#অন্ধকার
দু’বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া রাতুল যখন হঠাৎ করে বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো তখন বাড়ির পরিস্থিতি অনেকটাই থমথমে। বাবা-মা নিশ্চুপ, স্তব্ধ । ঘরের এক কোণে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে শায়লা। মাত্র এক মাসের বিবাহিত জীবন পার করেছিল রাতুলের সাথে। হানিমুন শেষ করে বাড়ি ফেরার কিছুদিন পরেই অফিসের কাজে বান্দরবান যাওয়ার পথে রাতুলের গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। গাড়িটা খাদ থেকে উদ্ধার করা গেলেও রাতুলের ডেড বডি আর পাওয়া যায়নি। প্রত্যেকে ধরেই নিয়েছিল রাতুল মারা গেছে, বহুদিন তার কোন খবর নেই।
এতদিন পরে স্বামী ফিরে এসেছে কিন্তু শায়লা নির্বাক হয়ে আছে। অনেক অনুসন্ধান করার পরেও রাতুলকে যখন খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন সদ্য বিবাহিতা শায়লা তার বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এই অল্পসময়ের মধ্যেই কি করে যেন রাতুলের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল। কাজেই রাতুলের নিখোঁজ হওয়া টা মানতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে।
-কেমন আছো শায়লা?
-ভালো আছি, মাথা নিচু করে শায়লা উত্তর দিল । তারপর চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেলো
রাতুল খানিকটা হতভম্ব হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে মা? শায়লা আমার সাথে এমন করছ কেন?
মা আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করছেন
বাবা রাতুলের পিঠে সান্তনার হাত বুলিয়ে খানিকটা গলা পরিষ্কার করে বললেন
– এতদিন কোথায় ছিলি?
-বাবা তুমি নিজেই তো আমাকে বান্দরবান পাঠিয়েছিলে ওখানে আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যায় ,তারপর আমার তেমন কিছু আর মনে নেই। বহুদিন পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে শুনলাম আমি নাকি কোমায় ছিলাম। তারপরেও ডাক্তার আমাকে ছাড়তে চায়না কিছুটা জোর করেই আমি হসপিটাল থেকে চলে এসেছি । তোমাদের কারো ফোন নাম্বার আমার মনে ছিল না তাই ফোন করতে পারিনি।
-হাতমুখ ধুয়ে নে, খাবার দিচ্ছি আমি। মা উঠে চলে গেলেন।
রাতুলের কাছে সবকিছুই কেমন যেন লাগছে এতদিন পরে ফিরে এসেছে অথচ কেউ মনে হচ্ছে খুশি না যেন সে উপযাজক।
বাইরে গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে রাতুল বারান্দায় এসে দেখলো শায়লা গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছে । আশ্চর্য !তাকে একবার বলার প্রয়োজন বোধ করলো না আর এখন সে ফিরে এসেছে এই মুহূর্তে বাইরে যাওয়াটা কি খুব দরকার?
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাতুল ছাদে উঠে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল , এই জীবনের কোন অর্থ হয় না। কেউ পরিষ্কার করে তাকে কিছু বলছে না।
কারোর পায়ের শব্দ শুনে রাতুল ফিরে তাকালো, বাবা এসেছে।
বাবা খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন ,রাতুলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-তুই নিখোঁজ হবার পর আমরা তোকে অনেক খুঁজেছি, কোথাও খুঁজে পাইনি , এমনকি তোর লাশ পর্যন্ত খুঁজেছি কিন্তু ফলাফল ছিল শূন্য ।শায়লা চলে গিয়েছিল ওর বাবার বাড়িতে। বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় এত বড় ধকল মেয়েটা সামলাতে পারেনি। সবকিছু সামলে নিতে ওর প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় লেগে গিয়েছিল তুই ভুল বুঝিস না, আমরা ভেবেছিলাম তুই মারা গেছিস আর এত সুন্দর একটা মেয়ে ওর জীবনটা যেন নষ্ট না হয় তাই তোর ছোট ভাই রাফির সাথে ওর বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাই। শুরুতে শায়লা না করলেও পরে এক প্রকার প্রায় বাধ্য হয়েই মেয়েটা রাজি হয় কারণ ওর পেটে তখন তোর সন্তানের ভ্রুণ যদিও সেটা পরবর্তীতে জন্ম নেওয়ার আগেই মারা গেছে। রাতুল স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।
-রাফি কোথায় বাবা?
-আমাদের গাজীপুরের প্রজেক্টটা দেখতে গেছে
-আমার আসার খবর দাও নি
– আসার সাথে সাথেই ফোন করেছিলাম, বললো কাজ শেষ করে ফিরবে
রাতুল একদম অবাক হয়ে গেলো কী আশ্চর্য এতদিন পর সে ফিরে এসেছে আর রাফির কাছে কাজটাই গুরুত্বপূর্ণ, সবকিছু এত বদলে গেছে।
রাতের খাবারের সময়েও রাফি ফিরলো না, রাতুল খেয়েদেয়ে শুয়ে পরলো।
পরদিন নাস্তার টেবিলে বসে রাতুল শুনলো, রাফি নাকি অফিসের কাজে কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেছে আজ সকালেই। এদিকে রাতুল ফিরেছে শুনে ওর পুরনো তিন বন্ধু দেখা করতে এসেছে। রাতুলের মনমরা ভাব দেখে কি হয়েছে ওরা জানতে চাইলো রাতুল পুরো ঘটনা খুলে বললো।
ওরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা চোখাচোখি করছে
-তোরা এমন করছিস কেন?
-শোন ভাই ব্যাপারটা আমাদের কাছে একটু খটকা লাগছে
-যেমন ?রাতুল কিছু বুঝতে পারলো না
-তুই নিখোঁজ হলি, ভাবী বাড়ি চলে গেল আর কিছুদিনের মধ্যে ভাবী রাফি কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল মানে ব্যাপারটা একটু কেমন না?
-তোরা আসলে কি বলতে চাচ্ছিস?
-দুয়ে দুয়ে একটু চার মিলিয়ে দেখ, আমরা বলছি না যে এটা নি ১০০% সত্যি কিন্তু তারপরও হয়তো রাফির সাথে ভাবীর কোন সম্পর্ক ছিল, তোর নিখোঁজ হওয়া টা ওদের জন্য একপ্রকার আশীর্বাদ। আমরা সবাই জানি বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসার কাজে তোর চেয়ে রাফি সবকিছু দেখাশোনা করে বেশি তাহলে ওই সময় ওই জায়গায় তোকে পাঠানোর কি প্রয়োজন ছিল হয়তো রাফি আংকেল কে বলেছিল পাঠাতে। হয়তো এটা রাফি আর শায়লা ভাবীর প্ল্যান ছিল কোন ভাবে তোর এক্সিডেন্ট টা করানো। তোর কথা অনুযায়ী পেছন থেকে কোন একটা গাড়ি তোকে ধাক্কা দিয়েছিল, তাহলে একটু মিলিয়ে নে।
সন্ধ্যায় রাফি বাড়ি ফিরলো কিন্তু রাতুলের সাথে দেখা করতে আসলো না দেখা হলো ডিনার টেবিলে কিন্তু দুজনেই চুপচাপ । রাতুল বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে যখন দাঁড়িয়ে আছে পেছন থেকে ছোটভাইয়ের পরিচিত কণ্ঠ
-কেমন আছো ভাইয়া?
-ভালো তোরাও তো দেখছি ভালই আছিস
-বিশ্বাস করো ভাই তুমি নিখোঁজ হওয়ার প্রথম ছয় মাস খুব কষ্টে ছিলাম
-তারমানে তারপর থেকে ভালো আছিস?
-ঠিক ধরেছো তারপর থেকে ভালো আছি । তুমি মারা গেছো এই দুঃস্বপ্নে যখন আমরা জর্জরিত প্রায় ছয় মাস পরে ঠিক তোমার মত একজনকে মালদ্বীপে দেখে ফেলে আমার এক বন্ধু , প্রমাণ স্বরূপ সে বেশ কিছু ছবি তুলে আমাকে পাঠায়। আমি হয়তো বিশ্বাস করতাম না কারণ একই চেহারার অনেক মানুষ থাকে কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা ছিল সাথে একটা মেয়ে ছিল , মেয়েটা আবার আমার পরিচিত, আমার না আমাদের সবার পরিচিত, আমাদের অফিসের স্টাফ তোমার পার্সোনাল সেক্রেটারি মিস তুলি। তুমি মারা যাবার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। দুজন মানুষের চেহারা একই সাথে কাকতালীয়ভাবে মিলে যেতে পারে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ঘটনার আগ পর্যন্ত আমরা কেউ খেয়াল করিনি যে তুমি তোমার ব্যাংকে রাখা সমস্ত টাকা তুলে নিয়েছিল পরে সেটা জানতে পেরেছিলাম একজন মানুষ যে কিনা ব্যবসার কোন কাজে যাচ্ছে সে নিশ্চয়ই তার সমস্ত টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে যাবে না অদ্ভুত, তাইনা ভাইয়া। সাথে শায়লার বাড়ি থেকে বিয়ের সময় দেয়া সমস্ত গহনা যেটা তোমার ব্যাংকের লকারে ছিল সেগুলোও উধাও হয়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের ম্যানেজার আমার বিশেষ পরিচিত যদিও ব্যাপারটা লিগ্যাল না তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে উনি লকারটা চেক করে আমার অনুরোধে আমাকে জানিয়েছিলেন। যদিও শায়লা এখনো বিষয়টা জানে না। আমরা চাইনি শায়লার দৃষ্টিতে তোমাকে ছোট করতে।
রাতুল অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে রাফির দিকে তাকালো।
-আমরা মানে
-আমি, বাবা আর মা। আমরা সবাই তোমারেই কুকীর্তির ব্যাপারে জানি। মা তোমার ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছেন, বাবা বলে দিয়েছেন কাল সকালে তুমি যেন শায়লার ফিরে আসার আগেই চলে যাও, বিশ্বাস না হলে যাও, গিয়ে জিজ্ঞেস করো।
রাতুল ঘরে ফিরে দেখল সত্যিই ছোট্ট একটা ব্যাগ তার মা তার জন্য গুছিয়ে রেখেছে
পরদিন সূর্য ওঠার আগে আগেই রাতুলের বাড়ির গেট খোলার শব্দ হলো। রাতুল এই শেষবারের মতো হয়তো তার নিজের বাড়ির গেট খুললো। নিজ পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতেই হবে। তার সেক্রেটারি তুলি তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গিয়েছে সমস্ত টাকা-পয়সা নিয়ে, রাতুল জানতো না কাওকে ধোঁকা দিলে সেটা ফেরত পেতে হয়। পূবের আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে, তারপরেও চার-পাশটা রাতুলের কাছে অন্ধকার হয়ে আছে।