পাত্রীপক্ষ থেকে পাত্রীর বাবা, মা, বড় মামা, বড় ভাই, ভাবি তাদের সাত আট বছরের ছেলে আর পাত্রী নিজে এসেছে আমাকে দেখতে।
পাত্রী আমার পরিচিত। আমাদের তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক। আমার চাকুরী হবার পরে কবে যাবো তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, তুমি আমার বাসায় আসবা কেন? বিয়ের পর যদি আমাকে তোমার বাসাতেই থাকা লাগে তাহলে আমার উচিত তোমাকে আগে দেখতে যাওয়া। তোমার বাসায় থাকার মত আমার পরিবেশ আছে কিনা তা জানতে হবে তাই না? আমার পছন্দ হলে তারপর তোমরা আসবা আমার বাসায়।
-এগুলা কি কও না কও? আর আমার বাসার খোঁজতো তোমরা নিবাই। তবে আমরা আগে যাবো তোমাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে, তোমাকে দেখতে, এটাই তো নিয়ম তাই না?
-নাহ এটা কোনো নিয়ম না। এটাকে নিয়ম করে ফেলছে কিছু মানুষ। আর আসলে তোমাকে আমার দেখার কিছু নাই। তোমাকেতো আমি গত তিন বছর ধরে দেখতেছি। এখন আমার বাবা দেখবে, মা দেখবে।
-সেটাতো দেখবেই। আমাদের বাসাতে যাবে সমস্যা নাইতো!
-সমস্যা আছে। আব্বু বলে দিয়েছে আগে তোমাকে দেখতে যাবো আমরা তারপর বিয়ের কথা আগাবে এর আগে না।
আম্মাকে সব খুলে বলার পরে আম্মা বললেন, ওরা আসবে তোকে দেখতে সমস্যা কি? আসুক! মেয়ে বিয়ে দিবে আর ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে না? আসুক।
আমি, আম্মা যত সহজ মনে করেছিলাম বিষয়টা এতো সহজ না ব্যাপারটা বুঝলাম যখন আমাকে নীতুর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি কি রান্না করতে পারো?
আমি একবার আম্মার দিকে একবার আব্বার দিকে তাকিয়ে বললাম, আংকেল একবার ডিম ভুনা করেছিলাম। আমার কথা শেষ করার আগেই আব্বা বললেন, সেই কথা মনে করাইস না! আমার এখনো পেট মোচড় দেয় তোর ডিম ভুনার কথা মনে পড়লে! আল্লাহর দুনিয়ায় অভিশপ্ত সেই দিনের কথা আর মনে করাইস না!
আব্বার কথা শুনে নীতুর বাবা বললেন, বাবা তুমি ঘর দুয়ার পরিষ্কার করো কখনো? তোমার জামা কাপড় কে ধুয়ে দেয়?
-জি বুয়া আছে।
-কখনো বুয়া না আসলে?
-আম্মা ধুয়ে দেয়।
-বাবা একটা কথা বলি, এক সময় তোমার বাবা মা বা আমরা কেউ থাকবো না। তখন তুমি আমার মেয়ের সাথে কীভাবে সংসার করো আমরা জানবো না। কিন্তু আমরা বেঁচে থাকতে বিশেষ করে আমি বেঁচে থাকতে দেখে যেতে চাই আমার মেয়ে এমন একজনের সাথে সংসার করছে যে আমার মেয়ের সবকিছুর অংশীদার হবে যেমন সুখে দুঃখে তেমনি কাজেও!
সংসারের কাজ দুজনে ভাগাভাগি করে করবে এমন ছেলের কাছেই আমার মেয়ে বিয়ে দিবো! ধরো মান অভিমানের সময় নীতু রান্নাবান্না বন্ধ করে দিলে তোমাকেতো না খেয়ে থাকতে হবে। তাই নিজের জন্যে হলেও রান্নাটা শেখা দরকার না? বাসায় বুয়া না আসলে কি ময়লা শার্ট গায়ে অফিসে যাবা?
তোমাকে ঘর পরিষ্কার করাও জানতে হবে। আমার মেয়েকে আমি তোমার হাতে তখনই তুলে দিবো যখন তুমি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবে তুমি সংসার কাজ ভাগাভাগি, সংসার করার উপযোগী! ছয়মাসের সময় দিলাম তোমাকে। রান্নার শেখার কোর্সে ভর্তি হতে হবে এবং ছয় মাস পরে আমার পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানোর পরেই আমরা ফাইনাল করবো তোমাদের বিয়ে হবে কি হবে না।
নীতুর বাবা কথা শেষ করে নিতুর মামাকে বললেন, আমার যা বলার আমি বলেছি এখন তোমাদের কিছু বলার থাকলে, জিজ্ঞেস করার থাকলে জিজ্ঞেস করো। নীতুর মামা নেড়ে বুঝালেন আমার কিছু বলার নাই তখন নীতুর ভাইয়ের সাত আট বছরের বদ ছেলেটা বলল, আংকেল আপনার দাঁত দেখি! হা করেন প্লিজ!
সবাই তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালেও আমি সত্যি সত্যি দাঁত বের করে দেখাচ্ছি বদটাকে!
নীতুর বাবা মা চলে যাওয়ার পরে আব্বা বললেন, আমিতো আদিম যুগে বিয়ে করে বেঁচে গেছিরে। তোর আম্মাই তো সারা জীবন রান্না করলো। এখন যুগ বদলাইছে। নীতুকে বিয়ে করতে চাইলে রান্নার কোর্সে ভর্তি হয়ে যা আর ঘরের কাজ কর্ম শিখে ফেল। আমার বউয়ের হাতে রান্না আর কতদিন খাবি গাধা?
অবশ্য আমিও ভুল করেছি। রান্নার কোর্স জানলে তোর আম্মা রাগ করে রান্না বন্ধ রাখলে না খেয়ে থেকে নিজেই রান্না করে খাইতে পারতাম। আর নিজের কাজ নিজে করতে পারাটা স্মার্টনেস বলে বুঝছিস? যা তোর আম্মাকে বল চা দিতে। আম্মাকে চায়ের কথা বলতেই বললেন, বাপ ছেলে মিলে চা বানায়া খা! আমি আর একা ঘরের কাজে নাই। বাপ বেটা দুজনে ভর্তি হ রান্নার কোর্সে।
আব্বা মিথ্যে মিথ্যে কোমরের ব্যথার অভিনয় করে আম্মার কাছে ক্ষমা পেলেও আমাকে নীতুর জন্য ভর্তি হতে হলো রান্নার কোর্সে। এই মেয়েকে পাওয়ার জন্য রান্না কেন আমি প্লেন চালানো শিখতেও রাজি। আবার কোনদিন নীতুর বাপ না সত্যি সত্যি বলে বসে, আমার মেয়ের তারা ছোঁয়ার ইচ্ছে হলে রকেট চালিয়ে তারা ছুঁইয়ে আনতে হবে তোমাকে! দেখি বাবা ছাদ থেকে একটা লাফ দিয়ে উড়ে দেখাও!
আমি রোজ অফিস শেষে রান্নার ক্লাসে যাই আর আমার সঙ্গি হয় নীতু। আমার রান্নার কোর্সে যা শিখি তা রান্না করে নীতুকে দেই টেস্ট করতে আর প্রতিবার সেইসব খাবার খেয়ে বমি করে সে। একবার তো বলেই বসলাম, তুমি ইচ্ছা করে বমি করো! আমারে বিয়ার শখ না থাকলে বলেই দাও আমি সারা জীবন একা থাকবো!
এমন ডিমচপ তোমাদের সারা গ্রামের মানুষ খাইছে কোনদিন? দাঁড়াও দেখো রিকশাওয়ালা মামাকে দেই এই চপ, দেখো মামা খেয়ে কী বলে! কী মামা কেমন হইছে?
রিকশাওয়ালা মামা রিকশা থামিয়ে বললেন, মামা একটু কুলি কইরা আসি! এমন নিষ্ঠুর চপ এই গরীবের জীবনে গরীব কোনোদিন খায় নাই মামা! আপনার ভাড়া লাগবো না আপনেরে রিকশায় নিমু না!
রিকশাওয়ালার কথা শুনে নীতু তার হাসি আটকে রাখলেও তার সারা শরীর হাসিতে কাঁপছে বুঝতেছি। তা দেখে আরো রাগে বললাম, এই রিকশাওয়ালা শিওর তোমাদের গ্রামের মানুষ এইজন্যে এই চপের মর্ম বুঝে নাই। এইভাবেই চলতে থাকে আমার রান্না শেখা!
ছয়মাস শেষে আজ নীতুর পরিবার আসবে আমার রান্নার টেস্ট করতে। রান্নার উপরে নির্ভর করে নীতুর আমার সংসার হবে কি হবে না। নীতুর বাবা ফোন করে বলে দিয়েছেন কাচ্চি রান্না করতে।
এবং কাচ্চি রান্নার সময় পরীক্ষক হিসেবে নীতুর মামা আমার পাশে থাকবেন যেন কোনো রকম নকল ও অসৎ উপায় অবলম্বন করতে না পারি। একবার ভাবলাম যা আছে কপালে! বিষ মিশিয়ে পুরা পরিবার শেষ করে দেই!
নীতুরে দরকার হলে বাইরে থেকে কাচ্চি এনে খাওয়াবো কিন্তু নীতুর মামা পাশে বসে একটু পর চা খাচ্ছেন আর গোৎ গোৎ করে শব্দ করছেন। গরীবের গরীব জীবনেও কাচ্চি খায় নাই মনেহয়।
রান্নার টেবিলে সবাইকে কাচ্চি বেড়ে আমি নীতুর বাবা রায়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে করুণাময়কে ডাকছি! করুণাময় এই জীবনে আমি নীতুকে ছাড়া তোমার কাছে কিচ্ছু চাই না।
আমি ঘরের সব কাজ করবো। নীতুর প্রতি কাজে তাকে সাহায্য করবো। তুমি শুধু তাকে আমার করে দাও। এই নীল শাড়ি নীল টিপ দেয়া মেয়েটা আমার পাশে না থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এই মেয়ের গেজ দাঁতের হাসি না দেখে আমি থাকতে পারবো না। তুমি এই মেয়েকে আমার করে দাও করুণাময়! বিনিময়ে রোজ দুবেলা গরীবকে কাচ্চি খাওয়াবো তবুও এই মেয়েকে আমি চাই!
আমার করুণাময়কে ডাকাডাকি থামে নীতুর বাবার ডাকে!
-বাবা কাচ্চির আসল জিনিসটা কি জানো? কাচ্চির আলু! কাচ্চির আলু হতে হবে প্রেমিকার হাতের মত কোমল! আলুতে চাপ দিলেই কুয়াশার মত গরম ভাপ বের হবে। মনে হবে কনকনে শীতে গরম গরম উষ্ণতা!
কিন্তু তোমার কাচ্চির আলু হয়েছে পালোয়ানদের হাতের মত শক্ত! এই আলু দিয়ে তুমি বল বানিয়ে ক্রিকেট খেলতে পারো আবার যে কারো মাথায় মেরে অজ্ঞান করে দিতে পারো। তবে যাইহোক, কাচ্চির মাংস আর চাল পারফেক্ট ছিল। আমি ডিসিশন নিলাম নীতুর আর তোমার বিয়ের কাচ্চি তোমাকে দিয়েই রান্না করানো হবে। সবাই বলেন, আলহামদুলিল্লাহ!
নীতুর বাবা নীতুর মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার কথা শেষ তোমাদের কারো কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করো।
নীতুর মামা মাথা নেড়ে বুঝালেন কিছু জিজ্ঞেস করার নাই কিন্তু নীতুর বদ ভাতিজা কাচ্চির মাংস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, আংকেল একটু হেটে দেখানতো প্লিজ!