®রোজা রহমান
‘
সাত মাস আগে নীহারের বউভাতের অনুষ্ঠানের দিন, সেই রাতে কুয়াশার ওমন অস্বাভাবিক আচরণ করার কারণ ছিল। যেটা সে শিশিরের থেকে লুকাতে চেয়েছিল। সে জানত তার স্বামী কেউ কোনো কটু কথা বললে আগে প্রতিবাদ করবে। সে বউ হোক আর পরিবার হোক৷ বাড়িতে কোনো ঝামেলা চায়ছিল না বলে কুয়াশা শিশিরের থেকে কথাটা লুকিয়েছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেনি৷
সেদিন বসার ঘরে সকলে রেস্ট করার পর জাকির মালিথারা অর্থাৎ পুরুষরা সকলে উঠে গেলে থাকে শুধু মেয়েরা। গল্প গুজবের মাঝে আম্বিয়ার বোন জিজ্ঞেসা করেন কুয়াশাকে,
” এত বছর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তোমরা বাচ্চা নিচ্ছ না কেন? ”
কুয়াশা চমকে উঠে। বাড়ির সকলের বিব্রত হয় সাথে কুয়াশাও লজ্জা সহ বিব্রততে পড়ে৷ কিন্তু গুরুজন হয়ে এমন প্রশ্ন করেছে বলে কিছু বলতে পারে না তার উপর আত্নীয়। আম্বিয়া বোনের কথায় চোখ রাঙিয়ে উত্তর দেন,
” আশা..! এসব কি কথা? ওরা এতদিন লেখাপড়া করছিল জানিস না? শিশির পড়াশুনোর জন্য বাহিরে ছিল৷ “
এই কথাতে তিনি বোধহয় একটু নত হয়েছিলেন কিন্তু তবুও আরো কিছু কথা বলেছিলেন। যেমন;- জলদি বাচ্চা নিতে, দেরি হলে সমস্যা হয় এমন আরো কিছু কথা৷ এবং সেই কথার সাথে তিনি নিজের মেয়ের তুলনা করেন৷ অনি নাকি বছর নাই-ই গড়াতে বাচ্চা নিয়েছে এমনটাও বলেন৷ আর তিনিই নাকি নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে জলদি বাচ্চা নিতে। বাচ্চা নাকি একটা সম্পর্কের ভিত। কুয়াশা রাগ তো হয়েছিল কিন্তু প্রচুর আঘাত লেগেছিল কথাগুলোই৷ একটা মেয়েকে এমন মুখের উপর বললে কতটা কষ্ট, আঘাত লাগতে পারে? আর রাগ হয়েছিল উনার মেয়ের সাথে তুলনা করাতে। মেয়েরা আর যায় হোক অন্যকারো সাথে নিজেদের তুলনা কখনো মানতে পারেনা৷ কুয়াশা কেন যেন সেদিন কোনো উত্তর করতে পারেনি। জড়তাতেই পারেনি নাকি সে চায়নি সেটা বোঝা যায়নি। তবে প্রতিবাদ আম্বিয়া করেন৷ বোনকে তিনি অনেক ধমক দেন। আম্বিয়া শহরের মেয়ে শহরের বউ। আর আশা শহরের মেয়ে হলেও বিয়ে গ্রামে হওয়াতে ট্রিপিক্যাল সব চিন্তা ভাবনা উনার মাঝে আছে৷ গ্রাম জিনিসটাই এমন।
তখনি সে ওখান থেকে উঠে আসে৷ তার সহ্য হচ্ছিল না৷ খারাপ লাগার সাথে কষ্ট হচ্ছিল এবং কিছু কথা বুকে বিঁধছিল। সত্যি কি একটা সন্তান একটা সম্পর্কের ভিত? ভালোবাসা, মায়া, অধিকার এসব কিছুই না? শিশিরকে সে খুব ভালোবাসে, খুব। কখনো তাকে সে হারাতে পারবে না। অন্যকারো সাথে দেখা কেন? কারো সাথে পাশেই সে মানতে পারবে না। তার একমাত্র প্রিয় স্বামী সে। সন্তানই যদি সম্পর্কের ভিত হয় তো তাই হোক! তার সন্তানই লাগবে। তবুও সে শিশিরকে হারাবে না। ভেবে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে৷ নিজে শক্ত এবং স্বাভাবিক করে ঘরে ঢোকে। তার কষ্ট নেভাতে একমাত্র তার স্বামীকে প্রয়োজন ছিল ঐ সময়ে৷ তাই এসে আহ্লাদী আহ্লাদ করতে লেগেছিল শিশিরের কাছে।
সেদিন শিশিরকে কিছু না বলে পরেরদিন রাতে সকলে চলে গেলে সে শিশিরকে জানায় তার বেবি চায়। শিশির অতি স্বাভাবিকভাবে জানায় এলএলবিটা যেন কমপ্লিট করে নেয়৷ নয়তো চাপ পড়বে প্রচুর৷ শিশির চায়নি কুয়াশা চাপ নিক। কিন্তু কুয়াশা এতটাই অস্থির হয়ে জেদ ধরে যে শিশির রীতিমতো বিস্মিত হয়৷ হঠাৎ বেবি নেবার প্রতি এতটা টান কেন হলো? সে তো লেখাপড়া করবে এখন তাহলে? সেদিন রাতেও কোনো কথা বের করতে পারে না শিশির বউয়ের মুখ থেকে৷
কিন্তু যতদিন যাচ্ছিল কুয়াশার জেদ বাড়তে লাগে। অতিরিক্ত ভাবে অধৈর্য হয়ে উঠে যেটা শিশিরকে রাগিয়ে তুলত। ধমকে, বকেও কিছু হচ্ছিল না। শিশিরের এক কথা এলএলবি কমপ্লিট করেই বেবির চিন্তা করবে৷ কুয়াশা কেঁদে কেটে অস্থির। রাগে শিশির চড়ও বসায় ওমন বেহায়া আচরণে। অবুঝপনা তার একটুও সহ্য হয়নি৷ মে-রে অনেক ধমকিধামকি দেয়। কুয়াশা তখন না পেরে শিশিরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে ওঠে৷ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” আমি তোমাকে কারো সাথে দেখতে পারব না৷ হারাতে পারব না তোমায়। ভালোবাসি খুব তোমায়। একটা সম্পর্কের ভিত নাকি সন্তান হয়! যদি তাই-ই হয় তো আমার সন্তানই লাগবে। তবুও তোমাকে হারাব না। প্লিজ মেনে নাও! “
শিশির বিস্মিত হয়ে হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে যায় তা শুনে৷ তার এত এত ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই এই মেয়ের কাছে? যে সম্পর্ক টিকাতে সন্তান লাগবে তার!! জাস্ট এমন কথা আসে মাথায়৷
কুয়াশার সব কথা রেখে তার কাটকাট, ভারী প্রশ্ন হয়,
” এসব কে বলেছে তোকে? “
” কেউ না। তুমি মেনে নাও প্লিজ! “
” আমি জানতে চেয়েছি কে বলেছে তোকে এসব? “
কুয়াশা বলতে চায় না। কিন্তু কুয়াশা বলতে না চায়লেই কি শিশির মেনে নিয়ে আপস করা পাত্র? উহু সে শুনেই ছাড়ে৷ কুয়াশা না পেরে বলে,
” আগে বলো কোনো হাঙ্গামা করবা না? “
” তোর কাছে এত কথা জানতে চেয়েছি আমি নাকি জ্ঞানই চেয়েছি? “
কুয়াশা স্বামীর অতি কঠোরতা টের পায়৷ কথা এতটায় রূঢ় ছিল যে কুয়াশা কেঁপে উঠতে লাগে। অতিরিক্ত ভারী লাগে কথাগুলো৷ কুয়াশা নত হয়ে নিভানো, নির্জিব কন্ঠে উত্তর দেয়,
” আশা আন্টি বলেছে “
চোয়াল সঙ্গে সঙ্গে শক্ত এবং কঠিন হয়ে আসে। সে বুঝেছিল ঐ মহিলা এই সামান্য কথা বলেনি আরো কিছুই বলেছিল যেটাতে কুয়াশার গায়ে লেগেছিল নয়তো এই মেয়ে লোকের কথা কানে তোলার মেয়ে না। উচিত জবাব দিয়ে আসত এবং লোকের কথায় গা ভাসাত না।
বউ তাকে এতটা ভালোবাসে ভেবেও শান্তি পায়। সংসার ভাঙবে না, তাকে হারাবে না ভেবে লোকের কথায় গা ভাসিয়ে সন্তান নিতেও মরিয়া সে? ভেবেই নিজের রাগ ফেলে সেদিন তার আহ্লাদী বউকে আগলে ধরে বুকের সাথে৷ মেয়েটা তার একমাত্র আহ্লাদী বউ। তাকে ছাড়া সে আর কারো চিন্তা করতেই পারবে না। সন্তান যদি আজীবনেও না হয় তবুও এই মেয়েকে সে ফেলতে পারবে না। ডায়লগটা টিভি সিরিয়ালের মতো লাগল কী? হয়তো লাগল৷ কিন্তু তাদের ভালোবাসা এতটাই স্ট্রোং হয়েছে যে এমন কথাই মাথায় আসে৷ তাদের শত্রুতার মতোই ভালোবাসাও স্ট্রোং। সে-দিন কুয়াশাকে অনেক আদর দিয়ে সবটা বুঝায়। আর বউয়ের ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেয়। পূরণ করতে রাজি হয়৷ যদিও কুয়াশার কথার মানে তার কাছে কোনো মূল্য ছিল না৷
‘
নীহারের ছুটি শেষ হলে সে চলে যায় তার কর্মস্থলে। সেই নিয়ে মন খারাপ করে সকলেই। ছেলেটা বাড়ি মাতিয়ে রাখে।
শিশির নীহারের প্রতি অনেক আকৃষ্ট৷ ভাই তার চলে যাওয়াতে মন খারাপ করে। ভাইকে খুব মিস করবে৷ ঢাকায় থাকতেও খুব মিস করত৷ ছোট থেকে ভাইটা তার সঙ্গী।
আম্বিয়া ছোট ছেলেটাকে দূরে দিয়ে ভালো থাকেন না৷ চলে যাবার দিন একটু চোখের পানি ফেলেন যদিও তিনি একটি শক্ত মনের তবুও মায়ের মন কিনা!!
কুয়াশা আরো একটা প্রিয় ভাইকে দূরে রেখে থাকতে পারেনা৷ বড় ভাইয়ের পর নীহারই তাকে বেশি আদর, ভালোবাসা দেয়৷ তুহিনও দেয় কিন্তু তুহিন আগে থেকেই সব সময় শান্তশিষ্ঠ এই জন্য সে ভালোবাসা কারো প্রতি বেশি প্রকাশ করে না প্রয়োজন ছাড়া৷ কুয়াশা নীহারের সাথে ফ্রিলি কথা বলতে পারে। সেই ভাইটা চলে যাবার দিন কান্না করে অনেক।
বাড়ির প্রতিটা সদস্য নীহারকে মিস করে। দূরে গেলে বাড়িটা শূণ্যতার পড়ে থাকে৷ বিশেষ করে আড্ডার সময়ে খুব মিস করে সকলে৷ সে সূদূরে গিয়ে সময় পেলে মাঝে মাঝে ফোন দেয়৷ কয়েক সপ্তাহ বাদে ভিডিয়ো কল দিয়ে পরিবারের সাথে আলাপচারিতা করে৷ কিন্তু শশীর সাথে পার্সোনালি কথা খুব কম বলে৷ শশীকে যাওয়ারদিন সবটাই বলে গেছিল৷ মেয়েটা শক্ত করার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছিল।
যে কদিন নীহার ছিল শশী তো রোজ এসব নিয়ে নীহারের কাছে কাঁদত। বিশেষ করে তাদের দাম্পত্যর বিশেষ সময়টাতে ফুঁপিয়ে কাঁদত৷ নীহার কখনো ধমকে বোঝাত তো কখনো আদরে বোঝাত৷ মেয়েটা নিজেকে শক্ত করার খুবই চেষ্টা করত৷ নীহারের তা দেখে খারাপই লাগত৷ দীর্ঘ শ্বাসের সাথে বিষাদ উড়াত৷ মস্তিষ্ক শুধু একটা কথা বাড়ি দিত, থাকবে কি করে সে তার ইঁচড়েপাকা পাখিটাকে ছাড়া!!
‘
নীহার চলে যাবার মাস খানেক পর রিজভী আর স্মৃতির বিয়ে উঠানো হয় বড় করে৷ ঢাকা থেকে আসার পর লেট করার কারণ রিজভীর একটা বোন ছিল না৷ সে আসলে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হয়৷ মালিথা ভিলার সকলকেই দাওয়াত করেছিল রিজভীরা৷ সকলেই তা হাসি মুখে ইনজয় করে আসে৷
রিজভীর বিয়ে উঠানো দেখে জাকির মালিথা শিশিরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তারা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পূরণ করতে চায় কিনা! শিশির সহ কুয়াশা মানা করে দেয়। এ নিয়ে বাড়িতে কেউ কথা বাড়ায়নি আর৷
‘
নীহার যাবার পর তিন মাসের মাথায় শিশিরের একটা কেস আসে। আর সেটা ঢাকায় গিয়ে হ্যান্ডেল করতে হবে৷ কারণ কেসটা ওর একটা ঢাকার বন্ধু ওর কাছে হস্তান্তর করে৷ বন্ধুটা তার ঢাকায় গিয়ে হয়৷ পড়াশুনোর জন্য ঢাকায় থাকাকালীন ওর আর রিজভীর তিনটা ভালো বন্ধু হয়। বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হয়৷ বন্ধুটা কেস পেয়েছিল কিন্তু কোনো কারনে সে কেসটা না নিয়ে শিশিরকে দেয়। অবশ্য শিশিরের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা সম্পর্কে তারা সকলেই জানত এবং ভরসা করে শিশিরই পারবে। তো সেই কেস শিশির নেয়। যেতে হয় তার কাজের জন্য ঢাকায়। ঢাকায় ওঁ প্রথমে গেছিল কেসটার জন্য। আদালত যেদিন থাকত সেদিন ডাকায় যেত কিন্তু এমন ওর সমস্যা হতে দেখে বন্ধুটা ওকে নিজের বাসায় থাকার অফার করে। সে অবিবাহিতই ছিল। পরিবার সহ তাদের বাড়ি ওটা নিজস্ব। ধনী লোকই তারা৷ রাজিও হয় এবং সেখানে কেস হ্যান্ডেল করতে করতেই আবার সে কেস পায়। সেটা সরকার থেকে দেয়া হয়। দুইটা কেস একসাথে সল্ভ করতে গিয়ে তার বাড়ি আসা খুব কমই হচ্ছিল। দুই বার আসে আর ঢাকায় সে দুই মাসের বেশি সময় থেকে কেস দুইটা সল্ভ করে৷ ছোট ছোট কেস খুব বেশি সময় লাগে না৷
কেস সল্ভ করার পর সেই বন্ধু অফার করে শীতে তারা ট্যুর দেবে একটা৷ ঐ বন্ধুর কয়েকটা বন্ধু এবং শিশির সহ রিজভী আর কুষ্টিয়ারই আরো একটা বন্ধু। মোট আটজনের ট্যুর ছিল। আর প্ল্যানটা করে ইন্ডিয়ায় যাবে তারা। শিশির, রিজভী প্রথমে রাজি হয়না। বউদের কথা ভেবে। কারণ ঐ ব্যাচেলর বন্ধুদের মাঝে শুধু ওরা দুইজনই বিবাহিত ছিল আর গুলোর বউয়ের চিন্তা না থাকলেও ওদের ছিল৷ কিন্তু ওরা এতটায় চেপে ধরে যে শিশির, রিজভী ভাবতে বাধ্য হয়। কেস ট্রান্সফার করা বন্ধুটা শিশির, রিজভীকে ট্রিট হিসেবে ট্যুরের যাবার খরচ দিতে চায় এবং জোরও করে নিতে। কিন্তু শিশিররা রাজি হয়না৷ তবে ট্যুরে যাবার জন্য রাজি হয় আর সেখানে গিয়ে একদিনের খাবার ট্রিট নিতে রাজি হয়৷ বন্ধুটাও মানে৷
সেদিন রাজি হয়েও শিশির, রিজভী চিন্তায় পড়ে বউরা তাদের ছাড়া পাগলী হয়ে ঘুরে বেড়ায় বন্ধুদের সাথে কি ভ্রমনে যেতে দেবে? না দিলেও কিছু করার নেই। সব খানে তো আর বউয়ের চিন্তা করতে গেলে চলে না! কিছু সময় স্পেসয়ের প্রয়োজন পড়ে। কখনো পড়াশুনোর মাঝে দেশের বাহিরের কোথাও যাবার সুযোগ পায়নি। এখন বিয়ে না হলে পড়াশুনো শেষে ব্যাচেলর লাইফটা ইনজয় করতে পারত। কিন্তু বউ হয়েছে বলে কি বাঁধা হয়ে থাকতে হবে? যদিও বউ ছাড়া কষ্ট তাদেরও হয় তবে কিছু সপ্তাহের জন্য তো আর খুব বেশি সমস্যা হবে না? ম্যানেজ করে নেবে শুধু বউদের মানাতে হবে। প্রয়োজনে দেশে এসে দেশের কোথাও বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবে৷ ওটা ছিল বন্ধুদের ট্যুর নয়তো বউ নিয়ে যাবার প্ল্যান করা যেত। ব্যাচেলরদের ভেতরে তো আর বউ চলে না!!
‘
এদিকে শিশিরের ঢাকায় কেস হ্যান্ডেল করে যেদিন একবারে ফিরবে তার দুইদিন আগে কুয়াশা জানতে পারে সে অন্তস্বত্বা। তার শারীরিক পরিবর্তন সে বুঝতে পারে না। পিরিয়ড মিস বেশি দিন হয় না। কিন্তু খাবার প্রতি অরুচি, মাথা ঘুরানো, আর দিনে রাতে দুই-তিনবার বমি এই নিয়ে সে টেস্ট করে। যদিও ভয়ে ছিল কারণ তার আগে প্রেগন্যান্সির আশায় টেস্ট করে ফলাফল নেগেটিভ পায়। যেটাতে কান্না করে অনেক। মনে ওর একটা বিশাল ভয় ঢুকে যায়৷ আম্বিয়ার বোনের কথা শুধু মাথায় বাড়ি দিত। শিশিরকে বললে শিশির ধমক দেয় অবান্তর সব কথা বলাতে। মানে মেয়েটা ঐ কয়মাসে এতটায় পাগলামী করে যে শিশির রীতিমতো বিরক্ত আর সামলাতেও হিমশিম খায়৷ শুধু অবান্তর, অবাস্তব কথা বলে রাগিয়ে তুলত শিশিরকে৷ কুয়াশা বকা শুনে চুপ তো করত কিন্তু নিজেকে শান্ত করতে পারত না৷ আল্লাহর কাছে শুধু দোয়া করত।
এরপর যখন জানতে পারল সে মা হবে আর মেডিক্যাল টেস্টেও যখন জানল ভ্রুনের বয়স প্রায় সাত সপ্তাহ তখন আনন্দে স্মৃতিকে জড়িয়ে ধরে হসপিটালেই কান্না করে৷ একমাত্র স্মৃতিই সর্বপ্রথম জেনেছিল৷ এরপর শিশিরকে জানাবে ভাবে। কিন্তু শিশির দুইদিন পর ফিরবে তাকে জানায়। এরজন্য সে উত্তেজনা নিজের মাঝে আঁটকে রাখে তার বুনো ওল স্বামীটার খুশি সে সামনে থেকে দেখার চিন্তা করে৷
বাড়ির কেউ সেটা ধরতে পারে না যদিও অসুস্থ মনে হতো কিন্তু প্রশ্ন করতেই বলত না। অন্য অযুহাত দেখাত৷ ঘরেই সবসময় থাকত পড়াশুনোর অযুহাতে পরীক্ষাও চলছিল তাই কেউ ঘাতট না৷ এভাবেই বাড়ির সবার থেকে লুকিয়ে যেদিন শিশির এলো দুপুরের দিকে এবং সে এসেই কুয়াশাকে কাছে ডেকে ইন্ডিয়ায় ট্যুরে যাবার কথা জানায় যেটাতে কুয়াশার প্রচুর রাগ ওঠে। রাগের সাথে অভিমান জন্মায়। তার উত্তেজনায় ভাটা পড়ে যায় শিশিরের ঘুরতে যাবার কথায়। কোনো কথা বলে না আর মানাও করে না৷ বলতে গেল কোনো প্রকার রা করে না৷ শিশির বুঝেছিল অভিমান কিন্তু বেশি কিছু বলেনি। এরপর শিশিরের থেকে দূরে দূরে ছিল, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলত না৷
শিশিররা ঢাকা থেকে আসার তিন সপ্তাহ পর ইন্ডিয়ায় ট্যুরের জন্য রওনা হয়। কারণ ভিসা নিতে দুই সপ্তাহ মতো লেগেছিল। পাসপোর্ট তার, রিজভীর এমনকি সবারই করা ছিল৷ তাই পার্সপোটের ঝামেলায় কারোরই যেতে হয়নি। দুই মাসের ভিসায় তারা ট্যুর দিতে যায়। ইন্ডিয়ার দার্জিলিং, কাশ্মীর, আগ্রার তাজমহল, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, কেরালা, গোয়া ইত্যাদি দার্শনিক জায়গাতে ঘুরে এসেছে এক মাসের বেশি সময় নিয়ে। বলে গেছিল সপ্তাহ তিনেকের মাঝেই চলে আসবে।
শিশির ইন্ডিয়ায় গেলে বাড়িতে কুয়াশা জানায় তার প্রেগন্যান্সির কথা। জাকিয়ারা, বৃষ্টিরা শুনে প্রথমে কুয়াশার দিকে ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে থাকে। যেন কুয়াশা কোনো এলিয়েন আর সে মঙ্গলগ্রহে ফিরে যাবার কথা জানিয়েছে। সকলের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে লজ্জা তো পেয়েছিলই সাথে বিরক্তও হয়েছিল৷ আরে ভাই সে কি এমন কথা বলেছে যে এমন এক্সপ্রেশন দেওয়া লাগবে? মা-ই তো হবে আর তো কিছু না! ঠিক এমন একটা কথা আসে মন, মস্তিষ্কে৷
সকলে একসাথে বলে উঠে,
” কিহ্…! “
কুয়াশা ভড়কে গিয়ে মনে মনে আবার রিপিট করে নিজের বলা কথাটা। সে ঠিকঠাক ভাবে বলেই নিউজ দিয়েছে তোহ্! পরক্ষনেই জাকিয়া বলে উঠেন,
” আমি আবার দাদি হব? “
এরপর আজমিরা বলেন,
” আমি নানি হব? “
শশী বলে,
” আমি ফুপু হব? “
একে একে আম্বিয়া, বৃষ্টি, ইয়াসমিনও বলে ওঠে। নিউজ টা পেয়ে ওরা সব জাকির মালিথা, তুহিন, হিমের কাছে পৌঁছে দেয়৷ কিন্তু কুয়াশা জেদ ধরে বলে শিশিরকে যেন না জানানো হয়৷ একপ্রকার জেদ ধরে। সকলে কারণ জানতে সে কারণ বলে। জাকিয়ারা ছেলে, মেয়ের ওমন বাচ্চামিতে হাসবে নাকি কাঁদবে সেটাই ভুলে যান৷ তবে আহ্লাদীর আহ্লাদকে একটু প্রশ্রয়ও দেন৷
সেদিন আনন্দের ফোয়ারা আবার ঝরে মালিথা ভিলায়। খুশিরা কানায় কানায় পূর্ণ হয়৷ জাকির মালিথা আবার দাদু হবার আনন্দে মিষ্টি বিলান। এতিমদের জন্য টাকা দেন। তাদের সিদ্ধান্ত কোনো ভুল হয়নি। ছেলে মেয়েরা সব বাঁধা পেরিয়ে সংসার জীবনে এগিয়েছে। ঝগড়া, হিংসাকে তারা প্রাধাণ্য না দিয়ে ছেলে, মেয়েদের ভবিষ্যত গুছিয়ে দিয়েছিলেন৷ মৃত ভাইয়ের মেয়েটা নিজের ছেলের কাছে সুখী আছে ভেবে শান্তিতে হৃদয় ঠান্ডা করেছিলেন।
জাকিয়ারা দু’হাত ভরে দোয়া করেছেন। আজমিরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙেছিলেন৷ তার সেদিনের মেয়ে জীবনের পথে কতটা এগিয়ে গেছে সেটা ভেবে আনন্দের অশ্রু ফেলে। বাবা ম-রা মেয়েটার এতটা সুখের জায়গা দেখে সব সময় দোয়ায় রাখেন যেন কোনো বদ নজর না লাগে। প্রথমবারের মতো নানি হবার আনন্দ পান তিনি৷ সেদিন স্বামীর কথা মনে হয়। অনেক কাঁদেন। সুখের দিনে মানুষটাকে পাশে পাবার বাসনা জেগেছিল।
___________
ঘুম থেকে কুয়াশা বারটার দিকে উঠে গোসল সেরে নেয়। শিশির তখনও ঘুমে ছিল৷ নামাজ সহ দুপুরে খাবার খেতে কুয়াশাকে ডাকে দেড়টার পর। শিশির উঠলে একসাথে দুইজন নামাজ আদায় করে নেয়। হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহর কাছে তাদের জীবনের আরো একটা নতুন সূচনার জন্য। সবকিছু যেন ভালো হয় সেই দোয়া করে৷
নামাজ শেষ করে দু’টোর দিকে খেতে নামে। সকলে একসাথে খেতে বসে। শিশির খাবার টেবিলে জানায় সে কিছু ফকির এবং এতিম বাচ্চাদের খাওয়াতে চায়। মিষ্টি বিলানোর কথা বললে জাকিয়া জানান সেদিন দেয়া হয়েছে। শিশির শুনে বলে,
” তবে আত্নীয়দের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ো আগামীকাল এনে দেব। “
জাকিয়া কিছু বললেন না। বাবা হবার আনন্দ সে-ও না হয় ছড়াক!! জাকির মালিথা বললেন,
” ফকির, এতিমদের কবে খাওয়াবে? “
” পাঁচদিন পর তো শুক্রবার! শুক্রবারেই খাওয়াই? “
” আচ্ছা আয়োজন করো “
” আচ্ছা বাবা “
বাবার কথায় উত্তর দিয়ে খাওয়ায় মন দিল সে। এদিকে কুয়াশার লজ্জায় জীবন যায় যায় অবস্থা। ব্লাশিং করছে সে। বৃষ্টিরা মিটমিট করে হাসছে। পাশে থেকে শশী ফিসফিস করে বলে ওঠে,
” বুবু, তুমি কি লজ্জা পাচ্ছ? “
চোখ পাকিয়ে তাকায় কুয়াশা শশীর পানে। শব্দহীন দাঁত কেলিয়ে শশী খাওয়ায় মন দেয়। শিশিরের সামনাসামনি বসা কুয়াশা। তাকালে শিশিরও তাকাল। শিশির খাবার মুখে নিতে নিতে ইশারা করল অর্থাৎ,
” কি? “
কুয়াশা মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে খাওয়ায় মন দেয়৷
‘
দুপুরের খাবার শেষ করে বসার ঘরে শিশির, কুয়াশা, শশী, বৃষ্টি, ইয়াসমিন সহ জাকিয়া, আজমিরা বসল। বর্ষণ ঘুমাচ্ছে। শিশির জানতে চায়লে বৃষ্টি জানাল। শশী শিশিরের লেপটপ এনে ইন্ডিয়াতে ঘুরার সব ছবি দেখছে আর জিজ্ঞেসা করছে কোনটা কোন জায়গা। উপস্থিত সকলে শিশিরের মুখে সব গল্প শুনছে তারাও পিক দেখছে লেপটপে।
কিছুক্ষণের মাঝে তুষার কল দিল। রোজ তিন বেলা করেই কল দেয় বৃষ্টিকে। ছেলের, বৃষ্টি খোঁজ সহ বাড়ির খোঁজ নেয়৷ এছাড়া ভিডিয়ো কলে সবার সাথে প্রায় দিনই কথা বলে। তুষার ফোন দিলে আজ তুষারকে শিশির, কুয়াশার মা-বাবা হবার কথাটা জানাল বৃষ্টি। বৃষ্টি শিশিরের কাছে দিতে বলে তার সাথে কথা বলল। শিশির বলল,
” হ্যাঁ ভাই আমিও বাবা হব “
শুনে মিটমিটিয়ে হাসল সব। কুয়াশার কেন যেন আজ লজ্জারা বার বার ঘিরে ধরছে যেটা এতদিনেও হয়নি। এই অসভ্য বুনো ওলটার জন্য এমন লজ্জাময় ফিলিংস আসছে! এতদিন তো আসেনি? শিশির ভাইয়ের সাথে কথা বলে রাখল ফোন। ফোন রাখতেই বৃষ্টিরা জোরে জোরে হেসে দিল। তা দেখে শিশির, কুয়াশা আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল শুধু। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকল শিশির। আজব এমন হাসির কি হলো! অদ্ভুত!! আজব এক পাগলের কারখানা তার বাড়িটা!
(একটা গান আছে নাহ্? “বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা”
শিশিরের কথাগুলোতে গানটা মনে পড়ল আরকি)
এদিকে বর্ষণ উঠে চেঁচাতে লেগেছে। শশী গিয়ে নিয়ে এলো। এসে সে শিশিরকে দেখে এক লাফে কোলে উঠতে উঠতে বলতে লাগল,
” তাচু তাচু! তুমিইই…! কথন এতেছ? “
বলতে বলতে লাফ দিয়ে উঠেছে। শিশির হেসে কোলে বসাল৷ চুমু দিল নরম গাল জোড়ায়। বর্ষণও গলা জড়িয়ে ধরে চুমু দিল শিশিরের দুই গালে। শিশির হাসল। বলল,
” অনেকখন আগে আব্বু। তুমি ঘুমে ছিলে, তাই ডাকি নি “
” আমাল থেলনা তই? “
” এনেছি বাবা ঘরে আছে। অনেক খাবার জিনিসও এনেছি তোমার জন্য। চলো তোমায় বের করে দিই “
বলে বর্ষণকে কোলে নিয়ে সে উপরে চলে গেল৷ শশীরা গল্প করতে লাগল।
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click