“আমি বাচ্চা কোলে নিতে ভয় পাই!”
কিছুটা অবাক হয়েই জিনিয়ার দিকে তাকালো ফাহাদ।
“মানে কি?”
“মানে একদম ছোট বাচ্চা কোলে নিতে ভয় লাগে আমার…!” জিনিয়া কাঁপা গলায় উত্তর দিলো।
“ভয়? কিসের ভয়?” ফাহাদের গলায় বিস্ময়।
“আমার সবসময় মনে হয়, একদম ছোট্ট কোন বাচ্চা যদি আমি কোলে নেই, ও আমার হাত ফসকে পড়ে যাবে! নিচের শক্ত ফ্লোরে পড়ে তার ছোট্ট মাথাটা ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সব মাখামাখি হয়ে যাবে রক্তে আর ম…!”
“থামো! স্টপ ইট!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো ফাহাদ। চোখমুখ প্রায় লাল হয়ে গেছে ওর। এই মেয়ে এসব কি বলে! বিয়ের আগে কোনদিন শোনেনি। বিয়ের পর দেড় বছর গেছে এতদিন তো শোনেনি এসব কিছু।
এখন যখন জিনিয়ার প্রেগন্যান্সির খবরে প্রচন্ড আনন্দ, খুশি হওয়ার কথা তখন এ ধরনের অশুভ ভয়ংকর কথা ওর মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে কিভাবে মাথায় ঢুকছে না ফাহাদের।
“কবে থেকে এই ভয় তোমার! কখনো বলতে শুনিনি আগে! আর এমন উদ্ভট সব কথা বলছো কেন!” ফাহাদ প্রচন্ড বিরক্তি আর উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করল। এখন আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে ওর কাছে, কেন কখনো জিনিয়াকে একদম নিউ বর্ন বেবি কোলে নিতে দেখেনি!
“সেই… ছোট থাকতে!” ভয় পাওয়া গলায় কান্না কান্না ভাব করে উত্তর দিলো জিনিয়া। ফাহাদের মায়া লাগছে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে।
জিনিয়ার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে ওকে আশ্বস্ত করলো নরম গলায়, এসবই মনের ভুল। সাবধানে থাকলেই কিচ্ছু হবে না! কোন এক সাধারণ ফোবিয়া হবে হয়তো! সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালেই ঠিক হয়ে যাবে। জিনিয়াও মাথা নাড়লো। সেও চায় সব ঠিক হয়ে যাক। এই ভয়াবহ ভয় নিয়ে কিভাবে নিজের অনাগত সন্তানকে আগলে রাখবে সে!
১০ মাস কেটে গেছে এরপর। ফাহাদ আর জিনিয়ার ছোট্ট সংসার আলো করে রেখেছে মিরা, ওদের চার মাস বয়সি মেয়ে।
জিনিয়া এর মাঝে সাইকিয়াট্রিস্টের থেরাপি সেশন শেষ করে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছিলো সেই ভয়টা।
কিন্তু, আজ বিকেলে যখন ব্যালকনিতে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলো ফাহাদ ও স্পষ্ট দেখলো জিনিয়ার চোখে মুখে সেই দশ মাস আগের রাতে দেখা সেই ভয়টা!
“কিছু হয়েছে?” ফাহাদ নরম গলায় প্রশ্ন করলো।
“কাল আমার চোখের সামনে একজনের কোল থেকে তার ছেলেটা পড়ে যাচ্ছিল, কোনমতে সামলেছে! আমি… আমি যদি সামলাতে না পারি! মিরার চার মাস হলো, কোনদিন ওকে কোলে নিয়ে হাঁটার সাহস করতে পারলাম না এখনো! কখনোই কি পারবো না?” করুন গলায় বললো জিনিয়া।
মিরার নানি সবসময় মিরার দেখাশোনা করে। জিনিয়া যতক্ষণ বেডে, শুধু ততক্ষণই তার কোলে থাকে মিরা ভুলেও ওকে নিয়ে বিছানা থেকে নামে না জিনিয়া। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পরও ও এই সাহসটা করতে পারেনি! এমনকি বাচ্চা রাখার বেল্ট, ক্যরিয়ার কোন কিছুতেই তার ভরসা নেই। যদি ছিঁড়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়? তাই কেউ আর তাকে জোরও করে নি।
“কিচ্ছু হবে না! কিচ্ছুই না। আই বিলিভ ইন ইউ ডিয়ার!” ফাহাদ জোর গলায় বললো।
পরদিন, দুপর দুটো।
ফাহাদ অফিসে। জিনিয়া বাসায় একা। মিরা ঘুমোচ্ছে বিছানায়। মিরার নানি বাইরে গেছেন কাজের মেয়েকে সাথে নিয়ে কিছু টুকটাক বাজার করতে। জিনিয়া একটা বই নিয়ে মন দিয়ে পড়ছে, হঠাৎ অনুভব করলো চারপাশে সবকিছু যেন ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠলো। কাঁপুনি থামছেই না! মুহূর্তেই জিনিয়া বুঝতে পারলো,
ভূমিকম্প!
ভয়াবহ ভূমিকম্প!
এই মুহূর্তে বাসা থেকে বের হতে হবে। তিনতলা থেকে নেমে যেতে হবে নিচে। মিরাকে নিয়ে নামতে হবে, এখন, এই মুহূর্তে!
কিন্তু?
স্বাভাবিক সময়েও যেটা করার সাহস জিনিয়া পায় না, আজ সেটা এ অবস্থায় করতেই হবে! মিরাকে কোলে তুলে নিলো জিনিয়া এক ঝটকায়।
ওর দু’হাত কাঁপছে। ভূমিকম্পের জন্য? না কি? জিনিয়া জানে না। চারপাশের ভয়ংকর কাঁপুনির মাঝে ও মিরাকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে চেষ্টা করছে বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে!
ঝনঝন ঝনঝন শব্দে কাঁচের জিনিসগুলো ভাঙছে! সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে চারপাশে। জিনিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মিরাকে জাপটে নিয়ে সে ছুটছে দরজার দিকে।
দরজা খুলে টলতে টলতে কোনমতে সিঁড়ি দিয়ে দু’পা নামতেই থেমে গেলো চারপাশের কাঁপুনি। এক ঝটকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে সব কিছু আরো অস্বাভাবিক লাগছে জিনিয়ার কাছে।
হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো ওর সিঁড়ির উপর মিরাকে কোলে নিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। ভূমিকম্প থেমেছে, মিরার হাতের কাঁপুনি থামছে না কেন!
ফাহাদের দেয়া সাহস, সাইকিয়াট্রিস্টের সেশনের সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছে জিনিয়া। ওর হাত ঠোঁট সব কাঁপছে। কিছুই হবে না। মিরার কিছুই হবে না। ও শক্ত করেই ধরে রেখেছে মিরাকে।
কোনমতেই কিছুই হবে না মিরার। জিনিয়া বিরবির করছে, কিচ্ছু হবে না। এ অবস্থায় মিরাকে নিচে আস্তে করে শুইয়ে দেয়াও সম্ভব না। সিঁড়ি ধাপে দাঁড়িয়ে ও! জিনিয়াকে নিয়ে আস্তে করে সিঁড়ি দিয়ে দুই ধাপ উঠে গেলেই হবে। আর কোন ভয় নেই, ও পারবে! ও পাগল না! এই ভয় অবাস্তব! এই ভয়ের কোন ভিত্তি নেই! বারবার বারবার নিজেকে শোনাচ্ছে জিনিয়া।
এক ধাপ পেছনে উঠতেই জিনিয়ার মনে হলো চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে আর পারছে না ও! মিরার চেহারাটা ঝাপসা হয়ে আসছে… মিরাকে কোনমতেই হারাতে পারবে না জিনিয়া… কিন্তু ও আর নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না!
হাত দুটো হঠাৎ করে সম্পূর্ন অবশ হয়ে গেলো, হাত ফসকে পড়ে গেলো মিরা!
জিনিয়ার মূর্তির মত চেয়ে চেয়ে রইলো, সিড়ির টাইলসে সজোরে পড়ে থেতলে গেলো ছোট্ট মিরার মাথা!
রক্তে মাখামাখি ছোট্ট শরীরটা গড়াতে গড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো নিচে! সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চেয়েও করতে পারলো না জিনিয়া। কোন শব্দ বের হলো না তার গলা দিয়ে চোখের সামনে বিভীষিকাময় ওই দুঃস্বপ্নের মত দৃশ্য আর সহ্য করতে পারলো না আর! নিকষ অন্ধকারে হারিয়ে গেল তার সমস্ত চেতনা, অনুভূতি।
———————————————————————————-
” আমি সত্যিই দুঃখিত ফাহাদ!” ফাহাদের পেছনে থেকে অস্ফুট গলায় কায়সার বললো। ফাহাদ ফিরে তাকালো না।
“আমি চেষ্টা করেছিলাম যতটা সম্ভব। কিন্তু সমস্যাটা যে এতটা গভীর ধারণার বাইরে ছিলো!” নিচু গলায় আরেকবার বললো জিনিয়ার সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফাহাদের বন্ধু, কায়সার।
ফাহাদ কিছু বললো না। হয়তো এটাই ভাগ্যের লিখন ছিলো!
সেদিন সিঁড়ির কোনায় লাগানো সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছিলো জিনিয়াকে। পাগলের মতো ছোটার চেষ্টা করছিলো মিরাকে কোলে নিয়ে। ওর ভাবভংগী দেখে মনে হচ্ছিল, বড় কোন ভূমিকম্প হচ্ছে! ও দুলছিলো। পাগলের মত মিরাকে আঁকড়ে ধরে নিজের ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করছিলো। পাশের বাসার লোক জিনিয়ার আতংকিত গলায় “ভূমিকম্প” চিৎকার শুনে বের হতে হতে সব শেষ!
সেদিন আদৌ কোন ভূমিকম্পই হয়নি!
জিনিয়া সব সময় আতংকে থাকতো, কোন না কোন একসময় তাকে মিরাকে কোলে নিতেই হবে, সেইদিনটা কবে? যদি সেদিন মিরাকে নিয়ে সে হাঁটতে না পারে? যদি মিরা তার হাত ফসকে পড়ে যায়! কবে? কবে সেই ভয়ংকর সময় আসবে? তার এই ফোবিয়া, অবচেতন ভাবে তাকে কল্পনা করিয়েছিলো ভূমিকম্প হচ্ছে! মিরাকে কোলে নিতেই হবে, মিরাকে বাঁচাতেই হবে!
“আমি ভেবেছিলাম, আমি জিনিয়াকে সুস্থ করতে পেরেছি। আমারই ভুল! আই লস্ট দ্য কেস অব জিনিয়া! আই লস্ট! আই এম সরি!” কায়সার অস্ফুট গলায় বললো।
“তুমি পুরোপুরি ব্যর্থ হও নাই কায়সার!” জিনিয়ার কবরের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কায়সারের দিকে তাকালো ফাহাদ। তার কোলে… ফুটফুটে মিরা! কায়সারের দিকে তাকিয়ে হাসছে যেন মেয়েটা!
সেদিন, জিনিয়া ভয়ংকর প্যানিক অ্যাটাক থেকে হার্ট ফেইলিওর হয়ে মারা যায়। কিন্তু তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জিনিয়ার অবচেতন মন, তার ফোবিয়া তাকে যতই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখিয়ে থাকুক না কেন, জিনিয়া সেদিন…
কোল থেকে ছাড়েনি মিরাকে। মৃত্যুর পরও তার দু’হাতে শক্ত করে ধরা ছিলো তার আদরের মিরা… সম্পূর্ন অক্ষত!
ফোবিয়া
#লেখনীতে_সাজ্জাদ_সিয়াম