ইলমা বেহেরোজ
বিনিময়েও পদ্মজাকে অন্তত এক রাত কাছে পাবার বাসনা জেগেছে মনে। পদ্মজাকে নিয়ে নষ্ট সব চিত্র ঘুরে বেড়ায় মানসপটে। আমির চুক্তি বাতিল করার আগে লোকদের পাঠিয়েছিল পদ্মজাকে তুলে আনতে। কিন্তু আমির হুট করে গুটি পাল্টে দিল। যেহেতু আমির ইয়াকিশাফির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করেছে তাই এই মুহূর্তে নতুন পদক্ষেপ না নেয়াটাই উত্তম বলে মনে হচ্ছে রফিকের। কিছুদিন যাক, তারপর পদ্মজাকে যেভাবে হোক তুলে আনবে – মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রফিক। অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে একটা হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে সকালের নাস্তা সাড়ল সে। যখন পুনরায় গাড়িতে উঠে তখন আকাশের মেঘ নিংড়ে ঝরতে শুরু করেছে ধরনীতে। এদিকের রাস্তা ভাঙা। একপাশে নদী, অন্যপাশে এবড়োখেবড়ো বিস্তৃত ক্ষেত। রাস্তা খাড়া থেকে ঢালু হচ্ছে। গাড়ির গতি কমাতে ব্রেকে পায়ের চাপ দিল রফিক। কাজ করছে না রেক! আবার ব্রেকে চাপ দিল। গাড়ির গতি বাড়ছে! বুক কেঁপে উঠল তার। সামনে তাকিয়ে দেখে একটা বাস আসছে। রফিকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আগের চেয়ে জোরে ছুটছে গাড়ি, প্রতি মুহূর্তে গতি বাড়ছে। বার বার ব্রেক চাপল সে, কাজ হলো না। গাড়ির উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তার। কে ব্রেক নষ্ট করল? প্রথমে চোখের পর্দায় ভেসে উঠল আমিরের মুখ! বাসের ড্রাইভার দ্রুত গতিতে গাড়িটিকে এগোতে দেখে ভড়কে যায়। দ্রুত মোড় পরিবর্তন করে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। কিছু দূর এসে বাস থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। যাত্রীরাও সেদিকে তাকাল। তাদের চোখের সামনে রোলার কোস্টারের মতো ছুটতে থাকা গাড়িটি একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে নদীতে। ঝড়ো হাওয়া আর বজ্রপাতের বিকট শব্দে প্রত্যেকের বুকের ভেতর শুরু হয় কম্পন। তাই আর কেউ ওদিকে পা বাড়াল না। বাসটি নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটতে শুরু করল।
ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বসে কিছু দলিলপত্র দেখছিলেন কুতুবউদ্দিন। সকাল থেকে তার তার মেজাজ বিগড়ে আছে। প্রথমে শুনলেন, বকুল বাড়িতে নেই। বাড়িতে পাঁচ জন কাজের মহিলা থাকা সত্ত্বেও বকুলকে রাখা হয়েছিল, তার ব্যক্তিগত সব কাজের জন্য। বকুলের হাতের চা কুতুবউদ্দিনের দিনকে সুন্দর করে। এতো ভালো চা যে কী করে বানায় এই মেয়ে ভেবে পান না তিনি। বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে গিয়ে দেখেছেন, বকুল কীভাবে চা তৈরি করে। অন্যরা যেভাবে বানায় সেভাবেই, অথচ স্বাদটা আলাদা হয়! তাই স্বাভাবিকভাবেই বকুলের হাতের চা না পেয়ে সকালটা মন্দ হয়ে উঠে। স্ত্রীর কাছে শুনেছেন, মাঝরাতে বকুলের বাবা উল্লাহ এসে মেয়েকে নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী নাকি খুব অসুস্থ। সারাক্ষণ, মেয়ে মেয়ে করছে। এদিকে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হবার কথা ছিল। আবহাওয়ার কারণে সেটা বাতিল করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক হয়েছে। দিনটা বড় অলক্ষুণে! কিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছে না। টেলিফোন বাজছে। কুতুবউদ্দিন এতে বিরক্তবোধ করলেন। গজগজ করতে টেলিফোন কানে তুললেন, ‘কে বলছেন?’ ওপাশ একটা চেনা স্বর বলল, ‘স্যার, আমি পারভেজ। আপনার ছেলে হামজাকে পাওয়া গেছে।’ কুতুবউদ্দিন চমকে উঠলেন। হামজা পলাতক: অনেকের সন্দেহ কুতুবউদ্দিন হয়তো নিজের ছেলেকে লুকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আদৌ তা সত্য নয়। হামজাকে পুলিশ গ্রেফতার করার পূর্বে কুতুবউদ্দিনের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়। সেই অভিমান থেকে জেল থেকে পালানোর পরও বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কুতুবউদ্দিন চারিদিকে লোক লাগিয়েছেন, ছেলেকে খুঁজে বের করতে। খুঁজে পেলে দেশ থেকে নিরাপদে বের করে দিবেন। 51% তিনি চারপাশ দেখে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কোথায়… কোথায় আছে আমার ছেলে?’ ‘মুর্শিদি জঙ্গলের লোহার গম্বুজে।’ এটা শুনে কুতুবউদ্দিনের পা থেকে মাথার তালু অবধি কেঁপে উঠল। এই লোহার গম্বুজকে ঘিরে রয়েছে এক গুপ্ত সৃস্মৃতি, তার প্রথম হত্যার স্মৃতি! তখন কুতুবউদ্দিনের বাইশ বছর, বেকার। তার বড় ভাই কাসেম ছিল দেশের একজন স্বনামধন্য মন্ত্রী। তার সামনে- পেছনে, ডানে-বামে ছিল শত্রুর মেলা। কুতুবউদ্দিন ক্ষমতার লোভে পড়ে বিপক্ষ দলের চক্রান্তে জড়িয়ে নিজের হাতে লোহার গম্বুজে পুড়িয়ে মেরেছিলেন কাসেমকে। তার হাতে হত্যার দায়িত্ব ছিল, কিন্তু কোথায় হত্যা করেছে তা কাউকে কখনো বলেননি। তাহলে হামজা কী করে ওই গম্বুজে গেল? ওপাশ থেকে পারভেজ বলল, ‘হামজা রাতে এখান থেকে চলে যাবে। তার সঙ্গে আরো দুজন আছে।’ কুতুবউদ্দিন কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল। তিনি অবাক হয়ে ভাবছেন, হামজা কী কাকতালীয়ভাবে ওখানে পৌঁছাল? নাকি এর পিছনে অন্য কারণ আছে? ভেবে কোনো কূল কিনারা মিলল না। বুকে একটা সূচ ক্রমাগত আঘাত করছে যেন। কাসেম নিখোঁজের তদন্ত এখনো চলছে। কেউ যদি জেনে যায় তাহলে কী হবে? কুতুবউদ্দিন জানে, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। ওই গম্বুজে গেলেও কেউ প্রমাণ পাবে না। তবুও তিনি ভয় পাচ্ছেন। বিশ্বস্ত তিনজনকে নিয়ে কুতুবউদ্দিন রওনা হোন লোহার গম্বুজের উদ্দেশ্যো চলার পথ শেষ হচ্ছে না। আঁকাবাঁকা রাস্তা আর বৃষ্টির জন্য গাড়ির গতি বাড়ানোও সম্ভব নয়। কুতুবউদ্দিনের বুকে দুরুদুরু কাঁপুনি।
চলবে,,,
পদ্মমির ২৭
ইলমা বেহেরোজ
কেনো এই কাঁপুনি তিনি জানেন না। ছেলের জন্য মন ছুটে চলছে আবার কোথাও যেন মনে হচ্ছে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। তিনি দ্বিধান্বিত। গন্তব্য আর চলার মধ্যে কোথাও যেন একটা টানাপোড়েন চলছে তার মাঝে। সে টানাপোড়েন শেষ পর্যন্ত চলার গতিতে কোনো ব্যঘাত ঘটাতে পারেনি। জঙ্গলের গভীরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি থেমে যায়, সন্ধ্যে হয়ে আসে। বাকি পথ হেঁটে পৌঁছালেন লোহার গম্বুজের সামনে। চারপাশ দেখে নিলেন এক পলক। বাহিরে এক স্থানে পঁড়িতে শার্ট টানানো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ছেলেটা বড্ড খামখেয়ালি! কতদিন ধরে আছে এখানে? জঙ্গল থেকে অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। চারপাশ বড় নির্জন। লোহার গম্বুজে কোনো জানালা নেই, একটামাত্র দরজা। তিনি একজনকে বাহিরে রেখে বাকি দুজনকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। নাকে এসে লাগে পেট্রোলের ঘ্রাণ। একটা অস্বস্তি হয় গায়ে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তিনি নরম সুরে ডাকলেন, ‘হামজা… হামজা?’ কোনো সাড়াশব্দ নেই। গম্বুজের ভেতর একটি ছোট ঘর আছে। কুতুবউদ্দিন গরটিতে ঢুকে দেখলেন একপাশে হারিকেন জ্বলছে। মৃদু আলোয় তারা একজনকে আবিষ্কার করল। দেয়ালের দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে আছে কেউ। কুতুবউদ্দিন টর্চ জ্বালিয়ে ডাকতে ডাকতে সেদিকে গেলেন, ‘হামলা, কথা বলছিস না’ কথাটি শেষ করার পূর্বেই চেয়ারে বসে থাকা মানুষটির মুখ দেখে চমকে উঠলেন তিনি। অস্ফুটম্বরে বললেন, পারভেজ।’ গলা কেটে হত্যা করে চেয়ারে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকো তিন ঘন্টা আগেই না কথা হলো। ব্যাপারটা ধরতে ধরতে ঘরের বাহির থেকে তীব্র আলো ভেসে আসে। তিনি দৌড়ে ঘর থেকে বের হলেন। চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। গম্বুজ থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একটি দীর্ঘদেহী মানব ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল। মানবটির মুখ এক পলক দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন কুতুবউদ্দিন। সেইসঙ্গে হঠাৎ করেই মনে পড়ল, এই লোহার গম্বুজ সম্পর্কে একজন জানত। সে হচ্ছে বাড়ির পুরনো দারোয়ান উল্লাহ! কিন্তু ততক্ষণে সময় ফুরিয়ে গেছে। যেভাবে ষড়যন্ত্র করে নিজের ভাইকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন ঠিক সেভাবেই তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। এই মৃত্যুর খবর কেউ জানবে না। হাজার চেষ্টা করেও সেখান থেকে বের হতে পারলেন না কুতুবউদ্দিন। তার করা বিকট চিৎকারে আঁতকে উঠে জঙ্গলের জীব ও কীটপতঙ্গরা।
পদ্মজা হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ জুড়ে অভিমান। আমিত্র এখনো বাড়ি ফিরেনি। বিকেলে অফিসের পিওন এসে বলে গিয়েছিল, ‘স্যার বলেছেন, আজ ফিরতে দেরি হবে।’ কেন ফিরতে দেরি হবে তা জানায়নি। পদ্মজা অভিমানী হয়ে ভাবছে, ‘গতকাল আমার সঙ্গে ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেল তবুও আজ সারাদিন উনি বাইরে থাকলেন, রাতে ফিরতেও এতো দেরি করছেন। আমাকে নিয়ে কী চিন্তা নেই? অচেনা একটা এলাকায় একা ফেলে রাখতে পারল? আমার থেকে বেশি কাজটাই বড় হয়ে গেল?’
চলবে,,,,
পদ্মমির ২৮
ইলমা বেহেরোজ
তার চোখে টলটল করে উঠল জল। আগে তবুও ভুবন ছিল। এখন সে একেবারে একা হয়ে গেছে। সারাদিন কত বৃষ্টি হলো, বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো পুরোটা সময় একা থাকতে হয়েছে। না, সে ভয় পায় না। কিন্তু একা একটা বাড়িতে থাকতে কী ভালো লাগে?
মনের ভেতর কত কথা ঘুরে বেড়ায়। একা থাকলেই পারিজার মৃত্যু আর হেমলতার মৃত্যু তাকে পোড়ায়। ভাইবোনদের খুব মনে পড়ে। পারিজার খুনিকে খুঁজে না পাওয়ার আক্ষেপে হৃদয়ে তোলপাড় বয়ে যায়।
পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ আসুক… আসুক শুধু।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমিরকে দেখা গেল। সে বাড়ির ভেতর ঢুকছে। পদ্মজা স্যান্ডেল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমির আসতেই গুমোট মুখে স্যান্ডেল জোড়া এগিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আমির বাসায় ফিরেই প্রতিদিন গোসল করে অথবা গলা অবধি গা ভেজায়। ঠান্ডার দিন, এতো রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গা ধুলে সর্দি-জ্বর হবে। পদ্মজা গরম পানি বসাল।
আমির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে বলল, ‘আজ খুব দেরি হয়ে গেল।’
পদ্মজা কিছু বলল না। সে রুম থেকে গামছা, ফতুয়া আর পায়জামা নিয়ে রেখে আসল গোসলখানায়। আমির পানি পান করতে করতে পদ্মজার ভাব-গতি দেখল। পদ্মজা যে আজ খুব ক্ষেপে আছে বোঝা যাচ্ছে!
কেন রেগে আছে বুঝতে পেরেও আমির নিষ্পাপ কন্ঠে বলল, ‘কী? কিছু হয়েছে? মুখ গোমড়া কেন?’
সে শার্ট খুলে চেয়ারের উপর রাখল। পদ্মজা শার্ট নিয়ে বলল, ‘কী হবে? কিছুই হয়নি।’
শার্ট ভেজা! পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল, ‘ভিজেছেন কেন? বিকেলের পর ভিজলে আপনার ঠান্ডা লেগে যায় জানেন না? জ্বর হলে তো শুয়ে থাকবেন, সব জ্বালা আমার উপর দিয়ে যায়।’ গজগজ করতে করতে সে শার্ট নিয়ে বারান্দায় চলে যায়।
আমির হাঁচি দেয়। অনেকক্ষণ ধরে হাঁচি দিচ্ছে। ইতিমধ্যে ঠান্ডা লেগে গেছে, মাথাটাও ব্যথা।
আমির চেয়ারে বসল। পদ্মজা উৎকণ্ঠা নিয়ে এসে তার কপালে হাত রেখে অনুভব করল, তীব্র উষ্ণতা! সে রীতিমতো ধমকে উঠল, ‘কোথায় গিয়েছিলেন? ভিজেছেন কেন? জ্বর বাঁধিয়ে বসেছেন।’
‘সন্ধ্যার দিকে বাড়িতেই ফিরছিলাম। ইমরানের বাবা মারা গেছে। জানাজায় গিয়েছিলাম।’
পদ্মজার চেহারা থেকে অভিমান সরে গিয়ে জায়গা নিল বিষণ্ণতা। বিড়বিড় করে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। কীভাবে মারা গেল? অসুখে?’
‘ক্যান্সার ছিল। কিছুক্ষণ আগে জানাজা হয়েছে।’
আমির গোসলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই পদ্মজা বাধা দিল, ‘গোসল করতে হবে না, জ্বর বাড়বে। আমি গরম পানি দিয়ে গা মুছে দিচ্ছি।’
‘জানাজা থেকে এসেছি। গোসল করতে হবে না?’
আমির রান্নাঘরে গিয়ে গরম পানির পাতিল ধরলে, পদ্মজা বলল, ‘আমি নিয়ে দিচ্ছি।’
‘গায়ে পড়বে। আমি নিচ্ছি।’
সে গরম পানি নিয়ে গোসলখানায় চলে যায়।
পদ্মজা দ্রুত হাতে টেবিলে খাবার সাজায়। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়। আমির গোসল সেড়ে টেবিলের পাশে দাঁড়াতেই পদ্মজা ঘুরে দাঁড়ায়। দুজন মুখোমুখি হয়।
আমির পদ্মজার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে বলল, ‘আমার লক্ষ্য আর গন্তব্য দুটোই তুমি। যেখানেই যাই তোমার কাছেই ফিরে আসব।’
পদ্মজা ছোটার চেষ্টা করে বলল, ‘বুঝেছি, ছাড়ুন।’
রান্নাঘরে শব্দ হতেই ওরা দুজন সেদিকে যায়। একটা বিড়াল। ঢুকেছে। আমির জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই পদ্মজা বলল, ‘বৃষ্টিতে ভিজছিল। তাই ঘরে এনেছি।’
‘আবার একেবারে রেখে দিও না যেন।’
‘রেখে দিলে কী হবে?’
‘কুকুর-বিড়াল আমার পছন্দ নয়। তবুও রাখবে?’
পদ্মজা কিছু বলল না। আমিরের পছন্দ নয় বলে ও কখনো কোনো পশু পালার কথা ভাবেনি। দুজন একসঙ্গে খেতে বসল।
আমির বলল, ‘তুমি চাইলে আমরা আগামীকাল ফিরব।’ পদ্ম নীড়ে
পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল। বলল, ‘আর দুইদিন থেকে যাই? বাড়িটার মায়ায় পড়ে গেছি।’ আমির না করল না।
রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো তার। পদ্মজা সারারাত জেগে জলপট্টি দেয়, সেবা করে। শেষ রাতে আমির ফিসফিস করে বলল, ‘যদি আমি আগে মারা যাই, আমার আত্মা থেকে যাবে। তোমাকে রেখে কোথাও যাবে না।’
জ্বরের ঘোরে মানুষ কত কী বলে! তবুও পদ্মজার বুকে কাঁপন ধরে যায়। তার আগে আমিরের মৃত্যু হবে সে ভাবতেই পারে না। বুকের ব্যথা তীব্র আকারে বেড়ে যায়। সে আমিরের উষ্ণ ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমার আগে
আপনি কোথাও যাবেন না।’
সকালের দিকে আমিরের জ্বর কিছুটা কমে। বারান্দায় বসে সকালের চা পান করছিল আর পাখির ডাক শুনছিল। ভোরের সূর্যোদয় দেখেই পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকেছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সুরুজ বাজার-সদাই করে দিয়ে যায়। সেইসাথে বিনয়ের সঙ্গে বলে, ‘ভুবনটা হঠাৎ চলে যাবে ভাবিনি। আপনাদের বিপদে ফেলল। তাই আমিই বাজার করে নিয়ে আসলাম। পদ্মজা সুরুজকে অপেক্ষা করে খেয়ে যেতে বলে। খাওয়ার লোভ হলেও আমিরের ভয়ে সে চলে যায়।
‘চায়ের কাপটা নিয়ে যাও।’ আমিরের গলা।
পদ্মজা কাপ নিতে যাবে তখনই দরজায় শব্দ হলো। এই সময়ে কে আসল? পদ্মজাকে থামিয়ে আমির এগিয়ে গেল।
দরজা খুলে আমির অবাক হয়ে যায়। মজিদ আর আলমগীর দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা মজিদকে দেখে দ্রুত মাথায় ঘোমটা টানল।
স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে মজিদের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
পদ্মজা বলল,’ কেমন আছেন আব্বা?’
মজিদ ভেতরে প্রবেশ করতে করতে গম্ভীর সুরে বললেন, ‘ভালো। তাহলে এখানেই থাকছ তোমরা।’
আমির বলল, ‘জি আব্বা।’
মজিদ আমিরকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘তোমাকে ওমন। লাগছে কেন? অসুস্থ? পদ্মজা, ওর কী হয়েছে?’
‘জ্বর বাঁধিয়েছে আব্বা। বৃষ্টির মধ্যে গতকাল জানাজায় গিয়েছিলেন।’
‘ডাক্তারের কাছে গিয়েছ? এখনের বৃষ্টি তো ভালো না। জ্বর সাড়ে না সহজে।’
আমির নম্র কণ্ঠে বলল, ‘ফাক আব্বা। আপনি বসুন। পদ্মজা
রান্না বসাও। বাজার থেকে কিছু আনতে হবে?’ ‘না, না। সব আছে।’
মজিদ বাধা দিলেন, ‘এতো তাড়াহুড়ো করো না। নাও মিষ্টিটা নাও। আমরা চলে যাব।’
পদ্মজা আঁতকে উঠল, ‘সেকী! ছেলের কাছে এসেছেন, চলে যাবেন কেন?’
‘ঢাকা আমার কাজ আছে। তোমাদের কথা শুনেছি, তাই দেখে গেলাম।’
‘না, না আব্বা। এটা ঠিক না। এমন করছেন যেন পরের বাড়িতে এসেছেন। ছেলের বাড়িতে বাবা কখনো না খেয়ে যায়?’
‘তোমরাই তো এখন বিপদে আছো।’
পদ্মজার জেদ, ‘না আব্বা, আপনি থেকে যাবেন।’
‘সেটা তো অসম্ভব। আমি কী-
পদ্মজা এগিয়ে আসল। অনুরোধ করে বলল, ‘দয়া করে দুটো
দিন থেকে যানা আমার মা-বাবা কেউই তো নেই। কাকে এনে রাখব কাছে?’
মজিদ নিরুপায় হয়ে বললেন, ‘এতো করে যখন বলছ, না থাকি কী করে?’
পদ্মজার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল, ‘আম্মাকেও নিয়ে আসতেন। দুজন কিছুদিন আমার কাছে থাকতেন।’
‘তোমার শ্বাশুড়ি এতো দূর আসার সাহস পায় না।’
মজিদ, আমির, রিদওয়ান গোল হয়ে ছাদে বসে আছে। রোদ নেই, বৃষ্টিও ষ্টিও নেই। চমৎকার পরিবেশ।
মজিদ বললেন, ইয়াকিশাফির চুক্তি বাতিল করা ঠিক হয়েছে?’
মজিদের আগমনে আমির বিরক্ত বোধ করছো তা তার চেহারায় ফুটে উঠেছে।
সে বলল, ‘অকারণে কিছু করিনি।’
মজিদ বললেন, ‘কারণটাই জানতে চাই।’
তার কাজের জন্য তার কাছেই কৈফিয়ত! কিন্তু আমির রাগল না। সে যদি শহরের রাজা হয়, মজিদ গ্রামের রাজা। নারী সংগ্রহের ৮০ শতাংশ কাজ মজিদের নিয়ন্ত্রণে হয়। তিনি এতোটাই ক্ষমতাধর, চাইলেই অলন্দপুর থেকে বেরিয়ে পুরো নেত্রকোনা জেলার প্রধান হতে পারেন। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়াও তার ক্ষমতা নেত্রকোনার সর্বত্র জুড়ে। মজিদকে ছাড়া আমির কিছু না, আমিরকে ছাড়া মজিদ কিছু না। বাপ-বেঠা দুজন দুজনার পরিপূরক। একজনের ধ্বংস হলে রাজত্ব অর্ধেক খসে যাবে।
মজিদ আবার বললেন, ‘আমি শুনেছি কুতুবউদ্দিন মারা গেছে। চুক্তি বাতিল না করে এই পরিকল্পনা করা যেত না? তুমি কীভাবে কী করেছ? কী ভেবে করেছ?”
আমির ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে পদ্মজার উপস্থিতি দেখল। বলল, ‘তাহলে পুরো ঘটনা বলতে হবে। আমি চুক্তি বাতিল করার উদ্দেশ্যে কুতুবউদ্দিনের বাড়িতে যাইনি। গিয়েছিলাম দুটো কারণে। প্রথমত, বোঝার জন্য, কে কে আমার আর পদ্মজার সম্পর্কে জানে। কিন্তু ওখানে থাকা নেতাদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে এরা কিছু জানে না। দ্বিতীয় কারণ, বাড়ির ভেতরে কে কে থাকে দেখতে চেয়েছিলাম। আমার বাড়িন ভেতরের খবর প্রয়োজন ছিল। হামজা কোথায় আছে জানা দরকার ছিল। বাকিটা ভাগ্যের জন্য হয়েছে। যখন ওরা আমাকে নিয়ে ভেতরে যায়, একটা মেয়েকে দেখি। মেয়েটার চেহারা উল্লাহর মতো। সন্দেহ হয়, ও হয়তো উল্লাহর মেয়ে। উল্লাহকে আমি চিনি। উল্লাহর মাধ্যমে চাইলেই মেয়েটাকে বের করে আনা যাবে। জানা যাবে, ভেতরকার কথা। রফিক আর ওর রক্ষিতা ময়নার দারোয়ানের কথাতে বুঝতে পারি, রফিক পরদিন কোথার
যাবে। পরদিন সকালে ওর বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে
থাকি। যখন ও বের হয়, পিছু ধরি। পথে ব্রেক নষ্ট করে দেহা যদি ব্রেক নষ্ট না করতে পারতাম তাহলে ওর সাথে ময়নার বাড়িতেই যেতাম। ওখানেই ওকে খুন করতাম। কিন্তু পথেই ও মারা গেছে। আর কুতুবউদ্দিনের ঘটনা বোধহয় জানেন। এখন আমি যদি সেদিন ওই বাড়ি থেকে এমনি এমনি বেরিয়ে যেতাম, ওরা সর্বক্ষণ সতর্ক থাকত। চুক্তি বাতিল করেছি বলেই ওরা ভেবে নিয়েছে, আমি দূর্বল হয়ে গেছি, হেরে গেছি। এটা জয়ী হবার একটা গুটি ছিল মাত্র।’
‘তাই বলে এতো বড় ত্যাগ! চাইলেই অন্য পরিকল্পনা করা যেত। বছর শেষে নির্বাচন কত টাকা প্রয়োজন। দলের লোকরাও এখন টাকা বেশি চায়। এটা একদম ঠিক হয়নি।’ আমিরের পদক্ষেপে মজিদ অসন্তুষ্ট।
আমিরের তাতে যায় আসে না। পদ্মজা কিছু জানার আগে সব শেষ হয়েছে এতেই সে খুশি। কিন্তু কেন যেন সেই খুশিটা পরিস্ফুট হচ্ছে না! সে দায়সারাভাবে বলল, ‘তিনটে অর্ডার আছে। দুটো চার মাসে দিতে হবে। আরেকটার জন্য পাঁচ মাস হাতে।’
‘টাকা দিয়েছে?’
‘অর্ধেক। নিয়ে যাবেন।’
আলমগীর মনে করিয়ে দিল, ‘কুয়েতের নূরস হান্নানের ভাই। সব টাকা এডভান্স করেছে।’
‘ওই টাকা আমার দরকার আছে। কক্সবাজারে বাংলো করব।
চলবে,,,
সম্পূর্ণ গল্প