৩৯.
বাকি দিন গুলো বাসাতেই কাটালো মলির। মাঝে মধ্যে ডাইনিং টেবিলে আবিদের সাথে দেখা হয় কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া কথাই হয়না। যেমন আবিদ জিজ্ঞেস করে,
কেমন দিন কাল যাচ্ছে মলি? মলি ম্লান হেসে বলে এই তো। কিংবা তোমার এই গান টা অনেক ভালো হয়েছে। আমি ত অফিস যেতে আসতে মাঝে মাঝে অফিসেও শুনি। অফিসের সব স্টাফ ও খুব প্রশংসা করে তোমার গানের। সত্যি খুব ভালো গাও তুমি।
মলি কেবল ছোট্ট করে থ্যংকিউ বলে। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের খোঁজ নিতে রাতে রুমে আসে আবিদ। তারা জেগে থাকলে খুনসুটি চলে বেশ রাত পর্যন্ত। তার পর বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েই নিজের রুমে চলে আসে। কিন্তু এর বেশি কোনো একটা শব্দ করেনা আবিদ। এই ব্যাপার গুলোই মলি হজম করতে পারছিলো না। এত টা স্বাভাবিক কিভাবে থাকছে আবিদ, আর যত কিছুই হোক আবিদ কে থাপ্পড় মারার জন্য মলি ভিতরে ভিতরে গুমরে নিস্তজ হয়ে আসছিলো। আবার পাছে এই ভয়, এই প্রসংগে কথা বলতে গেলেই আবিদ যদি ভেবে বসে যে তাকে মলি ক্ষমা করে দিয়েছে।
রিসোর্ট থেকে আবিদ চলে আসার দিন সন্ধ্যায় লনে মলি একা বসেছিলো। কেউ আসলে সাহস করতে পারছিলো না মলি কে এই ব্যাপারে কিছু বলার অথবা কেনোই না আবিদ কে থাপপড় মেরেছে। ওরা যতদূর জানে মলি বেশ ধৈর্যশীল মেয়ে। খুব অল্পকিছুতে রিএক্ট করার মতোন মেয়েই না। ফাহাদ আর পলাশ মলির কাছে আসে। রুমকি আসে আরো পরে নাস্তা হিসেবে ওরা অর্ডার করেছিলো স্যান্ডউইচ আর চা। মলি ওদের আসতে দেখে পা গুটিয়ে সোজা হয়ে বসলো,
ফাহাদ আর পলাশ রুমকির অপেক্ষা করছিলো। রুমকি আসতেই পরিবেশ হালকা করার জন্য ফাহাদ আর পলাশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, এই যে চলে এসেছে নাস্তা। সাথে গরম গরম চা, কথা টা এড করলো রুমকি। স্যান্ডুইচে কামড় বসাতে বসাতে ফাহাদ ভাবছিলো কিভাবে শুরু করবে। পলাশ আর ফাহাদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেই মলি বলে বসে,
তোমরা আসলে কি বলতে চাচ্ছো বলো কতো? জানতে চাচ্ছো কি কথা হয়েছে আমার আর আবিদের মাঝে?
রুমকি ঢোক গিলে বলে, প্রথমেই আমি সরি বলে নিচ্ছি দরজা টা আমি ই আটকেছিলাম বলে।
মলি দীর্ঘশ্বাস ফেললো, চায়ে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকালো। সিলেট শহরের আসল সৌন্দর্য হলো বৃষ্টি। পাহাড়ে ঝর্ণার ঢল এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। মলি উদাস কণ্ঠে বলল, যে আমি আগে চাইতাম আমার সংসার না ভাংগুক সেই আমি এখন সংসারের প্রতি উদাসীন হয়ে পরেছি। রুমকি বলে উঠে,
কই, একা হাতে কত কি সামলাচ্ছো তুমি। উদাসীনের কি হলো।
ফাহাদ এ পর্যায়ে বলে, আসলে তুমি কি চাচ্ছো মলি বলো তো। যদি আবিদ ভাই কে ক্ষমা করতে না পারো তবে সেপারেশন এ কেন যাচ্ছো না। এখন ত তুমি নিজে সাবলম্বী হয়েছো।
পলাশ ও কথার সাথে তাল মেলায়, হয় সব প্যাচ আপ করে ফেলো না হলে সেপারেশন হয়ে যাক। ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি মলি।
মলি চুপচাপ চায়ের মগের দিকে তাকিয়ে থাকে,
আমি মন থেকে কিছুতেই আবিদ কে ক্ষমা করতে পারছি না, না পারছি তাকে ছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে একা পথ চলতে। আমি চাচ্ছিলাম সময় যাক। হয়ত এক সময় সব স্বাভাবিক হতেও পারে। এক বছর, ৫ বছর কিংবা এক যুগ পরে। তবু চাই না বাচ্চারা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হোক।
এক্সেক্টলি মলি, ফাহাদ কথা বলতে শুরু করলো, এক সময় আমি,রুমকি আর পলাশ চাইতাম আবিদ ভাই এর শিক্ষা হোক। তুমি ভাবতে পারো এখন আবার কেন চাই সব ঠিক হোক। একা মেয়েদের পথ চলা অনেক কঠিন মলি। আমাদের সমাজ এখনো এত উদার হয় নি। যে অসম্মানের ভয়ে সেপারেশন এ যাবা সেই অসম্মান সেই মুহূর্ত থেকেই বাইরে প্রতি পদে পদে পাবে। আমি কোনো ভয় দেখাচ্ছি না। বাস্তবতা বলছি। কিন্তু এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে এখন অনেকেই সামনে এগুচ্ছে।
ফাহাদ আরো বলে,তোমার ক্যারিয়ার এখন মাত্র একটা ফর্মে আছে, আমরা ও চাই তুমি আগে পরে সব চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নাও। এখন ই না। আগে ভাবো। সত্যি বলতে আবিদ ভাই যে পথে হেটেছেন সেখান থেকে ফিরেছেন খুব কম মানুষ। আবার এও ঠিক কেউ নিজেকে শুধরাতে চাইলে বার বার তার অতীত মনে করাতে নেই। আমরা তাই চেয়েছিলাম তোমরা কথা বলো, নিজেরা নিজেদের বুঝো। তারপর ডিসিশন নাও। আমরা এনি ডিসিশনে পাশে আছি।
মলি আর কিছু বলল না, আবিদ যতবার কাছে এসেছে ততবার মলির মনে হয়েছিলো এই হাতেই তো কেয়াকে সে ছুয়েছিলো, যে মনে মলি স্থান ধরে রাখতে পারলে না, স্থান নিয়েছিলো অন্য আরেক জন। এখন সেই স্থান মলি কে ফিরিয়ে দিতে চাইলেই কেন নিবে সে???
৪০.
ঢাকায় ফিরে কিছুদিন যেতেই মলি একটা বিগ বাজেটের সিনেমায় গান গাইবার অফার পায়। গানের রেকোর্ডিং করে মলি বাসায় ফিরে মলি বেশ ক্লান্ত থাকতো। কিছুদিন পর ই সেই বিগ বাজেটের সিনেমার গান রিলিজ হয়। শুধু মাত্র স্থায়ী আর অন্তরা রিলিজ হউয়াতেই পুরো দেশ জুরে তোলপার। এত এত প্রশংসায় ভাসছিলো মলির গায়কী। নেটিজেনরা ধারণা করছেন এবার মলিই অনেক গুলো পুরস্কার পাবে সেরা নবাগত গায়িকা হিসেব।
গানের কাজ গুলো শেষ করে কোনো একদিন বাসায় বিকেলে পৌছেই দেখলো বাসার ড্রয়িং রুম খুব সুন্দর করে সাজানো। আর ড্রয়িং রুমে পরিচিত অপরিচিত অনেক মুখ। সাথে বেশ কিছু সাংবাদিক ও আছে বটে। মলি বুঝতে পারেনা এত আয়োজন কিসের। ফাহাদ রুমকি আর পলাশ ও আছে। সবাই ওকে পেয়ে সারপ্রাইজ বলে চিতকার করে উঠে। ওকে কনগ্রেচুলেট করার জন্য পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। সিড়ি বেয়ে আবিদ নেমে আসে। কাছে এসেই বলে,
অভিনন্দন মলি, তোমার এত বড় সাক্সেসের জন্য। সেরা গায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছো বলে অনেক অনেক অভিনন্দন। মলি বেশ অপ্রস্তুত, হাতের বুকে টি নিয়ে ছোট্ট করে থ্যংকিউ বলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মলির ভাই মাসুদ, মা ও ভাবি জয়া ভাতিজা ভাতিজী সহ দাঁড়ানো। মলির মা দৌড়ে আসে মলির কাছে। জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কান্না শুরু করে, যেন মেলায় হারিয়ে যাওয়া মেয়ে কে খুজে পেয়েছে। মলি বেশ বিরক্ত হলো। মনে মনে সবাই কে সুসময়ের মাছি বলে গালি ও দিলো। মা কে সরিয়ে বলল,
তোমরা! তোমরা কেন এলে?
মলির মা লজ্জিত ভংগীতে বলল, তুই এত বড় হয়েছিস নাম ডাক হয়েছে, আমরা আসবো না? জামাই বাবাজী ই নিয়ে আসছে আমাদের।
মলি এত এত মানুষের ভীড়ে নতুন কোনো ঘটনা ঘটাতে চাইলো না। আর সাংবাদিক তো আছেই লেগে। তাই আড়চোখে ভাই ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলল এসেছো যখন রাতের খাবার খেয়ে যেও। এক্সকিউজ মি বলে মলি উপরে চলে এলো। যাবার আগে আবিদ কে বলে গেলো, একটু আসবে উপরে? আবিদ মলির যাবার পিছন পিছন উপরে চলে আসে।
পার্টি শেষ করো আবিদ। আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য এত বড় পার্টির প্রয়োজন ছিলো না।
আবিদ মলির চোখে চেয়ে বলল, বেশি কিছু তো করিনি। সামান্য একটা পার্টি।
মলি বিরক্ত হয়ে বলল, কেন করছো এসব। আমি বলেছি? আমার এসব হট্টগোল এত মানুষ ভালো লাগে না। আর মা, ভাই ভাবি কে কেন এনেছো?
মলি, সেদিন উনাদের খবর দিয়ে উলটো তোমাকে আরো কষ্ট দিয়েছিলাম। তারাও এই ভয়ে ছিলো যে তুমি যদি তাদের ঘাড়ে চাপো। তাদের সংসারে যাও। কিন্তু সত্যি বলতে আমি কখনোই চাইনি আমার বাচ্চারা মা হারা হোক। আমাকে ক্ষমা না করো, প্লিজ তাদের তো কে ক্ষমা করতে পারো। তারা তো আমার জন্যই তোমাকে ভুল বুঝেছিলো।
মলি হেসে উঠলো, আমি কি দয়ার সাগর? তোমাদের কি আমাকে রক্তে মাংসের মানুষ মনে হয়না?
পিছনেই এসে দাঁড়ালো মলির মা, আমরা কি অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। তুই জামাই এর সাথে এভাবে কথা বলছিস কেনো?
না মা অন্যায় করবে কেন? মলি ঘুরে দাঁড়িয়ে কথা বলল, আমাকে আমার অবস্থান বুঝিয়ে দিয়েছিলে সেদিন সবাই মিলে। মেয়েরা তার স্বামীর বাড়িতে ঝামেলা হলে সবার আগে তার পরিবার থেকেই সাপোর্টের আশা করে। আর তোমরা? আমাকে এত বেশি ছোট করেছিলে আমার সেদিন মন চেয়েছিলো মাটির সাথে মিশে যাই। মলি ফুপিয়ে কেদে উঠলো।
একে একে করে ফাহাদ রুমকি পলাশ ও ঢুকলো। পলাশ আবার বের হয়ে গেছে গেস্টদের বাসা থেকে বিদায় জানাতে। সংসারে এত অশান্তি টের পেলে সাংবাদিক গুলো ও ভীর জমাবে।
আবিদ পাথরের মতোন দাঁড়িয়ে আছে
মলি কান্না করতে করতে ভাই ভাবির দিকে তাকিয়ে বলল, সোজা সাপটা বললেই পারো আমাকে এখন তোমাদের প্রয়োজন। না ঠিক তা না আমার টাকা তোমাদের প্রয়োজন। জয়া আর মাসুদ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিলো, লজ্জা পাচ্ছিলো আবিদ নিজেও। এত গুলো মানুষের সামনেই মলি এভাবে কথা বলছে। আবিদ মলির দিকে তাকিয়ে ই বলতে লাগলো,
সামান্য একটা পার্টির আয়োজন করেছি বলে এত রিএক্ট করছো। আর যতকিছু হোক, উনি তো তোমার মা তোমার উপর কি উনার কোনো অধিকার নেই?
মলি বিরক্ত হয়ে বলল, মায়ের মাসির দরদ বেশি হয়ে গেলো না? তুমি তো সব সময় ই মায়ের চোখে ভালো সেজে থাকছো। তখন ও তুমি ই ভালো সেজেছিলে এখনো। তোমরা সবাই এখন এক স্বাভাবিক হবার কথা বলে বলে আমার জীবন টাকে অস্বাভাবিক করে তুলছো। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যাবো আমি আর যদি কখনো তোমরা এত নীতিবোধ দায়িত্ব বোধ দেখাতে আসো।
রুমকি মলি কে শান্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত। মলি কাদছে, সেই কান্না যেন সবাই কে দায়ী করে যাচ্ছে। যখন এই মানুষ গুলো কে তার প্রয়োজন ছিলো তখন কেন তারা দূরে সরিয়ে দিলো।
মলির মা মাসুদ আর জয়া চলে গেলো। চলে গেলো রুমকি আর পলাশ ও। ফাহাদ যাবার আগে বলে গেলো, আজকে এত সবকিছু আবিদ ভাই ই আয়োজন করলো শুধু তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য। তোমার পরিবারের সবাই কে ডেকে এনে নিজের দোষ স্বীকার করেছে। তোমার সব কষ্টের কথা তাদের কে বলেছে যেন তারা বুঝে তুমি ভুল ছিলে না, তোমার অসময়ে তাদের পাশে থাকা জরুরী ছিলো। আর সব শেষে তোমার মায়ের কাছে সে জামাই হিসেবে ক্ষমাও চেয়েছে। যে জামাই কিথা দিয়েছিলো তার মেয়ে কে আগলে রাখার সেই তার মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিয়েছে এসব ভেবে। মলি দুনিয়া টা খুব নিষ্ঠুর, হয়ত আমার প্রতিও রাগ তোমার, কিন্তু ভেবে দেখো আমরা বাচি ই কয়দিন। উনি উনার ভুলের প্রায়াশ্চিত্ত করতে চান। একটা সুযোগ দাও।
মলি নিশ্চুপ, ফাহাদ বের হয়ে গেলো। আবিদ বুঝতে পারছে আর সম্ভব না। তাই সেও রুম ত্যাগ করলো। যাবার আগে বলে গেলো, আই এম রিয়েলী ভেরি সরি। এভাবে পার্টির আয়োজন করা কিংবা ওদের ডেকে আনা ঠিক হয়নি। তুমি আমার এসব আয়োজনে খুশি না হয়ে বরঞ্চ বিরক্ত হয়েছো। আই প্রমিজ আর কখনো বিরক্ত করব না তোমাকে।
চলবে…….
বি দ্র : এই পর্বেই শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পুরোটা পোস্ট হচ্ছে না কেন জানি।