#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব ৪৬
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
৫০.
শহরের বেশ বড়সড় এক আবাসিক হোটেলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তুর্য এবং আরুশ। যতদূর তথ্য পেয়েছে শাহীন মির্জার বস খলিল ভূঁইয়া অর্থাৎ এই ড্রা’গ’স পা’চা’র, হি’রো’ই’নে’র ব্যবসা, নারী পা’চা’র এই সবের মূল হোতা এই হোটেলেই গা ঢাকা দিয়েছে। আর তাকে ধরতেই এখানে ছুটে আসা আরুশ এবং তুর্যের। তাদের এই মিশনে চিহ্নিত করা প্রায় সকল অপ’রাধী’কেই ধরেছে তারা এখন শুধুমাত্র বাকি আছে এই খলিল ভূঁইয়া। একে ধরতে পারলেই এই মিশন সম্পূর্ণ হবে। আরুশ এবং তুর্য ইতমধ্যে হোটেলের চারদিক থেকে নিজেদের ফোর্স দ্বারা ঘিরে ফেলেছে। এখন শুধুমাত্র তাদের ভিতরে ঢোকার অপেক্ষা। আরুশ এবং তুর্য দেরী করলো না বেশি। চারদিকটা একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ঢুকে পড়লো হোটেলের ভিতরে। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে খলিল ভূঁইয়ার কক্ষের ডুব্লিকেট একটা চাবি নিয়ে গেল সেদিকে। খুব সাবধানে চাবি দ্বারা কক্ষের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই চমকে উঠলো আরুশ এবং তুর্য। একি এ কোথায় এসে পড়েছে তারা? এ কক্ষ দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো বাসরঘর। চারদিক ফুল এবং ফুলের পাপড়ি দ্বারা সাজানো। তুর্য হতবাক হলো। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,
-“আমরা ঠিক কক্ষে এসেছি তো আরুশ?”
তুর্যের কথা শেষ হতে না হতেই আরুশ দৌড় দিল বাইরের দিকে। কক্ষের দরজায় রুম নাম্বারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আবার ছুটে এসে দাঁড়ালো তুর্যের পাশে। আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
-“আমাদের তো এই রুমটার কথাই বলা হয়েছিল স্যার।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে চোখ বুলালো আশেপাশে। হোটেল কক্ষের শুভ্র রঙা বিছানাটা সাজানো হয়েছে লাল গোলাপের পাপড়ি দ্বারা, আবার সুন্দর স্বচ্ছ কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এমন এক কক্ষে খলিল ভূইয়া আছে? এ ব্যাটার কি বুড়ো বয়সে বাসরের শখ জেগেছে নাকি? তুর্যের ভাবনা চিন্তার মাঝেই হঠাৎ খট করে একটা শব্দ ভেসে এলো তাদের কর্ণে। শব্দের উৎস খুঁজতে তুর্য এবং আরুশ তাকালো সেদিকে। সাথে সাথে আঁখিদ্বয় বড় বড় হয়ে গেল দুজনের। এ তারা কোন স্থানে এসে পড়লো শেষ পর্যন্ত? এক রমনী খোলামেলা এক খানা নাইটি পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের সম্মুখেই। শরীরের প্রায় প্রতিটি ভাঁজই এই নাইটির উপর থেকে দৃশ্যমান। তুর্য নিজের চোখ নামিয়ে নিল। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
-“নাউজুবিল্লাহ।”
আরুশ ঢোক গিললো। মেয়েটির দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো অন্য দিকে। তুর্যের পাশে একটু চেপে দাঁড়িয়ে মিনমিনে কন্ঠে শুধালো,
-“এই মেয়েটির গায়ের নাইটিটা কি গুলিস্তান পাওয়া যাবে স্যার?”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। আরুশের পানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন এই খোলামেলা নাইটি দিয়ে তুই কি করবি?”
আরুশ এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো। ইতস্তত করে বলল,
-“দুই দিন পর তো আমার বিয়ে। বাসর রাতে বউকে উপহার দিতাম আর কি।”
তুর্য হতবম্ব হলো। হতবাক কন্ঠে সে বলল,
-“বাসর রাতে বউকে উপহার দিবি তাও গুলিস্তানের নাইটি?”
আরুশ কাঁচুমাচু করলো। আমতা আমতা করে বলল,
-“কি করবো বলুন স্যার ইরা তো আপনারই বোন। আপনার রক্ত বইছে ওর শরীরে। এই রক্তের উপরে বিন্দু পরিমাণ বিশ্বাস নেই আমার। বউকে বাসর ঘরে উপহার দেওয়ার জন্য বড় শপিং মল থেকে অনেক টাকা খরচ করে না হয় নাইটি কিনলাম। পরে দেখা গেল আপনার বোন নাইটিসহ আমাকে ধাওয়া করেছে নয়তো বাসর ঘরেই আমার মুখের উপরে নাইটি ছুড়ে মে’রে’ছে। তখন কি হবে? তার থেকে গুলিস্তান থেকে অল্প দামে নাইটি কিনে দেব সে ছুঁড়ে মা’র’বে আমার মুখে আমি ছুঁড়ে মা’র’বো আপনার কক্ষে। ব্যস টাকার ক্ষতি আর হলো না।”
তুর্য দাঁতে দাঁত চাপলো। কটমট করে তাকালো আরুশের পানে। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“নির্লজ্জ, বেহায়া। তুই আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমার বোনকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছিস? এক থাপ্পরে তোর সব দাঁতগুলো ফেলে দেব মীর জাফরের বংশধর।”
তুর্য আরও কিছু বলতে চাইছিলো হয়তো তবে তার আগেই মেয়েটি এসে দাঁড়ালো তুর্যের মুখোমুখি। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দিতে চাইলো তুর্যের বক্ষস্থল। সাথে সাথেই ছেলেটা ছিটকে দূরে সরে গেল। চেঁচিয়ে বলল,
-“দূরে থাক বেয়াদব মেয়ে মহিলা। আমার ঘরে মুরগির বাচ্চার মতো ফুটফুটে একটা বউ আছে।”
মেয়েটা তবুও দমলো না। নিজের কাঁধ থেকে নাইটির এক হাতা একটু নিচে নামিয়ে কামুক দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। ওষ্ঠ কামড়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলল,
-“ঘরের বউ ঘরে আছে আর আমরা আছি বাইরে। আমাদেরও একটু সময় দাও বাবু।”
তুর্য চেঁচিয়ে উঠলো। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“আমার মা আছে নতুন করে কোনো মায়ের দরকার নেই। দূরে সর বেয়াদব মহিলা।”
মেয়েটা যেন আহাম্মক বনে গেল তুর্যের কথায়। এসব কি বলছে এই ছেলে? মেয়েটা কিছুটা অবাক কন্ঠেই বলল,
-“আমি তোমার মা হতে যাব কোন দুঃখে? এসব কি বলছো তুমি?”
-“মা যখন হতে চাইছিস না তাহলে বাবু কেন বললি বেয়াদব মহিলা? কোন দিকে থেকে আমাকে তোর বাবু মনে হয়? আমার বিয়ে হয়েছে আট বছর। এতদিন বউয়ের কাছে থাকলে তোর মতো দুই চারটা বাবু বাপ বাপ করে আমার আগে পিছে হাউমাউ করে কাঁদতো।”
মেয়েটার মাথা ঘুরে উঠলো যেন। এ কার পাল্লায় পড়লো সে? সাথে কিছুটা অপমানিত বোধও করলো। তবে কিছু করার নেই যে। তাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে তা তো করতেই হবে। এই কাজের বিনিময়ে মোটা অংকের টাকাও ইতমধ্যে নিয়ে ফেলেছে সে। মেয়েটা আবারও এগিয়ে গেল তুর্যের পানে। রসিয়ে রসিয়ে বলল,
-“তুমি না বড্ড রসিক পুরুষ। আমার তোমাকে ভালো লেগেছে ভীষণ।”
তুর্য ওষ্ঠ বাঁকালো। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“কিন্তু তোকে আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। দূরে সর আমার থেকে।”
মেয়েটি মানলো না তুর্যের কথা। তবুও এগিয়ে যেতে শুরু করলো ছেলেটার পানে। সাথে সাথেই তুর্য তার পিছনে গোঁজা ব’ন্দু’ক’টা বের করে হাতে নিল। ঝড়ের গতিতে ধরলো মেয়েটির মাথায়। বাঁকা হেসে বলল,
-“তুই ভুল মানুষের কাছে এসে পড়েছিস। আর তোকে যারা এখানে পাঠিয়েছে তারাও হয়তো ভুলে গেছে আমি কে?”
থামলো তুর্য। আবার বলল,
-“স্ক্রিপ্ট ভালো ছিল। তবে বড্ড পুরোনো। এসব ঐ নাটক সিনেমাতে দেখতে দেখতে এখন মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে। তোদের অন্তত নতুন কিছু ট্রাই করা উচিৎ ছিল এবার।”
তুর্যকে এভাবে মাথায় বন্দুক ঠেকাতে দেখে ঘাবড়ে গেল মেয়েটা। মৃ’ত্যু ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো তার। ঢোক গিলে বলল,
-“আমাকে দয়া করে মা’র’বে’ন না স্যার। আমি এখনই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। আপনাদের আর বিরক্ত করবো না।”
তুর্য হাসলো। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
-“এই তো লাইনে এসেছিস। এখন মানে মানে বলে ফেল তো তোকে এখানে কে পাঠিয়েছে?”
মেয়েটি ভীত হলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,
-“কেউ না আমি নিজেই এসেছি।”
তুর্য চেতে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“বলবি নাকি এখনই গু’লি করে খুলি উড়িয়ে দেব তোর।”
মেয়েটা এবার ভীত হলো আরও। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
-“বলছি বলছি।”
-“বল।”
মেয়েটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দিল,
-“খলিল ভূঁইয়া।”
তুর্য বন্দুক নামিয়ে ফেললো মেয়েটির কপাল থেকে। আরুশের পানে তাকিয়ে বলল,
-“দুজন নারী সদস্যকে ডাক। এটাকে নিয়ে উত্তম মাধ্যম দিতে বল কিছু। দেখ মুখ থেকে আরও কিছু বের হয় কিনা।”
৫১.
সময় যতটা অতিবাহিত হচ্ছে আরুশ এবং ইরার বিয়ের দিনও ততটা ঘনিয়ে এসেছে। বাড়ির সকলে ইতমধ্যে শপিং এ নেমে পড়েছে। বাড়ির প্রথম মেয়ের বিয়ে বলে কথা। যদিও তুর্যের বিয়ে নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা ছিল তাদের কিন্তু তারপর যা ঝামেলা হলো তাতে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটেছে অনেক আগেই। আগে একদিন শপিং এ এলেও আজ আবারও বাড়ির সকল মহিলারা জোট বেঁধে চলে এসেছে শপিং মলে। টুকটাক সবারই কিছু কেনাকাটা বাকি ছিল তাই আর কি। তবে মলের ভিতরে ঢোকার আগেই রাস্তায় বেশ বড়সড় একটা জটলা চোখে পড়লো সকলের। এখানে আবার কি হয়েছে? মা’রা’মা’রি লেগেছে নাকি? আশেপাশের জনমানবের আলোচনা শুনে তো তাই মনে হচ্ছে। পৃথা উঁকি ঝুঁকি মে’রে ভীরের ভিতরের দিকটা দেখার চেষ্টা করলো। আবছায়ায় হঠাৎ কাউকে দেখে ভীষণভাবে চমকালো সে। কাকে দেখেছে সে? তুর্য! পরক্ষনেই নিজের ভাবনাকে নিজেই ধিক্কার জানালো মেয়েটা। তুর্য এখানে কিভাবে আসবে? সকালেই তো অফিসে যাই বলে বেরিয়ে গেল। তাহলে এখানে এই মা’রা’মা’রি’র মধ্যে কোথা থেকে আসবে? তবে কথাটা যতই সে নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা করুক না কেন মনটা যেন কিছুতেই মানতে চাইছে না। মনে হচ্ছে সে তুর্যকেই দেখেছে। পৃথা নিজের পার্স ব্যাগ ঘেটে মোবাইলটা বের করল। কল লাগালো তুর্যের নাম্বারে। এক বার, দুই বার, তিন বার নাহ কল ধরছে না ছেলেটা। তবে কি পৃথাই ঠিক দেখেছে? ওটা তুর্য! অনেকটা সন্দেহের বশেই পৃথা এগিয়ে গেল ঐ জটলার পানে। ভীর ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই চমকালো মেয়েটা। এ তো সত্যিই তুর্য। একটা ছেলের মাথায় ব’ন্দু’ক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর পাশেই আরুশ আরেকটা ছেলেকে বেধড়ক মা’র’ছে। এ কি দেখছে সে? সত্যি নাকি স্বপ্ন! না না এ সত্যি হতে পারে না। তুর্য এমন নয়। তুর্য এমনি নির্লজ্জ, খারাপ যাই হোক গু’ন্ডা ধাঁচের নয়। পৃথা নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। একটু সময় নিয়ে আবার তাকালো সম্মুখে। নাহ সে ভুল দেখছে না। এ তুর্যই। পৃথার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো রাজশাহীর সেই গো’লা’গু’লি’র দৃশ্যটা। সেখানে সে মাস্ক পড়া একটা ছেলেকে গু’লি চালাতে দেখে জ্ঞান হারিয়েছিল। জ্ঞান ফেরার পরে চোখের সম্মুখে সে তুর্যকে আবিষ্কার করেছিল। তবে কি সেই মাস্ক পড়া ছেলেটা তুর্য ছিল? পৃথার মাথা ঘুরে উঠলো। হাঁটু জোড়া কাঁপতে শুরু করলো থরথর করে। কোনো মতে মেয়েটা গলার স্বরটা একটু বাড়িয়ে বলল,
-“তুর্য!”
চেনা কন্ঠস্বর কর্ণে পৌঁছাতেই চমকে উঠলো তুর্য। পিছন ফিরতেই আবিষ্কার করলো পৃথাকে। মেয়েটা নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানেই। আস্তে আস্তে কেমন ঢলে পড়েছে নিচের দিকে। তুর্য ছুটে গেল স্ত্রীর পানে। মাটিতে পড়ার আগেই মেয়েটাকে ধরে নিল সে। তবে তাতেও রক্ষা হলো না। সেই রাজশাহীর মতো আজও জ্ঞান হারালো মেয়েটা। তুর্য অস্থির হলো। কি করবে কি ভেবে উঠতে পারছে না সে। নিশ্চই মেয়েটা তাকে ভুল বুঝেছে নয়তো জ্ঞান হারানোর কথা নয়। এখন কি করবে সে? তুর্য নিজের হাত দ্বারা আলতোভাবে চাপড় দিল পৃথার দুই গালে। ব্যগ্র কন্ঠে ডাকলো,
-“পৃথা! পৃথা!”
পৃথা তবুও সাড়া দিল না। তুর্যের অস্থিরতা বাড়লো আরও। দিশেহারা হয়ে আরুশকে বলল,
-“আরুশ গাড়ি আন তাড়াতাড়ি। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।”
আরুশ দেরী করলো না মোটেই। এদিকের কাজ ফেলে রেখেই সে ছুটলো গাড়ির পানে। আর তুর্যও দ্রুত কোলে তুলে নিল পৃথাকে।
চলবে…..