®রোজা রহমান
‘
অন্যান্য দিনের থেকে আজ সকালটা যেন অতি রোমাঞ্চকর, মনোমুগ্ধকর। অন্তর জুড়ানো শীতল ফুরফুরে সমীরণ। শরীর শিরশির করছে বাতাসে। চারিদিকে কিচিরমিচির শব্দ তুলে পাখিরা তাদের নীড় ছাড়ছে। ধরণীতে অন্ধকার কেটে আলো ফুটেছে। চারিদিকে পরিষ্কার। গ্রামের সকালটা এত সুন্দর হয়! কোনো সোরগোল নেই শুধু পাখিদের ডাক৷ নিরিবিলি প্রকৃতি।
‘
আলো ফুটতেই কুয়াশার ঘুম হালকা হয়ে এলো। কিছুক্ষণের মাঝে ভেঙেও গেল৷ পিটপিট করে তাকাল। সামনে শিশিরের লোমশ বুক দেখতে পেল। সে এখন শিশিরের কোলের ভেতর। রাতে হয়তো শিশির একপাশে শুইয়ে নিয়েছে। দু’জনেই কাৎ হয়ে শুয়ে। কুয়াশার মাথা শিশিরের বাহুতে। শিশির বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমচ্ছে। একটা বালিশে আর জায়গা হয়নি।
কুয়াশা ভালোভাবে দেখল শিশিরের নগ্ন শরীর। হয়তো গরমে শার্ট খুলে ফেলেছে। মাথা তুলে শিশিরকে দেখল৷ মুখটা দেখতেই আনন্দরা, খুশিরা, সুখরা এসে ভিড় জমাল। এই বুকটা অতি শান্তিময় জায়গা। এই বুকে শুয়ে সারাটা জীবন অনায়েসে পাড় করে দেয়া যাবে। সামনে এই ছেলেটা তার পূর্ণতা৷ তার স্বামী, তার জীবনসঙ্গী, তার অর্ধাঙ্গ। প্রণয়ের উতালপাতাল ঢেউ৷ এই ছেলেটাকে দেখলেই এখন সুখ সুখ লাগে সাথে অনুরাগ জাগে। আগে যেমন দেখলে হিংসে আসত সেসব কাজই করে না আর। আচ্ছা কেন করে না হিংসা কাজ? সে এখন তার মনের মানুষ বলে? তার অনুরাগ বলে? তার প্রণয়ের পূর্ণতা বলে? নাকি তিন কবুল বলা অর্ধাঙ্গ বলে! হুঁ এই সমষ্টি জিনিসই বলে আর আগের মতো হিংসাত্মক নজর আসে না মানুষটার প্রতি। শুধু ভালোবাসা পেতে মন চাই৷ মন চাই এই ছেলেটা তাকে মন উজাড় করে ভালোবাসুক তার বুকে এভাবেই চিরকাল আগলে রাখুক৷ ভেবেই মিষ্টি হাসল৷ মাথা নিচু করে শিশিরের নগ্ন লোমশ বুকে গভীর, গাঢ় করে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু আঁকল৷ নড়ে উঠল শিশির। দুহাতে বউকে সে বন্দি করে রেখেছে।
কুয়াশা আবার মিষ্টি হাসল। মাথা তুলে অনিমেষ অবলোকন করতে থাকল স্বামীকে। রাতের কথা মনে উঠল। শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল৷ শিরশিরে অনুভূতি হলো৷ সেই শিরশিরানি অনুভূতিতে স্বামীর বুকে আরেকটু ঢুকে যেতে চাইল।
শিশির বুকের মাঝে নড়াচড়া পেয়ে ঘুম হালকা করল৷ চোখে প্রকৃতির আলো পড়তেই ঘুম ভাঙল। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে ভেসে এলো। নিজের বাহুতে বুকের মাঝে বউকে অনুভব করল। বিড়াল ছানার মতো করে কাঁচুমাচু করছে। যেন সে জোর করে কোলের ভেতর আঁটকে রেখেছে আর বিড়াল ছানাটা ছু্টতে চাইছে৷ মস্তিষ্ক কথাগুলো ধারণ করতেই চোখ বন্ধ অবস্থায় ঠোঁটে হাসির রেখা আসল৷ ঠোঁট দুটো টানটান হলো হাসিতে৷ আপন হাতে আরেকটু শক্ত করল বাহুবন্ধনী। সে-ও যেন তার ঝগড়ুটে, আহ্লাদী, বিড়াল ছানা বউটাকে আরেকটু ঢুকিয়ে আগলে নিতে চাইল বুকের মাঝে। এইটা তার প্রাপ্তি, তার পূর্ণতা, তার অর্ধাঙ্গনী, তার সুখ। পরিবারের সকলে সত্যি জীবন সাজিয়ে দিয়েছে। এর থেকে আপনময়, সুখময়, রঙিনময় অনুভূতি আর দু’টো হয়! উহু হয় না। বড্ড আপনময় অনুভূতি।
‘
আসলে এ দু’জনের এত জলদি প্রণয়ের টান বোঝা শুধু আর শুধু মাত্র একে ওপরের প্রতি খাঁটি অধিকারবোধের জন্য, তিন কবুলের জোরে, প্রবিত্রতার সম্পর্কের নামে, প্রবিত্রার ছোঁয়াতে। নিজ দায়িত্বে অধিকারবোধ দেখিয়ে প্রণয়ে পরিপূর্ণ করতে পেরেছে। এই বিয়ে নামক বন্ধনে যদি দু’জনে আঁটকা না পড়ত তবে কি প্রণয়ের ছোঁয়া এদের মাঝে এসে হানা দিতে পারত? উহু পারত না। কখনো পারত না। কারণ তারা জনম শত্রু ছিল। আর এখন যে ঝগড়া, চুলোচুলি করে সেটা পুরোটা অভ্যাসে করে। কোনো হিংসে থেকে না। হিংসা তাদের কাজ করে না কারণ সম্পর্কে তাদের নমনীয়তা এসেছে। একে অপরকে ভালোবাসা বলে দাবি করতে শিখেছে। তাদের সম্পর্কে একটা অধিকারবোধের নাম এসেছে। তারা অধিকার খাঁটিয়ে বলতে পারবে তারা স্বামীস্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জোর একটা আল্লাহ প্রদত্ত জোর। আদিম নিয়মের আদিম জোর।
‘
শিশির চোখ খুলে তাকাল৷ মাথা নিচু করে বাহুবন্ধনীতে থাকা বউয়ের দিকে তাকাল৷ বুক থেকে মুখটা সরিয়ে বউয়ের সদ্য ঘুম ভাঙা মুখটাতে নজর দিল। যেটা রোজকার অভ্যাস হয়েছে তার। ঘুম ভেঙে জোরে নিঃশ্বাস টেনে আগে বউয়ের গলার মধ্যভাগের সুবাস নেবে এরপর মুখ অবলোকন করবে৷ শিশিরের নড়াচড়া টের পেয়ে কুয়াশা মুখ তুলে তাকাল। নজরে নজর পড়ল। কুয়াশার বুক ধুক করে উঠল। নতুন নতুন প্রণয়ের সঙ্গী তো এই মানুষটা-ই! যা এতগুলো বছরে কেউ দখল করতে পারেনি।
শিশির মুচকি হাসল। সালাম দিল বউকে। কুয়াশাও সালাম নিয়ে সালাম দিল। বউয়ের সালামের জবাব দিয়ে মুচকি হেসে ললাটে অধর চুম্বন করল বউয়ের৷ এরপর জিজ্ঞেস করল,
” সারারাত যে আমর শরীরের উপর রাজ করে রাত কাবার করলি। তা রাণীসাহেবার ঘুম কেমন হলো এই রাজার রাজমহলে? “
কুয়াশা খিলখিল করে হেসে ফেলল তা শুনে। দাম্ভিকতার সাথে উত্তর করল,
” যে রাজা সর্বদা তার রাণীকে বুকে আগলে রাখে সে রাণীর ঘুমটাও কি খারাপ হতে পারে? “
মুচকি এবং প্রশান্তিময় হাসি ফুটল ঠোঁটে। হাসল কুয়াশাও অমায়িক। বলল,
” ছাড়ো, অনেক সকাল হয়ে গেছে “
শিশির শুনে হাতের বাঁধন আলগা করে দিল। কুয়াশা এবার উঠে বসল৷ আজ কাজা নামাজ আদায় করতে হবে দুপুরে৷ ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল৷ শিশিরের বাম হাতটা অবস হয়ে গেছে। তাই ঝাড়া দিতে লাগল৷ কুয়াশা দেখে বলল,
” বালিশ দিতে পারতে “
” একটা বালিশে হত না “
কুয়াশা কিছু বলল না আর। বলল,
” লজ্জা করছে আমার। বাহিরে যাব কি করে?”
শিশির নজর তুলে তাকাল কুয়াশার চোখের দিকে। তাকিয়ে থেকে বলল,
” তুই আগে চলে যা। আমি বালিশ নিয়ে আসব। সমস্যা হবে না। আর এত লজ্জারই বা কি আছে? অদ্ভুত!! আমি কি তোর বয়ফ্রেন্ড? স্বামী তোর। “
” তবুও বড়দের সামনে পড়লে লজ্জা পাব। ঘর রেখে ছাদে শুতে এসেছ। তোমার তো আবার শখ জেগেছিল। শখেরও ব-লিহারি, বুনো ওল একটা “
বলে উঠে পড়ল। ফোন, ওড়না তুলে নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে ধাপধুপ করে পা ফেলে স্থান ত্যাগ করল। দরজা খুলতেই সকলের কথার সোরগোল শোনা গেল। সকলে উঠে গেছে! ইশশ কী লজ্জা জনক পরিস্থিতি! সে সিঁড়ির উপর থেকে শশীকে কল করে এক মিনিটের মধ্যে সিঁড়িঘরের কাছে আসতে বলল। যাতে লজ্জাটা কম হয়। দেখলেও যেন কোনো প্রশ্নের মুখে না পড়া লাগে। হাজার স্বামী হোক। বড়দের কাছে অতি লজ্জাজনক এটা।
এদিকে শিশির আহাম্মকের মতো বউয়ের ঝাঁঝ ওয়ালা বাণী গিলল।
যাক বাবা! যার জন্য সারারাত চুরি করল সেই চোর বলে গেল? বুকে শুয়ে রাত কাটাল এখন সেই ঝাঁঝ নিয়ে বলে গেল! এই বউজাতিগুলো বড় অদ্ভুত! সারাজীবন সংসার করেও বোধহয় মন বুঝতে পারবে না। ভেবে বিড়বিড়াল সে,
” গিরগিটি গোবর ঠাঁসা একটা”
বলে পাশে থেকে শার্ট তুলে নিয়ে গায়ে জড়াল। বোতাম লাগাতে লাগাতে মিষ্টি পরিবেশটা অনুভব করল। শীতল বাতাসটা অতিশয় মিষ্টি লাগছে। খোলা আসমানের নিচে শুয়ে, বসে রাত, সকাল অনুভব করল। ইশশ কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি!! ভেবেই হাসল৷ আল্লাহর কাছে দোয়া চাইল ভবিষ্যতের দিন গুলো যেন এর থেকে সুখময় হয়।
‘
সকাল নয়টা। সকলকে খেতে ডাকা হয়েছে। সকালের জন্য হালকা পাতলা নাস্তার আয়োজন করা হয়েছে। ভাত করে নি৷ রুটি, পরেটা, আলু ভাজি, ডিম ভাজি মাংস রান্না ছিল সেটা জ্বলানো হয়েছে। রাতের মতো করে আবার পাটি বিছানো হয়েছে। একে একে সকলে এসে খেতে বসল। শিশির এলো। সে নিচে নেমে গোসল করে নিয়েছে। শরীরে কেমন ঘামে চিপচিপে ভাব লাগছিল এছাড়া ধুলোও লেগেছিল আর তার থেকে বড় কথা নিজের কাছে কেমন কেমন যেন লাগছিল। রাতের কথা ভেবে গোসলই করে নিয়েছে। সকলে বসতেই খাবার দিল জিনিয়ারা। শিশিরের সাথে চোখাচোখি হলো কুয়াশার।
এদিকে রিজভীরা মিটমিট করে হাসছে। নীহার শিশিরকে দেখছে, খাচ্ছে আর হাসছে। শশী কুয়াশার পাশে বসেছে। অন্যপাশে স্মৃতি। কুয়াশা সকলের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বিচ্ছুবাহিনীরা সকলেই টের পেয়ে গেছে সে ঘরে ছিল না।
শিশির নীহারের হাবভাব দেখে ভ্রু কুঁচকাল৷ বলল,
” কিছু বলবি?”
” বুঝলি কি করে?”
” তুই যে একটা ফাজিল তা আমার থেকে ভালো কে জানে? “
নীহার দাঁত কেলাল শব্দহীন৷ তারা ফিসফিস করে কথা বলছে। শিশিরের আরেকপাশে রিজভী বসা৷ নীহারের পাশে শান্ত। নীহার বলল,
” বলেছিলাম না? এবার ঠোঁটে কামড় কনফার্ম খাচ্ছিস! আমার কথা ফলে গেছে। তোর ঠোঁটে কামড় খাওয়া ডান। মিষ্টি বিলা। “
শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷ রাতের কথা মনে হলো৷ কুয়াশা তো কামড় দিয়েছিল! সেটার কথা এরা জানল কি করে? কেটে টেটে গেছে নাকি? কই সে তো কিছু বুঝল না? আবার দেখলও না! ভড়কানো কন্ঠে বলল,
” কী যা তা বলছিস? “
পাশে থেকে রিজভী মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” আমিও স্পষ্ট দেখতে পারছি দোস্ত। তোর ঠোঁট কাটা। “
আরো ভ্যাবাচ্যাকা খেল শিশির। কী একটা জ্বালা! এদের জন্য একটু রোমান্স করেও শান্তি নেই। ঈগলের মতো সব টের পেয়ে যায়। ঐ বে-য়াদব গোবর ঠাঁসার জন্য সবসময় এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। বে-য়াদবটাকে আস্তে দিলাম উল্টে সে আবার জোরে দিল। ভেবে কুয়াশার দিকে কিড়মিড় করতে করতে কটমট নজরে তাকাল। কুয়াশা ভ্রু কুঁচকাল।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সকলে বিশ্রাম নিতে বসল। বড়রা অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে দিল। রান্না বান্নার জন্য একটা লোক আনা হলো। কারণ মানুষ বেশি না হলেও আবার কমও না। এতগুলো মানুষের রান্না বাড়ির লোক দিয়ে করা সম্ভব হবে না। তাই হানিফ সাহেব বাবুর্চি আনলেন। বাড়ির উঠানে আয়োজন করলেন রান্নার। জিনিয়া, সৌরজ, মিহির, শশীর ভাবি সিমী সকলে সাহায্য করছে৷
‘
দুপুর বারটা৷ শশীকে কুয়াশারা গোসল করিয়ে তৈরি করছে৷ শাড়ি পরানো হচ্ছে শশীকে৷ অনুষ্ঠান নামাজ পর শুরু হবে। কুয়াশারাও গোসল করে নিয়েছে। এক ঘরে তৈরি হচ্ছে সব। শশীর কাজিনরা চাচারা সকলেই এসেছে। কাজিনরাও এসে কুয়াশাদের সাথে যোগ দিয়েছে। পাড়ার কিছু মহিলারা সকাল থেকে এসে বার বার ঘুরপাক পাড়ছে৷ গ্রামের মানুষ বলে কথা৷ তারা সব বিষয়েই কৌতূহল বেশি দেখায়।
সাড়ে বারটার দিকে আজান দিলে বড় থেকে ছোট সকল ছেলেরা গোসল করে জুম্মার নামাজে চলে গেল৷
কুয়াশা আজ শাড়ি পরেছে। গাঢ় সবুজ রঙের সিল্ক-জামদানি শাড়ি। অসম্ভব সুন্দর শাড়িটা। অল্প কিছু জায়গায় কালো রঙের কাজ করা৷ ঈশা, স্মৃতিও শাড়ি পরেছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিনও পরেছে। খুব বেশি গর্জিয়াস কেউ সাজেনি আবার ড্রেসআপও কেউ গর্জিয়াস পরেনি। সবটায় সিম্পল। অনুষ্ঠান অনুযায়ী সকলের সাজগোজ সহ আয়োজন।
‘
নামাজ শেষ করে সকলে চলে এসেছে। আয়োজনও জমজমাট হয়ে গেছে। শশীকে সুন্দর একটা লাল শাড়ি পরানো হয়েছে। হালকা মেকাআপ সাথে সিম্পল কিছু জুয়েলারী। মায়াবী শ্যামবর্ণা মুখটা অপূর্ব লাগছে৷ গোলগাল বাচ্চা সুলভ মুখশ্রী যে দেখবে সেই মাশাআল্লাহ বলবে। চিকন ফিনফিনে শরীরটা এখনো গায়ে বাড়ল না। বড় বড় ডাগর আঁখি গুলো কাজলে রাঙানো। সকলে শশীকে তৈরি করার পর একসাথে বলে উঠল,
” মাশাআল্লাহ “
শশীর লজ্জায় চিবুক বুকের সাথে নূয়ে গেল। কিছুক্ষণ মেয়েরা ঘরে বসে গল্প করল৷
শিশিররা সকলে মিহিরের ঘরে বসে আছে৷ কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠান। ওরা পাঞ্জাবি, পাজামা পরেছে৷ শিশিরের পরনে কালো রঙের পাঞ্জাবি। নীহার সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। উপস্থিত সকল ছেলেকে আকর্ষনীয় লাগছে।
দুপুর তিনটা বেজে গেছে। জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা, হানিফ সাহেব অনুষ্ঠান শুরু করার কথা জানালেন৷ নীহারদের ডাকা হলো। শিশির মুচকি হেসে নীহারের হাত ধরল। এরপর নিয়ে এগুলো ডাইনিং রুমের দিকে। ঘরটা বড় সেখানেই এক সাইটে সোফা দিয়ে, চেয়ার দিয়ে বসার আয়োজন হয়েছে৷ নীহাররা বাবাদের পাশে গিয়ে বসল। একটুপর শশীকে আনা হলো। শশীরা ঘর থেকে বেড়িয়ে সেখানে পা দিতেই সকলে অপলক চাইল। শিশিররা তো হা ই হয়ে গেছে তাদের এক একজনের বউ, প্রেমিকা, হবুবউকে দেখে। সকলে শাড়ি পড়েছে। মনে হচ্ছে কয়েকটা পরী আসমান থেকে জমিনে নেমে এসেছে। শান্ত তো শশীর একটা চাচতো বোনের উপর পিছলাই খেল৷ মেয়েটা শশীর মতো চিকনচাকন। কিন্তু শশীর দেড় বছরের বড় নাম শোভা৷ মেয়েটা সুন্দরী নিঃসন্দেহে।
শিশির হা করে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। গাঢ় সবুজে পুরোই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আপন মন বলে উঠল,
” ইশশ বউটা আমার সত্যি অপূর্ব অপ্সরা। কী অপূর্ব লাগছে!! “
শশীকে দেখে নীহার তাকিয়েই রইল৷ লাল শাড়িতে কী দারুন লাগছে! আজই বিয়ে করে ফেলতে মন চাচ্ছে। কিন্তু খারুজ শ্বশুরটা আবার শর্ত জুড়ে রেখেছে। ভেবেই বিরক্ত হলো নীহার। রিজভী স্মৃতিকে দেখে পুরোই হা৷ লাগছে কখন মাছি ঢুকে যাবে৷ শিশির গুঁতো দিয়ে আস্তে করে বলল,
” হা বন্ধ কর বে-দ্দপ, মাছি ঢুকে যাবে “
” দোস্ত আমি বিয়ে করব ”
শিশিরের ফিসফিস করে বলেছিল কিন্তু রিজভী একটু জোরেই বলে ফেলেছে কথাটা৷ প্রায় অনেকেই শুনে নিয়েছে। শুনেই সকলে দম ফাটা হাসিতে মত্ত হলো। স্মৃতিরা অবশ্য শুনে নি তাই হাসির কারনটা অজানা তাদের। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল সব। ঈশা, বৃষ্টি, ইয়াসমিনকেও অসম্ভব সুন্দরী লাগছে৷ মিহির ঈশাকে এভাবে শাড়িতে দেখে আরো মুগ্ধ হলো। ছেলেটার অনুভূতিকে পাত্তা দেয় না এই মেয়ে৷ নাহ্ এর একটা বিহিত করতেই হবে। ভাবল মিহির৷
শশীকে নীহারের পাশে বসানো হলো। মেয়েটা লজ্জায়, উত্তেজনায় কাঁপছে। সাথে নার্ভাসনেস তো আছেই। সব মিলে রীতিমতো তার হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাচ্ছে। এত পরিমাণে কাঁপছে! নীহার বোধহয় টের পেল শশীর উত্তেজনা। মনে মনে হাসল সে। কিন্তু সকলের সামনে কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল পাশে থাকা হুবু বউয়ের দিকে।
জাকিয়ার কথা অনুযায়ী নীহার শশীর আঙুলে আঙটি পরানোর জন্য হাতটা তুলে নিল। কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে মেয়েটা কাঁপছে। বুঝে শশীর হাতটা শক্ত হাতে শক্ত করে ধরল আশ্বাস দিতে। মৃদু ফিসফিস করে বলল,
” শশী…! নিজেকে সামলাও। আমি আছি তো “
শশী একটু শান্ত হলো এই কথাটুকুতে। হাসল নীহার তা বুঝে। এরপর আঙটি পড়িয়ে দিল নীহার৷ হানিফ সাহেবও নীহারের জন্য আঙটি বানিয়েছেন। সেটা শশী পড়িয়ে দিল৷ মেয়েটার চোখ ছলছল করছে। আনন্দে, উত্তেজনায়। নীহার তা দেখে মুচকি হাসল। চোখের ভাষায় সব বুঝিয়ে দিল। আজ থেকে সে তার নামে করা। এখন শুধু তিন কবুল বলে ঘরে তোলা বাকি। তার ইঁচড়েপাকাকে তার নামে নামকরণ করে ফেলেছে। শশীর কী যেন হলো নীহারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারল না। কেঁদে দিল শব্দ করে। সকলে হতভম্ব হয়ে গেল। কুয়াশারা তড়িঘড়ি করে শশীর কাছে এসে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েটার কান্নার জের বাড়ল বয়ে কমল না। নীহার এবার না পেরে হানিফ সাহেবের উদ্দেশ্য করে বলল,
” খালু, শশীর সাথে আমি একটু একা কথা বলতে পারব? “
এরপর মায়ের উদ্দেশ্য বলল,
” আম্মু?”
জাকিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” বড়আম্মু? ”
বড়রা বুঝল মেয়েটাকে থামাতে এখন নীহারই পারবে। তারা শশীর কান্নার কারণটা বুঝেছে এও বুঝল এদের একটু একা কথা বলতে দেয়াও উচিত। নিজেদের আনন্দটাকে একটু নিজেদের মতো উপভোগ করুক। ভেবে জাকিয়া, জিনিয়ার দিকে তাকালেন এরপর জাকির মালিথার দিকে তাকালেন। দু’জনই সম্মতি দিলেন৷ জাকিয়া মুচকি হেসে বললেন,
” যাহ্ থামিয়ে আন।”
নীহার মুচকি হাসল। শশীর হাত শক্ত করে ধরে সেখান থেকে উঠে চলে এলো শশীর ঘরে। সকলে মুচকি হাসল। ছেলে মেয়েগুলো সব হয়েছে পাগল।
শশীর ঘরে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিল। এরপর বিছানায় শশীকে বসিয়ে দিল। নিজেও পাশে বসল। কান্না করেই যাচ্ছে ফুঁপিয়ে। তা দেখল কিছুক্ষণ নীহার৷ দেখল আর মিটমিট করে হাসল। দু’হাতে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
” আমার ইঁচড়েপাকাটা তো দেখি হাই লেভেলের ইঁচড়েপাকা। এভাবে আমার সাথে একা সময় কাঁটানোর জন্য কাঁদলে? নাকি কোনো ড্রামা,সিরিয়ালে দেখেছ এমনটা? “
শশী এবার নীহারকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল। আবার কেঁদে দিল। নীহার নিঃশব্দে হাসল। সত্যি ইঁচড়েপাকা। মেয়েটা ছোট হলেও অনুভূতিগুলো ছোট না। সব বুঝে। পাকনা একটা। ভেবে আবার ঠোঁটে হাসি ফুটাল। সে-ও মেয়েটাকে আলত হাতে আগলে নিল। শশী বলল,
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এসব৷ সত্যি আমি আপনাকে পেতে চলেছি? আপনার বউ হব আমি? আমার স্বপ্ন পূরণ হবে? “
কতটা পাগল ভাবা যায়? নীহার হেসে বলল,
” হ্যাঁ রে পাগলী তুই আমার হতে চলেছিস। আমার বউ হতে চলেছিস৷ তুই আমার নামে লিখিত এখন শুধু তিন কবুল বলা বাকি। “
শশী আবার কেঁদে দিল নীহারের কথা শুনে৷ শক্ত হাতে গলা জড়িয়ে ধরে রাখল৷বলল,
” আমাদের সম্পর্কের নামকরণ হলো আজ৷ তুমি আমার হবু বউ। এখন থেকে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে আমি তোমার হবু স্বামী, বুঝেছ ইঁচড়েপাকা মেয়ে? “
কথাগুলো বলতে বলতে নীহার শশীকে তুলল৷ এরপর চোখ মুছিয়ে দিল৷ কপালে চুমু খেল৷ নাকে নাক ঘষে বলল,
” কী অপূর্ব মায়াবিনী লাগছে আমার না হওয়া বউটাকে! আর কেঁদে সব নষ্ট করে দিলে?”
লজ্জা পেল শশী। হাসল নীহার। বলল,
” আর কেঁদো না মেয়ে। খুব জলদি দু’বছর কেঁটে যাবে। ইনশাআল্লাহ দু’বছর পর আমার ঘরে বউ করে নিয়ে যাব। “
শশী কোনো উত্তর করল না। শুধু আনন্দে আটখানা হলো। মুচকি হাসল৷ মাথা নূয়ে রাখল৷ নীহার অপলক, অনিমেষ অবলোকন করল তার ইঁচড়েপাকাটাকে। শক্ত করে হাতের ফাঁকে হাতে গলিয়ে দিয়ে উঠে আবার ডাইনিং রুমে চলে গেল৷
সকলে খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকাল তখন চারটা বেজে পাড়। খাওয়া দাওয়া করে সকলে বিশ্রাম নিল টুকটাক গল্প করার মাধ্যমে।
_________
বেলা গোধূলি লগ্নে। সূর্য ডুবে ধরণী লালাভ রঙ ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ পরে সন্ধ্যা নামবে। গ্রামে এই সময়টা অসম্ভব মিষ্টি হয় দেখতে। তেমনি আজও মিষ্টি লাগছে। শিশিররা সকলে ছাদে সেসবই উপভোগ করছে। তারা আশেপাশে ঘুরতে যাবার প্ল্যান করেছিল আজ কিন্তু ক্লান্ত লাগছে বলে কাল যাবে ঠিক করেছে। এই গোধূলি বেলাটা ছাদে কাটাচ্ছে সকলে। শশীর ভাবিও যোগ দিয়েছে আজ৷ তুষার, তুহিন সৌরজের সাথে গেছে হাঁটতে।
একপাশে মেয়েরা একপাশে ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। দাঁড়িয়েই আছে কেউ, কেউ চেয়ারে বসা তো কেউ রেলিঙের উপর বসা। এমনই সময়ে শিশিরদের আড্ডার মাঝে নীহার পাশ থেকে শিশিরের কাঁধের উপর হাত দিয়ে ডাকল,
” শিশির..!”
শিশির উত্তরে তাকালে সে বলল,
” ভালোবাসতে পেরেছিস? “
শিশির কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল৷ রিজভী, শান্ত, মিহির, হিম তাকিয়ে আছে। ওদের কথোপকথন শুনছে৷ শিশির বুঝল সময় নিয়ে। মুচকি হাসল বুঝতে পেরে। তার পরিবার যে তাদের দু’জনকে নিয়ে চিন্তা করে সেটা ভালোই বুঝতে পারে৷ শিশির মুচকি হেসে মাথা উপর নিচে করল,
” হুঁ “
বলে নীহারকে জড়িয়ে ধরল। নীহার আনন্দ পেল খুব৷ ভাইকে আগলে ধরল৷ তাদের বিশ্বাস ছিল এরা পারবে মানিয়ে নিতে। সময় নিয়ে ঠিকই মানিয়ে নিয়ে ভালোবাসতে পেরেছে। তাও এত জলদি? নীহার বলল,
” এত জলদি কিভাবে? বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার “
শিশির ছেড়ে দিয়ে বলল,
” ভালোবাসার জন্য অনেক কারণ দিয়েছে তোর বোন। বউ হিসেবে খারাপ না। “
নীহার মুচকি হাসল। বলল,
” বলেছিলাম না? “
” হুঁ, ওর প্রতি আমার নমনীয়তা ছিল না৷ যার জন্য ওর উগ্রস্বভাব আমার কাছে আঁটকে ছিল। তবে এখনো অভ্যাস রয়ে গেছে। সেদিনও মেরেছে জানিস? “
নীহার সহ রিজভীরাও হেসে দিল। নীহার বলল,
” ওর মনের মানুষ হতে পেরেছিস? “
” হ্যাঁ পেরেছি। তোর বোন সবটাতেই ফাস্ট বুঝলি৷ ভালোও সে আগে বেসেছে। আমিই লেট করেছি”
প্রশান্তিময় হাসল৷ বলল,
” সুখী থাকবি সবসময়। বোন দিয়েছি যত্ন করবি। আমাদের একমাত্র আদর ও “
শিশির ভাইকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল,
“জীবন সুন্দর ভাই, জীবনের রঙ সুন্দর।
পরিবার কখনো খারাপ চাই না ভাই। আর আমাদের পরিবার তো আরোই না৷ ”
নীহার আগলে ধরে বলল,
” হুঁ, আওয়ার ফেমিলি ইজ দ্যা বেস্ট ফেমিলি ইন দ্যা ওয়াল্ড “
সকলে হাসল। হিম বলল,
” পারমানেন্টলি তাহলে দুলাভাই হয়ে গেছ তো? এখন ডাকতে পারব দুলাভাই বলে?”
শিশির হিমকে বগলদাবা করে মেকি রাগ নিয়ে বলল,
” শা-লাবাবু বেশি পেকে গেছিস? নাকানিচুবানি সকলকে ভালোই দিতে পারিস। “
সকলে হেসে ফেলল। হিমও দাঁত বের করে হাসল।
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click