#কৃতজ্ঞতা
শফিক হঠাৎ করেই দেশে ফিরে আসাতে মা আয়েশা বেগমের চোখে পানি চলে আসলো। ছেলে যে দেশে ফিরবে এই সম্পর্কে তাকে কোন কিছু জানানো হয়নি। এতো বড় সারপ্রাইজ পেয়ে উনি সত্যিই উৎফুল্ল।
শফিক মাকে জড়িয়ে ধরলো,
– কেমন আছো মা?
-ভালো আছি রে বাবা। তুই আসবি একবার খবর দিবি না, আমি তোর ছোট ভাইকে পাঠিয়ে দিতাম এয়ারপোর্ট থেকে তোকে আনার জন্য
-তুমি এসব ঝামেলা করবে দেখেই আমি ইচ্ছে করে খবর দেইনি ।এখন বলো তোমাদের সবার খবর কি?
-সবাই ভালো আছে
দরজার এক কোনায় শফিকের স্ত্রী রিমা দাঁড়িয়ে মা-ছেলের কথা শুনছিল। বোঝাই যাচ্ছে স্বামীর এভাবে আগমনে সে খানিকটা অপ্রস্তুত। সারাদিনের পরিশ্রমে চুল এলোমেলো, চেহারা বিধ্বস্ত হয়ে আছে। বিয়ের পর শফিক দুই মাস দেশে ছিল তারপর তিন বছর পার হয়ে গেছে। টুকটাক ফোনে কথাবার্তা ছাড়া তাদের মধ্যে আর তেমন কোনো যোগাযোগ নেই আসলে শফিকের সারাদিনের কর্মব্যস্ততা তাছাড়া দুই দেশের মধ্যে সময়ের পার্থক্য সব মিলিয়ে রিমাকে তেমন একটা সময় দেয়া হয় না।
-ও বৌমা দাঁড়িয়ে দেখছো কি? যাও শফিকের জন্য ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে আসো , ছেলেটা আমার ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা আর তুমিও গোসল করে নাও, কি অবস্থা করছো চেহারার ।যাও মা তাড়াতাড়ি যাও, আয়েশা বেগম তাড়া দিলো।
রিমা খুব দ্রুত শফিককে শরবত বানিয়ে দিয়ে নিজে গোসলের পর সুন্দর একটা শাড়ি পরিপাটি করে পড়লো, কতদিন পর তার স্বামী দেশে ফিরেছে । এমনিতে আপন বলতে তেমন কেউ নেই, মা ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলেন। বাবাই তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই বসলে রিমা সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছিলো, আয়েশা বেগম চোখ পাকিয়ে বললেন,
– তুমি বসছোনা কেন বৌমা? ছেলেটা আমার এতদিন পরে এসেছে, দুজন মিলে একসাথে খেতে বসো।
রিমা একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাদের সাথে খেতে বসলো।
শফিকের ছোট বোন মিলি এখানেই থাকে, স্বামীর কর্মস্থল ঢাকার বাইরে হওয়াতে মিলি আর শ্বশুর বাড়িতে থাকে না, তাছাড়া ছোটভাই রফিক আছে এখনো বিয়ে-শাদী করেনি।
-বাবা কত দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিস তুই? আয়েশা বেগম শফিককে প্রশ্ন করলেন
-বেশ কিছুদিন থাকবো মা
আনন্দে আয়েশা বেগমের চোখে পানি চলে আসলো। ছেলেটা দেশ ছেড়েছে প্রায় আট বছর, তিন বছর আগে এসেছিল বিয়ে করার জন্য। ছেলেকে কাছেই পায়না কিন্তু কিছু করার নেই সংসার চালানোর জন্য ছেলেকে দূরে রাখতে হয়।
কিন্তু ছেলে দেশে এসেও সারাদিন এখানে সেখানে ছোটাছুটি করছে আয়েশা বেগম জিজ্ঞেস করেন কিন্তু ছেলে কোন উত্তর দেয় না
-বাবা শফিক তুই দেশে এসেছিস, এখন কোথায় আমাদেরকে একটু সময় দিবি, বৌমাকে একটু সময় দিবি ,ওকে নিয়ে একটু ঘুরে ফিরে আয় ,বেচারি তো তেমন একটা তোকে কাছে পায়নি ,এখন একটু সময় দে আবার তো চলেই যাবি। আয়েশা বেগম এক সন্ধ্যায় ছেলেকে বললেন।
-সরি মা কিন্তু একটু কাজের চাপে আছি, কাজ শেষ হলেই তোমাদের কে সময় দিবো।
এভাবে পার হয়ে যায় প্রায় দেড় মাস ।রাতে খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে
-মা, আমাকে চলে যেতে হবে। শফিক আচমকাই কথাটা বলে উঠলো
-হঠাৎ! আয়েশা বেগম চমকে উঠলেন
-হ্যাঁ মা আগামী সোমবার ফ্লাইট
-তুই আসার সময়ও কিছু বললি না আবার যাবার সময়ও কিছু বলছিস না, আগে থেকে জানাস নি কেন ? আগামী সোমবার মানে আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি আছে এর মধ্যে কিভাবে কি? তারপরও আসার পর দৌড়াদৌড়ি করেই পার করে দিলি, আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎ করলি না, সবাই কি ভাববে?
-কিছু করার নেই মা, তুমি তো বোঝো আমাকে তো যেতে হবেই।
-হ্যাঁ সেইতো যেতে তো হবেই, আয়েশা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন আবার কবে ছেলে আসবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই
-ওহ মা তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি আমি কিন্তু রিমা কে আমার সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি
-মানে ?আয়েশা বেগমের মাথায় যেন বাজ পড়লো
-অবাক হচ্ছো কেন মা? আমি বিয়ে করেছি, বউ আমার সাথে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি ওই দেশে ও এই দেশে এটা কেমন দেখায় তা ছাড়া আমি তো ঐদেশে সেটেল হওয়ার চিন্তা ভাবনা করছি। এগুলো নিয়েই এতদিন ধরে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম যাতে ওর ভিসাটা হয়।
-রিমা চলে গেলে এ সংসার দেখবে কে?
-তুমি তোমার সংসারের কথা চিন্তা করছো মা, আমার কথা চিন্তা করছো না। আমি ওর হাজবেন্ড আমার প্রতি ওর দায়িত্ব এবং কর্তব্য আছে, আমার সংসার কিভাবে চলে ?আমি সারাদিন কাজ করে এসে নিজে রান্না করি আর তাছাড়া স্বামী হিসেবে আমারও তো কিছু কর্তব্য আছে।
-তুই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল।
-সে জন্য আমি সরি না কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক তাই না তোমার কি মনে নেই বিয়ের পর তুমি সবসময় বাবার সাথে সাথেই থাকতে ।বাবা যেখানেই বদলি হতেন তুমিও সেখানেই আমাদেরকে নিয়ে যেতে তাই যেখানে স্বামী থাকবে স্ত্রী যদি সময় থাকে তাহলে সেখানেই তাঁর থাকা উচিত।
-দুটো কি এক হলো নাকি? আমাকে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত তুই বোধ করলি না?
এবার শফিক একটু নড়েচড়ে বসে।
– কিছু মনে করো না মা, আমি রিমাকে রেখে গেছি প্রায় তিন বছর ।তুমি আমার সামনে ওর সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করছো, এটা কি আমাকে দেখানোর জন্য?
-কি বলতে চাচ্ছিস তার মানে তোর আড়ালে আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করি! ওকি তোকে এসব ফোনে বলেছে নাকি দেশে আসার পরে বলেছে
-ও আমাকে কিছুই বলে নি মা। আমাদের কাজের লোক রহিম চাচা, উনার ছেলেকে আমি কিছু টাকা দিয়েছিলাম ব্যবসা করার জন্য, ও ব্যবসায় কেমন করছে সেটা নিয়ে মাঝে মাঝেই আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হতো তিনিই আমাকে সব তথ্য দিয়েছেন । রিমা সারাদিন সংসারের কাজকর্ম করেও এক টেবিলে তোমাদের সাথে কখনো খেতে বসতে পারে না । তোমাদের সবার খাবার হয়ে গেলে তারপর ও বেচারী খায়। প্রথম দিনই আমি লক্ষ্য করেছিলাম ও সবার সাথে টেবিলে বসতে অপ্রস্তুত বোধ করছিল, কারণ কি মা?
-ওই কাজের লোক যা বললো তুই বিশ্বাস করলি! তোর চোখের সামনে যা ঘটছে তা বিশ্বাস করিস না?
-এসেই তো তার নমুনা দেখেছি আমি মা। আমি এসেছি রাত আটটায় আর তখনও রিমা গোসল করার মতো সুযোগ পায়নি, বিধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়িয়েছিল । এই তিন বছরে রিমা বাবার বাড়িতে গেছে মাত্র একবার কিন্তু কি আশ্চর্য মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরেই ওর বাবার বাড়ি যে মেয়েটার স্বামী সাথে থাকে না তার কাছে বাবা-মা হচ্ছে পরম আশ্রয় আর তুমি ওকে ওখানেও যেতে বারণ করে দিয়েছো, বৃদ্ধ বাবার প্রতি কি তার কোন কর্তব্য নেই? রিমার কি কখনো ইচ্ছে করে না তার বাবাকে একবার রেঁধে খাওয়াতে? ওনার বয়স হয়েছে ওনার এখন আয়ের উৎস কি সেটা সম্পর্কে তোমরা কখনো জানার চেষ্টা করেছ? ছেলের যদি বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য থাকে তাহলে মেয়ের কেন থাকবে না। আমি রিমাকে নিয়ে যাব, আর ওখানে ছেলে মেয়ে সবাই সমান তালে কাজ করে রিমা নিজে তার বাবাকে কাছে না পেলেও অন্তত প্রতিমাসে কিছু খরচ বহন করতে পারবে এটা আমিও পারি কিন্তু আমি করলে রিমা মন থেকে ছোট হয়ে থাকবে আমার কাছে। আরো একটা জিনিস দেখো মা, কি অযৌক্তিক বিচার নিজের মেয়ে কে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেই দাও নি সর্বক্ষণ নিজের সাথে রেখেছো, কেন মা? শ্বশুরবাড়িতে তার কি কোন দায়িত্ব কর্তব্য নেই শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়িতে দায়িত্ব রিমার আছে? মিলির স্বামীর বদলি হওয়ার পরে একবার ও কি গেছে ওর শ্বশুর বাড়িতে, জানতে চেয়েছে ওর শ্বশুর শাশুড়ি কেমন আছে?
আয়েশা বেগম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে
-আমি সরি মা কিন্তু কিছু করার নেই তোমার আরো দুটি ছেলে মেয়ে আছে আমি ছাড়াও কিন্তু রিমার আমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। আমি আগে যেভাবে তোমাদেরকে টাকা পাঠাতাম সেভাবেই পাঠাবো, প্রয়োজনে আরো একজন কাজের লোক রেখে নেবে কিন্তু আমার স্ত্রীকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে আমার সাথে নিয়ে যাবো। রিমা তুমি তোমার অল্প কিছু জিনিসপত্র লাগেজে ভরে নিও ওখানে আবার সব নতুন করে কিনতেই হবে আর হ্যাঁ এখন থেকে নিজের সমস্যা গুলোর কথা অবশ্যই নিজ মুখে আমাকে বলবে, তুমি যদি আরো আগে বলতে তাহলে আমি নিজে থেকে আরো আগে সমাধান করতে পারতাম।
রিমার চোখের কোনে পানি টলটল করছে। রিমা সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলো। রিমা ভেবেছিল এটাই বোধহয় তার জীবন কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এতটাও কঠোর নন। অনেক ঘাত প্রতিঘাত দুঃখ যন্ত্রণা দেবার পরেও অন্যদিক থেকে তিনি কিন্তু ঠিকই জীবনটাকে গুছিয়ে দেন।