আমার বিয়ে হয়েছে তিন বছর হয়েছে। সম্বন্ধ করে বিয়ে। শ্বাশুড়ি মা আমাকে দেখে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে দিয়েছেন।
আমার পরিবার খুব খুশী। বাবা মরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের এত ভালো একটি পরিবারে বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা না যদিও আমি দেখতে সুন্দর, ভালো চাকরী করি। তাই আমিও খুব খুশী।
বিয়ের পরে আমি বুঝতে পারি আমাকে এ পরিবারে বৌ হিসেবে পছন্দ করার কারণ। ছেলের পছন্দ একটি চাকরীজীবি সুন্দরী মেয়ে আর শ্বাশুড়ির চাওয়া বৌমা এসে সংসারের রান্নাবাড়ি থেকে শুরু করে ঘর ঝাড়ু দেয়া সবই করবে। তবে সংসারের চাবিটা থাকবে তার আঁচলে। আমার মধ্যে দু পক্ষেরই চাহিদা পূরণের গুনাবলী আছে। বাবামরা গরীব ঘরের মেয়েকেইতো যেমন খুশী তেমন করে চালানো যাবে।
মনন ঠিক মা ভক্ত তা আমি বলবো না তবে কোন ব্যাপারে মায়ের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে মা’কে ক্ষ্যাপাতে চায় না। মা যেটা পছন্দ করে না সেই কাজটা মনন সাবধানে এড়িয়ে চলে। একটা উদাহরণ দিই। আমরা দুজন ঈদের শপিং করতে গিয়েছি। আমার একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছে। মনন বললো,
— আম্মা দেখলে বুঝে ফেলবে এ শাড়িটা অনেক দামী। তুমি অন্য একটা শাড়ি নাও।
আমি অপেক্ষাকৃত কম দামের একটা শাড়ি কিনলাম। মনন বললো,
— সবাইকে এ দামটাও বলার দরকার নেই। একটু কমিয়ে বলো।
আমি এর মধ্যেই নিজেকে সুখী ভাবি। সংসারে সবার মন যুগিয়ে চলি। আমিতো আসলে অনেক কিছু পেয়েছি। আমি এখন অভিজাত এলাকায় থাকি, দামী ফ্ল্যাটে সুন্দর একটা ঘর আমার, আমি চলাফেরা করি দামী গাড়িতে। আমার আর কি চাই! না হয় ঘরের সব কাজগুলি আমিই করলাম, সবার খাওয়া শেষে উচ্ছিষ্ট যা থাকে তাই খেলাম, তাতে কি!
বিয়ের বছর খানিকের মধ্যে আমার থাইরয়েডে একটা সিস্ট ধরা পড়লো। মননসহ বাসার সবাই আমার প্রতি দারুণ সহানুভূতিশীল। ডাক্তার দেখানো হলো, সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। ডাক্তার বললো,
— তেমন ভয়ের কিছু নেই। তবে অপারেশন করে ফেলা ভালো।
একজনের কাছ থেকে জানলাম, এ ধরনের অপারেশনে অনেক সময় গলার স্বর বিকৃত হয়ে যায়।
আমার শ্বশুরবাড়ির সবই দ্রুত অপারেশন করিয়ে ফেলার সাজেশন দিলো। আমি গলার স্বর বিকৃত হওয়ার সম্ভবনার কথা শুনে অপারেশন করতে একটু সময় নিলাম।
অফিসে আমার সাথে কাজ করে একজন মহিলা স্টাফ বহিঃবাংলাদেশ ছুটির জন্য আবেদন জমা দিয়েছে। আমি ওর ফাইলের সব পরীক্ষা করে দেখলাম ও ইন্ডিয়াতে ডাক্তার দেখাতে যাবে। ওকে ডেকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম খুব বেশী খরচ লাগে না। ওর স্বামীও একজন চাকরীজীবি। ওরা দুজন মিলে এ খরচ বহন করবে। সবকিছু শুনার পরে আমারও ইচ্ছা হলো আমার থাইরয়েড সমস্যাটাও যদি একটু ইন্ডিয়াতে চেক আপ করাতে পারতাম।
আমি বাসায় এসে মননের কাছে গল্প প্রসঙ্গে আমার অফিসের মেয়েটির ইন্ডিয়াতে চিকিৎসার কথাটা বললাম। আমি খুব আশা করেছিলাম মনন হয়তো সব শুনে আমার গলার জন্য আমাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে। কিন্তু ও কিছুই বললো না। আমার জন্য এতগুলি টাকা খরচ হবে এটা ভেবে নিজে মুখে বলতে লজ্জা লাগছিলো। আমার নিজের কিছু টাকা থাকলে হয়তো বলতে পারতাম, চলো আমরা একটু ইন্ডিয়া ঘুরে আসি। কিন্তু প্রতিমাসে আমার বেতনের প্রায় পুরো টাকাই আমার আম্মাকে পাঠাতে হয়।
ব্যবসার কাজে মনন এবং ওর ব্যবসায়িক পার্টনার হাসিব বছরে এক দু’বার ইন্ডিয়া যায়। এ মাসে ও আবার ইন্ডিয়া যাচ্ছে। আমার মন বলছে মনন যদি আমাকে একটু সঙ্গে নিতো! একবার একটু অন্যভাবে বললামও। মনন বললো,
— এসব ব্যবসায়িক ট্যুর, তোমার যাওয়ার দরকার নেই।
রাতে মননের সাথে মেসেন্জারে চ্যাটিং করছিলাম। বললাম, কিছু ছবি পাঠাও। দিল্লীর কয়েকটা ছবি পাঠালো। একটা ছবিতে একজনকে ঠিক কণা ভাবীর মত লাগছে। বললাম,
— হাসিব ভাই কি কণা ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে গেছে?
— হুম।
— তুমি যে বললে …
— যে কোম্পানির সাথে মিটিং করতে আসছি ওরাই কণার টিকিট দিয়েছে।
আমি আর কিছু বললাম না।
এর পরেও আরো দুই একবার দেখলাম ওরা ব্যবসায়িক কাজে ইন্ডিয়া গেলে কণা ভাবী সঙ্গে যায়। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করি না। ওরা তিনজন ইউনিভার্সিটির ক্লাসমেট। ইন্ডিয়াতে ওদের আড্ডাটা ভালো জমে, একেবারে ছাত্রজীবনের মত করে ওরা আড্ডা দিতে পারে। আমি গেলে হয়তো ওদের মাঝে বেমানান হয়ে যাবো।
বছরে দু’বার আমার থাইরয়েডের সিস্টের পরীক্ষা করা হয়। এটাই নিয়ম। মনন বলে,
— অপারেশনটা করে ফেলো।
— আমি একটা সেকেন্ড থট নিতে চাই।
— এখানেই আরো একজন ডাক্তার দেখাও।
— আচ্ছা দেখাবো।
আমি মনে মনে অপেক্ষা করি যদি সুযোগ হয় ইন্ডিয়াতে যেয়ে একটু ডাক্তার দেখাবো।
সেদিন ইমেইল খুলে আমি আনন্দে আত্মহারা। ইংল্যান্ডে ব্রুনেল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করার জন্য স্কলারশীপের আবেদন করেছিলাম। আবেদন গৃহীত হয়েছে। পড়া, থাকা, খাওয়ার সব খরচই ওরা দিবে।
মনন আর আমি লন্ডনে এলাম। কয়েকদিন থেকে ও ঢাকা ফিরে গেলো। আমি ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে উঠে গেলাম। তারপর একদিন জিপির কাছে গেলাম। আমার সব সমস্যা খুলে বললাম। জিপি আমাকে ওয়েস্ট মিডিলসেক্স ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে রেফার করে দিলো। সব পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে ওরা আমাকে জানায় ওরা আমার থাইরয়েডের সিস্টটা রিমুভ করে দিবে। সম্পূর্ণ বিনা খরচে। আমার ইনসু্রেন্স কভার করছে।
অপারেশনের কয়েকদিন আগে আমার ডাক্তার বললো আমার কিছু জটিলতা আছে তাই আমার অপারেশন ওরা করতে পারবে না। ওরা আমাকে আরো বড় হাসপাতালে রেফার করে দিলো।
আজ আমার থাইরয়েডের অপারেশন হবে হ্যামারস্মিথ হাসপাতালে। আমার একটুও ভয় লাগছে না। ওটিতে ঢুকার আগে মননকে কিছুটা নার্ভাস মনে হচ্ছে। আমাকে ওটির ভিতরে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাকে এনেস্হেসিয়া দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলবে। ডাক্তার আমার পাশে বসে টুকটাক প্রশ্ন করছে,
— লন্ডন তোমার কেমন লাগছে?
— ভালো লাগছে।
— তুমি কি জানো হ্যামারস্মিথ হাসপাতালে রয়াল পরিবারের লোকজন চিকিৎসা করায়?
— জ্বি জানি।
আমি বুঝতে পারছি ডাক্তার আমার নার্ভাসনেস কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমিতো একটুও নার্ভাস না। ডাক্তার বুঝতে পারছে না আজ আমি কি যে খুশী!
আমি যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকছি তখন মনন আমার হাতটা শক্ত করে ধরেছিলো। আমি বুঝতে পারি মনন আমাকে আসলে ভালোবাসে। তবুও আমার বলতে ইচ্ছা হয়, তুমি আমাকে ইন্ডিয়া না নিয়ে ভালোই করেছো।
******
লিখনীতেঃ কাজী তাসমীন আরা আজমিরী
ভালো লাগলে অবশ্যই আমার বাকি গল্পগুলো পড়বেন।
আপনারাই আমার লেখার অনুপ্রেরণা