®রোজা রহমান
‘
সকলে খোঁজা খুঁজির পরেও যখন শশীকে কেউ পাচ্ছে না তখন সকলে চিন্তায় পরে গেল। জলজ্যান্ত একটা মেয়ে কোথায় গেল? কোনো বিপদ হলো না তো? হাজারো খারাপ চিন্তা মাথায় এসে বাড়ি খেতে লাগল। শশীর মা-বাবা চিন্তায় স্ট্রোক করার মতো হয়ে যাচ্ছে। মিহির বোনের জন্য দিশেহারা হয়ে উঠেছে। সে বড় ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়ে জানতে চাইলো তার সাথে চলে গেছে কিনা! মিহিরের বড় ভাই জানালো শশী তাদের সাথে যায় নি। বড় ভাই শুনে অস্থির হয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ আবার আসতে চাইলে তাদের বাবা মানা করে দিল। বিষয়টা তারা দেখবেন বললেন।
‘
সকলের চিন্তার মাঝে নীহার চিন্তায় ডুবে গেছে। বুকের বা-পাশে চিনচিন করছে। ভারী হয়ে আসছে। মেয়েটা গেল কোথায়! এই কয়দিনে সে বুঝে গেছে ঐ মেয়েটাকে তার ভবিষ্যতের জন্যও লাগবে। এখন তার নিখোঁজে সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। শিশির সব লক্ষ্য করছে। হঠাৎই কী মনে করে যেন নীহার সোফা থেকে উঠে এক দৌড়ে ছাদের দিকে গেল। সকলে দেখলেও পাত্তা দিল না কারণ সকলে শশীকে নিয়ে চিন্তায় ব্যস্ত। কিন্তু শিশির বোধহয় আঁচ করতে পারল। এটা তো তার মাথায় আসেই নি! ছাদেও তো থাকতে পারে, সেখানে তো খোঁজায় হয়নি!
‘
নীহার জান হাতে করে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে ছাদের সিঁড়ি অতিক্রম করছে। মন তার একটা কথায় আওরাচ্ছে,
” আল্লাহ, শশী যেন ছাদে থাকে। ওখানে যেন ওকে পাওয়া যায় ”
বহু কষ্ট ছাদের সিঁড়ি গুলো অতিক্রম করে দরজা খুলে ছাদে পা রাখল। ঠিক তখনি একটা কান্নার আওয়াজ কানে এসে বাড়ি দিতে লাগল। কান্নাটা অবশ্যই মেয়ের। কান্নার ধরণ ফুঁপিয়ে কান্না। দম আটকে রাখারা মতো কান্না। সেই কান্নার আওয়াজ ধরে নীহার এগিয়ে গেল৷ তার ভেতরও ভেঙে আসছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখার জন্য। পা যেন চলা বন্ধ করে দিতে চাইছে। বহু কষ্টে ধীর পায়ে পানির টাঙ্কির সাইডে গেল। কারণ কান্নাটা সেই সাইড থেকেই আসছে।
গিয়ে দেখল একটা মেয়ে মাথা হাঁটুর সাথে ঠেকিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অনেকক্ষণ ধরে কান্না করছে বোঝা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ কান্নার ফলে কাঁপছে।
জোৎস্নার আরো, ছাদের লাইটিংর আলোয় নীহার স্পষ্ট দেখল এটা আর কেউ না এতক্ষণ যাকে সে আশা করছিল সেই কাঙ্ক্ষিত মেয়ে। টাঙ্কির পাশে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নীহারের বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। বুকটা ভারী হয়ে এলো। তার ভেতরটাও জড়িয়ে এলো। জ্বলে যাচ্ছে। এইটুকু মেয়ের জন্য তারও আবেগে গা ভাসাতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটা তার মাঝে যে আষ্টেপৃষ্টে জেঁকে বসেছে সেটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারল।
ভালোবাসা কী এটা? নাকি এ বয়সেও তাকে আবেগে পাগল বানিয়ে দিল? এখনো কী আবেগে কিছু করার মতো বয়স তার আছে? উহু, একদম নেই। সব বাস্তবতা। আর যায় হোক এই মেয়ে তার নাড়িনক্ষত্রে মিশে গেছে। সারাজীবনের জন্য একেই লাগবে। হ্যাঁ ভালোবেসে ফেলেছে সে। আর কিছু ভাবতে পারল না কোনো রকম ফোন প্যান্টের পকেট থেকে বের করে শিশিরকে ছোট্ট একটা মেসেজ করল,
” ও ছাদে। আমি নিয়ে আসছি। ওদিকে ম্যানেজ কর ”
তারপর কোনো রকম ফোন আগের জায়গায় রেখে এক নিঃশ্বাসে গিয়ে শশীর সামনে বসে পড়ল হাঁটু মুড়িয়ে। শশী টের পায় নি এখনো যে তার সামনে কেউ বসেছে। নীহারের চোখ-মুখের অবস্থা অসহায়। বিরস বদনে নির্লিপ্ত কন্ঠে ডাকল,
” শশী..! ”
ডাক শুনে চমকে উঠল সে। কান্না থামিয়ে ধীরে মুখ তুলে সামনে নীহারকে দেখতে পেল। চোখমুখ ফুলে গেছে। দেখল তা নীহার। শশী মলিন চোখে চাইল। চারিদিকে একবার নজর দিল। রাত হয়ে গেছে। এতক্ষণ ধরে এখানে সে!
পরনে মেয়েটার ভারী কাজ করা গাউন। কোমড় পর্যন্ত ঘণ কালো চুলগুলো পেছনে একটা বিনুনি করা৷ সামনের ছোট ছোট চুলগুলো ছড়িয়ে আছে। বড় বড় দুলজোড়া দৃশ্য মান। চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। লিপস্টিপ দেয়া ছিল সেটা এখন কিঞ্চিৎ পরিমাণ আছে ঠোঁটে। সবই দেখল নীহার, বলল,
” জান তো বেরই করে দিয়েছিলে!”
শশী অবুঝ নজরে চেয়ে রইল৷ চোখে মুখে এখনো পানি লেগে আছে। কান্নার দরুণ নাক টানছে। নীহার প্রশ্ন করল,
” কখন এসেছ এখানে? সবার কি অবস্থা করেছ জানো? ”
শশী চুপ। নীহার আবার প্রশ্ন করল,
” কাঁদছিলে কেন? ”
শশী তবুও চুপ। মাথা তার নিচে ঝুঁকানো। নীহার এবার কঠিন স্বরে বলল,
” এখানে একা বসে কাঁদছিলে কেন? ”
শশী এবার নড়ে উঠল। মাথা তুলে তাকাল নীহারের পানে। চোখে চোখ রাখল। এই লোকটার জন্যই তো কাঁদছিল সে। সে তাকে গ্রহণ করেনি। দুইটা বছরের আবেগ সে পায়ে ঠেলে দিয়েছে। আজ সে চলে যাবে মা বলেছে তাকে। কিন্তু মন তার চাইছে না যেতে। আরো কিছুদিন থাকতে ইচ্ছে করছে, দেখতে ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে। সে না মানুক তার অনুভূতি, আবেগ তো আর মিথ্যা না? তারপর হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন মাথায় এলো,
” আচ্ছা সে কি এতটাই ছোট?”
যার কারণে তাকে গ্রহণ করা যায় না! তাদের গ্রামে তো তার থেকেও অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়! তবে এই সামনে থাকা লোকটা কেন তাকে গ্রহণ করল না। নাকি সে দেখতে এতই বাজে!!
শশী বিরস বদনে উত্তর করল,
” বাড়ি চলে যাব। আম্মু বলেছে আজই চলে যাবে। আমাকে রাখবে না৷ ”
নীহার শশীর আঁধা কথার পুরো মানেটা বুঝে নিল। বুঝে নিল সে বাড়ি না যেতে চাওয়ার কারণ এবং কান্নার আসল কারণ। মেয়েটার বাচ্চামোতে মনেমনে আনন্দ পেল৷ ছোট হলেও মন দিয়ে ভালোবাসতে যানে মেয়েটা। ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস নিল৷
নীহার শশীর সামনে হাঁটু মুড়িয়ে বসা অবস্থাতেই কিছুটা ঝুঁকল ওর দিকে। কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে চটপট ভঙ্গিতে ক্লাসে স্যারের ন্যায় প্রশ্ন করার মতো করে প্রশ্ন করল,
” বয়স কত তোমার? ”
” হ্যাঁ? ”
ভড়কানো কন্ঠে শশী উল্টে প্রশ্ন করল। নীহার আবার বলল,
” বয়স কত তোমার? ”
” ষোল ”
” ইঁচড়েপাকা মেয়ে ”
বিড়বিড়াল নীহার ভাবটা এমন সে বয়সের সংখ্যা শুনে অতিশয় বিরক্ত। শশী তা শুনে বলল,
” আমি ইঁচড়েপাকা মেয়ে না৷ আমার বয়স কিছুদিন পর সতের পড়বে। ”
” হ্যাঁ তুমি তো পাকা বুড়ি, ইঁচড়েপাকা হবে কেন? ”
শশী হতবাক মুখে চেয়ে রইল। পাকা বুড়ি সে? মাত্র ষোল বছরের মেয়েকে পাঁকা বুড়ি বলছে? শশী নীহারের থেকে ডাগর চোখজোড়া নামিয়ে নিচে তাকাল। মলিন মুখে, প্রাণহীন কন্ঠে বলল,
” মাত্র ষোল বছর। আব্বু বলেছে আঠার পূর্ণ হয়ে গেলে বিয়ে দেবে। ”
শশী কথাটা কেন বলল জানে না। তবে মনে আসল তাই বলে দিল৷ এত ভেবে বলেনি৷ সে তো জানে এই লোকটা তাকে পছন্দ করে না৷ নীহার কথাটা শুনে আশ্চর্য হবার ভাব ধরে বিস্মিতর ন্যায় কন্ঠ করে কোলির চুল চুলকিয়ে মাথা নিচের দিকে দিয়ে বলল,
” এখনো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে তাহলে! এ মেয়ে মে-রেই ছাড়বে! ”
কথাটা অবশ্য নিজের কাছেই বলেছে নীহার৷ শশীকে শোনানোর ইচ্ছে ছিল না৷ তবুও শশী শুনে নিল। কারণ শশী নীহারের অনেকটা কাছেই। শশী ভ্রু কুঁচকে তাকাল বলল,
” কি বলছেন? কীসের অপেক্ষা করবেন?”
শশীর প্রশ্নে সে শশীর দিকে একদম ঝুঁকে এলো৷ মুখের সামনে মুখ। একে অপরের উষ্ণ নিঃশ্বাস মুখে মুখে বাড়ি খাচ্ছে। শশী ভয় পেয়ে গেল। ভড়কে গেল অনেকটা। কিছু বলতে যাবে তখনই নীহার বলল,
” বিয়ে মানে কী, বুঝো তুমি? ”
কথায় মাদকতা মেশানো মনে হলো৷ শশীর বুক ঢিপঢিপ করছে৷ এই লোকটার প্রতি তার আবেগ কতখানি এই লোকটা জানে কী তা! শশীর সরল স্বীকারক্তি,
” বুঝি ”
চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল সে। উত্তর শুনে নীহার মনে মনে হাসল একটু। চোখেমুখে একটু দুষ্টুমিও ধরা দিল৷ তা শশী ধরতে পারল না। এবার শশীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” ইঁচড়েপাকা মেয়ে, এতকিছু যখন বুঝো আমার কথার মানেও নিশ্চয়ই বুঝবে! খেয়ে দেয়ে মোটা হও মেয়ে, এই শরীরে আমার পোষাবে না। তুলোর ন্যায় ওজন শরীরের, কোলে তুললে মোমের ন্যায় উনিয়ে পড়ো ”
শশী তা শুনে শিউরে তো উঠলই সাথে হতভম্ব, হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল৷ চোখ বড় বড় করে শূন্যে তাকাল। কারণ নীহারের মুখ এখনো শশীর কানের কাছে৷ সে কী লজ্জা পাবে? নাকি খুশি হবে? কোনটা করলে এখন সঠিক হবে তা বুঝে আসছে না তার। শরীর কাঁপছে, ভেতরের সব কাঁপছে। সে ছোট, তবে কি এতই ছোট যে এই সামান্য কথার মানে ধরতে পারবে না! আপডেট যুগ সেখানে কিছুই অসম্ভব নয়৷ নীহার এবার মুখ সরিয়ে এনে শশীর দিকে তাকাল। কান্না ভেজা ডাগর চোখগুলোতে নজর বন্দি করল৷ শশী লজ্জা পেয়ে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। তারপর কী হলো কে জানে শব্দ করে কেঁদে দিল। মাথা নিচের দিকে নজর শানের উপর৷ শব্দ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়েছে। নীহার দেখল তা। দেখেই যাচ্ছে। কোনো সান্ত্বনাবাণীও দিল না৷ দু’হাত তুলে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
” দু’বছর অপেক্ষা করাবে মেয়ে, তার শাস্তি তোলা রইল৷ আমাকে ওয়েটিং নাম্বারে রাখলে তো? সুদেআসলে পুষিয়ে নেব, ইঁচড়েপাকা মেয়ে। ”
মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল। চোখ মুছিয়ে এবার শশীর গোলগাল শ্যামবর্ণা মুখটা নিজের দুই হাতের আজলায় নিল। উপরে তুলল। বলল,
” পড়াশোনা মন দিয়ে করবে। এমন উড়নচণ্ডী, ভবঘুরে স্বভাব বন্ধ করবে। শান্ত হয়ে পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট দেখাবে আমাকে। নয়তো, বিয়ে কিন্তু ক্যান্সেল করব বলে রাখলাম! ”
শশী ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,
” নাহ্, আমি পড়ব ভালো রেজাল্টও করব। আর ঘুরে বেড়াব না। ”
” হ্যাঁ, আর কোনো ড্রামা, সিরিয়ালও দেখবা না। ওগুলো দেখে আমার উপর এপ্লাইও করতে আসবে না এমনকি অন্যের উপরও না, ওকে? মনে থাকবে? “
” আচ্ছা, মনে থাকবে ”
নীহার হাসি অনেক কষ্টে আটকাচ্ছে। এই মেয়ে এখনো বাচ্চা। এটাকে মানুষ করতেই তো তার অর্ধেক বয়স পাড় হয়ে যাবে! মনে মনে ভেবে আফসোসের শ্বাস ফেলল একটা। তারপর বলল,
” আমি রোজ একবার করে ফোন করব, সব খবর কিন্তু নেব! কোনো এদিক ওদিক হলেই বিয়ে ক্যান্সেল। ”
” হবে না এদিক ওদিক। সব সময় মতো করব ”
নীহার মনে মনে অনেকটা হাসল৷ কী রকম পাগল এই মেয়ে তার প্রতি! সবরকম শর্ত মানতে রাজি তবুও তার তাকে চায়! নিজেকে সুখী সুখী লাগছে৷ একজীবনে একটা মেয়ের এতটা ভালোবাসা পাওয়া কী চারটেখানি কথা? সে তো বহু সাধনার ফল!!
শশী এবার প্রশ্ন করল,
” আমি সব করব, সব কথা মানব, মন দিয়ে পড়ব। শুধু আপনি আমাকে বেশি ভালোবাসবেন তো? আমার কিন্তু বেশি ভালোবাসা চাই! অল্প ভালোবাসায় পোষাবে না এই শশীর ”
” বাসব, অনেক বাসব রে। তোর প্রতিই পাগল হব ”
আবেগী উত্তর তার। শশী আনন্দে আটখানা হয়ে গেল। দাঁত বের করে হেঁসে দিল। নীহার তা দেখল। মন দিয়ে দেখল। চাঁদবরণ মায়াবী মুখখানায় চাঁদের আলোয় একটুকরো হাসির ঝিলিক হৃদয়ের গহীনে গিয়ে লাগল তার। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। এই একটুকরো ছোট্ট মেয়ে তার হৃদয় নাড়াতে সক্ষম হলো তবে! তুখোড় নেশালো এই মেয়ে একদম আফিমের ন্যায়। কাছে থাকলেই নেশা ধরে যায়। অন্য নেশার প্রয়োজন পড়বে না। ভাবনার মাঝেই শশীর উৎফুল্ল মনে হেসে বলল,
” আমার খুব আনন্দ লাগছে। বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি রাজি হয়ে গেছেন ”
কী রকম বাচ্চামো কথা! অন্য কোনো মেয়ে হলে লজ্জায় এখানে নুয়ে থাকত আর এই মেয়ে আনন্দে নাচছে! সবার থেকে আলাদা মেয়েটা। নীহার হেসে শশীর নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল,
” করো তবে আনন্দ ”
থেমে আবার বলল,
” তবে এখন ওঠো। নিচে যেতে হবে। সকলকে তো হার্ট অ্যা’টাকই করিয়ে দিয়েছিলে। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান সব আর এই বান্দা কিনা ছাদে এসে বিরহে নাকের পানি চোখের পানি এক করছিল! ঢংয়ের বিরহ দেখলে আর বাঁচি না। চলেন এখন, ওঠেন! ”
বলে শশীর হাত ধরে উঠতে নিল। কিন্তু শশী শক্ত হয়ে বসে। নিহার পিছন ঘুরে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। শশী বলল,
” একটা আবদার করব? ”
” কি? ”
” আমাকে জড়িয়ে ধরবেন একটু? ”
নীহারের আরো ভ্রু কুঁচকে গেল। একটু আগেই এই মেয়েকে বলা হলো কোনো ড্রামা, সিরিয়াল তার উপর এপ্লাই না করতে। আর দেখো, এই মেয়ে এখনি শুরু হয়ে গেছে। শশী আবার বলল,
” অল্প করে ধরলেই হবে, বেশি ধরতে হবে না। আর আবদার করব না ; ড্রামা, সিরিয়ালও এপ্লাই করব না। চলেই তো যাব! ”
শেষ কথাটা মন খারাপ করে নিচে তাকিয়ে বলল। নীহারের তা শুনে কেন জানি বুকের মধ্যে ভারী হয়ে শূন্য হয়ে যেতে লাগল। এই এক সপ্তাহে এই মেয়েটা অভ্যাস হয়ে উঠল নাকি! নীহার আর কিছু ভাবল না। শশীকে একটানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। শক্ত করে জরিয়ে ধরল। কিছু কিছু সময় অন্যের সাথে আবেগে গা ভাসালে খুব বেশি ক্ষতি হয় না। একটু আধটু প্রশ্রয় দেওয়াই যায়। একটু আবেগে ভাসলে ক্ষতি কী?
শশীর আবেগকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে সে নিজেও আবেগী হয়ে উঠল৷ সত্যি অভ্যাস হয়ে গেছে এই মেয়ে। খারাপ লাগছে মেয়েটাকে কাল থেকে দেখতে পাবে না। রিনরিনে কন্ঠ, হাসিখুশি মুখ আর শোনা হবে না দেখা হবে না। কেন যে মেয়েটা এত ছোট হলো!
জড়িয়ে থাকা অবস্থায় শশী কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
” আব্বুকে বলেন না আমি আজ যাব না। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না আজ। আপনার সাথে থেকে আমার মন ভরে নি ”
নীহার তা শুনে ভাবল সকলে তো কত করেই বলল শুনলেন না উনারা৷ ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিল। এরপর জড়িয়ে রেখে শশীর কানের পিঠে চুলের উপরে ঠোঁট ছুঁইয়ে আলতো করে একটা চুমু দিল। শশী বুঝে নি সেটা। দিয়ে শশীকে ছেড়ে বলল,
” চলো ”
শশী আর কথা না বাড়িয়ে নীহারের ধরে রাখা হাতটা আরো শক্ত করে ধরে হাটা ধরল নিচের উদ্দেশ্যে।
_____
নিচে সকলকে শান্ত করেছে শিশির। বলেছে শশী একটু পর আসবে। এই আসবে টা আর আসছে হচ্ছে না। তারা বসার ঘরে বসে অপেক্ষা করছে। সকলে উপস্থিত সেখানে। এর মাঝে শিশির মাকে ডেকে নিয়ে আলাদা একটা ঘরে গিয়েছে। এখানে কি হচ্ছে কেউই বুঝছে না। কুয়াশা শিশির ছাড়া তো কেউ জানেও না৷
‘
এরই মাঝে উপর থেকে নীহারের হাত ধরে শশী নেমে এলো ধীর পায়ে। শশীর মুখের অবস্থা বেহাল। চারিদকের লাইটের আলোয় তা স্পষ্ট সকলের নজরে এলো। তারথেকে বেশি নজরে বিঁধল নীহারের ধরে রাখা শশীর হাত। শিশির, কুয়াশার, জাকিয়ার বাদে সকলের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেল। সকলে একবার নীহারের ধরে রাখা শশীর হাতের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার তাদের মুখের দিকে। সকলের মনে কিছু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে কারণ আসল কাহীনি, কথা তো কেউই জানে না। এরা এমন হাত ধরে কেন? এমন একটা ছেলের এমন একটা মেয়ের হাত ধরে রাখা অনেক কিছুই বোঝায় আবার কিছুই বোঝায় না। আসলে সবটা নিজেদের ধরণার উপর ডিপেন্ড করে। কথায় আছে না? ‘ধরলে অনেক কিছু, না ধরলে কিছুই না’। তেমনি কেউ সঠিক কিছু না যেনে আকাশ পাতাল ভেবে কিছু ধরতেও পারছে না৷
নীহার, শশীর হাত ধরে আরো দু’কদম এগিয়ে এলো। শশী কারো দিকে তাকাচ্ছে না মাথা নিচু করে আছে। তার যেমন ভয়ও করছে তেমন লজ্জাও লাগছে। নীহার সকলকে একবার করে দেখে নিল৷ তার ভাবভঙ্গি একদম সোজাসাপটা। শিশিরের দিকে তাকাতেই সে আশ্বাস দিল চোখের ইশারায়। কুয়াশা সোফায় বসেই মিটিমিটি হাসছে৷ আরো একটা বিয়ে তবে খেতে চলল!
নীহার আপন মনে কথা সাজিয়ে বলল,
” খালু, খালামনি..! আপনাদের মেয়েকে আমাদের বাড়িতে, আমার বউ রূপে আনতে চাই।”
এইটুকু বলে থামল একটু। সকলের দিকে নজর দিয়ে সকলের ভাবভঙ্গি দেখল। নীহারের কথায় সেখানে ছোট খাটো একটা বা’জ পড়ল। শশীর মা-বাবা তো হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। সকলে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হা করে শুধু অদের দু’জনকে দেখছে। এটা কি করে সম্ভব? জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা, আম্বিয়া ছেলের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। শান্তশিষ্ট ছেলে গুরুজনদের সামনে এ কী বলে? তুষারও একই কথা ভাবছে।
নীহার আবার বলল,
” জানি আপনাদের মেয়ে এখনো ছোট, আমারও পড়াশোনা শেষ হয়নি। তবে আমার পড়াশোনা শেষ করতে করতে শশীর বিয়ের বয়স হয়ে যাবে তখন তো আর সমস্যা হবে না? আমি অপেক্ষা করব ততদিন। কিন্তু আপনাদের মেয়েকেই বিয়ে করব। ”
নীহারের কথা শুনে বাকিরা বার বার ধাক্কা খাচ্ছে। শিশির এবার বলল,
” খালু..! আমার ভাই লাখে একটা। শশী আমার আপন বোনের থেকে কম না। আমি আমার বোনের তো দায়িত্ব নিতেই পারি তাই না? বোনের প্রতি সেই দায়িত্ব থেকে বলছি, আমার বোনকে আমার বন্ধু তুল্য ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাই। আমার বোনের ইচ্ছে পূরণ করতে চাই আমি। ”
শিশিরের কথায় শশী সহ বাকিরা আবার বজ্রাহত হলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শশী ভাবল, ভাইয়া এসব জানে? মাথা তুলে নীহারের পানে তাকাল। নীহার সকলের দিকে তাকিয়ে। তুষার বলল,
” শিশির তুই? ”
” হ্যাঁ ভাইয়া আমি আগে থেকেই জানি৷ আর শশী নীহার ভাইকে পছন্দ করে নীহার ভাইও শশীকে পছন্দ করে। ”
শশী অনেক লজ্জা পেল৷ মিইয়ে গেল লজ্জায়। গুরুজনদের সামনে এমন কথায় তো লজ্জা লাগবেই। তবে হারলে চলবে না তাকে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এই লোকের হাত ধরে। নয়তো তাকে পাওয়া হবে না। কুয়াশা বলে উঠল,
” আমিও জানি সব ”
শশী আবার অবাক হলো। এবার জাকিয়া বললেন,
” জিনিয়া..! তুই আমার বোন। শশী তোর মেয়ে। তোর মেয়ে মানে আমারও মেয়ে। আমার নিজের কোনো মেয়ে নেই কুয়াশা, শশী এরাই আমার আপন। আমি আজ সব শিশিরের থেকে শুনলাম। শিশির আমাকে বলেছে সব। নীহার আমার পেটের ছেলে না হোক এই বাড়ির প্রতিটা ছেলেই আমার। আমি সর্বপ্রথম এই বাড়িতে পা রেখেছি। নিজে হাতে সংসার গড়েছি, গুছিয়েছি৷ আমার সংসার আমি বেঁধে রেখেছি। আজ পর্যন্তও এই বাড়ির বড় বউ হিসেবে কারো থেকে অসম্মান পাই নি৷ আমার দুই জা আমাকে খুব মানে। সেই জোরে, অধিকারে আমি আমার ছেলের জন্য তোর মেয়েকে চাচ্ছি। আমার এক একটা ছেলে সোনার টুকরো, লাখে একটা। সুখে থাকবে তোর মেয়ে। আমরা আদরে রাখব। ওরা একে অপরকে পছন্দ করেছে যখন, তখন আমরা গুরুজনেরা মিলে অদের সম্পর্কের একটা নাম দিয়ে দিতেই পারি! পছন্দ তো একটা ছেলে, একটা মেয়েকে করতেই পারে! এতে দোষের কিছুই নেই। আমার এই সম্পর্কে কোনো আপত্তি নেই। আশা করছি আমার অধিকারবোধে আমার বাড়ির কেউই হস্তক্ষেপ করবে না কারণ আমি ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং এই প্রস্তাব রাখছি আর তোরাও আমার প্রস্তাবকে সম্মান জানাবি। তোর বড় বোন আমি।
এখন কথা হতে পারে পছন্দ অপছন্দের। যদি সেটা হয় তবে আমি বলব, না শশী দেখতে শুনতে খারাপ আর না আমার দেবরের ছেলে খারাপ। যগ্যতাতেও কম নয়। তার ইচ্ছে নৌবাহিনীতে যোগ দেবার সেটা না হলেও অন্যকিছু ওর জন্য অপেক্ষা করবে। আর সব থেকে বড় কথা ওরা নিজেরা নিজেদের পছন্দ করেছে। এখানে আমরা গুরুজনেরা তাদের পছন্দে হস্তক্ষেপ করতে পারিন না৷ এটা আপডেট যুগ। এযুগের ছেলেমেয়েদের নিজের পছন্দ থাকবে এটাই স্বাভাবিক আমাদের সেটা বুঝে সম্মান করা উচিত।
যায়হোক আরো একটা সমস্যা যদি তোমরা বলো, ‘যে শশী ছোট’ তবে সেটার কথা আগেই নীহার বলে দিয়েছে। এর পরেও আর কোনো সমস্যা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। ”
সকলে অবকা নয়নে চেয়ে জাকিয়ার কথা শুনছিল। শিশির, কুয়াশা, তুষার, নীহার, বৃষ্টি মুগ্ধ নয়নে মাকে দেখছিল।
জাকিয়া এবার ঘুরে জাকির মালিথার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আমি ভুল বলেছি কিছু? ”
জাকির মালিথা মুচকি হেসে বললেন,
” একদম না ”
স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। এরপর জাহিদ মালিথার ও আম্বিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” জাহিদ ভাই..! আম্বিয়া! তোমাদের আপত্তি আছে আমার বোনের মেয়ে নিতে? ”
জাহিদ মালিথা আম্বিয়ার দিকে তাকালেন। মা হিসেবে তার মতামতও জানার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া তার আপত্তি নেই। ভাই, ভাবি মত দিয়ে দিয়েছেন সেখানে তিনি আর কি বলবেন? আম্বিয়া কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর ছেলের দিকে তাকালেন৷ ছেলের মুখে মায়ের প্রতি ভরসার নজর৷ ছেলে তার উপর ভরসা করছে! এরপর শশীর দিকে তাকালেন। মেয়েটা এখনো বাচ্চা। চঞ্চল, হাসি খুশি বাচ্চা সুলভ একটা মেয়ে দেখে আসছে এত বছরে। বদনখানি চাঁদের মতো। এই মেয়েকে তো অপছন্দ করার মতো কিছুই নেই! ছেলের পছন্দ। এছাড়া তিনি একজন শিক্ষিত মা হয়ে বাঁধা দিতে পারেন না এসবে। সব কিছু ভেবে চিন্তে ছেলের সুখের কথা ভেবে তিনি মুচকি হেসে শশীর কাছে গিয়ে ওর মাথা হাত রেখে বললেন,
” বুবু আমাদেরও আপত্তি নেই। আমার ছেলে যেখানে সুখী হবে বাবা মা হিসেবে সেই সুখ গুছিয়ে দেবার দায়িত্ব আমাদের।”
বাড়ির আর কারোরি তবে আপত্তি করার মতো নেই। নীহার শুধু চেয়েই দেখছে। তাদের পরিবার ভালো,বুঝদার সব থেকে ভালো তবে এতটা বুঝদার তার জানা ছিল না। কৃতজ্ঞতার নজরে তাকাল প্রতিটা সদস্যের দিকে। শিশিরকে এখনি বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলে শান্তি পেত৷ তবে আগে হবু শ্বশুর বাড়ির লোক কি বলে যেনে নেওয়া যাক!
জাকিয়া এবার বোন ও বোনের স্বামীকে বললেন,
” এবার তোমাদের মতামত দাও। আপত্তি আছে কি? ”
তারাও অনেকক্ষণ ভাবলেন। সময়ও নিলেন দুজনের মধ্যে আলাপচারিতা করার জন্য। অন্য ঘর থেকে শশীর মা-বাবা আলাপ করে এলেন। নীহার আর শশীর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। দু’জন এখনো হাত ধরা৷ তাই বুঝতে পারল। শশীর বাবা এসে বললেন,
” ছেলেকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই৷ তবে মেয়ে আমার একমাত্র তারউপর ছোট। তাই আমরা চাই সময় নিয়ে বিয়ে দেবার৷ গ্রামে সকলেই শশীর থেকে ছোট মেয়েদের বিয়ে করিয়ে দেয়। সেগুলো থেকে আমি দূরে থাকতে চাই। আমার মেয়েকে পড়ানোর ইচ্ছে। তবে ও ছোট এখনো এখনই বিয়ে দেব না। আমাদের এই সম্পর্কে আপত্তি নেই ”
জাকির মালিথা বললেন,
” হানিফ, তোমরা চাইলে আমরা সকলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের আঙটি বদল করিয়ে রাখতে পারি। তাহলে সম্পর্কের একটা নাম হবে। এমন নামহীন সম্পর্ক ওরা চালিয়ে যাক আমরা কেউ চাইব না৷ ”
সকলেই সম্মতি দিল এটায়। শশীর বাবা বললেন,
” তবে তাই হোক। আপনারা সময় সু্যোগ করে আসেন আমাদের ওখানে। আমাদের আপত্তি নেই ”
এই কথায় আনন্দ আর ধরে না শশীর৷ পারলে এখনি নাচতো। ওর উত্তেজনা টের পেল নীহার। চেপে ধরল আরেকটু হাত। স্বস্তির শ্বাস ফেলল শশীর দিকে তাকিয়ে। শশীও তাকাল। আস্তে করে বলল,
” খুশি? ”
” অন্নেকক ”
নীহার মুচকে হাসল শুনে। আউড়াল,
” ইঁচড়েপাকা মেয়ে “
শিশির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসল। বৃষ্টি খালাশাশুড়ির মেয়েকে জা হিসেবে পাবে ভেবে অনেক খুশি হলো। কুয়াশা খুশি হয়ে দাঁত বের করে হাসল। দূর্বল পায়ে উঠে আসতে গেল শশীর কাছে। কিন্তু উঠতেই মাথায় চক্কর দিল তৎক্ষনাৎ পরে যেতে নিল। কিন্তু সোফার পাশে শিশির দাঁড়ানো ছিল। শিশির আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। তুষারও দেখে ছুটে আসতে নিয়েছিল কিছুটা দূর থেকে আর এগুই নি। শিশির জড়িয়ে ধরাতে কুয়াশা বিরক্ত হলো। ওর বুকের উপর গরম, দূর্বল হাত দিয়ে ঠেলে দূরে সরাতে চাইল। কিন্তু শিশির সরল না৷ টের পেল আবার জ্বর ফিরে এসেছে। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে আছে। খুবই খারাপ লাগল সেই মুখের দিকে তাকিয়ে। শিশির ওর ধাক্কানো পাত্তা না দিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
” জ্বর তো আবার ফিরেছে শরীরে! ”
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click
অনেক বড় পর্ব দিয়েছি তাই বড় বড় কমেন্ট চাই কিন্তু