লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ফাল্গুন মাস। চাঁদের আলো নিভে গিয়েছে; এখন মধ্যরাত। আটপৌরে দেওয়ালে বড়ো অবহেলায় ঝুলছে একটা হতপ্রভ বাংলা ক্যালেন্ডার। তাতে মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, আজ আঠারো ফাল্গুন।
ফাল্গুন বটে! ল্যাম্পপোস্টের সফেদ আলোয় এক মাথা কমলা আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশও সেরকমই ঘোষণা করছে। সেই পলাশের রূপে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম, কেন কবির কলম থমকে যায়? কবির কলম যে কারণেই থমকাক। এই মাঝ রাত্তিরে আমার নিঃসাড় কলম সার পেল। বহুদিন পর আমি লিখতে বসলাম। পাঠকরা যার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকেন, পথ চেয়ে বসে থাকে আমার পুরো জ্ঞাতিমহল। চরপাড়ার বিশ্রী জ্যাম, উঠোনের টুকরো রোদ, অপরিচিত বাড়ির ওই শিউলি গাছটা পর্যন্ত যার জন্য দীর্ঘশ্বাসের পসরা সাজায় তার গল্প।
সে গল্প লিখতে গিয়ে অজান্তেই ডুবে যেতে হলো অতীতের চোরাবালিতে। স্মৃতির অতল স্তুপে তলিয়ে যেতে যেতে অস্থির হৃদয় যেখানটায় দু’দন্ড সুস্থির হলো হিসেব মতো সেদিনটি ৭ জানুয়ারি, ২০২২; শুক্রবার। দিনের হিসেব কষতে গেলে, আজ থেকে ঠিক দুই বছর এক মাস চব্বিশ দিন আগের এক মধ্যাহ্নবেলা। এতোদিন আগেকার গল্প, অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে স্মৃতির পাতায়। খুঁটিনাটি তথ্য মনে থাকার কথা না। তারপরও আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন দুপুরে মেঘ কেটে ঝলমলে রোদ উঠেছিলো। সকাল থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। একে তো শীত তার ওপর বৃষ্টিতে সেঁতানো আবহাওয়া। বৃষ্টিতে ভিজে, গায়ের জ্বরকে চৌহদ্দি পেরুনোর নিশ্চিত অবসর দিয়ে আমি গেলাম শুভ্র ভাইদের বাসায়। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড! তাকে নিয়ে ফেরার পথেই মেঘ কেটে সোনালি রোদ্দুরে ঝলমল করে উঠলো সারা পথ। যেভাবে ঝলমল করে উঠলো আমাদের বাড়ির অন্দরমহল। তাকে পেয়ে ভাই-বোনদের সেকি হৈ-চৈ! কিন্তু শুভ্র ভাই মহাবিরক্ত। আমাদের বাড়িতে সেদিন অতিথিদের ভিড়। ব্যাচে ব্যাচে খাবার খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ছোট ফুপি আমাদেরকে ফেলেছেন এক নম্বর ব্যাচে। শিশু হলো ফেরেশতার প্রতিরূপ। ফেরেশতাদের অভুক্ত রেখে ব্যাটা-বুড়ো খেতে বসবে? অসম্ভব। শুভ্র ভাইয়ের শিশু ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। তিনি খেতে বসেই হিসহিস করে উঠলেন। আলিফ ভাইকে ধমক দিয়ে বললেন,
‘ তোদের মামার গোষ্ঠীর আক্কেল দেখেছিস? আমাদের মতো জোয়ান মর্দ ছেলেপেলেকে দুই মুঠো খাবার দিয়ে চোখের পলকে শিশু বানিয়ে ফেলল! এদের যন্ত্রণায় তো দেখছি বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। আজ যৌবনে টান দিয়েছে কাল না জানি কোথায় কোথায় টান দিবে। হরবল!’
আলিফ ভাই চোখের পর্দায় অমাবস্যা নামিয়ে মামার গোষ্ঠীর ‘হরবল কন্ডিশন’-এর সাথে একমত হলেন। রাতুল ভাই ব্যথিত কণ্ঠে বললেন,
‘ সত্যিই হরবল কন্ডিশন ভাই। জ্ঞাতিগোষ্ঠীতে এক চিলতে ইজ্জত বলতে নেই। সেইদিন শুনলাম আমাদের পাশের বাড়ির এক চাচির মেয়ের নাকি ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিয়ে হচ্ছে। সেই চাচি ঢাকা শহরে বুয়ার কাজ করেন। মেয়ে পড়াশোনা তেমন করেনি। গার্মেন্টসে চাকরি করে। তিনি আম্মাকে এসে বলছেন, “আপনেরা শিক্ষিত পরিবার। আপনাগো পোলায় তো আরও বড়ো পাশ দেওয়ার দরকার আছিল। আমার মাইয়া জামাইও তো ইলেকটিক ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকা শহরে কারেন্টের খাম্বা ঠিক করে।” বুঝো অবস্থা? আম্মা এখন আমাকে দেখলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠছেন। বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারদের ইজ্জতে কেমন মর্মান্তিক থাবা পড়ছে, বুঝতে পারছ? দুঃখ-কষ্টে মাঝে মধ্যে মনে হয়, এর থেকে বাংলা সাহিত্য পড়লে ভালো হতো।’
রাতুল ভাইয়ের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল সবাই। কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। এমনিতে জ্বরে তেতো হয়ে আছে মুখ। তেতো মুখকে আরেকটু তেতো করে বললাম,
‘ তোমার ইলেকট্রিক খাম্বা নিয়ে তুমি মুছিবতে আছো ভালো কথা। সেখানে আমার সাবজেক্ট টানছ কেন? খবরদার! আমার সাবজেক্ট নিয়ে আজেবাজে কথা বলবে না।’
আলিফ ভাই খোঁচা দিয়ে বললেন,
‘ দুইটা অঙ্ক কইরা দেশের রাজা সাজতে চাওয়া ইঞ্জিনিয়ারদের থেকে আর কতটা আশা করতে পারিস রোদু? সবাই তো আর মেডিকেল স্টুডেন্টদের মতো মুক্তপ্রাণ হতে পারে না।’
আলিফ ভাইয়ের কথা শেষ হতেই দেখা গেল খাবার টেবিলের প্রত্যেকটি চোখ তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ভাই বললেন,
‘ বায়োলজির দুইটা চ্যাপ্টার মুখস্থ করে ইঞ্জিনিয়ারদের জাজ করতে আসিস রে পাগলা? ওসব বায়োলজির বই আমরা বহুত মুখস্থ করতে পারতাম। করি নাই। তার পেছনেও কারণ আছে। তোদের হাসপাতাল থেকে শুরু করে যাবতীয় যন্ত্রপাতি সবই তো আমাদের আবিষ্কার। এখন ওই বায়োলজির চ্যাপ্টারও যদি আমরাই মুখস্থ করি তোরা কী করবি বল? এজন্য ছেড়ে দিয়েছি। যা পাগলা বায়োলজি মুখস্থ করে খা।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হৈহৈ পড়ে গেল। আলিফ ভাই তীব্র প্রতিবাদ করলেন,
‘ ইফ “চুরের মন পুলিশ পুলিশ” হেড আ ফেইস। তোমরা দুই পাতা অঙ্ক কষে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাও বলে সবাইকে তাই ভাববে এমনটাই স্বাভাবিক। অঙ্ক মুখস্থ ইঞ্জিনিয়ারদের থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করা অবশ্য উচিতও না।’
নো বলে ছক্কা। খাবার টেবিলে আবার হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এতো বড়ো অপমানের পর মধ্যাহ্নভোজে উপস্থিত ইঞ্জিনিয়ারগণ চুপ করে থাকতে পারে না। শুরু হলো তীব্র আক্রমণ। কাজিনমহলের অধিকাংশই গর্বিত ইঞ্জিনিয়ার বিধায় আলিফ ভাই একা বেশিদূর এগোতে পারলেন না। পরিস্থিতি অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে মুখটা হাঁড়ির মতো করে চুপ হয়ে গেলেন। আমার মহান হৃদয়। হৃদয়বান মানুষরা অন্যের দুঃখে ব্যথিত হয়। আমি আলিফ ভাইয়ের দুঃখে ব্যথিত হয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম,
‘ থাক ভাই, মন খারাপ করো না। সামটাইমস্ হ্যাপেনস্। কাবাবটা দারুণ হয়েছে। কাবাব খাও, ভালো লাগবে। এক জীবনে এমন ছোটখাটো বিষয়ে এতো মন খারাপ করতে হয় না।’
এতো ভালো ভালো কথা বললাম অথচ দাম পেলাম না৷ আলিফ ভাই তার মন খারাপ অব্যহত রাখলেন। দু’চোখে এক সাগর দুঃখ নিয়ে নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করে উঠলেন,
‘ এই আমার কাবাব কই? কাবাব গেল কই! হয়ার ইজ মাই কাবাব? কে নিয়েছ তাড়াতাড়ি বলো, নয়তো আমি মামলা করবো। দরকার পড়লে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাব। এসব কোন ধরনের ডাকাতি!’
প্রায় রসাতলে যাওয়া বাংলাদেশের ভাবী ডাক্তার দুটো কাবাবের জন্য হাউমাউ করছে দেখতে খারাপ দেখায়। সাহিত্যের মানুষ হয়ে এই রকম দৃশ্য সহ্য করা কঠিন। তাই শান্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ দুইটা কাবাবের জন্য এমন উত্তেজিত হওয়া ঠিক না আলিফ ভাই। কাবাব দুটো বোধহয় তুমি ঝগড়া করতে করতে খেয়ে ফেলেছ। অতিরিক্ত উত্তেজনায় টের পাওনি।’
আলিফ ভাই চোখ বড় বড় করে বললেন,
‘ আমি খেয়েছি? কখন খেলাম!’
আমি তার দুঃখ কমাতে বিস্মিত হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
‘ মাত্রই তো খেলে! তোমার সত্যিই মনে নেই? আশ্চর্য!’
আলিফ ভাই মুখের কাছে হাত নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,
‘ মুখে তো কাবাবের চৌদ্দ গোষ্ঠীর গন্ধ পাচ্ছি না রে রোদু। মোবাইলটা দে তো। মুখের ভেতরে তদন্ত চালিয়ে দেখি।’
আমি নির্বিকার মুখে মোবাইল এগিয়ে দিলাম। আলিফ ভাই ফ্রন্ট ক্যামেরা খোলে হা করে মুখের ভেতর চেইক করতে করতে একবার আমার দিকে তাকালেন। সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,
‘ এই? তোকে আমার সন্দেহ হচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ কেন!’
আলিফ ভাই মোবাইল রেখে আমার দিকে ঘুরে বসে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললেন,
‘ ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাইনি! সব রেখে তুই কেন কাবাবের কথাই বললি? সত্যি করে বল রোদু, তুই খেয়েছিস?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এজন্যই কবি বলছেন, ওহে বৎস! এই অকৃতজ্ঞ ধরণীতে কখনও কারো মঙ্গল করতে যেও না। প্রচন্ড দুঃখ নিয়ে বললাম,
‘ এই মুহূর্তে এই টেবিলে একমাত্র আমিই তোমাকে সমবেদনা জানাচ্ছি, আলিফ ভাই। তারপরও তুমি আমাকে সন্দেহ করছ? আমাকে!’
আমার অতি নাটকে আলিফ ভাইয়ের সন্দেহ এবার দৃঢ় হলো। চিৎকার করে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে ফেলে বললেন,
‘ ইয়া মা’বুদ! তুই খেয়েছিস! তুই!’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। আলিফ ভাই আমার বিরক্তি দেখলেন না। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললেন,
‘ তুই আমার সাথে এমন বেঈমানী করতে পারলি রোদু? বুঝলাম ভবিষ্যতে ঘুরেফিরে ওই ইঞ্জিনিয়ারেরই বউ হবি। তাই বলে, বাপের বাড়ি ভুলে যাবি? ভাইয়ের সাথে এমন ছলনা?’
এ তো দেখি ভারি বিপদ! আমি অতিষ্ঠ চোখে তার দিকে তাকালাম। এই সুযোগে তার প্লেটে দ্বিতীয়বারের মতো ডাকাতি ঘটিয়ে ফেলল অদুত ভাই। রাতুল ভাই তার বিশ্বস্ত সহচর। গর্দভ আলিফ ভাই সেটা দেখলেন না। ছলছল নয়নে সকলের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বাংলা সিরিয়াল রিয়েকশন দিয়ে খাওয়ায় মন দিতে গিয়ে দেখলেন প্লেটের লেগ পিসটাও উধাও। আগেই বলেছিলাম, এই পৃথিবীতে ভালো মানুষদের শান্তি নেই। এই পৃথিবীর ধর্মই হলো সহজ-সরল-নিষ্পাপকে বদনাম করা। অপমান করা। এবারও তাই হলো। আলিফ ভাই পৃথিবীর সকল বিতৃষ্ণা নিয়ে আবারও আমার দিকেই তাকালেন। যেন সব দোষ আমার! আমার জন্যই ইউক্রেন-রাশিয়ার মিল মিছিল হচ্ছে না। আমার কারণেই ফিলিস্তিনের প্রতি ইসরাইলের এহেন আগ্রাসন! আমি দ্বিতীয়বারের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দেবদাস পার্বতীকে হারিয়ে যেমন হতাশ হয়েছিল। আলিফ ভাই তার থেকেও বেশি হতাশা নিয়ে বললেন,
‘ এটাও! এটাও আমার চোখের সামনে দিয়ে মেরে দিলি? তুই তো দেখি সাংঘাতিক বিচ্ছু! কেউ বউ ভাগিয়ে নিলেও এতো কষ্ট পেতাম না। যে ব্যথা তুই আমাকে দিলি। তুই তো শ্বশুর-শাশুড়ীর সামনে বসে জামাইয়ের মাথা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবি রে। তোকে তোর জামাই সামলাবে ক্যামনে?’
তারপর ঝট করে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন। চিৎকার করে বললেন,
‘ শুভ্র ভাই একে…’
কথার রেলগাড়ি জিহ্বার ডগায় এসেও থমকে দাঁড়াল। যা বলতে চেয়েছিলেন তা বদলে ফেলে বললেন,
‘ ভাই এই ভয়ংকর মহিলাকে কী করে বিয়ে দিবে তোমরা বলো তো? এ তো বরের মাথা চিবিয়ে খাবে।’
শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চেহারায় খাঁটি দুশ্চিন্তা এনে বললেন,
‘ কী আর করা যাবে বল? তোদের মামার গোষ্ঠীর কঠিন জিনিস তোরা স্বল্পপ্রাণ ডাক্তাররা তো আর ট্যাকল করতে পারবি না। তার জন্য সাহসী, বোল্ড ইঞ্জিনিয়ার গোষ্ঠীকেই এগিয়ে আসতে হবে। এলাম নাহয়। এই পৃথিবীর ক্রান্তিলগ্নে আরেকটা সুদর্শন-মেধাবী-নিষ্পাপ ইঞ্জিনিয়ারকে নাহয় কুরবান করে দিলাম। আমরা নির্বিক ইঞ্জিনিয়ারস্; আমাদের মন সব সময়ই বিশাল।’
রাতুল ভাই টিপ্পনী কেটে বললেন,
‘ কিন্তু আমার সিক্স সেন্স বলছে, রোদুর এতো দয়া-দানের দরকার হবে না। তার বর’ই স্ব-ইচ্ছায় নিজের মুন্ডু কেটে এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, কী গো খাচ্ছ না কেন? আমার মাথাটা একটু চিবিয়ে খাও। আমি প্রাণ ভরে দেখি। একজন মানুষ এতো সিভিলাইজড ওয়েতে কী করে কারো মাথা খেতে পারে! তুমি কী মানুষ নাকি পরি?’
রাতুল ভাইয়ের ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় হো হো করে হেসে উঠল ভাই সমাজ। শুভ্র ভাই গম্ভীর হয়ে থাকতে চেয়েও হেসে ফেললেন। রাতুল ভাই হাসতে হাসতে বললেন,
‘ আমাদের বংশের জামাইদের কিন্তু এমন রেকর্ড বহু আছে। এরা বউ পেলে আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না। তাই বলছি কী? আমাদের রোদু ওরফে তোমার স্নেহেএএএর ফুপাতো বোনের জন্য পাত্র খুঁজতে গেলে বর মহাশয়কে ব্যাপারটা আগে থেকেই জানিয়ে রেখো শুভ্র ভাই।’
আবার হাসির হুল্লোড় উঠল খাবার টেবিলে। আলিফ অদুত ভাই হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপর পড়ে যাচ্ছে। আমার শান্ত-সরল ভাইয়াকে পর্যন্ত দেখলাম মুখ টিপে হাসছে। চিন্তা করা যায়! মিথি আপু ধমক দিয়ে বললেন,
‘ এই সামান্য একটা কথা নিয়ে তোরা দৈত্যর মতো হাসছিস কেন? বাড়ি ভর্তি মেহমান। একটু পরই বড় মামা এসে দিবে এক ধমক।’
একটু থেমে সবাইকে তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
‘ কিন্তু তোদের কথাবার্তা কেমন সন্দেহজনক লাগছে। কেমন ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা বলছিস সবাই। কী ব্যাপার বল তো? রোদু কী প্রেম টেম করে নাকি? কার সাথে প্রেম? শুভ্রর কোনো ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর সাথে? আলিফ যে তখন বলল ইঞ্জিনিয়ারের বউ হবে? এই তুই কী করে জানলি, ওর বর ইঞ্জিনিয়ারই হবে?’
মিথি আপুর ডিটেকটিভের মতো প্রশ্নে আলিফ ভাই এমন এক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন যেন এই মহিলা বদ্ধ উন্মাদ। বিরক্ত হওয়ার নিঁখুত অভিনয় করে বললেন,
‘ আমি তো কথার কথা বলেছি। তবে আমার মনে হয়, আমার ভবিষ্যদ্বানী ফলে যাবে। ইঞ্জিনিয়ারদের বউ ছাড়া কোনো নারী এমন কুটিল হতে পারে না। তবে মাঝেমধ্যে হিসেবে গড়মিল হয়। নয়তো চয়ন ভাইয়ের মতো হিসেব নিকেশের মানুষ কী করে তোমাকে বিয়ে করে? চয়ন ভাই? ব্যাংকে চাকরি করেও এমন কুটিল নারীকে বিবাহ করেছেন। আপনার অনুশোচনা হয় না?’
মিথি আপু ক্ষেপে গেলেন। খালাতো ভাইকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। চয়ন ভাই নির্ভেজাল মানুষ। আপন মনে খাচ্ছিলেন। আলিফ ভাইয়ের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকিয়ে ঠাট্টা করে বললেন,
‘ সে অনুশোচনা তো আমার শুধু বউকে নিয়ে নয়। বউয়ের পুরো গোষ্ঠী নিয়েই হয়। এই যেমন আমার বিশ্ব খাদক শালারা।’
খাবার টেবিলে হৈহৈ পড়ে গেল। রাতুল ভাই আফসোস করে বললেন,
‘ এইতো পার্সোনাল এট্যাক করে ফেললেন ভাই। দিলে বড়ো ব্যথা পেলাম। জীবনে তো এক টাকার লজেন্সও খাওয়ালেন না। আর খোঁটা দেন আশি টাকা তোলা!’
আলিফ ভাই গম্ভীর মুখে বললেন,
‘ ঠিক আছে। ঠিক আছে। এই অপমানের বদলা আমরা নিব। এই ব্যাপারে এবার সকল বোঝাপড়া হবে আপনার বোনের সাথে। বেয়াইন আমাদের সাক্ষাৎ পরি। পরিকে রেখে সিন্দাবাদের ভূতের মতো একা একা জামাই আদর খেতে চলে আসেন, এসব তো ঠিক না চয়ন ভাই! বোনকে সাথে আনবেন। আমরা, পাঁচ ভাই তাকে দেখে টেখে রাখব। আদরযত্ন করব। তবেই না শান্তি?’
মিথি আপু বললেন,
‘ তোদের পরি তো আসার জন্য এক পায়ে খাঁড়া। তবে এলেও তোদের বিশেষ সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তার শুভ্রকে পছন্দ। ফাজিলটাকে বললাম, আমার ননদকে বিয়ে কর। রাজি হলো না। দেখব তো, কোন অপ্সরাকে বিয়ে করিস।’
শুভ্র ভাই নীরবে খাচ্ছিলেন। মিথি আপুর কথায় ভুরু বাঁকিয়ে তাকালেন,
‘ করলাম নাহয় অপ্সরা বিয়ে। কিন্তু, তোকে দেখাতে যাব কেন? আমার বউ আমি একাই দেখব। তোকে আমার বিশ্বাস নেই৷ দেখা গেল, আমার বউকে গিয়ে বলে দিলি শিশু বয়সে জঘন্য হাতের লেখায় জঘন্য একটা প্রেমপত্র দিয়েছিলি আমাকে। আমার বউ যদি তখন আমাকে ভুল বুঝে? ভাবে, তোর মতো পাকনা মেয়ের আশেপাশে থেকে আমি ছোটবেলা থেকেই পেকে গিয়েছি? অথচ আসল কথা তো ভিন্ন। সে তো আর বুঝবে না, আমি আসলে খুবই কাঁচা। আমার দেহ-মন শিশুর মতো সরল।’
বরের সামনে এহেন সত্য উন্মোচনে ক্ষেপে গেলেন মিথি আপু। একটা চামচ ছুঁড়ে মেরে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
‘ সুন্দর চেহারা নিয়ে কী দেমাগ রে তোর শুভ্র! এই দেমাগ নিয়ে নিজেকে সহজ-সরল বলিস?’
শুভ্র ভাই দারুণ রিফ্লেক্সে এক হাতেই খপ করে ক্যাচ ধরে ফেললেন উড়ে আসা চামচ। সেটি যথাস্থানে নামিয়ে রেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ সহজ-সরলকে সহজ-সরল বলব না? সেদিন আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করল, প্রেম কী? আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আবিষ্কার করলাম, প্রেম শব্দটা আমি জীবনে শুনিইনি। ভেবে রেখেছি, বাসর রাতে একেবারে বউকেই জিজ্ঞাসা করব। বউ আমাকে আদর করে শিখিয়ে দিবে।’
তারপর এমন একটা ভাব করলেন যেন লজ্জায় গলে যাচ্ছেন। শুভ্র ভাইয়ের এহেন নাটকে মিথি আপু আর আমি ছাড়া সকলেই হো-হো করে হেসে উঠল। আমাদের দু’জনের মুখই ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে আছে। মিথি আপুর বোধহয় ইচ্ছে হচ্ছিল এই অভব্য লোকটির মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। আলিফ ভাই বললেন,
‘ সেই তো! আমাদের ভাই-ব্রাদারদের গ্রুপে শুভ্র ভাই হলো সরলতার প্রতিমা। আমাদের গুরু। ভাই? তোমার পা’জোড়া কোথায়? সালাম করব।’
শুভ্র ভাই মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন,
‘ টেবিলের নিচে। খবরদার! হাত ধুয়ে তারপর সালাম করবি৷ পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব বউয়ের জন্য রিজার্ভ। বউ ছাড়া অন্যকেউ ছুঁলে ফোসকা পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। আমি খুব সেনসেটিভ।’
আমার ভাইগুলোও কম নাটুকে না! শুভ্র ভাইয়ের কথায় হৈ হৈ করে চলে গেল হাত ধুতে। শুধু হাত ধুয়েই এলো না সাথে করে নিয়ে এলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার। আনন্দিত কণ্ঠে বলল,
‘ স্যানিটাইজার নিয়ে এলাম ভাই। একটু পর পর হাত ঘষে জীবাণুমুক্ত করব। বলা তো যায় না, হুট করে যদি ছুঁয়ে ফেলি? বাসর রাতে তোমার বউ যদি জিজ্ঞাসা করে, হে স্বামী? তোমার এই সুন্দর দেহে ফোসকার দাগ এলো কী করে? তাহলে তো মুশকিল!’
শুভ্র ভাই বিস্মিত হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
‘ বাহ! তোর তো বেশ বুদ্ধি আলিফ? বেশ করেছিস। আমার বউয়ের মন এমনিতেও খুব নরম। বরের গায়ে ফোসকা টোসকার দাগ তার সহ্য হওয়ার কথা না।’
এদের এই নাটকে অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে কথা বললাম আমি। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ খেতে বসে তোমাদের সিনেমা দেখতে দেখতেই তো পেট ভরে যাচ্ছে আলিফ ভাই। আর শুভ্র ভাই? আপনি কী দয়া করে আপনার বউ বউ টেপরেকর্ডারটা বন্ধ করবেন? এখানে আমরা কেউ আপনার বউয়ের গল্প শুনতে বসে নেই। শান্তিতে খেতে বসেছি, খেতে দিন। বউ বউ করে পরিবেশ নষ্ট করবেন না। বউ নিয়ে আপনার আদিখ্যেতা অসহ্য লাগে।’
শুভ্র ভাই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন। এমন একটা ভাব করলেন যেন এই ধরনের আশ্চর্য কথা শোনার পরও তিনি বেঁচে আছেন এটাই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ধমক দিয়ে বললেন ,
‘ তোর এতো জ্বলছে কেন? আমি সারাদিন আমার বউয়ের কথা বলবো। প্রয়োজনে দিন পেরিয়ে রাতে বলবো। একশো বছর তপস্যা করে, আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে-টেয়ে দিন-রাতের সময় দুই ঘন্টা বাড়িয়ে এনে সেই দুইঘন্টাও বউয়ের কথা বলবো। তাতে তোর বাপের কী? ইয়াহিয়ার কন্যার বুকে শুধু দাউদাউ হিংসা, না? ইয়াহিয়া বাংলার স্বাধীনতা দেখতে পারেনি। তোর বাপ আমার স্বাধীনতা দেখতে পারে না। আর তুই আমার বউয়ের স্বাধীনতা দেখতে পারছিস না। তোদের নজর লেগেই বউটা আমার দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিষ্পাপ বর-বউ তোদের কী ক্ষতি করেছি?’
আলিফ-অদুত- রাতুল ভাই সুর তুলে বললেন,
‘ সেই তো! এই নিষ্পাপ দম্পত্তি তোদের কী ক্ষতি করেছে?’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলাম। সামনে কেউ না থাকলে এক্ষুনি দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে ফেলতাম, ‘হে বিধাতা! এই নাটুকে পুরুষের নাটক সহ্য করার ধৈর্য্য দাও। ধৈর্য্য দাওওও।’ সৃষ্টিকর্তা বোধহয় ইতোপূর্বে আমাকে যথেষ্ট ধৈর্য্য দান করে ফেলেছেন। নতুন করে আর মুখ তুলে তাকালেন না। আমি এই লোকের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে টেবিল থেকে উঠে সোফায় গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর আমার পিছু পিছু উঠে এলো রাফিয়া আর নিধি নামক দুই অদ্ভুত প্রাণী। এরা দুটোই শুভ্র ভাইয়ের অন্ধভক্ত। শুভ্র ভাইকে ব্লান্ডারে দিয়ে জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলতে পারলে তারা খুশি হয়। আমি তাদের দেখেই কানে এয়ারফোন গুঁজলাম। আপাতত তাদের দেবতা সদৃশ শুভ্র ভাইয়ের গুণকীর্তন শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওরা দু’জন আমার দু’পাশে বসে মনের সুখে বকবক জুড়ে দিল। আমার কানে পুরোদমে গান বাজছে। ওদের বকবক থেকে নিস্তার পেয়ে শূন্য দেওয়ালের দিকে চেয়ে অলস মুখে ভাত চিবুচ্ছি। আমার এই নিবিড় দেওয়াল বিলাস রাফিয়ার পছন্দ হলো না। কান থেকে এয়ারপ্লাগটা খোলে নিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
‘ এই? কী এতো গান শুনছিস? কখন থেকে ডাকছি। গান শুনে উদাস হয়ে নিশ্চয় ওই বিবাহিত লোকটার কথা ভাবছিলি?’
আচমকা প্রশ্নের তোপে হতচকিত হয়ে গেলাম আমি। বুঝে পেলাম না, কোন বিবাহিত পুরুষের কথা হচ্ছে? রাফিয়া আমার বিভ্রান্তিকে বিরক্তি ধরে নিয়ে তরল কণ্ঠে বলল,
‘ দেখ রোদু? রাগ করিস না। বুঝার চেষ্টা কর, প্রেমিকাযুক্ত পুরুষের দিকে তাকানো ইজ ওকে। কিন্তু বিবাহিত পুরুষের দিকে তাকানো কত শক্ত তুই জানিস? তার দিকে তাকালেই সর্বপ্রথম যে কথা মনে পড়ে তা হলো, এই লোক প্রতিদিন এক বেয়াদব, ডাইনী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমায়, ছিইইইই! কী অশ্লীল! তারপরও তুই কী করে একটা বিবাহিত লোকের প্রেমে পড়তে পারিস? হাও!’
আমি স্তব্ধ চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। মনে পড়ল, সেদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, আমি এক বিবাহিত লোককে ভালোবাসি। রাফিয়া সে কথাকেই মস্তিষ্কে সেঁটে নিয়ে মুখস্থ করে বসে আছে। রাফিয়া আমার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
‘ এজন্যই তো শুভ্র ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনলেই আমার কান্না পায়। বুকের ভেতরটা হাউমাউ করে ওঠে। আচ্ছা, শুভ্র ভাইকে বিয়েই কেন করতে হবে বল তো? শুভ্র ভাই সালমান খানের মতো চিরকাল চিরকুমার থাকতে পারে না?’
আমি ভুরু বাঁকিয়ে তাকালাম। বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ শখ তো দেখি তোর একেবারে ষোল আনা? নিজে বিয়ে করে বরের সঙ্গে হানিমুনের উপর হানিমুন ট্যুর দিবি। আর শুভ্র ভাই তোর সুখের জন্য চিরকুমার হয়ে বসে থাকবে?’
রাফিয়া দুঃখী কণ্ঠে বলল,
‘ শুধু আমার জন্য কেন? তাবৎ দুনিয়ার সকল রমণীর কথা ভেবে তার উচিত বিবাহ বর্জন করা। শুভ্র ভাই কাউকে চুমু খাচ্ছে। ও মাই গড! আমি কল্পনাও করতে পারি না! এতো সুন্দর একটা ছেলে কী করে অন্য একটা মেয়েকে চুমু খেতে পারে? আমি তো মানতেই পারব না। এই নিধি? তুই মানতে পারবি, বল?’
নিধি হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘ আমি তো ওনার চিরকুমার থাকাও মেনে নিতে পারব না রাফিয়াপু। আই ওয়ান্ট টু মেরি হিম। আমি চাই ওনি আমাকে বিয়ে করে চিরকুমারের ইতিহাস গুচিয়ে ফেলুক!’
আমার মাথার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটে গেল। রাফিয়ার আহাজারি শুনে শুনে আমি অভ্যস্ত। তাই বলে এই মেয়ে? কে এই মেয়ে? কোথা থেকে আসে এরা? আই ওয়ান্ট টু মেরি হিম? এতো বড় দুঃসাহস! কেন? এই পৃথিবীতে কী আর কোনো ছেলে নেই? নাকি সে মৌচাক? উড়ে উড়ে তার উপর এসেই বসতে হবে? আমি প্রলম্বিত শ্বাস ফেললাম। রাফিয়ার থেকে এয়ারপ্লাগটা ছিনিয়ে নিয়ে বিনাবাক্য ব্যয়ে বসার ঘর ছেড়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলাম। প্লেটটা সিঙ্কে রেখে খাবার টেবিলে পানি খেতে যেতেই আদিবা খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ রোদাপু জানো? আমি বড় হয়ে দাদাভাইকে বিয়ে করব।’
মেজাজটা আমার ঝনঝন করে উঠল এবার। এই দুইদিনের পুচকেরও নাকি বিয়ে করার জন্য শুভ্র ভাই চাই! দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘ কেন রে? দাদাভাই ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো ছেলে নাই? তোকে কেন দাদাভাইকেই বিয়ে করতে হবে?’
আদিবা বলল,
‘ দাদাভাই বেশি ভালো।’
‘ ভালো হলেই বিয়ে করতে হবে?’
‘ হ্যাঁ, হবে।’
আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
‘ শখ কত! দাদাভাই তোকে বিয়ে করবে না।’
‘ এ্যাহ্! তুমি বললেই হলো?’
আমার ক্রমবর্ধমান রাগ বাড়ছে। জেদ ধরা কণ্ঠে বললাম,
‘ হ্যাঁ, আমি বললেই হলো।’
আদিবা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘আমার দাদাভাইকে আমি বিয়ে করবো। তাতে তোমার কী?’
আবার মুখে মুখে তর্ক? কত বড় সাহস! রাগে-দুঃখে কান্না পেয়ে গেল আমার। ধমক দিয়ে বললাম,
‘ আমার দাদাভাই! এই তোর দাদাভাই কী করে হলো? ওনি আমার মামুর ছেলে। তোর কিছুই হয় না।’
আদিবা জেদ ধরে বলল,
‘ আমার দাদাভাই। একশোবার আমার দাদাভাই। দাদাভাই বলেছে, বড় হলে আমাকে বিয়ে করবে।’
এই তবে ঘটনা? এমনি মেজাজ খারাপ ছিল। এবার মেজাজের উপর ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে গেল। তীব্র চোখে সামনে বসে থাকা তার গর্বিত দাদাভাইয়ের দিকে তাকালাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
‘ তাই নাকি? এতো শখ বিয়ে করার?’
ততক্ষণে টেবিল খালি হয়ে গিয়েছে। দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছে আলিফ আর রাতুল ভাই। আমার মেজাজে ঘি ঢেলে শুভ্র ভাইয়ের বদলে উত্তর দিল আদিবা। তড়বড়িয়ে বলল,
‘ তাই, তাই। একশোবার তাই।’
নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ। আমি তীব্র চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে থেকেই আওয়াজ করে নামিয়ে রাখলাম পানির গ্লাস। রাগে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে আদিবার মুখ চেপে ধরে বললেন,
‘ চুপ কর বাপ! চুপ! তোর বোন চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে আমায়।’
আমি চিবিয়ে খেয়ে ফেলব! আমি? রাগ ধরে রাখতে না পেরে টেবিলের উপর থেকে টিস্যু বক্সটা তুলে নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে মেরে মনে মনে বললাম,
‘ ব্যাটা মর তুই। মর মর মর!’
শুভ্র ভাই অবলীলায় সেটা ধরে ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভুলানো হাসি হাসলেন। আলিফ ভাই আর রাতুল ভাই পাশ থেকে হৈ হৈ করে উঠে বললেন,
‘ ইশ! মিস। রোদু আরেকবার, আরেকবার। এইবার ভিডিও করব। রেডি ওয়ান টু থ্রী।’
আমি হাতের কাছের গ্লাসটা তুলে নিয়ে নির্বিকার মুখে পানি ছুঁড়ে দিলাম তাদের দিকে। দাঁতে দাঁতে চেপে বললাম,
‘ হয়েছে?’
তারা দু’জন হতবাক হয়ে গেল। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ আরে, আমরা কী করলাম!’
আমি উত্তর দিলাম না। মেজাজটা আমার দাউদাউ করে জ্বলছে। এদের সামনে আর এক মুহূর্ত না। জায়গাটা থেকে সরে যেতেই ভেতরের রোদু চিড়বিড় করে বলল,
‘ তোর রাগের পারদ যে হারে বাড়ছে, এই হারে বাড়লে যেকোনো সময় মাইল্ড স্ট্রোক করে বসে থাকবি তুই। ব্রেনের নার্ভ টার্ভ ছিঁড়ে পাগল হয়ে ঘুরবি। একটা ছেলের জন্য পাগল হয়ে যাওয়া কী বুদ্ধিমানের কাজ? কে এই শুভ্র? একে ময়লার ডাস্টবিনে ফেলে দে। ট্র্যাশ!’
আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,
‘ ট্র্যাশ?’
গম্ভীর রোদু ধমক দিয়ে বলল,
‘ অবশ্যই ট্র্যাশ। এইসব ট্র্যাশ ফ্র্যাশের জন্য দুঃশ্চিন্তা তোকে মানায় না। টেক আ ডিপ ব্রেথ। এন্ড থিংক, শুভ্র বলে পৃথিবীতে কেউ নেই। কিছু নেই। এই লোক মহাকাশে ভেসে যাক; ইউ ডোন্ট কেয়ার।’
আমি গম্ভীর রোদুর কথা মেনে নিয়ে গম্ভীর খোলসে ঢুকে পড়লাম। কিছুক্ষণ ছাদে ঘোরাফেরা করে নিজেকে বুঝালাম, পৃথিবী ভেসে যাক। আই ডোন্ট কেয়ার। আই ডোন্ট কেয়ার। নিজেকে ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ এর পট্টি পেরিয়ে নিচে নামতেই আবারও মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। আমাকে বসার ঘরে ঢুকতে দেখেই বারান্দা থেকে ডেকে পাঠাল মিথি আপা। গিয়ে দেখলাম তারা সেখানে আড্ডা পেতেছে। আমি যেতেই গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল,
‘ হ্যাঁ রে রোদু? তুই নাকি আলিফ আর রাতুলের মাথায় এক জগ পানি ঢেলে দিয়েছিস? রাফিয়া বলছিল, তোকে নাকি কোন বিবাহিত পুরুষ তাবিজ করেছে? তুই নাকি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস? ভদ্রলোকের প্রেমে পড়েই এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস? ভদ্রলোকের বউ নাকি আবার পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা? ঘটনা সত্য?’
মিথি আপুর মুখে নিজের সম্বন্ধে এতোগুলো নতুন তথ্য শুনে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। শীতল চোখে একবার রাফিয়ার দিকে তাকালাম। ততোধিক শান্ত কণ্ঠ বললাম,
‘ তুই তোর মাথা নিয়ে আমার কাছে আসবি? নাকি আমি ইট নিয়ে তোর কাছে যাব?’
রাফিয়া ততক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। আমি এগুলেই সে দৌঁড়ে পালাবে এমন ভঙ্গিমা নিয়ে বলল,
‘ আমি কী মিথ্যা বলেছি? তুই আমাকে সেদিন বলিসনি, তোর এক বিবাহিত লোককে পছন্দ? তাকে তোর জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়, বলিসনি? আমি তো সত্য কথায় বলেছি।’
আমি একনজর শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তিনি স্নিগ্ধ চোখে এক ঝাক হাসি নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ সেখানে এই অন্তঃসত্ত্বা ব্যাপারটা কোথা থেকে এলো?’
‘ ওটা আমি গেইস করেছি। আমি কী তোর মতো বোকা? ব্যাটা বিয়ে করেছে আর বউ অন্তঃসত্ত্বা হবে না? তুই প্রেমে পাগল তাই বুঝতে পারছিস না। দেখ গিয়ে সব কোর্স কমপ্লিট করে বসে আছে। ছেলেরা এমনই হয়৷’
আহারে! কতই না পুরুষ বিশারদ সে! আমি শীতল চোখে তাকিয়ে রইলাম। রাফিয়া ভয়ে ভয়ে বলল,
‘ ওমন কটমট করে তাকাচ্ছিস কেন? আমি তো তোর ভালোর জন্যই বলেছি। যে লোক ঘরে বউ রেখে প্রেম করে সে কী ভালো লোক হয়? শুভ্র ভাই? আপনিই বিচার করুন।’
শুভ্র ভাই রেলিঙে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে জারিফের একটা খেলনা গাড়ি পরীক্ষা করছিলেন। রাফিয়ার কথায় চোখ তুলে একবার আমার দিকে তাকালেন। গলা খাঁকারি দিয়ে কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন,
‘ সেই তো! এই রোদু? তুই এমন কটমট করে চেয়ে আছিস কেন? একে তো বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ে অন্যায় করেছিস তারওপর আবার কটমট করে চেয়ে আমাদের সাক্ষীকে ভয় দেখাচ্ছিস। তুই তো দেখি মহাপাপী! তোকে এই মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।’
আমি ভেবেছিলাম এই লোকের সাথে দ্বিতীয়বার কথা বলব না। কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টে শক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়া যাবে না এটা কোন আইনে লেখা আছে, শুভ্র ভাই? আমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয়েছে, আমি পড়েছি। আপনাদের কোনো সমস্যা? আপনাদের প্রেম নিয়ে তো আমি কোনো অভিযোগ করিনি তবে আমার প্রেমে এতো বিচার সালিশ কেন!’
শুভ্র ভাই ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ দেখেছিস মিথি? আজকালকার মেয়েদের কেমন চ্যাটাংচ্যাটাং কথা? অবশ্য ইয়াহিয়া বংশ থেকে এর থেকে বেশিকিছু আশা করা যায় না। তোর বাপ হয়েছে ইয়াহিয়া খান; আর তুই হয়েছিস ইয়াহিয়া খানের কন্যা বেয়াদব খান। বড়োদের মুখের উপর ফটফট করে প্রেমের কথা বলছিস। আমাকে দেখ, আমি কখনো প্রেমের কথা বলেছি? আমার তো প্রেম শব্দ শুনলেই লজ্জা লাগে।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। লজ্জা লাগে! বাংলাদেশের নাটক কমিটির প্রধান নাটকরাজ শুভ্রর লজ্জা লাগে! হাহ্! কৌতুকের পরিসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এই উপহাস। আমাকে চুপ থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন অদুদ ভাই,
‘ সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণ দেখিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাইতেছে যে, আমাদের রোদ বানু বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়িয়া আমাদের সম্মানহানি ঘটাইয়াছে এবং মাননীয় লাজুক শুভ্র ভাইয়ের সম্মুখে প্রেমের কথা বলিয়া ৪০২ ধারা লঙ্ঘন করিয়াছে এবং…’
মিথি আপু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ এই তুই দপ করে ৪০২ ধারায় চলে যাচ্ছিস কেন? বাকি ধারায় কী আছে?’
অদুদ ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ ঘোষণার মাঝখানে হাত ঢুকাবি না, মিথি। ৪০২ ধারা না বললে ফিল আসতেছে না এইজন্য বলেছি। প্রয়োজনে এক হাজার দুইশো পঁচিশ নম্বার ধারাও বলবো। তুই শাট আপ হ।’
মিথি আপা ‘শাট আপ’ হলেন। অদুদ ভাই আবারও তার গম্ভীর ভাবসাবে চলে গেলেন। পরবর্তী ঘোষণা শুরু হলো,
‘ এবং আঠারো বছরের আগে প্রেমে পড়িয়া ১০৭ নম্বর বিধি লঙ্ঘন করিয়াছে… ‘
আমি প্রতিবাদ করে বললাম,
‘ ফালতু কথা বলবে না, আই অ্যাম টোয়েন্টি নাউ। চারদিন আগে আমার বিশ বছর হয়ে গিয়েছে। আঠারো আমি আরও দুই বছর আগে পেরিয়ে এসেছি।’
শুভ্র ভাই বললেন,
‘ তুই বললেই হলো নাকি? তোর বাপ তো মানতে নারাজ। সরকার কী বলেছে শুনিসনি? মেয়ের আঠারো হওয়ার সাথে সাথে বিবাহ দিয়ে দাও। কিন্তু তোর বাপের তো তোর বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। রাফিয়ার তো ঠিকই বিয়ে হচ্ছে। তারমানে তুই আঠারো নোস। তোর বাপের হাবভাব দেখে মনে হয়, তুই কচি খুকি। কচি খুকির বয়স আমরা দিলাম, দশ বছর।’
এমন উদ্ভট যুক্তিতে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। বিড়বিড় করে বললাম,
‘ আশ্চর্য!’
জারিফ বিজ্ঞ পণ্ডিতের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,
‘ তারমানে রোদ আপু আমার থেকে দুই বছরের জুনিয়র। রোদ আপু আজ থেকে তুমি আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে। আমি তোমাকে তুই বলে ডাকবো।’
আমি হাত বাড়িয়ে জারিফের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে শুধালাম,
‘ ভাইয়া ডাক শোনার শখ মিটেছে?’
জারিফ গালে হাত দিয়ে মাথা দোলালো। আমি বললাম,
‘ গুড।’
আলিফ ভাই বললেন,
‘ যতোই থাপড়া-থাপড়ি করিস। দশ বছর বয়সে প্রেম-পিরিতি আমরা মেনে নিতে পারছি না। তোর শাস্তি অনিবার্য।’
আমি বললাম,
‘ আমার কাছে আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে। আমার বিশ বছর হওয়ার প্রমাণ আছে। তোমরা দশ বছর কমিয়ে ফেললেই হবে কেন?’
শুভ্র ভাই বললেন,
‘ এসব আইডি কার্ড ফাইডি কার্ড আমরা মানি না। আমরা সচেতন মানুষ, বুঝেশুনে বিশ্বাস করি। তবে তুই যদি আইডি কার্ড এবং তার সাথে একটা পৃষ্ঠা সংযুক্ত করে সেখানে তোর বাপের সাক্ষর আনতে পারিস তবে আমরা বিশ্বাস করবো। সংযুক্ত পৃষ্ঠায় বড়ো বড়ো করে লেখা থাকবে,
মাননীয় পিতা মহোদয়,
আমি এখন বিশ বছরের যুবতী কন্যা। ইতোমধ্যে আমার প্রেমের বয়স পেরিয়ে বিবাহের বয়স হয়ে গিয়েছে। আপনার উচিত অতি শীঘ্রই আমার বিবাহ দেওয়া। পাত্র আশেপাশেই আছে। ভালো করে দৃষ্টি করিলেই দেখিতে পাইবেন৷ ভালো করে দৃষ্টি করুন ;ইয়াহিয়া স্বভাব ত্যাগ করুন।’
আমি শীতল কণ্ঠে বললাম,
‘ এখানে প্রায় সবাই আপনার ছোট। ছোট ভাই-বোনদের সামনে যে আপনি বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলছেন? এতে কী আপনার সম্মান খুব বাড়ছে বলে মনে করছেন, শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হয়ে বললেন,
‘ আমি বাজে কথা বলেছি? আমি? শোন, আমি শুভ্র কখনও বাজে কথার ধারেকাছে নেই। আমার লক্ষ্মী বউ একবার আমাকে বলল, শুভ্র? তুমি তোমার নামের মতোই স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ মুখ নিয়ে তুমি কখনও বাজে কথা বলবা না। আমি বউ অন্তঃপ্রাণ মানুষ। সেদিন থেকে আমার মুখ থেকে হড়হড় করে মধু বেরোয়।’
আমি শান্ত চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, রাগে আমার কলিজা ফুসফুস ফেঁটে একাকার হয়ে যাবে। নিজেকে শান্ত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করে শুধালাম,
‘ আপনার ধারণা, একটু আগে মধু বেরুচ্ছিল আপনার মুখ থেকে?’
‘ অবশ্যই মধু। ইয়াহিয়া কত মান্যিগন্যি মানুষ ছিল তার কোনো ধারণা আছে তোর? সে ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। অখন্ড পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তোর বাপকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিলাম তাতেও দোষ?’
আমি জ্বলন্ত চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দৃষ্টিকে পরোয়া করল না। বরং খুব আগ্রহ নিয়ে সবাইকে বিশ্লেষণ করতে বসল কেন ইয়াহিয়া মান্যিগণ্যি? মান্যিগণ্যি হওয়ার পরও সে কতটা ধান্ধাবাজ, বেয়াদব। বাঙালিদের অধিকারের সাথে সে কী ধরনের নাফরমানি করেছে। আমি কিছুক্ষণ তার বক্তৃতা শুনে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই লোকের সাথে আর একটি কথা নয়। প্রয়োজনে ছাগলের সাথে কথা বলব, তারপরও তার সাথে না। আমার প্রিয় পাঠক মাত্রই জানেন, আমার শপথ আর বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনেকটাই একই। প্রায়শই বাস্তবের সাথে তাদের খুব একটা মিল মিছিল হয় না। তারপরও আমি পুরোদমে চেষ্টা করে গেলাম। সারাটাদিন শুভ্র ভাইয়ের আশেপাশেও ঘেঁষলাম না। সন্ধ্যার পর আদিবা-জারিফ এসে খবর দিল সবাই মিলে রাস্তা হাঁটতে যাচ্ছে। টং দোকানে চা খাওয়া হবে। আমি যেন তৈরি হই। আমি মুখের উপর নাকচ করে দিয়ে বললাম,
‘ আমি যাব না।’
আমি যাব না শুনে রাফিয়া আর নিধি এলো আমাকে মানাতে। দু’জন দুদিকে ঝুলে পড়ে বলল,
‘ এই রোদু? চল না প্লিজ? আমরা সবাই যাচ্ছি। তুই না গেলে একটুও মজা হবে না।’
আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,
‘ খবরদার! আমার সাথে পিরিতি দেখাতে আসবি না। আমার মানসম্মান ধুলায় মিটিয়ে এখন প্রেম দেখানো হচ্ছে! সর।’
রাফিয়া মন খারাপ করে বলল,
‘ আচ্ছা যা, পিরিতি দেখাব না। কিন্তু প্লিজ চল। তুই না গেলে আম্মু আমাকে ঘর থেকেই বেরুতে দিবে না।’
আমি বরফ খন্ডের মতো শক্ত হয়ে রইলাম। গলাগলির প্রশ্নই উঠে না। আমার গলার সম্ভবনা না দেখে বিরক্ত হয়ে এলেন মিথি আপু। এসেই ধমক দিয়ে বললেন,
‘ কী নাটক শুরু করলি বল তো রোদু? সবাই একটা জায়গায় যাবে বলে ঠিক করেছে তার মধ্যে বেঁকে বসলি তুই। শুভ্র কাল চলে যাবে। আজ সবাইকে খাওয়াবে বলল। তোর সমস্যাটা কী বুঝতে পারছি না।’
আমি নির্বিকার কণ্ঠে বললাম,
‘ আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার সমস্যাই হলো, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।’
মিথি আপু রাগ করে বললেন,
‘রুহি তো আগেই যাবে না। তুই যাবি না বলে রাফিয়ারও যাওয়া বন্ধ। শুভ্র বলেছে, কোনো মেয়েকেই নিবে না। আমারও যাওয়া বাদ। তোর একার জন্য সবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
এরপর আর তর্ক করা চলে না। নিজের জন্য নিজের আনন্দ মাটি হলে মাফ করা যায় কিন্তু নিজের জন্য অন্যের আনন্দ মাটি হলে সেটা মর্মবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজি হলাম।
শীতের রাত, তারওপর আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। নিয়ন বাতির আলোয় কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে এই শহর! আমাদের বারো জনের বিশাল দল হৈ হৈ করে রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। বেশিদূর যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়নি। এলাকার মধ্যেই কিছুদূর এগিয়ে চা, ভাপা পিঠা খাওয়াই আমাদের পরিকল্পনা। তিন দলে ভাগ হয়ে আমরা হাঁটছি। সামনে মিথি আপু, আলিফ-অদুদ-মিলাদ ভাই, ভাইয়া আর চয়ন ভাই। দ্বিতীয় দলে আমি, রাফিয়া, নিধি আর আমাদের হাত ধরে হাঁটছে আদিবা জারিফ। আমাদের পেছন পেছন হাঁটছেন শুভ্র ভাই আর রাতুল ভাই। সামনের দলে যত হৈ-চৈ তার আংশিক আমাদের দলে ঢেউ দিলেও তা একেবারে মিলিয়ে গিয়েছে শুভ্র ভাইদের দলে গিয়ে। শুভ্র ভাইরা হৈ-চৈ করছে না। তারা পড়াশোনা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করছেন। টং দোকানে চা খাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বেরুলেও ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ায় হৈ-হৈ করে রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। এলাকার ভেতরের দিকে রেস্টুরেন্ট। খরিদ্দার তেমন নেই। আমরা পাশাপাশি দু’টো টেবিল দখল করে বসলাম। শুভ্র ভাই আর রাতুল ভাই তখনও গম্ভীরমুখে আলাপ করছেন। নতুন রেস্টুরেন্ট এক্সপ্লোর করে, ছবি-টবি তুলে ক্লান্ত হয়ে আমরা সকলে অবচেতনেই শুভ্র ভাই আর রাতুল ভাইয়ের কথাতেই মনোনিবেশ করলাম। শুভ্র ভাই এক পর্যায়ে বললেন,
‘ শোন, যথেষ্ট ধৈর্য আর আগ্রহ না থাকলে পিএইচডির ঝামেলায় যেতে নিষেধ করব আমি। ফ্যাকাল্টি অথবা রিসার্চ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে না থাকলে ফাউ পিএইচডি করে লাভ কিছু হবে না। যদি না তোর ইন্টারেস্ট থাকে। পিএইচডি শুনতে যত মজা, করতে গেলে ততই সাজা। কুইজ, মিডটার্ম, ফাইনাল এক্সাম, প্রজেক্ট, টার্ম পেপার, প্রেজেন্টেশন, রিসার্চ রিলেটেড স্পেসিফাইড কোর্স, ট্রেনিং, ল্যাবের খাটুনির তো হিসেবই নেই। তারওপর যদি টিচিং-এ ঢুকিস তাহলে সেখানে আলাদা প্যারা। এসবের বাইরে সবথেকে প্রেশার যেটা, সেটা হলো, ফিনানশিয়াল ক্রাইসিস। লং টার্ম কোর্স; অনেকেই শেষদিকে হতাশ হয়ে পড়ে। তুই যতদিনে পিএইচডির জন্য খেটে মরবি ততদিনে দেখবি তোর কোনো ফ্রেন্ড মাস্টার্স কমপ্লিট করে সিক্স ডিজিটের চাকরি করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ টিপস কী জানিস?’
রাতুল ভাই শুধালেন,
‘ কী?’
শুভ্র ভাই মুখ গম্ভীর করে বললেন,
‘ বিয়ে করে ফেলা। যদি কোনো সিরিয়াস প্রেম থাকে; একেবারে জীবন-মরন সমস্যা। তাহলে সবার আগে তাকে ধরে বিয়ে করে ফেলতে হবে।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় ‘সিরিয়াস টিপসের আশায় ব্যকুল হয়ে বসে থাকা’ আমরা হতাশ হলাম। রাতুল ভাই হেসে ফেলে বললেন,
‘ কী যে বলো!’
শুভ্র ভাই হাসলেন না। থমথমে মুখে মাথা ঝাঁকালেন। বললেন,
‘ এটাই আসল টিপস। যেকোনো সময় প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাবে এই প্রেশার নিয়ে পড়াশোনা কিছু হবে না। বুদ্ধিমানরা বুদ্ধি দিয়ে কাজ করে। আমি ভাই সবার আগে এই কাজই করেছি।’
মিথি আপু ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
‘ তুই বলতে চাইছিস, তুই বিয়ে করে ফেলেছিস?’
ততক্ষণে আমাদের খাবার চলে এসেছে। জানুয়ারির ঠান্ডায় গরম গরম কফি আর গরম আড্ডা চমৎকার লাগছে। শুভ্র ভাই কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘ অবশ্যই। বিলেতে বসে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে পড়াশোনা ফেলে দৌঁড়ে দেশে আসো। এসে দেখো, প্রেমিকার বিবাহ সম্পন্ন। সে আরেক লোকের বাসর ঘরে বসে আছে। ও মাই গড! অসম্ভব! এতো ট্রাজেডি আমার সহ্য হবে না। বউ নিয়ে আমি খুব সিরিয়াস। আমার স্ট্রোক হয়ে যাবে। আমার মতো মেধাবী পুরুষ যদি বউয়ের চিন্তায় চিন্তায় মরে যায় তাহলে এই দেশ-দশ, সর্ব সাকুল্যে এই পৃথিবীর কত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে ভাবতে পারছিস? আমি এতো রিস্ক নিতে রাজি নই।’
শুভ্র ভাইয়ের কথার ধরনে হেসে ফেলল সবাই। ভাবল, শুভ্র ভাই বুঝি মজা করছেন। কেউ হাসি মজা করতে করতে ভরা আড্ডায় এমন এক গোপনীয় খবর দিয়ে দিতে পারেন, তা কারো বিশ্বাস হওয়ার কথাও না। মিথি আপু বললেন,
‘ যা সর! তোর যত নাটক। আমার ধারণা, তোর কোনো প্রেমিকাই নেই। শুধু শুধু সবাইকে ঢপ মারিস। সুন্দর ছেলেদের প্রেমিকা থাকে না। সব মেয়েরা তাদের উপর মৌমাছির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা এই বিষয়টা উপভোগ করে। তোর হয়েছে ওই দশা।’
শুভ্র ভাই হতাশ কণ্ঠে বললেন,
‘ এইযে বিশ্বাস করলি না। তারপর যখন ঘটা করে শুনবি তখন ঠিকই ঘ্যানঘ্যান করে বলবি, শুভ্র তুই বিয়ে করে ফেললি আমাদের বললি না? আমরা কী তোর পর? তোরা তো আসলেই আমার পর কিন্তু তখন তো আর মুখের উপর বলে ফেলা যাবে না।’
মিথি আপু বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ এখন তো ঠিকই বলছিস।’
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। হঠাৎ করেই সেই হাসি কী মিষ্টি দেখাল আমার চোখে! টোল পড়া গালে শিশুর মতো অনাবিল হাসি। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম।
আসার সময় হেঁটে হেঁটে চলে এলেও ফেরার সময় নামল প্রলয়ংকরী ঝড়। আকাশ ফুটো হওয়া ঝুম বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুটো অটোরিকশা ঠিক করলেন ভাইয়া আর শুভ্র ভাই। আমি উঠলাম প্রথম অটোতে। অটোর পর্দা টেনেটুনে কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো দুনিয়া থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। অটোতে বসে কাক ভেজা হওয়া দুই মানবের জন্য দুশ্চিন্তাও হলো। কী দরকার ছিল ভেজার? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যেত না? এখন আবার কোথায় বসেছে কে জানে? আমার দুশ্চিন্তার মাঝেই অটো থেমে গেল। দুশ্চিন্তায় ফেলে দেওয়া পুরুষ অটোর পর্দা সরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘ রোদ নেমে আয়।’
রাফিয়া আপ্লুত হয়ে শুধাল,
‘ ভাইয়া আমরা চলে এসেছি?’
শুভ্র ভাই জানালেন,
‘ না। আরেকটু বসো। রোদকে দরকার। রোদ তুই নেমে আয়। তুই রাহাত ভাইয়ের সাথে অন্য অটোতে যাবি। ভাই তোকে ডাকছে।’
ভাইয়ার প্রসঙ্গে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম আমি। ওনার সাথে কথা বলব না সিদ্ধান্তে এখনও অটুট আছি বিধায় কোনোরকম প্রশ্ন না করে নেমে দাঁড়ালাম। সাথে সাথেই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে গেল আমার একাংশ। দৌঁড়ে পেছনের অটোর কাছে যেতেই শুভ্র ভাই আমার হাত ধরে আটকে রেখে অটোর ভেতরে উঁকি দিয়ে বললেন,
‘ রাহাত ভাই? রোদকে আম্মু থাকতে বলেছে। তোমরা চলে যাও। আম্মু ফোন দিয়ে বাসায় জানিয়ে দিবে।’
সাথে সাথেই চমকে আশেপাশে তাকালাম আমি। খেয়াল করলাম, আমরা শুভ্র ভাইদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করে বললাম,
‘ না। কক্ষনো না। আমি বাসায় যাব।’
শুভ্র ভাই আমাকে অগ্রাহ্য করে অটোওয়ালাকে বললেন,
‘ মামা আপনি যান তো।’
আমি ওনার হাত থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে প্রায় চিৎকার করে বললাম,
‘ ভাইয়া আমি বাসায় যাব। ভাইয়া! ভাইয়া!’
ভাইয়া পর্দা সরিয়ে একবার আমার দিকে তাকাল। এক ঝলকের জন্য দ্বিধান্বিত দেখাল তার দৃষ্টি। কিন্তু ততক্ষণে অটো চলে গিয়েছে বেশ খানিকটা দূর। দুই মিনিটের মধ্যে নিঃশব্দ ভেজা রাতে একেবারে একলা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর শুভ্র ভাই। জ্বলন্ত চোখে একবার ওনার দিকে তাকালাম। ইচ্ছে হলো বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটেই রওনা দেই বাসায়। কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বিধায় মুখ গুঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে বৃষ্টি বাড়ল। জানুয়ারির ঠান্ডা রাতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন কেঁটে বসতে চাইল চামড়ার ওপর। আমি জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি। শুভ্র ভাই সেই জেদী তরুণীর পাশে শান্ত ছেলেটির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার চোখে ক্রোধ, তার চোখে মায়া। আমি বিরক্তিতে অস্থির, সে মুগ্ধতায় হতবিহ্বল। এক সময় আমি হেরে গেলাম। একটি সাধারণ রমণীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতায় বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া অসাধারণ পুরুষটির দিকে চেয়ে আমার মনে হলো, এই রাতটি বড় মনোরম। আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলোয় জল চিকচিকে শূন্য পথ। সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিমুগ্ধ এক পুরুষ। আমার সকালের জ্বর। শুভ্র ভাইয়ের জ্বরের ধাঁত সব যেন চোখের পলকে ভুলে গেলাম। শুভ্র ভাই আমার দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বললেন,
‘ চল হাঁটি।’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। ওনার উষ্ণ হাতে আমার শীতল হাত পুরে নির্বিকার মুখে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি আচ্ছন্নের মতো তার পিছু নিলাম। সারা শরীরে সঞ্চারিত হয়ে গেল অদ্ভুত এক ঢেউ। সব অভিমান গলে গেল। রাগ মুছে গেল। পৃথিবী ভুলে গেলাম। কিছুদূর হেঁটে একটা রিকশা ভাড়া করে তাতে চেপে বসলাম দু’জনে। রিকশাওয়ালাকে বলা হলো, পলি, হুড কিচ্ছু চাই না। বৃষ্টি ঝরুক। আপনি শুধু ছুটে চলুন। আমরা সেই পাগল জুড়ি যারা গন্তব্য পিছু ফেলে অযথাই ছুটে চললাম পরিচিত রাস্তা ধরে। যে পথ দিয়ে দু’জন পাশাপাশি বহুবার হেঁটেছি। যে পথ দেখেছে আমাদের রাগ। অভিমান। শুনেছে কারো খোলা গলার গান। সেই পথ ধরে ছুটতে ছুটতে বিপদসীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর নড়ে উঠলেন শুভ্র ভাই। ভেজা পকেট থেকে বের করে আনলেন ভিজে যাওয়া এক বেলীফুলের মালা। মালা থেকে শিশির বিন্দুর মতো টপাটপ জল গড়াচ্ছে। এই অসময়ে বেলীফুল দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। শুভ্র ভাই একটু কাছে সরে এসে আমার ভেজা চুলে এলোমেলো খোঁপা বাঁধার চেষ্টা করলেন। বহু কসরত করে তাতে জড়ালেন বেলী ফুলের মালা। ভেজা চুলের ভাঁজে উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে গাঢ় কণ্ঠে বললেন,
‘ এই পথ ধরে অনেকদিন হাঁটা হবে না আমার। আবার সেই চব্বিশের জুলাইয়ে। ততদিন এই পথ জেনে রাখুক, আমার সম্পূর্ণ পৃথিবী গুটিয়ে স্বেচ্ছায় জড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছি একটি তরুণীর খোঁপায়। সে চুল মেললে আমি ফুল হয়ে ঝরে পড়ব। আমি তাকে প্রতিদিন বেঁচে থাকার মতো করে মনে করব।’
আমার বুকের ভেতরটা টলমল করে ওঠল। স্বেচ্ছায় গায়ের ভার ছেড়ে দিলাম পেছন দিকে। একটা উষ্ণ হাত খুব সাবধানে আগলে নিল সেই ভারহীন দেহ। আকাশ ভেঙে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে বিদ্যুতের ঝলক। তার মধ্যেও আলাদা করে আমার দেহজুড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠল অন্যরকম এক আলো। উষ্ণ ওমে মাথা গুজে আমি টের পেলাম এই অসময়ের বৃষ্টি আমায় ছুঁতে পারছে না। কোমল গায়ে কাটার মতোন বিঁধছে না।
চারপাশটা থেকে থেকেই ভরে উঠছে তীব্র এক শুভ্র শুভ্র গন্ধে। আমার দু’চোখ ছলছল করে উঠল। এই পুরুষটিকে নিজের কাছে শক্ত করে বেঁধে ফেলতে না পারার দুঃখ, আসন্ন বিচ্ছেদের যাতনার পরও মন জানল, আমি ভালো আছি। সিঁথিতে স্থির হয়ে থাকা উষ্ণ অধর আমায় জানাল, এক দুঃসাহসী পুরুষ সমস্ত দুঃখকে দু’হাত মেলে আটকে দিয়েছে বলেই, এই মুহুর্তে, প্রেয়সী আমি কী ভীষণ সুখে আছি!