২৫.
কফি শপ থেকে বের হবার কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তীব্র নয় হালকা বাতাসের সাথে মৃদুমন্দা বৃষ্টি। মনের কথা বলার জন্য যেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্যবস্থা করে দিচ্ছে মলিকে। একটা মানুষ নিজের মনের এত কষ্ট আর কত চাপিয়ে রাখতে পারে! রুমকি উত্তেজনা চাপিয়ে রাখতে না পেরে আরো একটা কফি অরডার করে ফেলল। কিন্তু মলি তার পুরাতন কফির মগ টাতেই আংগুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলা শুরু করলো। ফাহাদের দৃষ্টি মলির দিকে নিবিষ্ট।
—- আমাদের একটা সুন্দর প্রেম কাহিনী আছে জানো তো? প্রেমকাহিনী বলছি কারণ ভালোবাসা প্রেম এসব কি জিনিস তা আমি বিয়ের সময় থেকেই টের পেয়েছিলাম। আমাদের আংটি বদলের পর থেকেই আমি একটু একটু করে আবিদের প্রেমে পরতে শুরু করি। বিয়ের আগে আমরা রিসোর্টে ঘুরতেও গিয়েছিলাম। আবিদ সারপ্রাইজ দিয়েছিলো আমাকে। বিয়ের প্রথম ৩ বছর ঠিক ঠাক ছিলো। কিন্তু আমার শাশুড়ী বিছানায় পরার পর থেকে আমার সংসারে বদল আসতে শুরু হলো।
—- আমার শ্বশুড়ের সমস্ত বিজনেস দেখা শুরু করলো আবিদ আর আমি বিছানায় পরা অসুস্থ শাশুড়ীর সেবা করতে করতে ক্লান্ত। সারাদিনে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ কমে যায় অথচ আমরা একি বাড়িতে বাস করি। চোখের কোণে জল মুছে মলি আবার বলতে লাগলো।
—- এর মাঝে তিতলি আসলো আমার পেটে। আবিদ অবশ্য খুব খোজ আর খেয়াল নিতো। কিন্তু কি করবো প্রেগন্যান্ট হওয়াতে আমি খুব ক্লান্ত থাকতাম আর শাশুড়ী কাজের মানুষের হাতে কিচ্ছু খেতে চাইতেন না। সব আমার করা লাগতো, আবিদ চাইলেও আমিই তাকে সময় দিতে পারতাম না। ও তাও সব মেনে নিয়েছিলো।
রুমকি ফট করে বলে উঠে,
—- যাকে ভালোবাসো তার মাকেই সেবা করছো তার তো তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত। নাকি তোমার সাথে চিট করা উচিত।
— ফাহাদ টিস্যুর বক্স টা এগিয়ে দিয়ে বলে এখন কি চাও তুমি?
— দেখো কারো জন্য কারো ভালো লাগার পাত্রী হবার জন্য নিজেকে চেইঞ্জ করার পক্ষে আমি নই ফাহাদ। খুব বিচক্ষণতার সাথেই মলি উত্তর দেয়। আমি কেমন তা জেনেই আবিদ আমাকে বিয়ে করেছে। আমি শুধু চেয়েছি আমাকে আমার প্রাপ্য সম্মান আর ভালোবাসা দেয়া হোক। বাহিরে তার যত কিছুই থাকুক না কেন আমার সংসার যেন ঠিক থাকে।
রুমকি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলল,
—- এটা কি বললা, মানে তুমি থাকবা তার সাথে অন্য কেউ ও থাকবে তার লাইফে। তুমি তোমার অধিকার পেলে বাকি ব্যাপার গুলো তে ছাড় দিবা? আমি তো জানতাম মেয়েরা ভাগ দিতে চায় না। হাউ কুড ইউ মলি??? জাস্ট রিডিকিউলাস।
মলি উত্তর দিতে কিছুটা সময় নেয়। তারপর বলে,
— আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এখনো ডিভোর্সি বা বিধবা মেয়েদের সাপোর্ট করতে শিখে নি। আমার বাবার বাড়ির তেমন সাপোর্ট নেই। আমি জব করিনা, পড়াশোনা শেষ সেই কবেই। দুই বাচ্চার মা। আমার একটু সহ্য করে যাওয়াতে যদি আমার বাচ্চাদের মাথার উপর বাবার ছায়া থাকে তাহলে আমি সহ্য করতে রাজি। তাছাড়া আবিদ নিজেও আমাকে ছাড়তে চায় না। তার প্রয়োজনে না, বাচ্চারা যেন ব্রোকেন ফ্যামিলির অংশ না হয় তাই আর কি!!
ফাহাদ আহত চোখে মুখে বলল, তুমি এখনো আদি যুগে এ-র শাবানার মতন কথা বলছো। আমি অবাক হচ্ছি মলি। যেখানে আত্মসম্মান থাকবে না সেখানে সংসার করবে কি ভাবে???
মলি ব্যগ কাধে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়,
— তাহলে তোমরা চাও আমার সংসার ভেংগে যাক তাই তো? এজন্যই শেয়ার করতে চাইনি। গেলাম আমি।
— রুমকি পথ আটকে বলে এই শোনো শোনো, রাগ হইয়ো না প্লিজ। তুমি ইচ্ছা করে শেয়ার করলে এই অনেক। আমরা তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই আমরা পাশে আছি।
—– ফাহাদ ও উঠে দাঁড়ায়, কথা শেষ করে যাও মলি। কি চাইছো তুমি?
— মলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, নিজের মতন বাঁচতে চাই। আবিদের সাথে আমার এখন দেখাই হয় না, আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাইনা। আমি আমাকে নিয়ে বিজি থাকতে চাই। আবিদ আবিদের মতোন থাকুক। তোমাদের সংগ আমার ভাল লাগে। মনে হয় সেই স্টুডেন্ট লাইফে ফিরে গিয়েছি।
—- আমি তো আগে এত বের হতাম না। তোমাদের পেয়ে বাইরে শপিং খাওয়া দাওয়া সব কিছুই করি। নতুন করে ডায়েট করা শুরু করেছি। সাথে হাটাহাটি তো আছেই। তোমাদের সাথে সারাদিন চ্যটিং আর বাচ্চাদের সাথে খুনসুটি। আমি এভাবেই ভালো আছি। আমার জীবন এভাবেই সুন্দর লাগছে।
ফাহাদের চোখে মুখে দ্যুতি খেলে যায়। হাসিমুখে বলে উঠে
— যেখানে আমাদের পরামর্শ দেয়া প্রয়োজন সেখানে তুমি নিজেই কত সুন্দর করে নিজেকে বুঝিয়েছো। ফ্রেন্ড হিসেবে আমি খুব প্রাউড ফিল করছি মলি। সত্যি। রুমকি ও কাধ ঝাকিয়ে হাসি মুখে সায় জানায়।
সেদিন বাসায় ফিরে মলি দুই বাচ্চাকে বুকে নিয়ে সারা রাত বিছানায় পরে রইলো। যেন তারাই যক্ষের ধন তার। সারা রাত হাজার ভাবনায় কেটে গেলো তার। কিন্তু কোনো কূল কিনারা পেলো না। তবে এখন মানুষ পেলো মনের কথা শেয়ার করার সেজন্য শান্তি শান্তি লাগছিলো।
২৬.
আজকে ছুটির দিন, কিন্তু দেশের বাহির থেকে ক্লাইন্ট এসেছে। আবিদের গার্মেন্টস প্রডাক্টের প্রযেক্ট নিয়ে একটা মিটিং আছে ক্লাইন্ট দের সাথে। এ নিয়ে দ্বিতীয় বার মিটিং হচ্ছে কোনো না কোনো মতভেদের জন্য ডিল টা হচ্ছে না।
আবিদ শুনেছে আরো কয়েকজন বিজনেস ম্যগ্নেটের সাথে তারা মিটিং করেছে। কাদের সাথে ডিল টা ফাইনাল হবে এটা চিন্তার বিষয়। ক্লাইন্টদের ইম্প্রেস করার জন্য আবিদ গাজীপুরের একটা রিসোর্টে মিটিং এরেঞ্জ করেছে।
মিটিং এর আগের দিন সন্ধ্যায়ই কেয়া আর আবিদ চলে এসেছে, কিছু ইনফোরমেশন আবিদ একাই ডিল করতে চায়। আর তাছাড়া কেয়ার সাথে আলাদা সময় ও কাটানো হয়।
রাতে রুমেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। খাবারের পর আবিদ দুইটা গাড় লিকারের চা অরডার দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যালকনিতে বসলো। রুম সারভিস চা দিয়ে গেলে কেয়া চা নিয়ে আবিদের কাছে এসে টেবিলে চা রেখেই আবিদের কোলে বসে পরলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সময় আবিদ ঝামেলা একদম পছন্দ করে না, কেয়ার এমন আচরণে কিঞ্চিত বিরক্ত হয় সে।
দেখি সরো প্লিজ কেয়া, ফাইল টা সেইভ ও করিনি আমি।
কেয়া নিজেকে সামলাতে সামলাতে উঠে দাড়ালো। একটু লজ্জা ও পেলো। তাই সরি বলে সেখান থেকে চলে গেলো। আবিদ বুঝতে পেরেছে কেয়া হয়তো কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু আগামীকালের মিটিং নিয়ে আবিদ কোনো রিস্ক নিতে পারবে না। মনে মনে ভাবছে, মেয়ে মানুষ, আদর আর গিফট পেলেই সব সোজা হয়ে যায়৷
রাতে বিছানায় গা এলিয়ে খেয়াল করল কেয়া গভীর ঘুমে।আবিদ শাড়ির আচলের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কেয়ার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে কাছে টেনে নেয়। কেয়া তখন অভিমানী হয়ে উঠে,হাত সরিয়ে দূরে সরতে চাইলেই আবিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কেয়া আর তখন বাধা দেয় না, আবিদ কষ্ট পাক কিংবা মাথা গরম করুক কেয়া তা চায় না। আবিদ যখন কেয়াতে মত্ত তখন কেয়াও সন্তর্পণে আবিদের মাঝে নিজেকে হারাতে ব্যস্ত।
একটা সুন্দর সকাল, ঘুম থেকে উঠে জাস্ট এক কাপ কফি খেয়ে আবিদ রেডি হয়ে নেয়। তার টাই বেধে দিচ্ছে কেয়া,
কেয়া, আজকে মিটিনং টা যেনো সাকক্সেস্ফুল হয়, উইশ মি গুড লাক।
কেয়া টাই ঠিক করেই কপালে চুমু খেয়ে বলে গুড লাক জান। ওরা অন দ্যা ওয়ে। এখুনি চলে আসবে। চলো আমি গিয়ে বসি।
**********
অনেক দিন যাবত ফাহাদ রুমকি বলছিলো কোথাও ঘুরতে যেতে। এই তো কয়দিন আগেই ওদের গ্রুপ চ্যাট হচ্ছিলো। মলি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না বলে ফাহাদ বলছিলো,
আরে মাইন্ড ফ্রেশ করার জন্য অবশ্যই ঘুরতে যাওয়া দরকার। আর তোমার তো বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে মলি।
মলি হেসে চ্যাটিং করে আর লিখে,
বাচ্চাকাচ্ছা থাকলে এরকম প্ল্যান করার চিন্তা মাথায় আসে না। তোমরা যাও না প্লিজ। আমার জন্য প্ল্যান ক্যান্সেল করো না।
রুমকি তখন উত্তর দেয়,
দুনিয়াতে মনে হয় আমি আর পলাশ ই একমাত্র কাপল যে কিনা বন্ধুদের নিয়ে বিয়ের পরের সময় গুলা পার করি। আমরা চাচ্ছি তোমাকে নিতে আর উলটা তুমি মানা করে যাচ্ছো।
মলি সেন্টি ইমু দিয়ে চুপ হয়ে থাকে। পলাশ তখন অফিসের এক ফাকে ঢুকে আন্সার করে,
দেখো তোমরা তিনজন সময় এক সাথে কাটালেও প্রায় ই আমি বাদ যাই, এবার আমি টাইম বের করলাম আর মলি যেতে চাচ্ছে না। এইটা কিছু হলো। প্লিজ ফাহাদ ভ্যানু ঠিক করো মলি যাচ্ছে এটাই ডান।
ফাহাদ ও হাসির ইমু দিয়ে বলে, তিতলি তোতন আমার আর পলাশের দায়িত্ব, তুমি তাও রাজি হও মলি। দেখবে ওরাও খুব মজা পাবে।
মলি আর মানা করে না। নির্দিষ্ট দিন তারা রউনা হলো, ভ্যানু ঠিক হলো গাজীপুরের একটা রিসোর্টে। খোলা মাঠ, সাজানো রুম আর বারান্দা পেয়ে সবার মন তখন ফুরফুরা। ওরা এসেছে বেলা এগারোটার দিকে। একটু ফ্রেশ হয়েই সবাই ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য ছুটলো।
মলি এসেছিলো একটা শাড়ি পরে, কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে এখন ছুটাছুটি করবে আর আরাম আরাম ফিলের জন্য একটা হাই নেক ওয়ালা সিংগেল কামিজ আর একটা জিনস প্যান্ট পরেছে। সাথে সদ্য কাটা চুল গুলোকে পনি টেইল করেছে। বাচ্চাদের ও একটু খোলা মেলা ড্রেস পরিয়ে মাঠে চলে এলো সবাই। এতদিন শাড়ি পরাতে কেউ বুঝতে পারেনি মলি বেশ শুকিয়েছে আর দেখতেও বেশ লাগছে। বয়স যেনো কমে ২৫/২৬ এর কোঠায় নেমে গেছে।
রুমকি জায়গায় জায়গায় গিয়ে এত পোজ দিয়ে পিক তুলছিলো। মলি উঠাতে না চাইলে একদম ধমকে উঠে,
এই মেয়ে, যতক্ষণ আছো সব ভুলে এঞ্জয় করো। বাচ্চারা তো ফুটবল খেলছেই পলাশ আর ফাহাদের সাথে।
মলি প্রথমে সংকোচ করলেও পরে ফ্রি হয়ে যায়। সবাই এত বেশি এঞ্জয় করছিলো। এরি মাঝে একটা ঘটনা ঘটলো। ফুটবল খেলতে খেলতে বাচ্চাদের নিয়ে যখন ফিরছিলো তখন ই আবিদের মিটিং শেষ করে ক্লাইন্টদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আবিদ মলি আর আবিদের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বের হয়ে লম্বা লন ধরে সামনে এগুচ্ছিলো। আবিদ খেয়াল না করলেও তোতনের আর তিতলির চোখে ঠিক ই পরে আর তখন ই তারা বাবা বাবা বলে চিতকার করে উঠে।
তোতন আর তিতলি দৌড়ে বাবার কাছে যেতেই মলিও খেয়াল করলো তাদের। তোতন কাছে যেতেই আবিদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকে কোলে নেয় আর অবাক হয়ে বলে তোমরা এখানে। ঠিক এখানেই আবিদ ভুল করে। মলি কাছে আসতেই ক্লাইন্টরা জানতে চায় পরিচয়। আর তখন আবিদ বলে উঠে,
আমার মিসেস, মলি,আর আমার দুই ছেলে মেয়ে। মলি এরা আমার বিজনেস ক্লাইন্ট। ক্লাইন্ট দের মাঝে একজন বলে উঠে,
ওহ মিস্টার আবিদ, উই থট ইউ আর আনম্যারিড এন্ড মিস কেয়া ইজ উইর উড বি ওয়াইফ।
পুরো ঘটনা টা এত দ্রুত ঘটে যে আবিদ কিভাবে সামলাবে বুঝতে পারে না। তখন সে গলা নিভিয়ে বলে উঠে,
নো নো, কেয়া ইজ মাই পারসোনাল সেক্রেটারি। কথা টা বলে আবিদ সামনে এগুনোর জন্য ইশারা করে। কিন্তু কেয়া সেখানেই থমকে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। এই সাময়িক সময়ের পরিচয় পর্বটা যেন তার ও মলির অবস্থান কে একি সাথে নড়িয়ে তথা পাকাপোক্ত ভাবে বুঝাতে সক্ষম হলো।
চলবে……