#পরিবর্তন
রাত দুইটায় ভয়ংকর শারীরিক অত্যাচার শেষে আজিজ বলে উঠলো, যা শালী এবার গিয়ে তোর পুলিশ বাপদের কাছে আমার নামে মামলা কর, বলেই একটা বিশ্রী হাসি দিলো। আমি অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে কাপড় গুছিয়ে নিলাম। ওর মুখ থেকে আসা মদের তীব্র গন্ধে আমার বমি পাচ্ছিলো। এই লোকটা আমার স্বামী, একমাস হয়েছে আমাদের বিয়ের।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি, কলেজে পড়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকটা টিউশনি করতাম। আজিজ ছিল আমাদের এলাকারই বখাটে গুন্ডা। সবসময় আমাকে বিরক্ত করতো। খুব চেষ্টা করতাম এড়িয়ে যেতে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। এক রাতে টিউশনি শেষে ফেরার পথে আমার আর ঘরে ফেরা হলো না, দুটো রাত আর একটা দিন আমার উপর বয়ে গেল অমানুষিক নির্যাতন। আমাকে ছেড়ে দেবার সময় আজিজ ঠিক এই হাসি টাই হেসেছিল ।
আব্বা আম্মার কাছে ফিরে এসে প্রথমেই বললাম, আব্বা চলো থানায় যেতে হবে। কিন্তু আব্বা নড়লেন না।আমাকে কাছে বসালেন, অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, দেখ মা তোকে যেদিন ওরা ধরে নিয়ে গেছে সেদিন রাতেই এসে আমাদেরকে বলে গেছে যেন আমরা থানা পুলিশ না করি তাহলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে আর তাছাড়া তোর ছোট দুটো বোন আছে এখন তোর ক্ষেত্রে যদি এমন হয় তাহলে আমি আমার ওই দুটো মেয়ের বিয়ে দিতে পারব না। সব শুনে আমি স্থবির হয়ে গেলাম এ যেন আমার আব্বার ভিন্ন চেহারা, আর তাছাড়া আজিজ নাকি নিজে বলেছে তোকে বিয়ে করবে, আব্বার মুখে এই কথা শুনে আমি যেন জীবন্ত লাশে পরিণত হলাম।
এখন আমি তার আইনগতভাবে স্ত্রী, প্রায় প্রতি রাতেই মদ খেয়ে এসে আমার ওপর চলে নির্যাতন। আমি মুখ বুজে সহ্য করি, নিজের পরিবার যখন আমার বিরুদ্ধে আমি তখন কি করতে পারি।
আমি নিজের মনকে শক্ত করলাম, ধীরে ধীরে নিজেকে আজিজ এর মতো করেই তৈরি করতে শুরু করলাম। সে বাড়িতে ফেরার আগেই ঘরদোর পরিষ্কার করি বেশ কয়েক ধরনের রান্নাবান্না করি, নিজেও খানিকটা সাজগোজ করে থাকি। একদিন ঘরে থাকা একটা মদের বোতল ফেলে দিলাম ভাবলাম খুব মারবে, কিন্তু গায়ে হাত তুললো না শুধু রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলো।
ধীরে ধীরে তার সমস্ত পছন্দ-অপছন্দ জেনে নিলাম। ঘরে সেই খাবারগুলো রান্না করতাম যেগুলো তার পছন্দ। একবার মার্কেট থেকে ওর জন্য দুইটা শার্ট কিনে নিয়ে আসলাম ভেবেছিলাম পড়বে না পরে দেখলাম গা থেকে খুলছেই না।
আস্তে-ধীরে আজিজ বদলে যেতে লাগলো, এখন আর কথায় কথায় আমাকে মারধোর করে না, তাছাড়া মদের নেশাও কমিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে আবার ঘরের কাজে আমাকে সাহায্যও করছে। একদিন টের পেলাম আমি মা হতে যাচ্ছি।
ঘটনাটা ওকে জানালাম, এই প্রথম ওকে আমি এত খুশি হতে দেখলাম আমার কোন ব্যাপারে নাকি এটা আমাদের ব্যাপার কে জানে? ও হাসতে লাগলো, আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম একটা মানুষ প্রায় পুরোদস্তুর বদলে গেছে কিন্তু হাসিটা এখনো সেই আগের মতো বিশ্রী আর কদাকার লাগছে আমার কাছে। তারপরের পুরো নয় মাস, সে আমার পিছু ছাড়লো না, কাজের একটা মানুষ রেখে দিলো। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, কোন ওষুধ কখন খেতে হবে কোনটা খেলে বাচ্চা ভালো হবে, কোন খাবার আমার জন্য পুষ্টিকর সবকিছু মুখস্থ। ধীরে ধীরে সময় পেরিয়ে গেল, আর হ্যাঁ এই পুরো সময়টাতে আমি আজিজ কে বলেছিলাম আমার পরিবারের কোনো লোকজনের সাথে যেন সে যোগাযোগ না রাখে এবং তারা যেন ভুলেও কখনো এখানে না আসে, আজিজ কথা রেখেছে।
আমি একটি ক্লিনিকে একটা চাঁদের টুকরা জন্ম দিলাম, ছেলেকে কোলে নিয়ে তার আনন্দের কোনো শেষ নেই। আমি তাকিয়ে থাকি, দেখতে থাকি তার জীবনের খুশির জোয়ার, দেখতে থাকি একটা মানুষের অভাবনীয় পরিবর্তন।
একটু সুস্থ হলে ক্লিনিক থেকে আমাকে ছেড়ে দেয়া হলো। আজিজের দিন রাত কাটছে আমাকে আর ছেলেকে নিয়ে। আমরা একটু চোখের আড়াল হলেই সে বিরাট হট্টগোল শুরু করে দেয় আমিও মনে মনে হাসি।
আমার কেমন শীত শীত করছে, আমি বাসের জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, কোলে আমার ছোট্ট তিন মাস বয়সী ছেলে জিসান। কোথায় যাচ্ছি জানিনা তবে এই শহর ছাড়ছি, বাসায় একটা চিঠি ছেড়ে এসেছি যেন আজিজ ফিরেই সেটা দেখতে পারে, শুধু ছোট্ট করে লিখেছি একদিন তুমি আমার জীবন থেকে সব রঙ সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছিল, আজ আমি নিলাম। ভালো থেকো, জানি পারবে না কারণ এই তিন বছরে আমি সত্যিই পারিনি ভালো থাকতে এক মুহূর্তের জন্য।