#শারমিন আঁচল নিপা
পুরো গ্রামবাসী তেড়ে এসেছে আনহারিকে গ্রাম থেকে বের করার জন্য। তাদের দাবি আনহারি ফেইক। এখানে এসেছে দ/ঙ্গা করার জন্য। আনহারিকে আবার অনেকে ভূত ভেবেও মারতে এসেছে। কেউ কেউ তো বলছে তালাক আমাদের সামনে হয়েছে এখন এই মেয়ের এ বাড়িতে কোনো অধিকার নেই। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ গোলমেলে হয়ে আছে। আমি একটু উঁকি দিয়ে দেখে আনহারির কাছে এসে বললাম
“গ্রামের লোক তো অনেক ক্ষেপেছে। এখন কী করবেন আপনি? আমার জন্য যদি আপনার কোনো বিপদ হয় আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। হুজুগে বাঙ্গালি কিছু হলেই বাছ, বিচার না করেই লাফায়তে থাকে। এরা সবাই আপনাকে মারতে এসেছে। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”
আনহারি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
“যুদ্ধের ময়দানে কখনও ভীত হতে নেই। আমরা এসেছিই যুদ্ধ করতে। সংগ্রাম যত প্রবল হয় বিজয়ের হাসিও তত সুন্দর হয়। এসব নিয়ে ভেবো না। আমি বাইরে গিয়ে দেখছি কী করা যায়।”
কথাগুলো বলে, আনহারি বাইরে যেতে নিলেই… আমি তার হাতটা চেপে ধরে বললাম
“প্লিজ বাইরে গেলেই সবাই তেড়ে আসবে। আপনি বাইরে যাবেন না। পরিস্থিতি এখন ভীষণ খারাপ। এমন সময় আপনার বাইরে যাওয়াটা রিস্ক। এক আপাকে হারিয়েছি আরেকজনকে হারানো ধৈর্য আমার নেই। আপনাকে আমি আমার বড়ো আপার মতোই ভালোবাসি। দয়াকরে আপনি ঘরেই বসুন। পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক এরপর বের হোন।”
আনহারি আমার কথা শুনল না। জোর করে সে তার রুম থেকে বের হয়ে মূল দরজায় গেল। মূল দরজায় যেতেই একটা পাথর ছুড়ে মারল একজন। সেটা একদম আনহারির কপাল বরাবর পড়ল। কপালটা কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আরও কয়েকজন আনাহারিকে সামনে এগিয়ে মারতে নিলেই আনহারি বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল
“এক পা যদি কেউ এগিয়ে এসে আমার গায়ে হাত তুলেছেন আপনাদের খবর আছে। পেছনের দিকে তাকান। তারপর চিন্তা করেন কী করবেন। আমি কোনো দাঙ্গাতে যেতে চাচ্ছি না। আপনাদের যদি সন্দেহ থাকে তাহলে সেটা সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপন করুন। আমিও ফেইক না সেটার প্রমাণ দিব আমি। আমি যে ভূত ও না সেটারও প্রমাণ দিব।”
আনহারির কথা শুনে সবাই পেছনের দিকে তাকাল। পুলিশ অফিসার মাহিদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে গাড়ি থেকে নামছে। পুলিশ অফিসার মাহিদ দেখতে ভীষণ সুন্দর। বয়স ২৮ থেকে ৩০ এর মাঝামাঝি হবে। দেহের গড়ন বেশ বলিষ্ঠ। লম্বায় ৬ ফিট ২ ইঞ্চি। গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণের। মনে হচ্ছে সালমান খান গাড়ি থেকে নেমে আসছে। এত করুণ মুহুর্তেও যে কারও মনে প্রেমের ঘন্টা বাজতে পারে এটা আমি নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। এই মাহিদকে দেখে আমার শরীরে বেশ অস্থিরতা কাজ করছে। পুরো দুনিয়া একদিকে আর সে যেন আরেকদিকে। আমি কেন এসেছি? কার জন্য এসেছি। সব লক্ষ্যই যেন আমি ভুলে যাচ্ছি।
সবাই মাহিদকে দেখে চুপ হয়ে গেল।।ষোড়গোল থেমে গেল। চারপাশটা নীরব হয়ে গেল মুহুর্তেই। মাহিদ সবার সামনে এসে দাঁড়াল। আর আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমার বুকটা ধুকধুক করছে কেন জানি না। মাহিদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
“এখানে কেউ কোনো অরাজগতা করলে আমি এর কঠিন পদক্ষেপ নিব৷ সবাই নিজেকে সামলান। আপনাদের কোনো অভিযোগ থাকলে বলুন আমি তদন্ত করে সুষ্ঠ পদক্ষেপ নিব। তবে আইন নিজের হাতে নিয়ে কিছু করবেন না।”
তারপর আনাহারির দিকে নির্দেশ করে বলল
“এই মেয়েটা বলছে সে অনন্যা। এবং তার যথেষ্ঠ প্রমাণ আমাকে দিয়েছে। আপনাদের কাছে যদি সলিড প্রমাণ থাকে দিন। আমি পদক্ষেপ নিচ্ছি কী করা যায়।”
আনজুমান পাশ থেকে বলে উঠল
“আমার ভাইয়ের বউ জাম গাছে গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে বারো বছর আগে। তার ময়না তদন্ত হয়। এমনকি তার দাফনও হয়ে যায়। এ মেয়েটা আমার ভাইকে ফাঁসিয়ে টাকা নেওয়ার জন্য এমন করছে।”
অফিসার মাহিদ ভ্রু টা কুঁচকে বললেন
“অনন্যা যথেষ্ট যোগ্য। তার আশ্রিত মা তাকে যে পরিমাণ জায়গা সম্পত্তি দিয়েছে সেটা আপনার ভাইয়ের তুলনায় দশগুণ। আপনারা অত্যাচার করে এ মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন কৌশলে৷ অজানা শহরে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে লাবনী জোহা নামক একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মেয়ে তাকে নিজের মেয়ের মতো উদ্ধার করে লালন পালন করে। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে আসে। তার যোগ্যতাও আছে টাকা ইনকাম করার জন্য। দেখতে শুনতেও সে সুন্দরী। তাহলে শুধু শুধু এরকম ব্লেইম দেওয়া তো উচিত না। এখন আপনারা কেন অনন্যাকে বারো বছর আগে দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন সেটার জবাব দিবেন। জাম গাছে যে অনন্যা ছিল না সেটার প্রমাণ অনন্যা দিবে। অনন্যার নিকট তার বিয়ের কাবিননামা আছে। কাবিননামায় টিপসই আছে তার। সেটা ম্যাচ করালেই হবে। যদি সে অনন্যা হয় তখন তো আপনারা ফেঁসে যাবেন।”
আনজুমান মুখের উপর বলে দিল
“ঐটা বানোয়াট কাবিন নামা। আমার ভাইয়ের কাবিননামা তার কাছেই ছিল। অনন্যার মৃ/ত্যুর পর সেটা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।”
অফিসার মাহিদ এবার বলে উঠলেন
“তাহলে সে কাবিননামায় আপনার ভাইয়ের যে আঙ্গুলের ছাপ আছে সেটাও মিলানো হবে। মিলে গেলে বুঝতে হবে এটাই আসল।”
আমজুমান শক্ত গলায় বলল
“তাই করা হোক। আমি জানি এ মেয়েটা মিথ্যায় প্রমাণিত হবে।”
এদিকে অফিসার মাহিদের কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম আনহারি তাকে এসব বলতে বলেছে। লাবনী জোহাকে নিজের মা বলে পরিচয় দিলে বিষয়টি উল্টো দিকে মোড় নিতে পারে। আর তার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে লাবনী জোহা পর্যন্ত যাওয়া খুব বেশি কঠিন নয়। তাই এত বড়ো নাটক আনহারিই সাজিয়েছে। কারণ এটা সত্য যে বড়ো আপা মা/রা গেছে সেদিন। বড়ো আপার মুখ অস্পষ্ট ছিল না। অস্পষ্ট থাকলে হয়তো সংশয় থাকত মনে।
এবার অফিসার মাহিদ গ্রামবাসীর দিকে তাকিয়ে বলল
“কেউ কোনো বিশৃঙ্খলা করবেন না। আমার সম্পর্কে আপনাদের ধারণা আছে আমি জানি। অন্যায়ের ব্যাপারে আমি একদম আপোস করি না। আমি বারো বছর আগেই কেইসটা আবার ওপেন করব। সবকিছু নিয়ে আবার ঘাটব। তারপর সত্যতা যাচাই করে এর একটি সমাধান দিব। সে পর্যন্ত অনন্যা বাড়িতেই থাকবে। আর আপনারা যে যার বাড়িতে যান। সে জীন ভূত নয় জলজ্যান্ত একটি মানুষ।”
গ্রামের লোকেরা মাথা নত করে চলে গেল। বাড়িটা একদম নীরব হয়ে গেল। আমি অফিসার মাহিদের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম সব। আমার হাত পা কাঁপছে। উনার প্রতি এত প্রবল অনুভূতি আমার কেন জাগছে আমি জানি না। আমার ভীষণ অস্থির লাগছে। এ অস্থিরতা আমাকে ভীষণভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে।
মাহিদ সাহেব আনহারির দিকে তাকিয়ে বলল
“আমার সাথে হাসপাতালে চলুন। আপনার মাথায় ব্যান্ডেজ লাগাতে হবে। রক্ত পড়ছে বেশি।”
আনহারি জবাব দিল
“আমি ঠিক আছি। কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলেই হবে। আমি আপনাকে কোনো সমস্যা হলে কল দিব। ধন্যবাদ এ পরিস্থিতি টা সামাল দেওয়ার জন্য।”
“আপনার কাবিননামা টা আমি নিয়ে গেলাম। ফিংগার প্রিন্ট ম্যাচ করার জন্য।”
তারপর দীপক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
“দীপক সাহেব একজনকে পাঠাব। সেখানে আপনি নিজেও ফিংগার প্রিন্ট দিবেন?”
দীপক হালকা গলায় জবাব দিল
“ঠিক আছে।”
অফিসার মাহিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে চলে গেলেন। আনাহারি তার রুমে বসে আছেন। মাথাটা সে শক্ত কাপড় দিয়ে বেঁধে নিয়েছে। এতে তার রক্ত পড়াটা অনেকটা কমেছে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। আনহারি ড্রইং রুমে আসলো। আনজুমান আর তার হাসবেন্ড দাঁড়িয়ে আছে। আনহারি আনজুমানের সামনে গিয়ে তার হাসবেন্ডকে বলল
“দুলাভাই আমার জন্য একটু পায়েস করে নিয়ে আসেন। মনে আছে আমাকে বলেছিলেন আপনি বেশ ভালো পায়েস রান্না করেন। শুধু অর্ডার দিলেই হবে। কিন্তু বিনিময়ে আপনি আমার কাছে আমার সম্মান টা চেয়েছিলেন। কতশত অপমান করেছিলেন। সব ভুলে গেছেন নাকি মনে পড়ছে? আজকে আমার সম্মান দিব না, তবে পায়েস না পেলে আপনার সম্মানটা কেড়ে নিব।”
এ কথা শুনে আনজুমান তেড়ে এসে বলতে লাগল
“সাহস কত বড়ো আমার জামাইকে হরমাইশ দাও।”
আনহারি আনজুমানের চুলের মুঠিটা ধরে বলল
“হরমাইশ দিয়েছি জান কেড়ে নেইনি। ভালোয় ভালোয় পায়েস করতে বল। নাহয় তোর মাথায় একটা চুলও থাকবে না। আগের অনন্যা আমি না। এ অনন্যা জ্বলতে জ্বলতে, পুড়তে পুড়তে শক্ত হয়ে গেছে।”
আনজুমান ভয়ে বিদ্ধস্ত হয়ে তার হাসবেন্ডের দিকে তাকিয়ে বলল
“প্লিজ যাও তুমি। নাহয় আমাকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করবে না এ মেয়ে।”
আনজুমানের হাসবেন্ড দৌড় লাগালো রান্না ঘরের দিকে। ঠিক এমন সময় আরও একটা আওয়াজ কানে ধেয়ে আসলো। আর…
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার