে। মা, খালা, নানীদের কথা মতো যার মনঃরঞ্জন করাই ছিল আমার সারা রাতের দায়িত্ব। সেই লোক দুই ঘণ্টার ব্যাবধানে এটা কী বলল! কাকে বলল?
বলার অবশ্য কারণ ছিল। পিতৃহারা এতিম, অসুন্দর মেয়েকে সে বিয়ে করতে চায়নি। নেহাৎ মায়ের অবাধ্যতা করতে পারেনি।
সেই লোকের সাথেই আমি বাধ্য হয়ে ৩৫ বছর সংসারও করেছি সাথে চার সন্তানের মাও হয়েছি। ও ভালো কথা আমার সাহেবও কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত এবং সরকারি চাকরিজীবী ছিল।
সমাজে ভদ্র মানুষ হিসাবেও বেশ নাম ডাক ছিল। অনেকে বিভিন্ন সালিসেও ডেকে নিয়ে মধ্যস্ততা করাত। বেশিরভাগই পারিবারিক সমস্যার সমাধান। অথচ সে সমস্যাগুলোই সে প্রতিনিয়ত সংসারে সৃষ্টি করত।
অথচ ঘরের খবর আমি চাপা রেখেছি। ইটের দেয়ালের ভেদ করে উঠোনেও বের হতে দেইনি।
সে কারণে মেয়েদের বিয়ের জন্য যত প্রস্তাব এসেছে। যত বায়োডাটা জমা পড়েছে। সবার মতো আমি ছেলের সার্টিফিকেট দেখিনি, চাকরির পদমর্যাদা দেখিনি। ছেলের ছবি দেখিনি। শুধু বংশ দেখেছি। কোন বংশের ছেলে? স্বভাব কেমন? আচরণ কেমন? শুধু বই পড়েই পাশ করেছে না-কি আদব কায়দাও কিছু শিখেছে?
আলহামদুলিল্লাহ আমি নিরাশ হইনি। বড় মেয়ের জামাই যেমন ভদ্র, তেমন ব্যাবহার। সে মনে হয় জীবনে কোনে মেয়েকে তুই বলেও সম্বোধন করনি। কারণ বেয়াই আমার একজন সৎ, আদর্শবান স্কুল শিক্ষক। ছেলে তো বাবার মতোই হবে।
মেজো মেয়ের বরও আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। পরিবারে ব্যলেন্স করে চলতে জানে। মাকেও সে অসম্মান করে না, স্ত্রীকেও অমর্যাদা করে না। ছোট মেয়ে অনার্সে পড়ে তার জন্যও আমার তেমন ছেলেই চাওয়া। বাকিটা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছে।
জেনেটিক একটা ব্যাপার আছে না। সেটাকে আমি কোনোভাবেই ঠিক করতে পারিনি। এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে অামার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় ভালো ফলাফল করছে। অথচ নারীদের প্রতি তার একধরনের বিদ্বেষ। সে নারী স্বাধীনতা পছন্দ করে না। নারীদের পুরুষের উপর কথা বলা পছন্দ করে না। ছেলের দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই।
সে সারা জীবন তার মাকে মিনমিন করতে দেখেছে। বাবার চড়া গলার নিচে মায়ের গলার স্বর চাপা পড়ে যেতে দেখেছে।
সে হয়তো ভেবেছে দুনিয়ার সব মেয়েই বুঝি তার মায়ের মতোই হবে।
আমি অনেক বুঝিয়েও ছেলের স্বভাব পরিবর্তন করতে পারি না। এটা তেমন কোনো দৃশ্যমান দোষ নয়। তাই হয়তো প্রেমিকার চোখে ধরা পড়েনি।
মারিয়ার সাথে তার তিন বছরের জানা শোনা ছিল। ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করবে, সেটা নিয়ে আমাদের দ্বিমত ছিল না। কিন্তু একা একা বিয়ে করবে সেটা মানতে পারিনি।
মারিয়ার বাবা অন্যত্র তার বিয়ে ঠিক করেছে। সে কারণে মেয়েটা রাতারাতি এসে আসাদের কাছে হাজির হয়েছে। পরে বাবা- মা কাউকে না জানিয়ে নিজেরাই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।
নিজের একমাত্র ছেলে ধুমধাম করে বিয়ে করাব। সে ‘
আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ছেলে বা ছেলের বউ কাউকে কিছু বলিনি।
ভয়ে হোক বা লজ্জায় হোক মেয়েটা আমাকে ভীষণ এড়িয়ে চলে। আমিও অপ্রয়োজনে কখনো কথা বলিনি।
সে হয়তো ভাবছে সংসারে শাশুড়ির কর্তৃত্ব চলে। তাকে ভয় না পেয়ে উপায় নেই।
অথচ এই কর্তৃত্বটুকু অর্জন করতে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোহাতে হয়েছে।
বছর পাঁচেক আগে আফজাল সাহেব স্ট্রোক করে প্যারালাইসিস হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত সংসারের নুন, তেলটুকুও তার পছন্দে কিনতে হয়েছে।
চলার ক্ষমতা, বলার ক্ষমতা হারিয়ে হুইল চেয়ারে জীবন আবদ্ধ করে এখন এতটাই নির্ভরশীল হয়েছে আমার উপর। আমাকে সঙ্গে না নিয়ে ওয়াশরুমেও যেতে পারে না। একক কর্তৃত্বে চলা সিঃহ পুরুষকে এভাবে লেজ গুটিয়ে চলা দেখতে আমার পছন্দ হচ্ছে না।
আমি সব কাজে তার পরামর্শ নেই, অনুমতি নেই। ছেলের বউতো আর এত কিছু জানে না।
আমার পায়ের শব্দ শুনে দুজনেই চুপ হয়ে গিয়েছে। আজই কিন্তু নতুন নয়। আমি প্রায় ওদের রুমে উচ্চস্বরে কথা শুনতাম। সবসময় স্বর আমার ছেলেরই চড়া থাকত। ভেবেছি হয়তো, জামা কাপড় পছন্দ মতো হাতের কাছে না পেয়ে বউয়ের উপর রাগ করছে। ছেলেটা একসময় এমন রাগ আমার উপরও করতো। এখন বউয়ের উপরও করছে ভেবে আমি খুশি হতাম না। ছেলে এখনো নিজের দায়িত্ব নিতে শিখেনি।
আজই ব্যতিক্রম হয়েছে। ভয়ে আমার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে সাথে আনন্দও লাগছে।
ভয়ে ধুকপুক করার কারণ, নিজের পছন্দের বউকে এমন কি বলেছে যে মেয়েটা এমন রেগে গেল?
আনন্দের কারণ হলো ত্রিশ বছর আগে প্রতিনিয়ত আমার বুকের ভেতর চাপা পড়ে যাওয়া যে বিদ্রোহী কন্ঠস্বর মরে কঙ্কালসার হয়ে গেছে, সে স্বরই আমি নতুন করে অন্যের কণ্ঠে শুনতে পেলাম।
” খবরদার তুমি আমার পরিবার তুলে কথা বলবে না।”
ত্রিশ বছর আগে যদি এই মেয়েটার মতো এমনি করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে পারতাম
” খবরদার, কথা মুখ সামলে বলবে…”
তাহলে হয়তো স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাকে ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হতো না।
দুঃখজনক হচ্ছে, কেউ নিজের ভুল বুঝে স্বেচ্ছায় আমার স্বাধীনতা মেনে নেয়নি। বাধ্য হয়ে আমার উপর দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে মাত্র।
কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির কাছে মারিয়ার হাই হিলের শব্দ শুনতে পেলাম। মেয়েটা এগিয়ে আমার কাছে এলো।
বাম হাতে একটা ব্যাগ আর ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছছে।
” মা আমি এলাম।”
আমি ওকে ফিরানোর চেষ্টা করিনি। যাক, ওর যাওয়াই উচিত। ফুলশয্যার পরের রাতে যদি এভাবে সাহস করে আমিও চলে যেতে পারতাম। তাহলে হয়তো এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হতো না আমাকে। আফজাল সাহেব আমাকে ফিরিয়ে আনলে নাকে খত দিয়েই ফিরিয়ে আনত। জীবনেও আর বাবা-মা তুলে কথা বলত না।
কী মনে করে কয়েক পা এগিয়ে মারিয়া আবার ফিরে এলো।
” মা আপনি নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি বাধ্য হয়েছি ফিরে যেতে। আপনার ছেলেকে বলবেন আমাকে ফিরানোর চেষ্টা না করতে।”
আমি শান্ত হয়েই জানতে চাইলাম
” যদি কিছু মনে না কর, কী হয়েছে মারিয়া।”
” মা আপনার ছেলে একটা অসভ্য, বর্বর, সাইকো। আমি রোজ অফিসে যাওয়ার আগে তার ফাইল, ঘড়ি, শার্ট জুতো সব রেডি করে রাখি। আজ রাখতে পারিনি। তাতেই…..”
মারিয়া নাক টেনেটেনে কাঁদছে। আমার খুব মায়া হলো মেয়েটার জন্য।
” তাতে কী হয়েছে…”
” আমার মা চাকরিজীবী। তিনি বাবা ঘুম থেকে উঠার আগেই অফিসে চলে যেতেন। বাবা নিজেই নিজের শার্ট,প্যান্ট, ঘড়ি, চশমা, জুতা রেডি করতেন। মাঝেমধ্যে চা পর্যন্ত বানিয়ে খেতেন। দুই দিন পর আমার চাকরি হলে কে তার এসব রেডি করে দেবে। তার কত বড় সাহস সে আমাকে আমার মায়ের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন বলছে।”
আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ আমার ছেলেতো দেখেছে। আমি সারারজীবন তার বাবার হুকুমের চাকর হয়ে ছিলাম। চুলার উপর দুধ রেখেও তার বাবার গলার শব্দ শোনা মাত্র সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি।
আসাত হয়তো জানে না, বুঝতে পারেনি কোনোটাই তার মা ভালোবেসে করেনি। ভয়ে করেছে, বাধ্য হয়ে করেছে।
আমার সাহসী, আত্মসম্মানে ভরপুর মেয়েটাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু করিনি। যে মেয়েটাকে আমার অত ভালো লাগেনি। যার উপর কষ্ট ছিল। আজ তার উপর শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা কাজ করছে।
আমি তো ছেলেটার জন্য এমনই একটা মেয়ে চেয়েছি। যে দীর্ঘদিন ধরে আমার ছেলের রক্তে লালিত আধিপাত্যের অহংকারের দেয়াল ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সত্যি কারের মানুষ বানাবে।
তিনমাস পর আসাদ মারিয়াকে ফিরিয়ে এনেছে। তিনমাস আগে যে মেয়েটা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তার চোখে, মুখে যে আত্মসম্মানবোধ আমি দেখেছি, সে যে এমনি এমনি ফিরে আসেনি সেটা আমি ঢের বুঝতে পেরেছি।
আশা করি আর কখনো ছেলের রুম থেকে উচ্চবাক্য বাইরে বের হবে না। আমার ছেলেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে, মেয়েদের আর যাই হোক অসম্মান করে কথা বলা যায় না।
ছোটগল্প
#আত্মসম্মান
কামমরুন নাহার মিশু
৪.রিলেশনের কষ্টের গল্প
একটি চকলেটের বাক্স
নাজমুন নাহার শামস
(ছোট গল্প)
হলিউডি মুভি আমি খুব একটা দেখি না। সময়ও নেই, দেখবই বা কেমন করে? বন্ধুরা নেটফ্লিক্স, হুলু আর কী কী সব দিয়ে দেখে ওসব কিছু নেই। তবে আমি অনেক গল্পের বই পড়ি, ইংরেজি নভেলও। নিজেকে গল্পের নানা চরিত্রে কল্পনা করি, তাদের সাথে কথা বলি। আমার তো কথা বলার কেউ নেই, তাই গল্পের চরিত্ররাই খুব আপন হয়ে উঠে, ওদের সাথে বসবাস করি। পুরোনো বইই বেশি কিনি, পড়া শেষে বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে অন্য বই কিনি। আমার একমাত্র বিলাসিতা, কিছুটা প্রয়োজনও। বিড়বিড় করে ইংরেজি গল্পের ডায়লগগুলো প্র্যাক্টিস করি, আমার ইংরেজি শেখার একটা কৌশল। আন্ডারগ্রেড শেষ হলেই, আমেরিকা যেতে চাই। আমার বহু দিনের স্বপ্ন, সেই ছোটবেলা থেকে। শুনেছি আমেরিকা স্বপ্নের দেশ, মোহের দেশ! কী সেই মোহ? তাছাড়া আমেরিকায় একজন মানুষ থাকে, তাকে একবার দেখার খুব শখ আমার!
ডিপার্টমেন্টে আমাদের স্টাডি গ্রুপে বেশ কিছু বড়লোক বন্ধু পেয়েছি। চলন বলন অনেক কিছুতেই আমাদের তেমন একটা মেলে না। কিন্তু বড় গ্যাদারিং হলে ওরা আমাদের মত অচল বন্ধুদেরও ডাকে, ট্রিট দেয়। দল ভারী হলেই না মজা করে আনন্দ! দর্শক না থাকলে ক্যারিশমা দেখানো যায় বুঝি! তাছাড়া আমার মত এত সুন্দর করে ক্লাসনোট গুছিয়ে রাখার সময় ওদের নেই। ওরা মাঝে মাঝে আমাকে ট্রিট দেয়, ওদের আড্ডায় ডাকে, আর আমি কখনও ওদের নোট ধার দেই, পড়া বুঝিয়ে দেই… অনেকটা গিভ এন্ড টেক রিলেশন। নট ব্যাড, রাইট? যেখানে বাবা-মা সন্তানের সম্পর্কগুলোই একসময় গিভ এন্ড টেক হয়ে যায়, তখন বন্ধুত্ব আর কতটুকু নিঃস্বার্থ হতে পারে। হ্যাঁ যা বলছিলাম, সেরকমই একদিন, সেদিন ছিল অনিন্দ্যর জন্মদিন। ওদের বাগান বাড়ির উঠোনে প্রজেক্টরে আমরা একটা মুভি দেখেছিলাম, “ফরেস্ট গাম্প”। সে মুভির নায়কের একটি ডায়লগ আমার ভীষণ প্রিয়,
“Life is like a box of chocolates,
you never know what you’re going to get.”
এ সত্যটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? ঠিক এই মূহুর্তেই, এক বাক্স চকলেট হাতে আমি পিয়াদের বসার ঘরের সোফায় বসে আছি। আর সেই চকলেটের বাক্সে বন্দী হয়ে আছে আমার গোটা জীবন। আমার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত! গতকাল কুরিয়ারে আমার কাছে এই বাক্সটি এসেছে, এরকম চকলেটের বাক্স আগে কখনও দেখিনি। অবশ্য আমার দেখার গণ্ডিও বেশি বড় নয়। তবে বাংলাদেশে এমন জিনিষ পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। সাথে এসেছে একটি ছোট সাদা তুলতুলে পুতুল ভালুক, যার বুকের মাঝখানে একটা নীল হার্ট আর একটা চিঠি। ঠিক চিঠি না, একে নোট বলাই শ্রেয়।
“যদি নীল শাড়ি পরে, আপনার সামনে এসে দাঁড়াই,
দেবেন কি একটি নীল টিপ আমার কপালে পরিয়ে?”
গতানুগতিক প্রেমপত্র নয়, তবে আহ্বানটা সুস্পষ্ট! নীচে নাম লেখা নেই, দরকারও নেই। এই হাতের লেখা আমার খুব পরিচিত। পিয়া মানে, আমার এক ছাত্রী লিখেছে। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম, কী রিয়েকশন হওয়া উচিৎ আমার? কী করা উচিৎ? ছাত্র-ছাত্রীর সাথে শিক্ষক শিক্ষিকার প্রেম বা বিয়ে আমি পছন্দ করি না। আবার কাছাকাছি বয়সের দু’টো মানুষের মাঝে প্রেম হওয়াটা অস্বাভাবিকও বলব না। মন কি আর এত বাধা মানে? আমার বাবাই নাকি মায়ের গৃহশিক্ষক ছিলেন। বাবা মায়ের ভালোবাসাবাসি নিয়ে সন্তানদের খুব বেশি জানার সুযোগ থাকে না। নানু একবার বলেছিলেন, বাবার প্রেমে পাগল হয়ে মা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। তারপর সকলের অসম্মতিতে নিজেদের বিয়ে করা, সেসব নিয়ে দু’পরিবারে কত ঝামেলা! সেই থেকে মা তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন! আমার অবশ্য এসব ঝামেলা নেই। পিয়াকে নিয়ে পালালে পিয়ার পরিবার কী করবে, বা আদৌ কিছু করবে কিনা জানি না, তবে আমার পরিবার কিচ্ছু করবে না। করবে কী করে? আমার তো পরিবারই নেই, নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ!। কিন্তু আমি নিজে কী করব? আমি কি পিয়াকে গ্রহন করব, নাকি বর্জন? প্রশ্নটা আপাতঃ সহজ মনে হলেও, জানেন তো, “সহজ কথা যায় না বলা সহজে”। নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন, আমি কি পিয়াকে ভালবাসি? হুম! বাসি! হয়ত! কিংবা হয়ত ঠিক ভালোবাসা নয়, শুধুই আকর্ষণ! কিংবা মোহ! আচ্ছা আপনি হলে কী করতেন? শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, অভিজাত পরিবারের সুন্দরী মেধাবী মেয়েকে এড়িয়ে চলা কি খুব সহজ? যখন সে নিজেই আপনার দু’বাহুর মাঝে ধরা দিতে চায়। আমি রক্ত মাংসের মানুষ, জৈবিক ক্ষুধা তৃষ্ণা আমারও পায়। এবার নিশ্চয়ই বলবেন, যদি ভালোবাসি তাহলে তো হয়েই গেল…, “সে ইয়েস ম্যান!! একটা নীল টিপ হাতে বেরিয়ে পড়ুন।”
বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। চকলেটের বাক্সটা বেশ সুন্দর! উপরের অফহোয়াইট হার্ড কভারের উপর একটা নীল রেশমি ফিতা দিয়ে সুন্দর করে বো বানানো। আমি নিশ্চিত এটা বিদেশি! পিয়ার চাচা-চাচী আমেরিকায় থাকে, আর পিয়া খুব চকলেট পছন্দ করে, ওনারাই হয়ত ওর জন্য এনেছেন! আর পিয়া সেটা আমাকে পাঠিয়েছে। সন্তর্পণে বো’টা খুলে, উপরের কভারটা সরিয়ে দেখলাম, আরেকটা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সিল করা বাক্সে চব্বিশটা ছোট ছোট খোপে চব্বিশটা চকলেট। একেকটা একেক রকম! আকৃতি, রং, স্বাদেও নিশ্চয় আলাদা! যদি কেউ বলে, কোন একটা এখন আমাকে খেতে হবে, আমি কিছুতেই ঠিক করতে পারব না কোনটা রেখে কোনটা খাব, কোনটা বেশি মজা বা কোনটা বেশি সুন্দর!
কাল সারারাত আমি ঘুমাইনি, অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে অতীত আর বর্তমানের যুদ্ধ আবার করেছি, ভবিষ্যতের আশংকায় শংকিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চকলেটের বাক্সটা ফেরত দেব। পিয়া এখন বাসায় নেই, আজকে আমার আসার কথা ছিল না, ফোনও করিনি। ভয় হয়েছিল, ফোন করলে যদি এসে দেখি পিয়া সত্যি সত্যি একটা নীল শাড়ি পরে হাতে টিপ নিয়ে বসে আছে! তখন আমার কী হবে? হয়ত আমার কথাগুলো আর বলতে পারব না। পিয়ার মা আমাকে অসময়ে দেখে একটু অবাক হলেন, বললাম তিনদিন পর পিয়ার একটা কঠিন পরীক্ষা আছে তার খোঁজ নিতে এসেছি। গুরুজনদের সাথে মিথ্যে বলতে খারাপ লাগে তবুও উপায় ছিল না। তিনি পিয়াকে ফোন করে, আমাকে জানালেন ও নাকি পনের মিনিটের মধ্যে বাসায় আসছে। আমাকে বসতে বলে, আন্টি ভিতরে গিয়ে চা পাঠালেন। চায়ে মাত্র চুমুক দেব, এক মাঝবয়সী মহিলা ড্রইংরুমে কী একটা খুঁজতে এলেন। আগে কখনও দেখিনি, সাজ পোশাক একটু অন্যরকম বোধহয় পিয়ার বিদেশ ফেরত চাচী।
দিনদশেক আগে পিয়া জানাল, এ মাসের মাঝামাঝি থেকে আগামী দেড়মাস ও পড়বে না। ওর মেজ চাচা-চাচী আর তাদের দুই ছেলে আসবে আমেরিকা থেকে। সবাই মিলে ঘুরবে, বেড়াবে, পিয়ার ছোট ফুপুর নাকি বিয়ে হবারও সম্ভাবনা আছে। পিয়া মহা উত্তেজনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে এসব বলছিল, আমার তখন মাথায় চিন্তার ছুটোছুটি। পিয়া পড়বে না মানে, এই দেড় মাসের বেতন পাব না। কীভাবে চলবে আমার? মাথা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল কোথায় কত টাকা জমানো আছে। তিনটি টিউশনি করে মাসে বিশ হাজারের মত পাই, খারাপ না। তার থেকে মেস ভাড়া, খাওয়া, যাতায়াত, ফটোকপি… এসবে প্রায় তেরো চৌদ্দ হাজার চলে যায়। আরও তিন-চার হাজার ইনসিডেন্টাল খরচ, বাকিটা চেষ্টা করি জমাতে। আমার পাঁচ-ছয় লাখ টাকা দরকার। ঐ যে পাশ করার পর আমেরিকা যাব। আমি ছাত্র খারাপ না, মন দিয়ে পড়াশোনা করি, রেজাল্টও ভাল। গ্র্যাড স্কুলের অ্যাডমিশন হয়ত আটকাবে না, ফান্ডও পাব আশা রাখি। কিন্তু শুরুতে যাবার সময় কিছু টাকা লাগবে। টাকা দেবার মত আমার কেউ নেই। ছোটবেলায় নানুর কাছে বড় হয়েছি। ক্লাস টেনে পড়ার সময়, নানু মারা গেলেন, মামারা কেউ আমার দায়িত্ব নেয়নি।
কিন্তু চাইলেই কী আর টাকা জমানো হয়! প্রতিমাসে কিছু না কিছু বাড়তি খরচ থাকেই! সেমিস্টার ফি, কোন কোর্সের বই লাগবে, পুরোনো শার্টটা ছিড়ে যাবে, মেসের খালার ধার চাই, হাজারটা ঝামেলা! টিউশনিও সবসময় থাকে না। শুধু পিয়ার টিউশনিটাই অনেকদিন থেকে টানা করছি। পিয়াকে পড়াই প্রায় চার বছর। শুরু করেছিলাম ও যখন ক্লাস টেনে পড়ত, আমি তখন কলেজে পড়ি। এখন পিয়া আমার ডিপার্টমেন্টেই ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে আর আমি থার্ডইয়ারে। বছরখানেক ধরেই পিয়ার মধ্যে একটু একটু পরিবর্তনের শুরু…. যখন পড়াতে আসি ও হাল্কা সাজগোজ করে আসে, একেকদিন একেকরকম জামা পরে, কোনদিন স্কার্ট, টিশার্ট, লেহেঙ্গা সালোয়ার কামিজ, কত রকমভাবে যে চুল আঁচড়ায়! আর আমার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জানতে চায়,
“আমাকে কেমন লাগছে ভাইয়া?”
আমি দায়সারা ভাবে “খুব সুন্দর, পড়তে বসো” বলে পড়াতে মনোযোগী হই। একদিন নীল শাড়িও পরেছিল, সেদিন ওর জন্মদিন ছিল। খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, তাই মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম,
“নীল শাড়িতে তোমাকে দারুন লাগে তো!”
ভাবতাম, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করেছে তাই হয়ত এসব পরিবর্তন। কিন্তু ওর চোখে মুখের চাপা কৌতূহল, অভিমান বা অনুরাগের ছোঁয়ার আভাস আমার নজর এড়ায় না। পাত্তা দেইনি, ও যত প্রগলভ হয়ে ওঠে আমি তত বইয়ের পাতায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করি। ক্যাম্পাসেও যখন তখন নানা ছুঁতো নাতায় ও আমার কাছে চলে আসে। আমি ব্যাস্ততার ভান করে সরে যাই। মুখে আমি যত যাই বলি না কেন, লুকিয়ে চুরিয়ে আমিও ওকে দেখি। ও চুপচাপ লিখে যখন আমি অপলক তাকিয়ে থাকি। ও প্রগলভ হয়ে যখন কথা বলে আমার বুকে কলকল ঝর্না বয়ে যায়। ও মিষ্টি করে হাসে আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, আমার চোখ ওর ঠোঁটে আটকে যায়… আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে পরি, ভীষণ ইচ্ছে করে…। তবুও অনেক সযত্নে নিজের ইচ্ছেকে লাগাম টেনে ধরি। আমি জানি আমার দৌড় কতটুকু। আমার বাবা-মায়ের একই ভুল আমি করতে চাই না। তাছাড়া এই টিউশনিটাতে আমি দশহাজার পাই, যা কোনভাবেই হাতছাড়া করা উচিত হবে না। তাও মাস শেষে টাকাটা নিতে কেন যেন মনের মধ্যে খচ খচ করে। তাই আরেকটা টিউশনি খুঁজছিলাম, পেলেই এটা ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আজ হঠাৎ করে ছেড়ে দেবার সময়টা বুঝি চলেই এল।
পিয়ার চাচী আমাকে দেখে একটু দাঁড়ালেন, স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন কিছুক্ষণ, কেন যেন ওনার ভ্রু কুঁচকালেন। খেয়াল করে দেখলাম, ওনার দৃষ্টি আমার হাতে ধরা চকলেটের বাক্সের দিকে। বিব্রত হলাম, কী ভাবছেন কে জানে? কিন্তু আমি কী বলব? বুঝতে না পেরে, উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম,
– আমি পিয়ার টিউটর।
উনি এখন চকলেট রহস্য কিছুটা অনুমান করতে পারলেন। পারারই কথা, আমাকে বসতে বলে, নিজেও মুখোমুখি সোফায় বসলেন,
– এই চকলেটের বাক্স পিয়া তোমাকে দিয়েছে?
এখন কী বলব? যদি বলি পিয়া দিয়েছে, ও কি কোন ঝামেলায় পড়বে? আবার যদি না বলি, তাহলে আমি পেলাম কোথায়? আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি কী বুঝলেন কে জানে? এবার সরাসরিই জানতে চাইলেন, পিয়ার সাথে আমার কোন সম্পর্ক আছে কিনা। এবারে আমি উত্তর খুঁজে পেলাম, একটু হেসে বললাম,
– জ্বী না! ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নেই।
– গুড! এ ধরনের কোন সম্পর্কে কখনও জড়াবেও না।
– জ্বী আচ্ছা!
– তোমার ব্যাক্তিগত ব্যাপারে, আমার অযাচিত উপদেশ নিশ্চয়ই তোমার ভাল লাগছে না!
– না না তা কেন হবে? আপনি বয়সে বড়, আমার ভালোর জন্যই তো বলছেন! কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না।
– আমি রেহানা, পিয়ার চাচী! আমেরিকায় থাকি ছুটিতে দেশে এসেছি। রেহানা আন্টি বলতে পার।
– হুম! পিয়া বলেছিল আপনাদের আসার কথা।
– তুমি কিছু মনে করো না, কম বয়সে দুনিয়াটা রঙীন মনে হয়, তখন অনেকেই ভুল করে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন আর ভুল থেকে ফেরা হয় না। সারাজীবন সেই ভুলটা বয়ে বেড়াতে হয়।
আমি চুপ করে রইলাম, সবাই ভুল জীবন বয়ে বেড়ায় না। কোন জীবনটা ভুল আর কোন জীবনটা ঠিক, সেটাও বলা মুশকিল! বাবাকে ছাত্র অবস্থায় বিয়ে করার দু’তিন বছরের মাথায় আমার মায়ের ভুল ভাঙে কিংবা ভুল হয়। কিন্তু ততদিনে আমি এই দুনিয়ায় চলে এসেছি। বউ-বাচ্চার খরচ যোগাতে বাবা হিমশিম খান। চাকরি আর চাকরির পর টিউশনি করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত! মা সারাদিন বাসায় একা, যে কোনদিন নিজের বাড়িতে কোন কাজ করেনি, এক হাতে সংসার সাথে ছোট বাচ্চার নানা ঝামেলা সামলাতে গিয়ে তিনি হাঁপিয়ে যেতেন। বাবার এক বন্ধু তাদের দুঃসময়ে অনেক সহযোগিতা করতেন। তিনি বছরের অর্ধেক সময় আমেরিকা থাকতেন, বাকীটা বাংলাদেশে। আমার জন্য বিদেশি ডায়পার, জামা, খেলনা আর মার নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিষ আমেরিকা থেকে তিনিই নিয়ে আসতেন। দেশে থাকলে নিয়মিত আমাদের খোঁজ নিতেন, বাসায় আসতেন। খালি বাসায় মার সাথে জমিয়ে আড্ডা দেন… মা’র সাথে ওনার সখ্যতা বাড়ে। ধীরে ধীরে তা গাঢ় হয়… আর বাবার প্রতি মায়ের অনুভূতি ফিকে হতে শুরু করে। এক পাত্রের পানি আরেক পাত্রে ঢালতে শুরু করলে অন্য পাত্রটি পূর্ণ হতে থাকে আর আগের পাত্রটি শূন্য হয়ে যায়! তাই বাবা-মায়ের একসময়ের ঘর পালানো তুমুল ভালোবাসা শূন্য হল, নাকি কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে! তারপর…
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তারপর একদিন মা তার জীবনের সব ভুল শুধরে, নতুন পথে যাত্রা শুরু করে, আর পিছনে পড়ে থাকি আমি আর বাবা। বাবা কিছুদিন মাকে অভিসম্পাত করে, একসময় নতুন পথ খুঁজে নেন। আমি শুধু একা পড়ে থাকি নানুর কাছে। নানা-নানু তাদের একমাত্র মেয়ের দু’ দু’বার পালিয়ে বিয়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে, অনেক আগেই আমার মায়ের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আমাকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে, মিসেস রেহানা এবার দুঃখ প্রকাশ করলেন,
– সরি তোমাকে উল্টো পাল্টা কথা বলছি। কিছু মনে করো না, বয়স বাড়ছে যে তারই লক্ষ্মণ!
আমি মাথাটা একটু কাত করে মৃদু হাসলাম। উনি চকলেটের বাক্সটা দেখিয়ে বললেন,
– জানো এটা বেলজিয়ামের হ্যান্ড ক্র্যাফটেড চকলেটের সিগনেচার কালেকশন! পিয়া আনতে বলেছিল। কিন্তু ওর টিচারকে দেবে সেটা বলেনি।
সারা দুনিয়ার এত দেশের নাম থাকতে উনি বেলজিয়ামের কথা বললেন কেন? ওদের চকলেট কী বিখ্যাত নাকি? হবে হয়ত, আমি বেলজিয়ামের আয়না বিখ্যাত শুনেছি! আবার হ্যান্ড ক্র্যফ্টেড! নাঃ বাবা কী বলতে কী বলে ফেলি, তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো। আমি আবারও একটু বোকার মত হাসলাম। উনি এবার প্রসঙ্গ বদলালেন, কোথায় পড়ি, কী করি, শেষে জানতে চাইলেন কোথায় থাকি।
– জ্বী মগবাজার।
– বাবা-মা’র সাথে?
– জ্বী না, আমি মেসে থাকি।
– ওহ! তাহলে তোমাদের বাড়ি কোথায়?
আমার কোন বাড়ি নেই, মামাদের বাড়িকে নিজের বাড়ি বলা যায় কি না জানি না। তাছাড়া আমার কে আছে না আছে কোথায় থাকে, তা এই অচেনা মানুষকে জানানোর দরকার কী! আচ্ছা! পনের মিনিট কি এখনও হয়নি? পিয়া আসছে না কেন? তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললাম,
– নাটোর।
– তাই নাকি! আমার বাড়িও নাটোর। নাটোরের কোথায় তোমার বাড়ি?
– শহরেই।
– কী বল? তুমি কলিমউদ্দিন শারাফাত সাহেবকে চেন?
– অবশ্যই! ওনাকে তো সবাই চেনে। শহরের নামকরা আইনজীবি।
হঠাৎ কলিং বেল বাজল, ভাবলাম, পিয়া, কিন্তু এক ভদ্রলোক আর দু’জন ছেলে ঢুকল। মনে হল, মিসেস রেহানার স্বামী আর দুই ছেলে। একজনের বয়স বার কি তের হবে, আরেক জনের সাত বা আট। মিসেস রেহানা ওদিকে তাকিয়ে বললেন,
“প্রবাল-শৈবাল জাদুঘর দেখা হয়ে গেল? আব্বুকে বেশি বিরক্ত করনি তো?”
ঘরে ঢুকেই দু’পাশ দিয়ে দুজন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ওনার দুই গালে দু’জনেই তাদের গাল ছুঁয়ে দিল। ছোট ছেলেটা মুখে বলল, “লাভ ইউ মাম্মা” বড়টা বলল, “উই মিসড ইউ”।
মিসেস রেহানাও ওদেরকে পাল্টা আদর ফিরিয়ে দিলেন, “আই নো মাই বয়’জ”
ওদের বাবা মৃদু তিরস্কার করলেন, “ডোন্ট কিস ইউর মাম, বাইরে থেকে এলে আগে হাত মুখ ধুতে হয় বলেছি না?”।
প্রবাল-শৈবাল মাকে ছেড়ে দিয়ে, বাবার সাথে বাড়ির ভিতরে গেল। মিসেস রেহানা আবার আমাদের কথোপকথনে ফিরলেন।
– হুম! দ্যা ফেমাস কলিমউদ্দিন শারাফাতের কথা বলছিলাম। উনি কে জানো?
আমি মাথা নাড়লাম। উনি কে সেটা বলেইছি, আবার উনি কী জানতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।
– আমার বাবা।
কোন কিছু ছাড়াই আমি শুকনো গলায় বিষম খেলাম। চারপাশে অক্সিজেনের বড্ড অভাব! কাশি আসছে, এতবড় ঘরেও ভীষণ দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে। এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিলাম। এই প্রথম আমি মাথা তুলে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ওনার দিকে তাকালাম। যাকে দেখার আমার আজন্মের অপেক্ষা, যার কোন ছবিও কোনদিন দেখিনি।
আমার হিসেবে ওনার বয়স চুয়াল্লিশ বা তেতাল্লিশ! কিন্তু দেখতে পঁয়ত্রিশের মত লাগছে। শ্যামবর্ণ আর ফর্সার মাঝামাঝি চমৎকার একটা গায়ের রং, স্লিম ফিগার, চুলগুলো অর্ধেক কালো আর অর্ধেক বাদামী রঙয়ের শেড নিয়ে ঘাড় জুড়ে ছড়িয়ে আছে। গোল মুখ, কী মিষ্টি হাসি! কী যে দারুণ দেখতে! আমি বেশ কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে দেখলাম ওনাকে। ইচ্ছে করছে তাকিয়েই থাকতে! কিন্তু কেন যে আমার শরীর হাল্কা হয়ে যাচ্ছে, যেন কোনকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সেই দমবন্ধ অবস্থাতেই আমার গলা দিয়ে অস্ফুট অথচ যথেষ্ট পরিস্কার স্বরই বের হল,
– আর… আমার নানা।
উনি হা হয়ে গেলেন, চোখে বিস্ময়! ওনার হাসি মিলিয়ে গেল, হা হওয়া মুখের ফাঁক দিয়ে ওনার নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল,
– তু… তু… তুমি অর্ণব!
আমি চোখ বন্ধ করলাম। হুম! আমার নাম অর্ণব, কিন্তু সে নাম বলার কোন ইচ্ছে আমার এখন হল না। তাছাড়া আমার অর্ণব হওয়া না হওয়ায় কিছু যায় আসে না! বলেছিলাম না জীবনটা চকলেটের মত! এসেছিলাম পিয়াকে চকলেটের বাক্সটা ফেরত দিতে। কিন্তু এসে পেলাম মিসেস রেহানাকে, যার জীবন নামক বাক্সে অনেকগুলো চকলেট থাকলেও, অর্ণব নামের দু’বছরের ছোট্ট চকলেটটির জায়গা হয়নি, যাকে তিনি অনেকদিন আগেই ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। আমার কাছেও এক বাক্স হ্যান্ড ক্র্যাফ্টেড বেলজিয়াম চকলেট! অথচ আমার এখন কোন চকলেট ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। শুধু উপরের হার্ড কভারের বাক্সটা আরেকবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব, যেখানে মিসেস রেহানার স্পর্শ লেগে আছে। হয়ত দোকান থেকে কেনার সময়, স্যুটকেস গোছানোর সময়, পিয়াকে দেবার সময় কতবার ওনার হাতের ছোঁয়া লেগেছে, তাই না? আমার খুব ইচ্ছে করছে বাক্সটা একবার গালে ছোঁয়াতে ঠিক একটু আগে যেমন করে প্রবাল-শৈবাল ওর মায়ের গালে গাল ছুঁয়েছিল।
সেসবের কিছুই আমি করলাম না। চকলেটের বাক্সটা সামনের টি টেবিলে রেখে, দ্রুতই উঠে পড়লাম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আরও একবার পিছন ফিরে মিসেস রেহানাকে দেখলাম। যাকে দেখার জন্য আমি একটু একটু করে টাকা জমিয়ে আমেরিকা যেতে চাই, যাকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম, আমার কী দোষ ছিল? তিনি আজ আমার সামনে, আমার দিকেই অপলক তাকিয়ে আছেন। ওনার সুন্দর মুখে অনেকগুলো অভিব্যাক্তির একত্রিত সমন্বয়! কিন্তু আজ আমার এখন কোন প্রশ্নও করতে ইচ্ছে হল না, এখন আর আমার আমেরিকায় যাবার কোন প্রয়োজন নেই। ভালই হল, এতক্ষণ ধরে মাথায় অনেক টেনশন ছিল। পিয়ার টিউশনিটা ছেড়ে দিলে আমার চলবে কীভাবে? আরেকটা টিউশনি কতদিনে যোগাড় হবে? এখন মাথা পুরো ফাঁকা। আমি নীরবে দরজা দিয়ে বের হয়ে এলাম। পিয়ার সাথে সিঁড়িতে দেখা, হন হন করে নেমে গেলাম, ও পিছু ডাকল, কিন্তু ফিরে দাঁড়ালাম না। আমার কোন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। পিয়ার জন্য চকলেটের বাক্সে আগেই একটা নোট লিখে রেখেছিলাম,
“নীল শাড়িতে তোমাকে নীল পরির মত লাগে। কিন্তু আমি যে মানব সন্তান! তোমার জন্য একটা নীল সুতির শাড়ি কিনতে গেলেও, তোমাকে পড়িয়ে পাওয়া টাকা থেকেই আমাকে কিনতে হবে। তাই পরি আর মানুষের দেখা হয় রুপকথার গল্পে। তোমার জীবন অবশ্য রুপকথারই, আমারটা অরুপকথার। তাই টিপটা না হয় রেখে দিও রুপকথার কোন রাজপুত্রের জন্য।”
তবে ঐ নোটের মনে হয় আর দরকার হবে না। পিয়ার চাচী আমাকে যেমন করে বোঝালেন, তেমনি হয়ত ভাসুরের মেয়েকেও বোঝাবেন, ভুল মানুষকে ভালোবাসতে নেই।
গেট দিয়ে বেরিয়ে, রাস্তায় জনস্রোতে গা ভাসালাম! চোখ দুটোতে বড্ড জ্বালা! বুকের কাছেও কী ভীষণ উত্তাপ! আজ কি খুব বেশি গরম পড়েছে!
(সমাপ্ত)
#নাজমুন_নাহার_শামস
অনেকদিন পর লিখলাম, কেমন লাগল?
৫.বউকে কষ্ট দেওয়ার গল্প
নাসরিন আমার বিয়ে করা বউ হলেও তার সাথে শুইতে আমার গা ঘিন ঘিন করতো। সরকার বাড়ির এই বিধবা মেয়েটিকে বিয়ে করে আনার পর থেকে আমার কেবল মনে হতো একটা সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিস কিনে আনলাম। কিনলাম আর কোথায়? তাকে বিয়ে করে যৌতুক বাবদ আড়াই লাখ টাকা গুনতে ভুল করিনি আমি। বাড়ির পাশে মুদির দোকানটি সেই টাকাতেই দাঁড় করিয়েছি। আমার তো এক পা খোঁড়া। খুঁড়িয়ে হেঁটে দেড় মাইল পাড়ি দিয়ে গঞ্জে গিয়ে কোনো কাজ করার সামর্থ্য নেই আমার। একসাথে মোটা অঙ্কের টাকাটা পেয়ে আমার বাবা যেমন সালাউদ্দিনের সরকারের কথায় রাজী হয়ে গেলেন। আমিও আর অমত করিনি। শুধু পাড়া প্রতিবেশীরা গুঞ্জন করে বলতো, “মেয়েটা বিয়ের সাত মাসের মাথায় জামাইটারে খাইলো। নাজমুল সে মেয়েটাকেই বিয়ে করলো টাকার লোভে। কী যে আছে তার কপালে আল্লাহ-ই জানে।”
আমি সেসব কথায় কান দেই না। বরং মনে হতো, টাকার লোভে তো বিয়ে করিনি। খোঁড়া মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমার যেমন এক পা খোঁড়া। আমার বউয়েরও আগে বিয়ে হয়েছে তাই সেও আমার মতো খোঁড়া।
বিপত্তি হলো আমার মনে। বড় একটা অসুখ বেঁধেছিল মনের ভিতর। সপ্তাহে তিন চারদিন রাতে তার শরীর ডিঙ্গাতে পিছপা হই না। কেন পিছপা হবো? সে আমার বিয়ে করা বউ। এতটুকু আমার পাওনা। কিন্তু কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। গা ঘিন ঘিন করতো আমার। তাকে ছুঁইলে মনে হতে থাকে, আমার আগেও নাসরিন অন্য পুরুষের সাথে ঘুমাইছে। অন্য পুরুষ তাকে চুমু খেয়েছে, গালে গাল ঘষেছে, আর….
ভাবলেই কেমন গা গুলিয়ে আসে। তবুও তার শরীর ডিঙ্গাতে হয়। না ডিঙ্গিয়ে তো উপায় নেই। বিয়ে করে আড়াই লাখ টাকা নিলাম যে। গতবারের বন্যায় যখন সব ফসল পানির নিচে। অভাবে পড়ে বাবা বাছুরসহ গাভী বিক্রি করে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন, গোরু বেচার টাকা খাওয়া শেষ হলে পরে কী খাবি? এবার তো কিছু একটা করা দরকার।
গোরু কিনে নিলেন সালাউদ্দিন সরকার। তখন সাত মাস হলো বিধবা নাসরিন বাবার বাড়ি এসে উঠেছে। বাবাকে ডেকে সালাউদ্দিন সরকার প্রস্তাব দিলেন, “তোমার ছেলেটার বেশ সুনাম আমাদের এলাকায়। গরীব ঘরে জন্মেও খোঁড়া পা নিয়ে মেট্রিক দিলো। এলাকার মানুষের বিপদে খোঁড়া পা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ে। আমার মেয়েটা বেশিদিন জামাইর ঘর করতে পারেনি। কারেন্টের শকে মরে গেছে। আল্লাহর কাজ সবই ভালো। আমি বলি কী? আমার মেয়েটারে নাজমুলের বউ কইরা নেও। আমি লাখ দুয়েক টাকা দিব, বাড়ির পাশে একটা মুদির দোকান দিয়ে বসুক। আর বিপদে আপদে আমি তো আছিই।”
বাবা তো রাজী হলো-ই, খুশি মনে আবারো সরকার বাড়ির কথাটুকু বাবা আমাকে শুনালেন। আমি খোঁড়া মানুষ, আর অমত করতে পারিনি।
আমাদের দুইজনের মাঝখানে একটা কোলবালিশ থাকতো। যখন শরীর ডিঙ্গাতে হতো, বালিশ সরিয়ে ফেলতাম। আবার বালিশ মাঝখানে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। শ্যামবর্ণের নাসরিন আমাদের বাড়ি আসার পর তাকে সাজতে দেখিনি। কথাবার্তাও খুব কম বলে। নম্র, ভদ্র হয়ে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি কেন যেন মন থেকে মেনে নিতে পারি না। কখনো মনে হয়, শরীরের প্রয়োজনে বিয়েটা করা না-কি টাকার প্রয়োজনে? আমার মনের প্রয়োজন তাহলে কোনটা? একরাতে নাসরিন আমাকে কোলবালিশ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে। আমি জেগে উঠলাম বালিশের ধাক্কায়। জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? উত্তরে বলল, বাইরে শেয়াল ডাকছে। ফিসফিস করে বাইরে কে যেন কথা বলে। আমার বড্ড ভয় লাগছে।
আমি বললাম, বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাও। তাহলে আর ভয় করবে না।
বাতি জ্বালিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো ঘুমানোর চেষ্টা করছে। একবার খুব ইচ্ছে হলো, মাঝের কোলবালিশটা চিরতরে সরিয়ে দেই। নাসরিনকে বুকে টেনে বলি, আমি আছি তো। ভয় পাচ্ছ কেন? বলা হয় না। কোথায় যেন একটা গা গুলানো ব্যাপার। রাতে শরীর ডিঙ্গানোর সময়ও আদর করে তাকে চুমু দেয়া হয় না। কী বিশ্রী এক অসুখ ধরেছে আমার মনে।
আমাকে নিয়ে যখন সরকার বাড়ি অর্থাৎ বাবার বাড়ি যায়। কত প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা। দুই ঘরের ভাবির সাথে গলাগলি ভাব করে হেসে লুটিয়ে পড়ে। আমি তখন সালাউদ্দিন সরকার মানে শ্বশুরের সামনে বসা থাকি। তিনি তার জমি সংক্রান্ত কথা বলেন। আমাকে বসে বসে সেসব শুনতে হয়। কথা একটু বেশি বলেন। তাছাড়া বিপত্নিক হয়ে বড্ড একাকী জীবন তার। কথা বলার মানুষ পেলে ছাড়তে চান না। আমি শ্বশুরের সামনে বসে আড়চোখে নাসরিনকে দেখি। জলপাই খাচ্ছে হাতের তালুতে লবন নিয়ে। আর কী এক কথা বলে চূলার পাড়ে দুই ভাবীর সাথে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। আবার কেমন হিংসে হতে লাগলো। আমাদের বাড়ি গেলে তার হাসি নেই। চুপচাপ থাকে সারাদিন। অথচ এখানে তার কত আনন্দ। আমি কি তার আনন্দ কেড়ে নিয়েছি? আমি কী করলাম? বারো তের ঘন্টা দোকানে বসে দুই চার পয়সা রোজগাড় তো করে আনি। অন্য পুরুষদের মতো তো মদ খেয়ে নটিবাড়িতে পড়ে থাকি না। তার বাবা আমার কত সুনাম করে। সুনাম আমার এলাকাতেও। শুধু পা একটা খোঁড়া। এমন জামাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
-বাবা নাজমুল। তোমার কোনোকিছু লাগলে আমাকে বলবা। আমার একটাই মেয়ে। আমি দু’হাত ভরে মেয়েটাকে দিতে চাই। মা মরা মেয়েটা তবুও হাসিখুশি থাকুক।
আমি কথার জবাব দেই না। মনে মনে ভাবি, একটা সূতার নাল-ও নেব না। যা নিয়েছি পারলে সেটাই ফেরত দেব।
বিকেলে বাড়ি আসার পথে নাসরিনের বড় ভাইয়ের বউ আমাকে ডাকলো। আমি কাছে যেতেই ভাবী আমাকে বললেন, সারা বছর তো দোকানদারি করলেন। এবার কয়েকটা দিন আমার ননদটারে সময় দেন। এখন কিন্তু ননদ একা না, পেটে আরেকজন আছে।
এটা শোনার পর থেকে আমার মনে নতুন করে অসুখ করলো। দোকানে মন বসে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। গা গুলানোর ব্যাপারটা, ঘিন ঘিন করতে থাকা বেড়ে গেল। আমি নাসরিনের দ্বিতীয় বর। তার পেটে বাচ্চা এলো। কিন্তু আমার মনে অসুখ। কিসের অসুখ তা কিছুটা আন্দাজও করতে পারি। তবুও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না।
নাসরিনের পেটে বাচ্চার বয়স যখন ছয় মাস তখন থেকে তার মানষিক অবস্থার পরিবর্তন হলো। রাতে খেয়াল করতাম সে বালিশ ডিঙ্গিয়ে আমার গায়ে হাত দিয়ে রাখতো। আমার হাত চেপে ধরে রাখতো। আমি তার হাত সরিয়ে দিতাম। একদিন সে কী মনে করে বলল, “আমাকে তুমি মন থেকে আজও মানতে পারোনি। তাতে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমাদের সন্তানটাকে মেনে নিও। এই সন্তান তোমারই। আমি আগে যার সাথে সাত মাস সংসার করেছি, সেখানে আমাদের সন্তান আসেনি। আর আমি যদি মরেও যাই, তুমি বিয়ে করিও। আর সন্তানটাকে মেনে নিও। তবুও যদি তোমার মানতে কষ্ট হয় তাহলে আমার বড় ভাবীকে দিয়ে দিও, বিয়ের পর থেকে ভাবীর সন্তান হয় না।”
আমার অসুখ হঠাৎ করে সেরে গেল। মনের অসুখটার মুখে যেন ঔষধ পড়লো নাসরিনের কথাগুলো। আমি কী মনে করে যেন মাঝের কোলবালিশটাকে মেঝেতে ফেলে দিলাম। নাসরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, “আমাদের সন্তান আমি কাউকে দেব না। এটা আমার সন্তান। আমি প্রথমবারের মতো মন থেকে নাসরিনের কপালে চুমো দিলাম। বললাম, আর কখনো মরার কথা বলবে না। কোনো সমস্যা হবে না তোমার, আমি আছি তো।” যে মেয়েটা বাবার বাড়িতে এতো হাসিখুশি। সে মেয়েটা হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠলো। আমি তাকে ফিস ফিস করে বললাম, এভাবে কাঁদলে বাবা মা কী ভাববে বলো তো? এই কথা শুনে নাসরিন হেসে উঠলো। এই অবস্থায় মেয়েদের বুঝা বড় দায়। এই হাসবে, এই কাঁদবে। কখনো রাগে ফোঁসতে থাকবে। এটা যেন প্রকৃতির খেলা।
গোরুর গাড়িতে করে বাবা আর নাসরিনের ভাই-ভাবী নাসরিনকে গঞ্জের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি হেঁটে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আজ শান্তি পাচ্ছি না। এই প্রথম মনে হলো, পা দুটো ভালো থাকলে দৌঁড়ে চলে যেতাম হাসপাতালে। ভোর সকালে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে বলল, আমার জানি কেমন লাগছে। আমি ব্যথা সহ্য করতে পারছি না। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো।
আমি নাসরিনকে শক্ত করে ধরে বললাম, এই সময়ে অবশ্যই মা চাচীদের ডেকে আনতে হয়। তুমি একটু সহ্য করো, আমি মা’কে বলি দাই নিয়ে আসতে।
দাই এসে বলল, হাসপাতালে নিয়ে যান তাড়াতাড়ি। আমি পারব না। আর প্রশ্ন করিনি কেন পারবে না? সরকার বাড়িতে খবর পাঠানোর পর গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিলো। নাসরিন যাবার সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, জানো? আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমানোর জন্য।
এই প্রথম নাসরিনের জন্য আমার চোখ ভরে পানি এলো। আমি বললাম, তুমি ফিরে আসবে। আমার খাঁ খাঁ করা বুকটার পূর্ণতা দিতে তুমি অবশ্যই এই বুকে ফিরে আসবে।
মাটির রাস্তায় গোরুর গাড়ির একেকটা ঝাঁকুনিতে নাসরিনের কেমন কষ্ট হচ্ছে সেটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে। আমি মেয়েটাকে অনেক অবহেলা করেছি। বিধাতার কাছে হাতজোর করে মিনতি, মেয়েটাকে বাকি জীবন যেন ভালোবাসতে পারি সেজন্য হলেও তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিও।
গঞ্জের কাছাকাছি বাঁশের সাকু পেরিয়ে যাবার পর দেখি নাসরিনের বড় ভাই মিষ্টি নিয়ে আসছে। আমাকে দেখে বলল, হা করো। একটা মিষ্টি মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, গ্রামের সবাইকে গোরু জবাই করে খাওয়াবে বাবা আগেই বলেছে। তোমার ছেলে হয়েছে মিয়া। তাড়াতাড়ি যাও।
ছেলে হবার আনন্দ আমাকে আনন্দিত করতে পারেনি। আমার ভিতরে শুধু নাসরিন। সে ভালো আছে তো?
হাসপাতালে ঢুকার পর নাসরিনের ভাবী বলল, জায়গা দাও বাচ্চার বাবা আসছে।
নাসরিন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার পাশে বসার পর নাসরিন আমাকে বলল, “তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমাদের ছেলে হওয়াতে তুমি খুশি হওনি? ছেলেকে কোলে নিবা না?”
আমি নাসরিনের হাত ধরলাম। একটু কাছে গিয়ে বললাম, তুমিই তো আমার সব খুশি। বাচ্চা তো কেবল উপলক্ষ।
নাসরিন মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলছে, এখন আবার বেশি খুশিতে চুমো দিও না। ভাবীরা আছে, বাবা ঔষধ আনতে গেছে। যেকোনো সময় আসতে পারে। আমি লজ্জা পাবো।
মনে মনে ভাবলাম, নিষেধ করল না সম্মতি দিল? আমি ফিস ফিস করে কথা বলার ছলে কপালে চুমু এঁকে দিলাম। দেখতে পেলাম অপূর্ব সৌন্দর্য, বউটার লজ্জারাঙ্গা মুখ।
গল্পঃ খোঁড়া
,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ