#শারমিন আঁচল নিপা
“ফিয়না তোর বাবা কাল থেকে খুব অস্থির ছিল। রাত তখন বারোটা। কাজ সেরে বাসায় আসে। খাবার দিলাম। না খেয়ে বসে আছে। কী যেন ভাবছে। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। সে কোনো উত্তর দিল না। চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইল। আমার কাছে মনে হলো শরীর খারাপ। তাই কাছে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম
” আপনার কি কিছু হয়েছে? হলে বলুন। শরীর খারাপ লাগছে? কাজের জায়গায় কি কোনো সমস্যা হয়েছে? টাকা পয়সা নিয়ে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
টাকা পয়সার কথা বলতেই তোর বাবা কেঁদে উঠল। তোর বাবার কান্না দেখে ভাবলাম হয়তো টাকা পয়সার সমস্যা চলছে। জিনিস পত্রের যে দাম আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি। তাই আশ্বাস দিয়ে বললাম
“তুমি চিন্তা করো না। ফিয়নার চাকুরি হয়েছে। সে তো আয় করবে এখন। তার আয় দিয়েই আমরা ভালো করে চলতে পারব। বেতনও ভালো পাবে। এত চিন্তা করে শরীর খারাপ করার দরকার নেই। “
আমি এসব বলার পরও তোর বাবা বারবার কাঁদতেছে। আমি বুঝতে পারছি না এত কেন কাঁদছে সে। বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে তার দুটো হাত দিয়ে আমার দুটো হাত চেপে ধরে বলল
“অনন্যার মা আজকে একটা কথা বলব তুমি শুনার পর কষ্ট নিও না। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।”
আমি ভাবলাম হয়তো তোর বাবা কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছে, তাই এমন বলছে। সেজন্য একটু অভিমানী সুরেই বললাম
“আমাকে রেখে কি তুমি অন্য কোনো মেয়ের কাছে গিয়েছো?”
সে আমার কথার প্রতি উত্তরে বলল
“এমন করলে আমি কষ্ট পেতাম না। অনন্যার মা অনন্যার খু/নে আমি জড়িত ছিলাম। অনন্যার অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে বরং তাদের আরও সুযোগ করে দিয়েছিলাম।”
তোর বাবার কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাবা কী করে মেয়ের খু/ন করতে পারে সেটাই আমি বুঝতে পারছিলাম না। অনন্যার প্রতি আমাদের অনেক ক্ষোভ ছিল। তবুও যতই হোক আমরা তার বাবা, মা। তাকে লালন পালন করেছি। একটা মায়ার বাঁধন তো আছে। কুকুর পাললেও তার প্রতি মায়া জন্মায় অনন্যা তো মেয়ে ছিল। এটা আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একদম নির্বাক হয়ে পড়ি।
তোর বাবা কাঁদতে কাঁদতেই বলল
“অনন্যা সন্তানসম্ভ্যাবা ছিল। দীপকের সন্তান অনন্যার পেটে ছিল। আমাকে সে বলেছিল দীপকের কাছে যেন নিয়ে যাই। ভাঙা সংসারটা হয়তো সন্তানের সেতু ধরেই জোড়া লাগতে পারে। তাই আমি অনন্যাকে নিয়ে দীপকের কাছে গিয়েছিলাম। দীপক আমাদের বলল সে সব ঠিক করে নেবে। তবে একটা শর্ত অনন্যার বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে হবে। কারণ সব ঠিক করার পর এ বাচ্চার উপর সবাই আঙ্গুল তুলবে। যেহেতু অনন্যার পরকিয়া আছে এমন কিছু রটেছে। অনন্যা একদম চাচ্ছিল না বাচ্চাটা নষ্ট হোক। আমিই তাকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। যতই হোক মেয়ের সংসার ঠিক করতে হবে তো। ডিভোর্সি মেয়েকে কে বিয়ে করবে। এদেশে একটা ডিভোর্সি ছেলে কুমারী মেয়ে বিয়ে করলেও একটা ডিভোর্সি মেয়ে তা পারে না। সমাজ খুব বাজে চোখে তাদের দেখে। আমি তো দীপকের দাবার চাল বুঝিনি। সে আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল।
বাচ্চা নষ্ট করার পর বেশ কয়েকবার আমি দীপকের কাছে যাই। কিন্তু দীপক সাফ সাফ জানিয়ে দেই সে আর অনন্যাকে মেনে নিবে না। কার না কার বাচ্চা পেটে বাজিয়ে আমরা নাকি তাকে ফাঁসাতে চাচ্ছি। বিষয়গুলো আমি অনন্যাকে গোপন রাখতে বলেছিলাম। কারণ এটা যদি আবার রটে তাহলে আর অনন্যাকে চাইলেও বিয়ে দিতে পারব না। তাকে বিয়ে দেওয়া আরও কঠিনতর হয়ে যাবে।
অনন্যা বারবার আমার কাছে এসে বলত
” বাবা চলেন আরও একবার গ্রামের লোকজন নিয়ে বসি।”
তবে আমার সাহসে কুলায়নি। কারণ ঘুরে ফিরে দোষ অনন্যারেই হত। সমাজের নিয়মটাই যে এমন।
অন্যনার যেদিন মৃত্যু হয়, আমি সেদিন শেফালিদের বাড়িতে ধান উঠিয়ে সকাল ৪ টা ৩০ টায় বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সারারাত ধান তুলে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি ফিরছি। তখনও আলো ফুটে নি। দীপকদের জাম গাছের তলা দিয়েই আসতে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে চোখে পড়ে আনজুমানের স্বামী আর তাদের বাড়ির দারোয়ান কাউকে গাছে ঝুলাচ্ছে। লাশটা গাছের ডালে দড়ি দিয়ে উপরে তুলছে। আলো ফুটেনি তাই বুঝতে পারিনি কার লাশ।
লাশ ঝুলানোর পর লাশটাকে ডালেই ঠেক দেওয়া হয়েছিল। আমি সেখানে পৌঁছাতেই আনজুমানের স্বামী চমকে গেল। আধো আধো আলোতে লাশটাকে দেখে আমি জোরে চিৎকার দিতে নিলাম। কারণ অনন্যা
ছিল। আমি চিৎকার দেওয়ার আগেই আনজুমানের স্বামী আমার মুখ চেপে ধরল। আমার দিকে তেড়ে এসে বলল
“যা হবার হয়ে গেছে। চায়লেও এ মেয়ে বিয়ে দিতে পারতেন না। ঘরের মরা হয়ে থাকত। দুটো অপশন দিচ্ছি হয় এখন আপনাকে প্রাণে মারব নাহয় পাঁচ লাখ টাকা দিব একদম মুখ বন্ধ রাখবেন। ভুলে যাবেন না আপনার আরও একটা মেয়ে বিয়ে দেওয়া বাকি। এ মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের জীবন নষ্ট করবেন না।”
আমার যে তখন কী হলো জানি না। ফিয়নার কথা চিন্তা করে আর পাঁচ লাখ টাকার লোভে পড়ে আমি রাজি হয়ে যাই। সবটা চেপে যাই। নিজের মনকে বুঝ দেই যা হওয়ার তো হয়ে গেছে। আর এটা নিয়ে দৌড়ে লাভ কী। অনন্যাকে তো পাব না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামে হই হই শুরু হলো। অনন্যার ঝুলে যাওয়ার খবর পৌঁছে গেল পুলিশের কাছে। তারা অনন্যাকে নিয়ে যায়। এরপর তো সবটা জানই তুমি। সেদিন যদি আমি লোভ না করতাম তাহলে অনন্যার খু/নীরা আজকে এত আয়েশ করতে পারত না। এত মজায় থাকত না। আমার লোভের জন্য আমার মেয়ের খু/নীরা শাস্তি পায়নি।
তোর বাবার কথা শুনে আমার শরীর জ্বলতে লাগল। আমি মা যাই করিনা কেন নিজের সন্তানের খু/নীকে কখনও ক্ষমা করতাম না। দশ মাস অনন্যাকে পেটে ধরেছি আমি। নাড়ির টান বলেও একটা কথা আছে ফিয়না। তোর বাবার কথা শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে তোর বাবাকে বলতে লাগলাম
“আমার মেয়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় কী করে করলে তুমি? একটা বার ও অনন্যার আত্মার কথা চিন্তা করলে না?
ওর আত্মা কী শান্তি পেল বলো?”
আমার এ কথা শুনার পর তোর বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলল
“আমার মেয়ের আত্মা শান্তি পায়নি বলেই এত বছর পর সে ফিরে এসে আমাকে ধরেছে অনন্যার মা। আমি আর এ জীবন রাখব না অনন্যার মা। অনন্যা এসে আমার কাছে এসবের জাবাব চায়। আমি যেখানে যাই সেখানেই অনন্যা এসে আমাকে কথা শুনায়।”
এ কথা শুনার পর আমি ভেবেছিলাম তোর বাবা হয়তো নিজের মেয়ের শোকে এমন করছে। আমিও নিয়তি মেনে নিয়ে তোর বাবাকে বুঝ দিলাম
“যা হয়েছে ভুলে যাও। অনন্যাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করছো তাই এমনটা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। আল্লাহ ক্ষমা করে দিলেও আমি হয়তো পারব না। আর তারা তো তোমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল। সেটা কী করেছিলে? সে টাকা হজম করতে পেরেছো।”
তোর বাবা হুহু করে কেঁদে দিয়ে বলল
“সে পাঁচ লাখ টাকা তারা দেয় নি। মেয়ের লাশ নিয়ে নিয়ে ঘুরেছি। কেউ দাফন করার জায়গা পর্যন্ত দেয়নি। পাঁচলাখ টাকার জন্য গিয়েছিলাম তারা বলেছে আমি যদি বলি তারা খুন করেছে তাহলে তারাও বলবে এতে আমি জড়িত। আমার কথা রেকর্ড করে রেখেছিল তারা। সবমিলিয়ে আমি আর টাকা পাইনি। লোভ আমার সব কেড়ে নিছে। এরপর ফিয়নার কথা ভেবে এটা নিয়ে আর বাড়বাড়ি করিনি।”
“আজ এত বছর পর এসব সামনে এনে তোমার লাভ হলো কী? আমার চোখে তোমাকে অপরাধী বানালে। আর কখনও তোমার দিকে তাকিয়ে আমি হাসি মুখে কথা বলতে পারব কিনা জানি না। গোপন যেহেতু ছিল গোপনেই রাখতে।”
“না রে অনন্যার মা। আমার মেয়ে আমার পিছু নিয়েছে তাই গোপন রাখতে চাইলেও পারতাম না। সব ফাঁস হয়ে যেত। আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে শাস্তি দিব।”
এসব বলে কাঁদতে লাগল তোর বাবা। আমি আর কথা বাড়াইনি। রুমে গিয়ে বসে আমিও কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকাল বেলা কারও স্পর্শ অনুভব করলাম পায়ে। চোখ খুলতেই দেখলাম অনন্যা।।আমি চোখ খুলতেই সে চোখের পলকে রুম থেকে বের হয়ে গেল।।আমি তার পিছু নিয়ে বের হতে গিয়ে তোর বাবার ঝুলন্ত লাশটা চোখে পড়ে। এরপর তো পুলিশ আসে৷ লাশ নিয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে শুধু অনন্যার আত্মা এসে তার প্রতিশোধ নিয়ে গেল।
আমি মায়ের কথা শুনে ভাবতে লাগলাম সেটা আসলেই অনন্যার আত্মা ছিল নাকি অন্য কেউ? আনহারির এখানে আসা সম্ভব না। কারণ আনহারি কুঁড়গাও ছিল। কুঁড়গাওয়ের দূরত্ব ঢাকা থেকে অনেক। তাই চায়লেও সে আসতে পারবে না। তবে সে মেয়েটি আসলেই কী মায়ের মতিভ্রম ছিল নাকি অন্য কিছু?
মাথাটা বিগড়ে যাচ্ছে আমার। এর মধ্যেই আনহারির কল আসলো। আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তার কল ধরলাম। সে সাথে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেলাম। বিগড়ে যাওয়া মাথাটা আরও বিগরে গেল।
কপি করলে নাম সহ করতে হবে। আর পেইজে পোস্ট করার তিন ঘন্টা পর করতে হবে। এ রুলস মেইনটেইন না করলে আমি এর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিব।
সবার আগে গল্প পেতে নীল লেখায় চাপ দিয়ে লাইক ফলো দিন শারমিন আঁচল নিপা । Sharmin Achol Nipa
শারমিন নিপা