কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৪)
ঘড়িতে এগারটা বিশ! এখনও কলেজ পৌঁছুয়নি তীব্র। যথারীতি তার ক্লাসের সময় প্রথম দুটো প্রিয়ড পরেই থাকে। ছেলেটির চমৎকার বাচনভঙ্গি আর অনবদ্য উপস্থাপনের কারণে,শিক্ষার্থীরা মুখিয়ে রয় ক্লাস করার জন্যে। সাথে দর্শনে এগিয়ে থাকা ফার্স্টক্লাস চেহারা তার। এই তালিকায় বরাবরের মতো এগিয়ে আছে
মেয়েরা। তীব্র কথা বলা, ফরসা-শক্ত হাত দিয়ে সাদা বোর্ডে লেখালেখি করা,কিংবা বাইসেপসে ফুলে থাকা বাহু তুলে মাঝে মধ্যে আঙুল বোলানো সোনালী চুলে? এইসব কিছু যেন মুগ্ধতায় বিন্যস্ত হওয়ার ব্যাপার। এমন দেখতে-শুনতে চোখ ধাধানো পুরুষ কি আর গোটা গাজীপুরে আছে?
অথচ
আজ এতোটা সময় শেষেও তীব্রর দেখা পাওয়া যায়নি। সবার প্রচন্ড মন খারাপ এ নিয়ে। ততোধিক বেশি আহত হলো পুষ্পিতা। সারা ক্লাস শুকনো চেহারায় বেঞ্চে বসে থাকে মেয়েটা। তনুজার উশখুশ দেখে ক্ষণে ক্ষণে আকাশ ছোঁয় সেসব। কেন যে তীব্রর প্রেমে পড়তে গেল! এখন এই তনুজা স্যারের জন্য ছটফট করছে, একটুও যে সহ্য হচ্ছে না ওর৷
এর মধ্যে ক্লাসে দপ্তরি ঢুকলেন। খোশগল্পে মেতে থাকা সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন,
“ এই শোনো,কেউ যেও না। তীব্র স্যার ওনার ক্লাস ছুটির আগে নেবেন।”
যেমন ব্যস্ত পায়ে এসেছিলেন,অমন ভাবেই আবার বেরিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু হৈচৈ বেঁধে গেল ছেলেমেয়েদের মাঝে। তীব্রর ক্লাস মানেই বইয়ের কঠিন পাতাও,চোখের সামনে স্বচ্ছ জলের মতো।
হাহ! অভাগা গুলো কী আর জানে? বিদ্বান এই স্যারের ভেতরের রহস্য? রাতভর বই গিলে খেয়ে ক্লাসরুমে উগড়ে দেয়ার ঘটনা? জানে না। জানলে কী করত? বয়কটের ডাক দিয়ে শহর মাতাতো নিশ্চয়ই?
সবাই স্রোতে থইথই নদীর মতো খুশি। আনন্দ তাদের জ্বিভের ডগায়। কিন্তু পুষ্পিতার ওই খুশি আর ফেরত আসেনি। তনুজার হাসি হাসি মুখখানা দেখে চুপসে বসেছে আদল। তাতে এক কৌটো ঘি ঢালতে মেয়েটা লাফিয়ে উঠল ফূর্তিতে। হইহই করে বলল,
“ উফ, ফাইনালি স্যার আসছে। আমি তো ভাবলাম আজ আমার প্রপোজ করাই হবে না।”
নিরস পুষ্পিতার নয়ন দুটো চমকে উঠল অমনি। ধড়ফড় করে বলল,
“ আজ প্রপোজ মানে?”
তনুজার রাঙা ঠোঁটে লাজুক হাসি ভিড়ল। মাথা নুইয়ে মুচকি হাসল একটু। কণ্ঠ চেপে বলল,
“ আমি আজ স্যারকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেব।”
স্থান-কাল ভুলে আর্তনাদ করল পুষ্পিতা,
“ কী?”
তার চিৎকার দূর-দূরান্তে পৌঁছে যায়। সামনের বেঞ্চ হতে সবাই ঔৎস্যুকে ফিরে চায় পেছনে। তনুজা থতমত খেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“ সরি! ইউ গাইস ক্যারি অন।”
সব কিছু আবার আগের মতো। তটস্থ চাউনী গুলো ফেরত গেল জায়গায়। তনুজা ফিসফিস করে বলল,
“ আরে পুষ্পিতা কী কোরছো? সবাই শুনে ফেলবে না? আচ্ছা বুঝেছি,বেশি এক্সাইটেড হয়ে গেছিলে। শোনো, আমি না আসার সময় দুটো গোলাপ কিনে এনেছি বুঝলে? ব্যাগেই আছে। দেখবে?”
পুষ্পিতা হ্যাঁ-না বলল না। তার মাথাটা প্রবল বেগে ঘুরছে। কণ্ঠে উদ্বেগ ঢেলে বলল,
“ কিন্তু তনুজা আজ স্যারকে প্রপোজ করবে কেন? তুমি তো বলেছিলে পরশুর কথা।”
তনুজা ফুল বের করতেই যাচ্ছিল,থেমে অবাক চোখে চাইল ওর দিক।
“ ওমা, ওই কথাটা তোমার মনে আছে? আশ্চর্যের ব্যাপার।”
মেয়েটা মিইয়ে এলো না। থতমতও খেলো না। বরং দ্বিগুণ উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ ওসব ছাড়ো। আগে বলো, সত্যিই আজ প্রপোজ করবে স্যারকে?”
তনুজার বিস্ময় ভাব ক্ষয়ে পড়ে। মুখখানা উজ্জ্বল দেখায় খুব। লাজুক কণ্ঠে বলল,
“ হ্যাঁ।”
মাথায় বাঁজ পড়ল পুষ্পিতার। নরম স্বরের মেয়েটা হুট করে চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ কী? কেন?”
তনুজা ফের ভরকে যায়। চোখ ঝাপটে ফিসফিস করে,
“ আরে আস্তে। বারবার এমন করছো কেন? সবাই শুনলে কী ভাববে!”
কে কী ভাববে তা নিয়ে পুষ্পিতার ভাবান্তর নেই। বাসি লুচির মত নেতিয়ে আসছে মন।
তনুজা নিজেই বলল,
“ আসলে আগামী দুদিন আমি কলেজে আসব না। আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে বুঝলে,সিলেট যাব সবাই মিলে। তাই ভাবলাম শুভ কাজটা আগেই সেড়ে রাখি। আর তাছাড়া ইদানীং স্যারের জন্য অন্য মেয়েগুলো কেমন হাভাতের মত করছে দেখেছ? এই যে স্যার আসবে শুনে কী হাহাহিহি লাগিয়েছে! এদের জন্য আর রিস্ক নেব না। একবার স্যার এ্যাক্সেপ্ট করুক,পটিয়ে-পাটিয়ে দু মাসের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলব।”
পুষ্পিতা থমকে রইল দুঃখে। বুক চেড়া ভারি শ্বাস গিলে বসে থাকল অমন। তনুজার সাথে স্যারের বিয়ে হবে? ওর তীব্র স্যারের? স্যার এ্যাক্সেপ্ট করবেন ওকে? তরুণীর মৃগনয়ন ঝলসে যেতে চায় হৃদয় দহনে। উদাস চোখ ভরে ওঠার ইচ্ছে দেখায় বড্ড। কিন্তু পুষ্পিতা কাঁদল না। বুকের তোলপাড় কিছু যুক্তির ভিড়ে চাপা দিয়ে রাখল।
ব্যগ্র চিত্তে মনকে বোঝাল,
“ তনুজা তো স্যারকে সেই প্রথম থেকেই ভালোবাসে। আমিই ওদের মাঝখানে উড়ে আসা পাতার মতো তৃতীয় ব্যক্তি । শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস কেন পুষ্পিতা? কী লাভ এতে? তোর মত অনাথ-আশ্রয়হীন মেয়েকে কি আর স্যারের মতো অত বড়ো মাপের মানুষ কোনওদিন জীবনে জড়াবে?”
কিন্তু মাথার যুক্তি মন শোনে না। তারা ফুঁসে ওঠে প্রতিবাদে। চিৎকার ছোড়ে বিরোধিতায়। তীব্রর কাছে আসার একেকটি দৃশ্য মনে করিয়ে বুক জ্বালিয়ে দেয় অনলে। পুষ্পিতা না চাইতেও চোখের কোণে উপচে এলো জলরাশি।
ভরতি কোটর হতে একটা দীর্ঘ কণা গালে লুটিয়ে পড়ার আয়োজন করছিল খুব। সে সময় ক্লাশে ঢোকে তীব্র। সহসা তীরস্থ বেগে দাঁড়িয়ে যায় সবাই। তনুজার পর পুষ্পিতাও উঠে দাঁড়াল। তবে মনে হলো একটা নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে সোজা করেছে কেউ। অমন মর্মাহত মেয়েটিকে তীব্র একবার ফিরেও দেখেনি। শক্ত গলায় ভারি আওয়াজ তুলল,
“ সিট ডাউন।”
______
এখন ফেব্রুয়ারী মাস। দীর্ঘদিনের শীতের দাপাদাপির পর এখন হুড়হুড়ে রোদ ওঠার পালা। সারা দিনের মতো প্রখর দুপুরও মিষ্টি হবে। নৈসর্গিক প্রশান্তি নেমে আসবে হৃদয় মননে। কিন্তু বসার ঘরে থম ধরে থাকা তরুণীর মন মেজাজ জমে রইল শুভ্রকায় এক হিমালয়ের মতোন। শৃঙ্গের কোল ছুঁয়ে এক্ষুনি ধ্বসে পড়বে তুষার। নূহার চোখ বেয়ে টলটলে জল গলার খাঁজে গিয়ে থামল।
এমনিতে সে কাঁদে না। ওই কথায় কথায় ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদার মেয়ে তো একেবারেই নয়। কিন্তু আজকে কান্না পাচ্ছে। একটা গোটা আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ার মতো কান্না। সাথে রাগ-ক্ষোভের অদম্য কিছু পোকা কিলবিলিয়ে ছুটে যাচ্ছে শরীরে। পুরো পৃথিবী গুড়িয়ে ফেলার রাগ হচ্ছে নূহার। তবু যদি শাস্তি হতো একটু!
আচমকা ভীষণ জোরে কেঁদে ফেলল নূহা। হা-হুতাশ করে প্রলাপ করল,
“ এতো বড়ো ভুল তুই কী করে করলি নূহা? তুই না খুব বড়াই করিস,মানুষ চিনতে ভুল হয় না বলে? কোথায় গেল সেই বড়াই? দিনের পর দিন একটা মাস্তান, শিক্ষক সেজে তোর সরল বন্ধুটাকে ঠকিয়ে গেল। আর তুই বুঝতেও পারলি না? উলটে তার হয়ে প্রসংশা করতে করতে ওর মনে প্রেম উষ্কে দিলি? এখন কী হবে? পুষ্পিতা যখন জানবে তার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী সেই গুণ্ডাই ওর স্যার। যাকে সদ্য মেয়েটা ভালোবাসতে শুরু করেছে, তাকে নিয়ে এসব ও মানবে কী করে? কী করে সামলাবে নিজেকে? মন ভাঙার মতো কষ্ট যে পৃথিবীতে নেই। ছি নূহা! কেন আরেকটু সাবধান হলি না তুই? কেন?”
কান্নাকাটির মাঝেই হঠাৎ শব্দ এলো কেন। ওপাশের দরজা হতে বাইরে এসেছে বেশ কটা গলার স্বর। নাহিদকে কিছুতেই আজকে মিরাজরা অফিস যেতে দিলো না। ছেলেটা শার্ট-প্যান্ট পরে তৈরিই ছিল, কিন্তু যেতে পারেনি। তিন বন্ধু জোর করে আটকে রাখল বাসায়। নিসঃহায় যুবক প্রতিবারের মতো আজকেও ওদের সাথে পেরে ওঠে না। কিন্তু মনে মনে ভীষণ চিন্তায় কাহিল নাহিদ। নতুন চাকরি,প্রথম সপ্তাহেই এ্যাবসেন্ট? কাল অফিসে ঢুকতে দেবে তো?
সে বাইরে এসেও একই কথা বলল,
“ মিরাজ আমি যাই না ভাই প্লিজ। আমার নতুন চাকরি,ছুটে গেলে কী হবে?”
আরমান সানন্দে বলল,
“ ছুটে গেলে ধরে এনে দেব। আরে আমাদের বিট্টু আছে তো। এতো ভাবছিস কেন?”
মুশফিক সহসা পিঠে চড় বসাল ওর। রেগেমেগে বলল,
“ এখানে বিট্টু উচ্চারণ করতে মানা করেছি না? ও থাকলে এক্ষুনি তোর কলজি ভুনা করে ফেলতো।”
ছেলেটা জ্বিভ কেটে ফিসফিস করল,
“ সরি ভাই সরি।”
সবাই মিলে জুতো পড়ল। মুখ কালো করে দরজায় তালা ঝোলাল নাহিদ৷ ছেলেটার শত আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, কোথাও একটা বগলদাবা করে নিয়ে চলল ওরা৷
এই পুরো দৃশ্য ফ্যালফ্যাল করে দেখে গেল নূহা। লুকিং গ্লাসে চোখ পেতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার সামনে, সব কিছু কেমন জলের মতো স্বচ্ছ হলো অচিরে। হুট করেই মানসপটে ভেসে উঠল কতক ছবির ন্যায় দৃশ্য।
সেই উত্তরার ওভারব্রিজের নিচে! গাড়িতে বসে একটা ছেলে তার উদ্দেশ্যে বাজে গান গেয়েছিল। হ্যাঁ, ওই ছেলেটাও তো ছিল এখানে। এরা সবাই ছিল। আর নাহিদ? এই তো মানা করছিল বন্ধুদের। এজন্যেই তবে ওকে শুরু থেকে এত চেনা চেনা লেগেছিল নূহার? এরা সবাই তবে ওই বিট্টু মাস্তানের বন্ধু? এরাই ওর সাথে মিলে গুণ্ডামি করে বেড়াতো?
আর নাহিদ,সেও তাহলে ভালো মানুষির ভান করেছে এতদিন? এই যে এত বোকা,অবুঝ সেজে থাকা এইসব কিছু নাটক? এতো নিখুঁত অভিনয়ও কেউ করতে পারে? পুষ্পিতার সাথে কি আমি নিজেও ঠকে যাইনি?
নিজেকেই প্রশ্ন করল নূহা। উত্তর আসে না। তবে বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা হয়! নাহিদের সাথে কাটানো সময় গুলো ভেবে বেড়ে আসে তা। ও কি আসলেই এতোটা বোকা? সরল ভাবা একটা ছেলে ভেতর ভেতর মাস্তান? ছি!
পরপরই মেয়েটা মুখ শক্ত করল। এভাবে কাঁদে দূর্বলরা। ওতো দূর্বল নয়। বিট্টু মাস্তানের এই দূর্দান্ত অভিনয়ের আসল উদ্দেশ্য ও জেনেই ছাড়বে। কেন,কীসের জন্য একটা অনাথ মেয়ের আবেগ নিয়ে খেলল সে,জানতে তো হবে। ভাবল দাঁত পিষে,
“ যা হবার হবে। মাস্তান যত ভয়ানকই হোক,এই পরিস্থিতির জন্য যে দায়ি,তার মুখোমুখি আমি হবই আজ। ”
***
ক্লাশ শেষ হতেই রকেট বেগে বেরিয়ে গেছে তীব্র। অন্ধকার চোখমুখ নিয়ে চেয়ে থাকা এক রূপসীকে খেয়াল অবধি করেনি। ঠিক তারপরপরই ছুটির ঘন্টা বাজল। হুড়মুড় করে একে একে বেরিয়ে গেল সবাই।
পুষ্পিতা নিষ্প্রভ চিত্তে উঠে দাঁড়ায়। এখন ক্লাসে না থেকে যদি একা থাকতো? ঠিকই বুক ভাসাতো কেঁদে। এই যে কণ্ঠনালীতে কুণ্ডলীর মত কিছু একটা ঘুরছে, এটাকে কী বলে?
সাথে অলিন্দ গুলোয় শুরু হওয়া যে দম বন্ধ ব্যথা? এই ব্যথা পুষ্পিতা কাকে দেখাবে? চোখের কোণে সদ্য ডোবা জল,এটাই বা কী করে লুকাবে? এতটা ভারি তো বুকে পাথর রাখলেও লাগে না।
আকাশের গায়ে যখন কালো মেঘ ঘোরে? পশলা ধরা বৃষ্টি না নামা অবধি শান্তি আসে না? পুষ্পিতারও তেমন কাঁদা প্রয়োজন। জীবনে প্রথম ভালোবেসে না পেলে কতটা কাঁদতে হয়? কতদিনই বা কাঁদতে হয়? হয়ত সারাজীবন!
পুষ্পিতা চিবুক গলায় ঠেকিয়ে ক্লাস ছাড়তে যাচ্ছিল,হুট করে কনুই টেনে ধরল তনুজা। থামল ও। ছোট্টো ঢোক গিলে ফিরল পিছনে।
“ কোথায় যাচ্ছো?”
“ বাসায়।”
পুষ্পিতার মিহি উত্তর।
“ আজ একটু দেরি করে গেলে হোতো না?”
সে কিছু বলল না। তনুজা নিজে নিজেই বলল,
“ আসলে স্যারকে এখন বলব তো কথাটা,নার্ভাস লাগছে খুব। তুমি থাকলে ভালো হোতো! আমিও তো তোমায় ছাড়া তেমন কারো সাথে মিশি না।”
জীবনে প্রথম ভয়ানক রাগ হলো পুষ্পিতার। মাথার চুলে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরানোর মতো রাগ। তোর প্রপোজ করতে হয়, তুই কর না ভাই। মরতে আমাকে যেতে হবে কেন? যাকে ভালোবাসি তাকে অন্য মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেবে আর আমি তামাসা দেখব দাঁড়িয়ে? এটা কত যন্ত্রণার কেউ জানে?
এই কষ্ট, এই বুক ব্যথা খালুজানের অপমানের থেকেও ধারালো। মিথিলার উঠতে বসতে কথা শোনানোর থেকেও মর্মান্তিক। চারপাশের মানুষের চরিত্র নিয়ে কথা বলার চেয়েও জঘন্য।
ওসব ক্ষত একটা সময় ভুলে থাকা যায়। কোনো সুখের মলম দিয়ে প্রলেপ আকা যায় ওপরে। কিন্তু নিজের ভালোবাসাকে অন্যের হতে দেখা যায় কখনও? এই মর্মপীড়ার কোনও বিশ্লেষণ নেই। থাকলে কবেই উপশম আসত দুনিয়ায়। এত এত মন ভাঙা মানুষ কি আর বালিশ ভেজাতো কেঁদে?
না, এসব হজম করার সাহস পুষ্পিতার নেই। মেয়েটা আলগোছে ক্লেশ চাপা দিলো ভেতরে। ধীর জবাব ছুড়ল,
“ আমার মাথা ব্যথা করছে তনুজা। বাড়ি গিয়ে ঘুমাব। ছাড়ো প্লিজ!”
তনুজা মুখ কালো করল। অথচ আজ পুষ্পিতা ফিরেও দেখেনি। নিজে থেকে হাত ছুটিয়ে চুপচাপ চলে যায়।
উপায় না পেয়ে তনুজা সাহস টানল বুকে। ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল কবার। সত্যিই ভীষণ নার্ভাস লাগছে! এত ঘামছে নাক-মুখ! হাত উলটে চটচটে তরল মুছে নেয় মেয়েটা। ব্যাগ থেকে টকটকে লাল গোলাপ দুটো তুলে নেয় মুঠোয়। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, পিঠের সাথে ফুল লুকিয়ে বেরিয়ে আসে তারপর। গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় তীব্রর অফিস রুমের সামনে। সে পুরুষ ব্যস্ত তখন! কী সব এক গাদা ফাইল গোছগাছ করছিল। পুরোটা সময় তনুজা আবিষ্ট মোহে দেখে যায় ওকে। মন-প্রাণ দিয়ে চায়,এই সুপুরুষ একান্ত মানুষ হোক তার জীবনে। তবে আর কিচ্ছু চাওয়ার থাকবে না। কিচ্ছু না।
তীব্র ফাইল রেখে গাড়ির চাবি ভরল পকেটে। ফোন হাতে নিতেই,তনুজা মৃদূ কণ্ঠে বলল,
“ আসব স্যার?”
এতক্ষণে চোখ তুলে চাইল সে। চশমার ফাঁক হতে বিলাতি নয়ন সোজাসুজি ঠিকড়ে পড়ায় তনুজা গুটিয়ে এলো একটু! তীব্রর শুভ্র মুখে হাসি বিলীন। চোখ নামাল আবার। বলল ছোটো করে,
“ আসুন।”
তনুজা ভেতরে যায়। এই দৃশ্যে পুষ্পিতার বুকের পাজর সহ টনটন করে উঠল।
এতক্ষণের চেপে রাখা জল, ছুটে বেরিয়ে আসে গতিতে। গাল-গলা সব ভিজে যায়। অচল পা টেনেটুনে রিকশা ডেকে উঠে পড়ে সে।
***
তখন সন্ধ্যে।
অবসন্ন পায়ে বাড়ি ফিরল তীব্র। যেমন সকাল সকাল বেরিয়ে গিয়েছিল? পৌঁছাতে তেমনই দেরি। দরজায় তালা ঝুলছিল। নাহিদ এখনও ফেরেনি। তীব্র পকেট থেকে চাবি বের করে। খোলার সময় একবার ঘাড় কাত করে দেখে নেয় পুষ্পিতাদের ফ্ল্যাটের দিক। ওদের দরজা হাঁ করে খোলা। দু মিনিট আগেই পুষ্পিতা ছাদে গিয়েছে কাপড় তুলতে। তীব্র সেসব জানে না! উৎসুক নয়ন জোড়া মিছিমিছি খুঁজে বেড়াল প্রিয় সেই মুখ। ভীতু মেয়েটার সাথে আজ সারাদিন দেখা হয়নি। ক্লাসেও ইচ্ছে করে হদিস করেনি তীব্র। অথচ এখন একটুখানি দেখার জন্যে বক্ষভাগে উচাটন হচ্ছে ভীষণ! মেয়েটা তো ছুটির পরেও তো গেইটে ছিল না। মাঝখান থেকে একটা উটকো ঝামেলার জন্যে তারই বের হতে দেরি হয়েছিল। অবশ্য তাতে খারাপ কিছু হয়নি৷ পুষ্পিতা সাথে থাকলে ফ্ল্যাটের কাজটা এত আরামসে করত কী করে তীব্র?
তীব্র দরজার লক ঘোরাল। ঘরে গিয়ে আগে ফ্রেশ হোক,তারপর ঠান্ডা মাথায় মেয়েটাকে কাছে ডাকার একটা অজুহাত খোঁজা যাবে। মস্তিষ্ক যখন সেই চিন্তায় ব্যস্ত, সহসা পাশ হতে ডেকে উঠল কেউ একজন,
“ বিট্টু!
তীব্র তাকায়নি। বেখেয়ালে জবাব দেয়,
‘’ হু?”
পরপরই চমকে উঠল সে। তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে দৃষ্টি। চকিতে ফিরে চায় পেছনে। নিজেদের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে নূহা। মেয়েটার মুখের পরতে পরতে প্রস্তর বসানো। এত শক্ত,নিষ্পৃহ চাউনীও হয়!
তীব্র স্তব্ধ হয়ে গেল ওকে দেখে। হকচকানোর ছাপ পড়ল চেহারায়।
নূহা এগিয়ে আসে। কণ্ঠে শ্লেষ উপচে পড়ছে যেন,
“ কী, ঠিক নামে ডেকেছি তো? নাকি কিছু ভুল বললাম? বিট্টু,না বিট্টু মাস্তান? কোনটা ডাকলে ভালো হোতো বলুন তো!”
তীব্রর মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। স্তম্ভিতের নীল ছোবলে ঢোক গিলছে শুধু। বা হাত তুলে কপালের ঘাম মুছল। কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে এলো জ্বিভ,
“ কী করে জানলে?”
নূহা বিদ্রুপ করে হাসল।
“ যাক, অস্বীকার করেননি দেখে ভালো লাগল।”
পরপরই চিবুক কঠিন করে বলল,
“ আমি অনেক ঠক-প্রতারকের গল্প শুনেছি। কিন্তু চোখে দেখলাম প্রথম বার। এত নিখুঁত অভিনয়! আপনাকে তো এ্যাওয়ার্ড দিলেও কম হয়ে যাবে।
আচ্ছা, লজ্জা করে না আপনার? পরিচয় লুকিয়ে একটা মেয়ের সাথে দিনের পর দিন নাটক করতে বিবেকে বাঁধলোও না? এই সবে আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল পুষ্পিতা আর আপনি!”
তীব্র কিছু বলতে যায়,হাত উঁচিয়ে বাঁধ সাধল নূহা। ক্রুদ্ধতায় একাকার হয়ে বলল,
“ আপনার কোনও সাফাই শুনতে আমি চাই না। শুধু বলতে এসেছিলাম আপনার সমস্ত খেলা শেষ বিট্টু মাস্তান। এই ভালো, সভ্য মানুষের যে মুখোশটা আপনি পরে আছেন এখন? পুষ্পিতার সামনে আজকেই খুলে দেব আ..”
কথা শেষও হয় না, আচমকা তীব্র ঝড়ের বেগে ওর মুখ চেপে ধরল। কলিজা সুদ্ধ ছলকে উঠল নূহার। কোনও কিছু বোঝার আগেই তীব্র হিড়হিড় করে টেনে ওকে ঢুকিয়ে নিলো ঘরে। শক্ত পায়ের এক লাথিতে দোর আটকে গেল আবার। ভয়ে,আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসে নূহার। শরীরের সবকিছু অবশ হয়ে রয়।
ভাবে, এইত এখানেই তার জীবনের সব কিছু শেষ।
চলবে।