১.
‘বাহ, নেকলেসটাতো বেশ সুন্দর। কোথা থেকে কিনলে?’
‘কিনি নি। আমার মায়ের নেকলেস এটা।’
‘ওহ আচ্ছা। খুব সুন্দর, অসাধারণ।’
প্রশংসা করতে করতে অর্পার গলার নেকলেসটার দিকে তাকিয়ে থাকে রুনা। এরকম একটা নেকলেস কেনার খুব শখ ছিলো তার। বোঝাই যাচ্ছে অর্পা নেকলেসটা বিক্রি করবে না, মৃত মায়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন কেই বা বিক্রি করতে চায়? তবুও এই নেকলেসটা তার চাই, যে কোনো ভাবেই হোক।
পার্টি থেকে ফেরার সময় রুনা অর্পাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘যাই এখন। অনেক সুন্দর একটা পার্টি দিলে। অনেক এনজয় করলাম।’ অর্পা টেরও পেল না, এই ফাঁকেই রুনা তার গলা থেকে নেকলেসটা খুলে লুকিয়ে ফেলেছে।
নিজের ঘরে এসে নেকলেসটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো রুনা। কি অদ্ভুত সুন্দর নেকলেসটা, এমন সুন্দর এক নেকলেস যে এখন কেবল তার সেটা ভাবতেই বুকটা আনন্দে ভরে গেলো। এই নেকলেসটা এখন আর সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। নেকলেসটা বিছানার পাশে রেখে রুনা শুয়ে পড়লো, সকালে উঠে সূর্যের চকচকে আলোয় আবার সে নেকলেসটাকে দেখতে চায়।
মাঝরাতে রুনার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠেই বিছানার পাশে তাকালো নেকলেসটা দেখার জন্য, দেখলো ওটা জায়গামতোই আছে। কিন্তু ঘরে কেমন একটা পঁচা, বাজে গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠলো রুনার, ভাবলো ঘরের কোন কোণে মনে হয় ইঁদুর মরে পড়ে আছে। সকালে উঠে সাফ করতে হবে, এখন খুব ঘুম পাচ্ছে ওর। ঘুমানোর চেষ্টাতেই বাম পাশ থেকে ডানপাশে ফিরলো সে, কিন্তু যা দেখলো তাতে ভয়ে জমে গেল।
ও দেখতে পেল এক বুড়ি মহিলা মশারিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের মাংস যেন পঁচে গলে পড়ছে, চোখ দুটো টকটকে লাল। সে রাগী গলায় রুনাকে বললো, ‘তোর এতো লোভ? আমার মেয়ের কাছ থেকে আমার দেয়া জিনিস চুরি করেছিস। তোকে আমি ছাড়বো না।’ রুনা কিছুই বলতে পারলো না, ভয়ে তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো।
পরেরদিন অর্পা তার স্বামী সাহেদের কাছে গিয়ে হাসিমুখে বলতে লাগলো,’জানো, কাল রাতে মা এসেছিলেন। পার্টিতে যে নেকলেসটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেটা ফেরতে দিতে।’ সাহেদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অর্পার পাগলামিটা আবার বেড়েছে। ওকে আবার সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
ওদিকে রুনা আহমেদের বাসায় ততক্ষণে কান্নার রোল পড়ে গেছে। কাল রাতে মারা গেছে রুনা। ডাক্তার সন্দেহ করছেন স্ট্রোক, নয়তো হার্ট অ্যাটাক। তবে সবাই বলাবলি করতে লাগলো, সকালে যখন রুনাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, তখন নাকি তার চোখদুটো সম্পূর্ণ খোলা ছিলো, আর মুখে ছিলো ভয়ানক আতংকের ছাপ। যেন কাল রাতে ভয়ঙকর কিছু একটা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলো সে।
২.
কয়েকদিন ধরেই আনিস সাহেব বাসার ছাদে মার্বেল খেলার আওয়াজ পান। আজও পাচ্ছেন। আজ আর তিনি কৌতূহল সামলাতে পারলেন না, সিঁড়ি বেয়ে চুপিচুপি ছাদে উঠে গেলেন কে ছাদে আছে দেখার জন্য।
দেখলেন দুটো বাচ্চা ছেলে মার্বেল খেলছে, এদের তিনি আগে কখনো দেখেননি। এরাই তবে প্রতিদিন বিরক্ত করে? আজ তবে এদের একটা শিক্ষা দিতে হবে।
আনিস সাহেব আড়াল থেকে বেরিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই, কি হচ্ছে? এটা মার্বেল খেলার সময়?’
ছেলে দুটো তাকে দেখে ভয়েই আধমরা। একজন কোনোরকমে আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘ভাইয়া, তুই না বলেছিলি এ বাসায় কেউ থাকে না? তাহলে এ লোকটা এলো কোথা থেকে?’
আনিস সাহেব রাগী গলায় বললেন, ‘ভূত হয়ে এসেছি। আরেকদিন যদি তোদের এখানে দেখেছি তো ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খাব। যা, পালা এখন।’ বলতে না বলতেই ছেলে দুটো দৌড়ে এ বাড়ির লাগোয়া পাশের বাড়ির ছাদে লাফিয়ে চলে গেল। সেখান থেকে এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে।
আনিস সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ভাবতে লাগলেন, তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখনও বাচ্চারা তাকে ভীষণ জ্বালাতো। মরার পরও এদের জ্বালাতন থেকে রেহাই পাওয়া গেল না।
৩.
‘এটা কি রেনুদের বাসা?’
কলিংবেল বাজানোর পর যে মহিলা দরজাটি খুললেন তাকেই মিলি প্রশ্নটা করলো। মহিলাকে সে আগে কখনো দেখেনি। মহিলার চেহারাটি কেমন যেন, দেখেই কেমন একটা ভয় লাগা অনুভূতি তৈরি হয়।
মহিলাটি একটু হাসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু উনার কঠিন মুখে হাসি ফুটলো না। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ও তো ভেতরেই আছে। তুমি ভেতরে এসো।’
একটু ইতস্তত করেই ঘরে ঢুকলো মিলি ।
ঘরের ভেতরে কেমন যেন একটু অন্ধকার অন্ধকার ভাব, কম পাওয়ারের বাতির জন্যই হয়তো। মিলি সোফায় বসে বললো, ‘রেনুকে একটু ডেকে দিন না। আমার একটু তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।’
মহিলাটি বললেন, ‘আরে ওতো তাড়া কিসের? বাসায় যখন এসেছো, একটু জিরিয়ে নাও। আমি রেনুকে ডেকে দিচ্ছি।’
‘মাফ করবেন, আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। আগে হয়তো দেখি নি…’
‘হ্যাঁ আমাকে দেখোনি আগে। আমি রেনুর খালা হই।’
মহিলাটি চলে গেলেন। মিলি বসে রেনুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। রেনুর কাছে কিছু নোটস নিতে এসেছে, আজকেই ফটোকপি করে আবার ফেরত দিয়ে যেতে হবে। কাল এক্সাম আছে এগুলোর ওপর।
এটা রেনুদের নতুন বাসা, আগে এখানে আসেনি মিলি । বাসার লোকেশনটা রেনু বলে দিয়েছিলো ফোনে, বলেছিলো বাসার নিচে এসে কল দিতে, রেনু এসে ওকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ঠিকানায় পৌঁছে রেনুকে ফোন দিয়ে রেনুর নম্বর বন্ধ পায় মিলি। শেষে বাধ্য হয়েই তিনতলাতে উঠে পড়ে ও, রেনুর কাছে কবে যেন শুনেছিলো তিনতলায় ফ্ল্যাট নিচ্ছে ওরা। আর তিনতলায় উঠেই এই মহিলার সাথে দেখা।
কিন্তু রেনু এখনো আসছে না কেন? মহিলাটিরও তো কোনো দেখা নেই। মহিলাটি যে ঘরে ঢুকেছিলেন তার সামনে গিয়ে মিলি বললো, ‘খালা, রেনুকে একটু তাড়াতাড়ি ডেকে দিন না প্লিজ। আমার এখনই যাওয়া লাগবে।’
‘হ্যাঁ মা, একটু বসো, ও এখনি আসছে।’
মিলি আবার গিয়ে সোফায় বসলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। এরমধ্যেই ওর মোবাইলে কল আসলো। ও অবাক হয়ে দেখলো রেনু ফোন দিয়েছে।
ফোন ধরতেই রেনু বললো, ‘স্যরি রে, ফোনে চার্জ ছিলো না। তুই কি নিচে দাঁড়িয়ে আছিস?’
‘না তো। আমি তো তোদের বাসায়।’
‘আমাদের বাসায়? কি বলিস!’
‘ হ্যাঁ। তোদের বাসার ড্রয়িংরুমে বসে আছি। তোদের বাসা তিনতলায় না?’
‘না তো। আমাদের বাসা তো চারতলায়। তিনতলাতো পুরো খালি, ওখানে তো কেউ থাকে না। তুই কোথায় আছিস বলতো..’
কথাটা শুনেই মিলির মেরুদন্ড বেয়ে ভয়ের এক শীতল স্রোত নেমে গেল। ও তাহলে কোথায় আছে? ওকে এক্ষুণি এখান থেকে পালাতে হবে, যতো দ্রুত সম্ভব।
দরজার দিকে দৌড়ে গেল মিলি। দরজা খোলার চেষ্টা করলো, কিন্তু খুললো না দরজা। এসময়ই ওর পিছে কেমন একটা অদ্ভুত ভয়ঙকর গর্জন শুনতে পেলো। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালো ও।
দেখলো মহিলাটি বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। তার চেহারা বদলে গেছে। চুলগুলো খোলা, চোখদুটো রক্তের মতো টকটকে লাল। মহিলাটি এগোতে লাগলেন মিলির দিকে।
মিলির চিৎকার সেদিন তিনতলার বন্ধ দরজার বাইরে কেউ শুনতে পায়নি।
লেখনীতে – সোয়েব বাশার