#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩৯
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
আরুশ সময় ব্যয় করেনি। তুর্যকে নিয়ে অতিদ্রুত শহরের এক নাম করা হাসপাতালে ছুটে এসেছে, ভর্তি করেছে তাকে। আসার পথে গাড়িতেই তুর্যের পরিবারকে কল করে জানিয়েছে তুর্য সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ব্যস সেই রাতেই পরিবারের সকলে মিলে হানা দিয়েছে হাসপাতালে। তাহমিনা বেগম ইতমধ্যে কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। যত যাই হোক তার ছেলে তো তুর্য, নারী ছেড়া ধন তার। আর তাছাড়া তুর্যের সাথে যে ঝগড়া বিবাদটা সর্বদা লেগে থাকে ওটা তো সত্যি সত্যি ঝগড়া নয়, ওটা তাদের মা ছেলেরই ভালোবাসার একটা অংশ। সকলের ভালোবাসা প্রকাশের ধরন তো আর এক হয় না। তেমনি তাদেরও মা ছেলের ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন।
পৃথাও এক কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে লাগাতার। তুর্য দূর্ঘটনার কবলে পড়েছে এই সংবাদ শ্রবণেই তো মেয়েটার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়েছিল। বুকের ভিতরে থাকা কলিজাটা যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠেছিল। এতদিন যে পুরুষের উপরে বিরক্ত ছিল আজ সেই পুরুষকে হারানোর ভয়ে দিশেহারা হয়ে উঠেছে মেয়েটা। ঐ যে কথায় আছে না “মানুষ কাছে থাকলে মর্ম বোঝে না, দূরে গেলে ঠিক মর্ম বুঝে নেয়।” পৃথা এতদিন যে তুর্যের মর্ম একটুও বোঝেনি তেমন নয় সে এতদিনও বুঝেছে। তবে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তুর্যের জন্য তার ভিতরে জাগ্রত হওয়া অনুভূতিকে ঠিক কি নাম দিবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তবে আজ তুর্যের এই দূর্ঘটনার পরে পৃথার সকল সংশয়, সকল সন্দেহ দূর হয়েছে। মেয়েটা বেশ বুঝতে পেরেছে সে ভালোবাসে তুর্যকে, ভীষণ ভালোবাসে। তুর্যকে হারিয়ে সে বাঁচতে পারবে না, কিছুতেই না। এই যে এখন তুর্যের এই সামান্য এক দুর্ঘটনাতেও হৃদয়ে ব্যথা উঠেছে পৃথার, নাজুক হয়ে উঠেছে মেয়েটা। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। ছুটে গিয়ে একবারের জন্য হলেও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে ঐ তুর্য নামক পুরুষকে। কিন্তু আজ সে অসহায়, ভীষণ অসহায়। এতদিন তুর্য তাকে বারংবার কাছে টানতে চেয়েছে অথচ সে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর আজ সে নিজে তুর্যের কাছে যেতে চাইছে কিন্তু পারছে না। পৃথার হৃদয় ব্যাকুল হলো, একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো তুর্যের কেবিনের সম্মুখে। কেবিনের স্বচ্ছ কাঁচ গলিয়ে তাকালো ভিতরে। সাথে সাথেই মেয়েটার হৃদয়টা ছটফটিয়ে উঠলো। আঁখিদ্বয় ভরে উঠলো অশ্রুকনায়। সারাক্ষণ ছটফট করে সকলকে জ্বালিয়ে মা’রা ছেলেটা কেমন নিথর হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের শুভ্র রঙা বিছানায়। যদিও ডাক্তার বলেছে তেমন গুরুতর চোট লাগেনি, কালকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে কিন্তু মন যে মানছে না। সত্যিকার অর্থে ভালোবাসলে, ভালোবাসার মানুষটার একটু ব্যথাও যে সহ্য করা কষ্টকর। পৃথা হাত উঠিয়ে আলতোভাবে আলতোভাবে রাখলো কেবিনের স্বচ্ছ কাঁচের উপরে। ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,
-“ভালোবাসি প্রিয়।”
****
আরুশ হাসপাতাল করিডোরের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপভাবে। ভিতরে ভিতরে তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ সে। এমন একটা কাজ কিভাবে করলো সে? এত বড় একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তা হয়ে এই টুকু সাবধানতা তার অবশ্যই অবলম্বন করা উচিৎ ছিল। সে ঠিক কাকে মা’র’ছে পর্যবেক্ষণ করে নেওয়া উচিৎ ছিল। আজ তার হাতে লাঠির বদলে ব’ন্দু’ক’ও তো থাকতে পারতো। যদি সে নিজের ব’ন্দু’ক’টা চালাতো স’ন্ত্রা’সী’র উদ্দেশ্যে এবং সেই ব’ন্দু’কে’র গু’লি লাগতো তুর্যের শরীরে তখন কি হতো? যেখানে তাদের ডিপার্টমেন্ট তাদের বিন্দু বিন্দু বিষয়গুলোর উপরেও লক্ষ্য রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়, সর্বক্ষন চোখ কান খোলা রেখে চলতে শিখায় সেখানে সে কিভাবে এত বড় একটা ভুল করে ফেললো? সে ভুলের অনুশোচনা তো আছেই সাথে আরও যোগ হয়েছে তুর্যের ভয়। এ ব্যাটা একবার সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে অসুস্থ বানিয়ে ছাড়বে। তেজপাতা করে ছাড়বে আরুশের শান্তশিষ্ট জীবনটা। জ্ঞান হারানোর আগে তুর্যের বলা শেষ কথাটা বার বার স্মরণে আসছে আরুশের।
-“একবার বেঁচে ফিরি, তারপর তোকে আমি দেখে নেব মীর জাফরের বংশধর।”
এই একটা বাক্য স্মরণে আসলেই তো আরুশের বুকটা ধরফরিয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে তুর্যের উদম কেলানি খাওয়ার ভয়ে জর্জরিত হয়ে পড়ছে বেচারা। আরুশের আকাশ পাতাল ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ ইরা এগিয়ে এলো তার পানে। কিছুটা অবাক কন্ঠেই বলল,
-“একি আরুশ ভাই! আপনার হাত কেটেছে কিভাবে?”
ইরার কন্ঠে আরুশ নিজের চিন্তা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। হাতের পানে তাকিয়েই চমকে উঠলো সে। সত্যিই তার হাত কেটেছে। কনুই থেকে বেশ অনেকটা ছুলে গেছে। রক্তও শুকিয়ে আছে হাত জুড়ে। হয়তো ঐ জঙ্গলে স’ন্ত্রা’সী’দে’র আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের সময় হয়েছিল কিন্তু নিজেদের যুদ্ধ চালাতে চালাতে এ দিকটা খেয়ালই করেনি। আর তারপর তো আবার তুর্যকে নিয়ে ছোটাছুটি। হাতের পানে তাকানোর দিকে খেয়াল আছে নাকি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো আরুশ। কন্ঠটা স্বাভাবিক রেখেই বলল,
-“ঐ এক্সিডেন্টের সময় সম্ভবত কেটেছে। তুর্য স্যারের সাথে ছিলাম তো।”
ইরা অস্থির হলো। বিচলিত কন্ঠে বলল,
-“ইসস কতখানি কে’টে’ছে। আর আপনি কিনা সেই কা’টা হাত নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন? চলুন ডাক্তারের কাছে চলুন।”
আরুশ সাথে সাথেই অসম্মতি জানালো ইরার এ প্রস্তাবে। জোরপূর্বক হেসে বলল,
-“একটু খানিই তো কেটেছে। এ এমনিই সেড়ে যাবে, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।”
ইরা সাথে সাথেই প্রতিবাদ করলো আরুশের কথার। বিরোধীতা করে বলল,
-“এটা আপনার কাছে একটু কাঁটা? কতখানি কেটে গেছে। আবার বলছেন ডাক্তারের কাছে যাবেন না? চলুন বলছি।”
আরুশ তবুও বাঁধা দিচ্ছিল ইরাকে। শেষমেষ মেয়েটা উপায় না পেয়ে নিজের এক হাত বাড়িয়ে ধরলো আরুশের ভালো হাতটা। শাসিয়ে বলল,
-“আর একটা কথাও বলবেন না। আপনার হাত অল্প কেটেছে নাকি বেশি তা আমি বুঝে নেব। আপনি আসুন আমার সাথে।”
ইরার আকস্মিক এমন স্পর্শে কেঁপে উঠলো আরুশ। এটাই তার প্রেয়সির থেকে প্রথম স্পর্শ। কেমন শিহরন জাগলো হৃদয়ে। তার থেকেও ভালো লাগলো ইরার এই জোর করা, অধিকার দেখানো। আরুশের হৃদয়টা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেল। ইরার উপরে আর একটা কথাও বলল না সে। শুধুমাত্র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে চললো ইরার পিছু পিছু। মেয়েটা তাকে টেনে নিয়ে ঢুকলো এক কেবিনে। এত রাতে এই অল্প স্বল্প চিকিৎসার জন্য ডাক্তার খুঁজে না পাওয়া গেলে একজন নার্সের শরনাপন্ন হলো তারা। নার্স মহিলাটি তার চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়ে বসলো আরুশের পাশে। নিজের মতো করে ঔষধ লাগাতে শুরু তার হাতে। তবে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আরুশের। সে এখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ইরার পানে। আরুশকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো মেয়েটা। এক ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“সমস্যা কি? আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
অপ্রস্তুত হলো আরুশ। সাথে সাথে দৃষ্টিতে নত করলো সে। আমতা আমতা করে বলল,
-“এমনিই।”
৪১.
ভোরের আলো ফুটেছে। রাতের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে পুরো শহর। তুর্যের জ্ঞান ফিরেছে মাত্রই। ঘুমের ইনজেকশনের গুনে বেশ অনেকক্ষণ বেহুঁশের মতো পড়ে ছিল সে। জ্ঞান ফিরতেই পিট পিট করে চোখ খুললো তুর্য। চোখের সম্মুখে দৃশ্যমান হলো হাসপাতালের শুভ্র রঙা ছাদটা। ছেলেটা তৎক্ষণাৎ আবার চোখ বন্ধ করে নিল। একটু নড়েচড়ে উঠতেই অনুভব করলো ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে ভীষণ আবার হাতেও উপরেও ভারী ভারী ঠেকছে। তুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পাশে। আবার চোখ মেলতেই চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো প্রেয়সির ঘুমন্ত মুখশ্রী। পৃথা তার হাতের উপরে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তভাবে ঘুমিয়ে আছে। তুর্যের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠলো। কি স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটাকে। ঘাড়ে এবং হাতে ব্যথা অনুভব করলেও হাতটা আর সরালো না সে। নিজ স্ত্রীকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়ার জন্য হাতটা আরও ছড়িয়ে দিল। আর অন্য হাত দ্বারা বিলি কেটে দিতে শুরু করলো স্ত্রীর চুলের ভাঁজে। এর মধ্যেই একজন নার্স সকালের চেকআপের উদ্দেশ্যে ঢুকলেন কেবিনের দরজা থেকে। তুর্যকে চেয়ে থাকতে দেখেই সে হাসি মুখে বললেন,
-“উঠে গেছেন….”
এই টুকু বলতেই তাকে হাত উঠিয়ে থামিয়ে দিল তুর্য। ফিসফিসিয়ে বলল,
-“আস্তে কথা বলুন আমার স্ত্রী ঘুমাচ্ছে।”
নার্স মহিলাটি হাসলেন। তিনিও তুর্যের মতোই ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“স্ত্রীকে ভালোবাসেন ভীষণ?”
তুর্য লাজুক হাসলো। উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-“হুম।”
নার্স মহিলাটি আর কথা বাড়ালেন না। নিজের মতো করে তুর্যের চেকআপ করে চলে গেলেন কেবিন থেকে। তবে কেবিনে চুপ থাকলেও কেবিনের বাইরে গিয়ে আর চুপ রইলেন না। তুর্যের বাড়ির সকলকে জানিয়ে দিলেন তুর্যের জ্ঞান ফেরার কথা। ব্যস আর কে শোনে কার কথা। আরুশ ব্যতীত সকলে হুরমুরিয়ে ঢুকতে শুরু করলো তুর্যের কেবিনে। সকলের টুক টাক শব্দ কর্ণে পৌঁছাতেই ঘুম ভেঙে গেল পৃথার। সাথে সাথেই মেয়েটা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়লো। রাতে খুব বড় মুখ করে সবাইকে বলেছিল সে তুর্যের কাছে থাকবে, স্বামীর সেবা করবে। অথচ সেই কিনা ঘুমিয়ে পড়লো। পৃথা এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ওয়াশ রুমের দোহাই দিয়ে দ্রুত কেটে পড়লো সকলের সম্মুখ থেকে। পৃথা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই তুর্য কটমট করে তাকালো সকলের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবিরিয়ে বলল,
-“সব শ’ত্রু! সব শ’ত্রু’র দল আমার। বউটার সাথে একটু ভালো মুহুর্ত কাটাচ্ছিলাম তাও সহ্য হলো না কারো।”
_________
NOTE : তাড়াহুড়ো করে লেখার কারনে পর্বটি হয়তো একটু এলোমেলো হয়েছে। কষ্ট করে পড়ে নিবেন সবাই। আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…..