#শারমিন আঁচল নিপা
পায়েসে পটাশিয়াম সায়ানাইড পাওয়া গেছে। এটা সাধারণ কোনো যৌগ নয়। এটা খাবারের সাথে সেবন করলে মৃত্যু ঝুঁকি ৯৫ %। এটি বর্ণহীন। দেখতে লবনের মতো। খুব সহজেই খাবারের সাথে মেশানো যায়। আর মেশানোর পর খাবারের স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। গন্ধহীন হওয়ায় খাবারের ঘ্রাণেরও কোনো পরিবর্ত হয় না। এটা সহজে কেউ পাওয়ার কথা না। যেকোনো দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না। বড়ো বড়ো ঔষধের কোম্পানিগুলোতে এ যৌগ থাকে। অনেক সময় গহনার দোকানগুলোতেও এটা পাওয়া যায়। যে কেউ চায়লেও এটা হুট করে সংগ্রহ করতে পারবে না। আর এটা সেবনের সাথে সাথেই রিয়েকশন হয় না। ৫-১৫ মিনিট সময় নেয়। এরপর অজ্ঞান হয়ে যায় রোগী। এজন্যই আপার শ্বাশুড়ির পায়েস খাওয়ার সাথে সাথে কিছু হয়নি। একটু পর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল।
এটা অসম্ভব যে জটলা এটা মুহুর্তের মধ্যে সংগ্রহে করে খাবারে মিশিয়েছি। আর আনহারি পুরোটা সময় জুড়ে আমার সামনে ছিল। তাকে আমি রান্না ঘরে প্রবেশ করতে দেখিনি। সুতরাং এতটুকু আমি নিশ্চিত এটা আনহারিও খাবারে মেশায় নি। তবে মিশিয়েছে কে?
জটলাকে আপাতত পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। জটলাকে যখন পুলিশ নিয়ে যাচ্ছিল তখন আনজুমান পুলিশের পায়ে ধরে অনুরোধ করল তাকে যেন গ্রেফতার করা না হয়। তার মায়ের এ অবস্থার জন্য সে দায়ী নয়। আর তারা কোনো অভিযোগও দায়ের করতে চায় না। দীপকও পুলিশকে একই কথা বলল। তবে আনহারি তার শ্বাশুড়ির পক্ষ থেকে সুষ্ঠু বিচারের জন্য একটা মামলা করেছে। যার দরুণ শত চেষ্টার পরও জটলাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হলো না। পুলিশ জটলাকে ধরে নিয়ে গেলে আনজুমান আনহারির পা চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার স্বামী ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। আমার মেয়ে বাপ ছাড়া হবে। আমার থাকার মতো জায়গা নেই। বাপের বাড়িতে একমাত্র অবলম্বন আমার স্বামী। আমাদের মা, আমরা বুঝব বিষয়টি। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা উঠিয়ে নাও প্লিজ। আমি বড়ো হয়ে তোমার পায়ে ধরছি। আমার মাথা গুজার ঠাঁই টা কেড়ে নিও না এভাবে। আমার সন্তানকে বাবা থাকা সত্ত্বেও এতিম করো না। আমি একটা এতিম মেয়ে হয়ে তোমার পায়ে ধরছি। মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের এত বড়ো ক্ষতি করো না দয়াকরে।”
আনজুমানের কথা শুনে আনহারি বেশ হেসে হেসেই বলল
“আপা এক স্বামী গেলে আরও স্বামী পাবেন। আপনার তো খুশি হওয়ার কথা। নতুন নতুন স্বামীর আদর পাবেন। দুনিয়ায় কী একটায় ছেলে! ছেলের অভাব নেই। আরও ছেলে পটিয়ে বিয়ে করে নেন। আপনার বাবা টাকা রেখে গেছে। টাকা ঢালুন অনেক কচি ছেলে চলে আসবে।”
আনহারির কথা শুনে আনজুমান রুষ্ঠ গলায় বলে উঠল
“একজন মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এসব বলতে লজ্জা লাগছে না? তুমি কী মানুষ?”
আনহারি এবারও হেসে হেসেই জবাব দিল
“মানুষ ছিলাম। তবে অমানুষ তো বানিয়েছেন আপনারা। বারো বছর আগের কথা ভুলে গেছেন? এত সহজে সব ভুলে গেলে হবে? আপনি একজন মেয়ে হয়ে আমাকে এসব বলেছিলেন তখন কী আপনার বিবেকে বাঁধে নি?”
আনহারির কথা শুনে স্মৃতির পৃষ্ঠে চলে গেলাম বারো বছর আগে। আপার নামে শালিস বসেছে। আপাকে শালিসে তালাকনামা দেয়া হয়েছিল। তালাকনামাটা আনজুমানেই আপার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন ঠিক আপা এভাবেই আনজুমানের পায়ে ধরে বলেছিল,
“মারেন কাটেন যাই করেন, স্বামী ছাড়া কইরেন না৷ আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই। বাবা মা থাকতেও আমি এতিম। আমি সংসারটা করতে চাই। আপা আপনি তো জানেন আমি খারাপ মেয়ে না। আমার চরিত্রে সমস্যা নাই। এরা সবাই মিথ্যা বলছে আপনিই বলেন আপা। আপনি আমার সংসারটা ভাঙতে দিয়েন না। একটা মেয়ে হয়ে মেয়ের কষ্ট তো আপনি বুঝবেন আপা। দয়া করুন আমার উপর। আল্লাহর ওয়াস্তে আমি কোনো ভুল করলে মাফ করে দেন৷ আমার কলিজায় এভাবে আঘাত কইরেন না আপু৷ আমি আপনার ছোটো বোনের মতো। আমার সাথে এত বড়ো অন্যায় করতে দিয়েন না। দীপক ছাড়া আমার জীবনে কেউ নাই।”
তখন আনজুমান লাথি দিয়ে আপাকে পা থেকে সরিয়ে বলেছিল
“তোর মতো মেয়ের পোলার অভাব হবে নাকি! একটা গেছে আরও পাবি। নতুন নতুন পোলার সঙ্গ পাবি। তোর তো খুশির দিনেই আসছে।”
আপা ঠিক আনজুমানের মতোই অবাক হয়ে বলেছিল।
“একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে এভাবে বলতে খারাপ লাগল না?”
আনজুমান তখন মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। আজকে যেন সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। শুধু চরিত্রের বিপরীত প্রতিফলন ঘটেছে। কীভাবে যেন আপার অত্যাচারীরা ঠিক আপার মতোই শাস্তি পাচ্ছে। আনজুমানের এ হাল দেখে আজকে মনে ভীষণ শান্তি লাগছে। আনজুমান এবার নড়ে চড়ে বসলো। আনহারির পা ছাড়িয়ে গুটিসুটি মেরে রইল। তারপর আবার বলল,
“আমি সে সময়টায় ভুল করে ফেলেছি। মানুষেই তো ভুল করে অনন্যা। আমি তো ভুল করে ফেলেছি এখন তো চায়লেও শুধরানোর সুযোগও নেই। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি নিজেও তো তাদের হাতে জিম্মি ছিলাম। স্বামীর কিছু ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি থাকি। এখন যদি মা, ভাইয়ের কথা না শুনতাম তাহলে তো আমাকেও বের করে দিত। নিজের পায়ের মাটি শক্ত করতেই আমি এমনটা করেছি।
আনহারি মাটিতে থুথু ফেলে বলল
” যে স্বামীর আপনাকে খাওয়া পরার ব্যবস্থা করার সাহস নেই। শ্বশুড় বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে বাহাদুরি করে। সে স্বামীর জন্য কাঁদছেন? যে স্বামীর জন্য মা ভাইয়ের বা/ন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে সে স্বামীর জন্য আপনার এত মায়া লাগছে? যার চরিত্রের ঠিক নেই তাকে আপনি বাঁচাতে চাচ্ছেন? তার জন্য আপনার এত মায়া? আর আমি কিছুই করিনি, তখন আমাকে আপনিই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছেন। তখন তো একটা মেয়ে হেয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। আপনি নিজেও একজন নিকৃষ্ট মহিলা। আমি এ মামলা তুলব না। আপনার স্বামী ফাতেমাকেও খুন করেছে সেটা আপনাদের আড়াল হলেও আমার আড়াল হয়নি। “
আনজুমান কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ফাতেমা খুন হবে কেন? তিনমাস আগেও তার সাথে আমার দেখা হয়েছে।”
“দু মাস আগে আপনার স্বামী ফাতেমাকে খুন করেছে৷ ফাতেমার সাথে আপনার স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক এ পর্যন্ত বহাল ছিল। তাদের ঘরে চার বছরের একটা ছেলে সন্তানও আছে। এতদিন সংসারটা সবার আড়ালে গিয়ে করেছিল। তিনমাস আগে ফাতেমা এসেছিল নিজের অধিকার আদায় করে নিতে। আপনার স্বামী তাকে কোনো রকম বুঝ দিয়ে পাঠিয়েছে। তার সাথে যে ছেলে সন্তান ছিল সেটা আপনার হাসবেন্ডের। ফাতেমা চলে যাওয়ার তিনদিন পর ফাতেমার ছেলেকে আপনার স্বামী বোর্ডিং এ ভর্তি করায় আর ফাতেমার লাশ পাওয়া যায় নদীতে। ফাতেমার পরিচিত এ দুনিয়ায় ঐরকম কেউ না থাকায় ফাতেমার লাশটা বেওয়ারিশ বলে দাফন করা হয়।
এমন একটা মানুষের জন্য কাঁদছেন? যে আপনাকে দিনের পর দিন ঠকিয়েছে।”
আনজুমান বসা থেকে শুয়ে পড়ল। বাচ্চাদের মতো গড়াগড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল
“আমি এটা বিশ্বাস করি না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব না।”
দীপক এবার রেগে গিয়ে আনহারির কাছে এসে বলে উঠল,
“মনগড়া গল্প বলে আপাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন তুমি? তোমার নাটক গুলো বন্ধ করবা? ফাতেমাকে যে দুলাভাই মেরেছে তার কী প্রমাণ আছে তোমার? আর ফাতেমার বাচ্চা যে দুলা ভাইয়ের সেটার কোনো ভিত্তি আছে?”
আনহারি অট্ট হাসলো। অট্ট হেসে এবার যা বলল তা শুনে আমার হাত পা রিতীমতো কাঁপছে।
কপি করা নিষেধ। আর যারা কপি করেন দয়াকরে কার্টেসী সহ পেইজে পোস্ট করার ৩ ঘন্টা পর করবেন। অন্যথায় স্টেপ নিব।
শারমিন নিপা শারমিন আক্তার