প্লেনের ভিতরে ঢুকতেই পরিচিত কে যেন আমার নাম ধরে ডাক দিলো। তাকিয়ে দেখি রোমান ভাই আর তিথী বসে আছে। আমি হাত নেড়ে রোমান ভাইর ডাকের উত্তর দিলাম। বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগলো। কত দিন পরে তিথীকে দেখলাম; কেমন যেন একটা কষ্টের অনুভূতি হচ্ছে। বুঝতে পারছিনা এখনো এ অনুভূতির কারণ কি – এক সময়ে তিথীর প্রতি আমার ভালোবাসা নাকি তিথীর প্রত্যাখ্যান?
আমি আর একটু পিছনে যেয়ে আমার সিটে বসলাম। প্লেন আকাশে উড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরে রোমান ভাই এসে আমার সাথে কুশল বিনিময় করলো। একটু মুচকি হেসে বললো, আমার সঙ্গে তিথীও আছে। নিউইয়র্কে ছেলের গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে যাচ্ছি।
রোমান ভাইর হাসিটা দেখে আমার বুঝতে বাকী রইলো না আমাদের বিষয়টা উনি জানেন। জানতেই পারে। হয়তো তিথীই বলেছে, “আরমান ভাইতো আমার জন্য পাগল ছিলো।” মেয়েরা তাদের বরের কাছে এমন গল্প করতে পছন্দ করে। অবশ্য আমিও তো শামার কাছে তিথীর গল্প করেছি।
শামার সাথে আমার সেটেল ম্যারেজ। বিয়ের পর শামা প্রায়ই বলতো ও বিশ্বাসই করে না বুয়েটে পড়া একটা ছেলের কোন মেয়ের সাথে প্রেম ছিলো না। ওর ধারণা আমি মিথ্যা বলছি। আমি ওকে বলেছি, তিথীতো আমার চিঠির জবাবই দিলো না। জবাব দিলে হয়তো একটা প্রেম হতো। ও হাসে আর বলে, চিঠি দেয়ার কি দরকার ছিলো? একদিন ওকে সামনাসামনি বললেইতো হতো।
আমি তখন বুয়েটে থার্ড ইয়ারে। দারুণ ব্যস্ত কবিতা আবৃত্তি, নাটক, বিতর্ক নিয়ে। হল সাময়িকীতে লিখালিখিও করতাম। কোন কোন রাজনৈতিক দল আমাকে দলে ভীড়ানোর চেষ্টা করছে। সামনের ইউকসুর নির্বাচনে নমিনেশন দিবে। লেখাপড়াও খুব খারাপ করছি না। এমন যখন অবস্হা তখন ফার্স্ট ইয়ারে সিভিলে ভর্তি হলো তিথী। প্রথম দেখাতেই ওকে আমার ভালো লেগে গেলো।
আমি প্রায় প্রতিদিনই সুযোগ খুঁজি কি করে তিথীকে একটু দেখা যায়। চেষ্টা করি তিথীর সামনে নিজেকে প্রকাশ করার। সে সুযোগও আমার একদিন হয়ে গেলো। ফার্স্ট ইয়ারের নবীন বরণে একটা নাটক মন্চস্হ করলাম। নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করলাম। মন প্রাণ দিয়ে অভিনয় করলাম। শেষ দৃশ্যে নায়িকার দিকে দুহাত বাড়িয়ে বললাম, আমি যে তোমারই অপেক্ষায় আছি হে প্রিয়তমা। আমি আসলে মনে মনে এ কথাটা তিথীকেই বললাম। ডায়লগটা মন্চের সামনে প্রথম সারিতে বসা তিথীর দিকেই তাকিয়ে বললাম।
মন্চের পর্দা নেমে গেলো। বন্ধু রিন্টু, রিমন আর পাভেল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। রিমন বললো, দোস্ত, তুইতো ফাটায় দিছস। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা আমাকে ঘিরে ধরলো। পিয়াসা বললো, আরমান ভাই আপনার অভিনয় অসাধারণ হয়েছে। পিয়াসার দিকে তাকাতেই আমার চোখ আটকে গেলো ওর পিছনে দাঁড়ানো তিথীর দিকে। আমার কানে আর কারো কথা ঢুকছে না। আমার ইচ্ছা করছে বলি, এই মেয়ে তুমি কি আমার চোখের ভাষা পড়তে পারো? কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। তিথী একটি কথাও বললো না তবে আমি ওর চোখের তারায় প্রশংসার ফুলঝুড়ি দেখলাম। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা আরো গভীর হতে লাগলো। কিন্তু আমি জানি না আমার এই ভালোবাসার কথা ওকে কি করে জানাবো।
রিন্টুর বাসা যেন আমার ঘরবাড়ী। ওখানেই সব সময় আড্ডা দিই, দুজন মিলে লেখাপড়া করি। এখন আড্ডার পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো। রিন্টুর বোন পিয়াসা আগের মতই আমাকে চা নাস্তা করে দেয়। দুপুর বেলা গেলে ভাত খেতে সাধাসাধি করে। কিন্তু আগে কখনও পিয়াসার প্রতি আমার কোন আগ্রহ ছিলো না। এখন ওকে ডেকে ডেকে কথা বলি। ওদের পড়ালেখা কেমন চলছে, বুয়েটে ক্লাস করতে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা, ও ছাড়াও ওর ক্লাসে তিথী নামের যে মেয়েটা আছে তার সাথে ওর কেমন বন্ধুত্ব হয়েছে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করি।
আমার অস্হিরতা, তিথীকে নিয়ে আমার অতি উৎসাহ দেখে রিন্টু একদিন বললো, দোস্ত, তোর খবরতো ভালো মনে হচ্ছে না। রিন্টুর কাছে সেদিন মনের সব কথা খুলে বললাম। ওকে শক্ত করে ধরলাম, দোস্ত, তুইই আমার এ অসুখ সারিয়ে দিতে পারিস। ও বললো, আমি পিয়াসাকে কিছু বলতে পারবো না। তুই নিজে ওকে বল। আমি পিয়াসাকে বললাম, তুমি তিথীকে রাজী করিয়ে দাও। ও বললো, সে এ কাজ পারবে না। তারপর আমার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, চিঠি দিলে আমি সেটা পৌঁছে দিতে পারবো।
আমি রাত জেগে চিঠি লিখলাম। জীবনের প্রথম প্রেম পত্র। চিঠির শেষে লিখলামঃ
ও মেয়ে,
তুমি কি আমার চোখের ভাষা পড়তে পারো?
তুমি কি আমার মনের কথা বুঝতে পারো?
ও মেয়ে,
তুমি কি আমার অস্হিরতা দেখতে পারো?
তুমি কি আমার মনের অসুখ সারাতে পারো?
ও মেয়ে,
আমি যে তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখি,
তোমায় নিয়ে কবিতা লিখি,
আমার দিন রাত্রি কাটে তোমার অপেক্ষাতে।
পরদিন চিঠিটা পিয়াসার হাতে দিলাম। ও চিঠি নিয়ে চলে গেলো। আমি তীব্র উত্তেজনা নিয়ে তিথীর জবাবের আশায় রইলাম। মাঝে মাঝে পিয়াসাকে জিজ্ঞাসা করি, কি খবর? ও বলে, তিথী এখনো কিছু বলেনি। আমার অস্হিরতা উৎকন্ঠায় পরিণত হলো। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম কিন্তু তিথীর জবাব আর কখনো এলো না। আমার কষ্টগুলি এক সময় অপমান আর লজ্জায় পরিণত হলো। আমি রিন্টুর বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
বুয়েট থেকে পাশ করে বন্ধুরা সব আমেরিকা পাড়ি জমালো। আমি দেশেই রয়ে গেলাম। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে তিথীর কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। এর মাঝে রিন্টু একবার দেশে এসেছিলো, ওর কাছেই শুনেছিলাম আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র রোমান ভাইর সাথে তিথীর বিয়ে হয়েছে।
রোমান ভাই টুকটাক কথা বলে নিজের সীটে ফিরে গেলো। যাওয়ার আগে বললো, দুবাইতে নেমে একসাথে কফি খাবো। আমি আমার পুরনো ক্ষত জাগাতে চাই না। কফির টেবিলে হাসি মুখে তিথীর সামনে বসে গল্প করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমি দুবাই এবং জে এফ কে এয়ার পোর্টে এমনভাবে নামলাম যাতে রোমান ভাই আমাকে দেখতে না পায়।
নিউইয়র্কে আমার কাজ ছিলো তিন দিনের। কাজ শেষে টেনিসি এসেছি রিন্টুর বাসায়। দেশ থেকে আসার আগেই ও বার বার অনুরোধ করেছিলো ওর ওখানে ঘুরে যাওয়ার জন্য। ওর বাসায় পিয়াসাও এসেছে ওর বাচ্চাদের নিয়ে। পিয়াসা স্বামীর সাথে ডালাসে থাকে। রাতে জম্পেস আড্ডার এক ফাঁকে রিন্টু বললো, কিরে তুই আর তিথী নাকি এক সাথে এক প্লেনে নিউ ইয়র্ক আসছিস? আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। রিন্টু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, দোস্ত, ফাজলামি করলাম। পিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো, তিথী নিউইয়র্ক থেকে ওকে ফোন করছিলো। আমিও পুরো বিষয়টিকে হাল্কা ভাবেই নিলাম। তাই ঠাট্টার সুরে বললাম, সেদিন আমার চিঠির জবাব দিলে আজ আর এত হাহুতাশ করতে হতো না। রিন্টু হা হা করে হাসতে হাসতে বললো, চিঠির উত্তর কিভাবে দিবে; পিয়াসাতো ওকে তোর চিঠিটাই দেয়নি। আমার কেমন যেন একটা অস্বস্হিকর অনুভূতি হলো। আমি পিয়াসার দিকে তাকালাম, পিয়াসা নিশ্চুপ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।
******
গল্পঃ যে কথা হয়নি বলা
লেখকঃ কাজী তাসমীন আরা আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ভালো লাগলে অবশ্যই আমার বাকি গল্পগুলো পড়বেন।
আপনারাই আমার লেখার অনুপ্রেরণা