#শারমিন আঁচল নিপা
ঘরটা পুরো অন্ধকার হয়ে আছে। কারও সাড়া শব্দ নেই। আনহারি কোনোরকম মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে আই পি এস টা অন করল। ঘরের লাইটগুলো জ্বলে উঠল। সে লক্ষ্য করল কেউ একজন কারেন্টের মেইন সুইচটা অফ করে দিয়েছে। সে দ্রূত মেইন সুইচ অন করল। রুদিতা ড্রইং রুমের একটা টেবিলের নীচে গুটিসুটি মেরে বসে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে? কারণ ড্রইং রুমের সব স্বাভাবিক ছিল। রুদিতা আলো জ্বলতেই যুক্তিকে দেখে দৌঁড়ে আসল। যুক্তিকে জড়িয়ে ধরে রাখল। আনহারি রুদিতাকে ধরতে গেলে সে আনহারিকে ভীষণ ভয় পেতে লাগল। বিষয়টি আনহারি বুঝতে পেরে রুদিতার কাছে আর গেল না। সে সরাসরি বাড়ির প্রতিটা ঘর খোঁজ করতে লাগল কিছু হয়েছে কি’না।
প্রথমেই গেল তার মা লাবন্য জোহার ঘরে। লাবন্য জোহা ঘুমুচ্ছে। এখানে কিছু হয়েছে সে ব্যাপারে সে হয়তো কিছুই বুঝতে পারেনি। পারলে এভাবে শান্তিতে ঘুমাত না। এবার সে ফিয়নার রুমে গেল। ফিয়না বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। তার সাথে তার হাত পা বাঁধা। আনহারির কাছে ব্যাপারটা কেমন জানি বিদঘুটে লাগছে। কারণ ঘরে কে এসেছিল বুঝতে পারছে না৷ কোনোরকম চুরির আভাস পায়নি সে৷ সে সাথে ঘরের সব জিনিস পত্র যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই আছে।
এবার আনহারি প্রবেশ করল তার রুমে। তার রুমে যেতেই সে চমকে উঠল। একমাত্র তার রুমেই ভাঙচুর হয়েছে। তার রুমেই লন্ড ভন্ড হয়ে আছে। সে সাথে বাসার দুই দারোয়ান এবং বাসার দুই আয়ার হাত মুখ বেঁধে এ রুমেই ফেলে রেখেছে। আনহারি দ্রূত গিয়ে দারোয়ান গুলোর হাত পা খুলল। তারপর আয়া দুজনের। আয়া দুজনের মানসিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে তারা রুমেই যেভাবে বসা ছিল বাঁধন খুলে দেওয়ার পরও সেভাবে বসে আছে।
দারোয়ান গুলো বাঁধন খুলার পর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। হাত দিয়ে ইশারা করল পানি খাবে তারা। আনহারি দ্রূত পায়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে পানি এনে তাদের দিল। তারা চারজনেই আনহারিকে দেখে ভয় পেতে লাগল। আনহারি বিষয়টি বুঝতে পেরে দারেয়ানকে জিজ্ঞেস করল
“তোমরা কী আমাকে ভয় পাচ্ছ? আর তোমাদের এখানে কে বেঁধে রেখেছে? কে এসেছিল? কারা এমন করেছে?”
তারপর দারোয়ান গুলো উত্তরে যা বলল সেটা এক রোমাঞ্চকর থ্রিল ঘটনার রূপ দিল। তারা উত্তরে বলল
“আপনি বের হওয়ার আধা ঘন্টা পর আপনি এবং আপনার সাথে দুজন ছেলে বাসায় আসে। আমরা ভেবেছি গাড়ি হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে তাই আপনি হেঁটেই বাসায় ফিরেছেন। আপনার সাথে কে আছে সেটা তো জিজ্ঞেস করার স্পর্ধা রাখি না আমরা। স্বশরীরে আপনি নিয়ে আসছেন মানে আপনাদের পরিচিতই হবে। আপনি তাদের নিয়ে রুমে প্রবেশ করার প্রায় ২০ মিনিট পর আমাদের ভেতরে যেতে বলা হয়। আপনার সাথে আসা দুজন ভদ্রলোকের মধ্যে একজন আমাদের ডেকে ভেতরে আনে। আমরা আসতেই দুজন মিলে আমাদের বেঁধে ফেলে। এরপর আপনি আলমারি খুলে কী যেন দেখেন। দেখার পর আপনার ইশারায় লোক দুজন ঘরের সকল ছবি ভেঙে দেয়। এরপর চলে যায়। আপনিও বের হয়ে যান৷ “
আয়াদের জিজ্ঞেস করলেও তারাও একই বয়ান দেয়। আনহারির মাথা ঘুরছে। তাহলে কী অনন্যা এসেছিল? কারণ সে তো আসে নি। সে ছিল অনুভূমিক প্রান্তর বাসায়। তাহলে যে এসেছিল সে নিশ্চয় অনন্যা। আমাদের সাথে হয়তো কেউ মাইন্ড গেম খেলছে। নাহয় অনন্যা নিজেই আমাদের সাথে কোনো কিছুর অভিমান ঝাড়ছে। আনহারি আয়াদের এবং দারোয়ানদের জিজ্ঞেস করল
“তোমরা কী পাশে যারা ছিল। মানে বাকি দুজন লোকের বর্ণণা দিতে পারবে?”
আয়াগুলো বলে উঠল
“তাদের মুখে মাস্ক ছিল। তাই তারা দেখতে কেমন আমরাও জানি না।”
আনহারি কিছুটা রেগে দারোয়ানকে বলল
“এ গরমে এভাবে দুজন লোক এসেছে আর তোমরা ঢুকতে দিয়েছো? একটুও বাঁধা দিলে না?”
তারা কাঁপতে কাঁপতে বলল
“ম্যাডাম আপনার সাথে তারা এসেছিল। তাহলে বাঁধা দেই কী করে। আমরা তো এখনও বুঝতে পারছি না আপনি এসেছিলেন নাকি অন্য কেউ।”
আনহারি হালকা একটা ঢোক গিলে তাদের রেস্ট নিতে বলল। এরপর যার যার কাজে যেতে বলল। যুক্তি সব শুনেই গেল। রুদিতা ভয় পেয়ে যাওয়ায় তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না। যুক্তিকে আনহারি বলল
“তুমি পাশের রুমে একটু বিশ্রাম করো। আমি পুলিশকে ইনফর্ম করি। বিষয়টার শেষ প্রান্তে আমি গিয়েই ছাড়ব। এতদিন তো সব মনের ভুল ভেবে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে এটা মনের ভুল না। আমার সাথে বড়ো কোনো খেলা চলছে। হয়তো অনন্যা নিজেই সেটা করছে। এর কারণ তো আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে৷ কিছু তো একটা রহস্য আছেই। আমাদের উপর হয়তো তার কোনো একটা রাগ আছে। তাই বুদ্ধি করেই এমন করেছে। অনুভূমিক প্রান্তর কাছে অন্য একটা মেয়েকে অনন্যা সাজিয়ে নিয়ে গেছে। যাতে করে আমরা সেখানে চলে যাই। আর সে যেন সে মুহুর্তে এখানে আসতে পারে। আর যেহেতু সে দেখতে আমার মতো সেহেতু এখানে ঢুকতে কেউ তাকে বাঁধা দিবে না। আর সেটাই হলো। কিন্তু সে কেন এসেছিল। শুধুমাত্র আমার ছবিগুলোর উপর রাগ ঝাড়তে এসেছিল। নাকি আরও অন্য কোনো কারণ ছিল। সব গুলো প্রশ্নের উত্তর আমি চাই।”
যুক্তি আনহারির কথা শুনে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। না চায়তেও সে যেন রহস্যের ফাঁদে চলে এসেছে। যুক্তির এখন রুদিতাকে ইজি করতে হবে। তাই রুদিতাকে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। এদিকে আনহারি পুলিশকে কল দিয়ে সবটা জানাল। পুলিশ আনহারির কল পেয়ে ঘটনা স্থলে এসে সবটা শুনে অবাক হলো। কারণ পুলিশের প্রশ্ন
“আপনার জমজ বোন মারা গেছে তাহলে সে আবার বেঁচে ফিরে কী করে। আচ্ছা আমরা তো ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি। তাই সেটা করে চলে যাচ্ছি। আপনার কেইসটা আমাদের কাছে জটিল লাগছে। আমরা এ বিষয় নিয়ে আমাদের সিনিয়র অফিসার আনামের সাথে কথা বলব। এবার উঠি আমরা।”
আনহারির পুলিশদের বিদায় দিয়ে ড্রইং রুমের দেয়ালে তাকাতেই একটু চমকে উঠল। সে খেয়াল করল অনন্যার একটা স্থির চিত্র বিভোর এঁকেছিল সেটা টানানো ছিল ড্রইং রুমে। সে সেটা নিয়ে গেছে৷ অথচ একই রকমের আঁকা আনহারির স্থির চিত্রটা রেখে গেছে। তাহলে এটা জানান দেয় অনন্যা বেঁচে আছে। কিন্তু অনন্যা কেন তাদের উপর হামলে পড়ছে এটাই মূল বিষয়।
এদিকে আয়ারা পুলিশ যাওয়ার পর ঘর পরিষ্কার করে ফেলল। আনহারি নিজের ঘরে এসে এসবেই ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেল সে। ফজরের আযানে তার ঘুম ভাঙলো। উঠেই ঘরে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর আবার নিজের জায়গায় এসে বসল। কিছুক্ষণ বসে থেকে লাবন্য জোহার ঘরে গেল। লাবন্য জোহার রুমে গিয়ে ডায়পার চেন্জ করে দিল তার। কারণ সার্বক্ষণিক নার্স তিনজন ছিল। রাতে যার ডিউটি করার কথা ছিল সে আসতে পারে নি। তার অসুস্থতার জন্য। তাই আনহারি নিজেই লাবন্য জোহাকে পরিষ্কার করে নাস্তা খাইয়ে দিল। লাবন্য জোহা কেবল শুয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। কথাও সে বলতে পারে না৷ লাবন্য জোহাকে খাইয়ে সে তার রুমে আসলো। ততক্ষণে ৭ টা বেজে গেছে।
বাসার বাকিরা উঠল। ফিয়না একটু স্বাভাবিক হলো। গতরাতের ঘুম তাকে একটু মানিয়ে নিতে সহয়তা করেছে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে সে। যুক্তি আনহারিকে বলল
“আমার যেতে হবে। আজকে কোনোভাবে হাসপাতাল থেকে লীভ নিলেও কাল পারব না। আর রুদিতাও ভীষণ ভয় পাচ্ছে। তাই চলে যাওয়ায় ভালো হবে।”
আনহারি যুক্তিকে বলল
“নাস্তা খেয়ে তারপর যাও।”
সবাই একসাথে নাস্তা করল। ততক্ষণে ১০ টা বেজে গেছে। আনহারির মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো। মেসেজটি হলো তার ব্যাংক একাউন্ট থেকে ৮০ লাখ টাকা উইথ ড্র করা হয়েছে। আনহারি চমকে গেল মেসেজ টি পেয়ে। সে দ্রুত ব্যাংকে কল দিলে তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল। কারণ তাদের ভাষ্যমতে কিছুক্ষণ আগে সে নিজেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে। সে সাথে আরও একটি রহস্যময় ঘটনা বলে উঠল। যার জন্য কাহিনির একটা নতুন মোড় নিল।
কপি করা নিষেধ