‘খাদ্য মন্ত্রীর বখাটে ছেলে ধ্রুবর সঙ্গে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের ভীতু মেয়ে অদিতির গভীর প্রেম চলছে, যাকে বলে বিছানায় শুয়ে পরা টাইপ প্রেম।’
কথাগুলো যেন মুহূর্তেই ধোঁয়ার ন্যায় উড়ে উড়ে চষে বেড়ালো পুরো ভার্সিটি। এক কান-দু কান করে এই নোংরা কথাগুলো অদিতির কান অব্দি পৌঁছালো। অদিতি যেদিন এসব শোনেছে, সেদিন থেকে লজ্জায়-অপমানে ওর ছোট দুনিয়াটা ভেঙ্গে পড়েছে। সেদিন সারারাত অদিতি ওসব কথা ভেবে কেঁদেছিল। ভীষণ ছোট এক অজপাড়া গ্রাম থেকে এসেছে ও এই ঢাকা শহরে। তাদের ওই ছোট গ্রামে মেয়ে-ছেলে একসঙ্গে দেখলেই বিয়ে পরিয়ে দেওয়া হয়। সেই ভয়ে গ্রামে কেউ প্রেম করলেও দূর গ্রামে গিয়ে দেখা করে। আর অচেনা ছেলে-মেয়ে তো গ্রামে মুরুব্বিদের সামনে একসঙ্গে দাঁড়ায় অব্দি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে- বিয়ে করিয়ে দিলে তো ভালো। কিন্তু না, বরং মোটেও ভালো না ওদের এই নিয়ম। কারণ;
যেসব ছেলে-মেয়ে প্রেম করে ধরা খায়, তাদের নিয়ে পুরো গ্রামে পঞ্চায়েত জড়ো করে সালিশ বসে। অপমানিত হতে হয় দুই পরিবারের বাবা-মা-আত্মীয়কে! ওদের গ্রামে সবার মধ্যে এই প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে বিদ্বেষ একটা আছে।
সেই ছোট গ্রাম থেকে উঠে এসেছে অদিতি। পড়াশোনায ছোট থেকেই বড্ড চালাক, তাই ঢাকা ভার্সিটিতে চান্সও হয়েও যায়। তারপর? তারপর অদিতি-ওর মা এবং বাবার সঙ্গে লাগে মহাযুদ্ধ।
যুদ্ধততে অদিতি এবং ওর মা ফাহিমা ছিলেন এক পক্ষে, বিপক্ষে ওর বাবা তোফাজ্জল। সে কি ভয়াবহ বিতি-কেচ্ছা! অদিতি এখন ওসব ভাবতেও চায়না। যেভাবেই হোক, শেষ অব্দি স্বপ্নের ভার্সিটিতে পড়তে পেরেছে ও। এখানে আসার পর, নিজের খরচ কটা টিউশনি করিয়ে চালানো হয়। গ্রাম থেকে টাকা যেগুলো আসে, ওগুলো বই-একাডেমিক জিনিস কিনতেই ব্যয় হয়। থাকা-খাওয়ার খরচ ও নিজে চালায়। বাকি টাকা জমা করে, ভেবেছে কিছু টাকা জমলে এবারের ওর বাবার জন্যে একটা পাঞ্জাবি কিনবে, আর মায়ের জন্যে একটা স্বর্ণের চিকন চেইন! এটুকু আপাতত ওই ছোট গ্রামের অদিতির ইচ্ছে-স্বপ্ন!
ওই ছোট-ছোট স্বপ্নগুলোই অদিতিকে বাঁচিয়ে রাখছে এতদিন যাবৎ! স্বপ্ন দেখতে দেখতে এতদূর আসা অদিতি জানতেই পারে না- ওর জন্যে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ কেউ, বখাটে-অশৃঙ্খল এক পুরুষ- নাম ধ্রুব, ধ্রুব ইয়ামিন! নামটা ভীষণ সুন্দর, সে দেখতেও খারাপ নয়। শ্যামলা গড়নের লম্বা-উঁচু ছেলে! পড়াশোনার ধার কখনোই ধারেনি। বন্ধু বান্ধব মিলে সারাক্ষণ টো-টো করে বেড়ানোই ওর কাজ। ধ্রুব ইয়ামিন-সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র অদিতি হায়াতের।
তবে এই বিপরীত চরিত্র-দুটোর যেন কি থেকে কি হয়ে গেল- ছোটমটো গ্রাম থেকে আসা ভীতু অদিতির নামের সঙ্গে জড়িয়ে গেল বখাটে ধ্রুব ইয়ামিনের নামটা।
সেদিনের কথা- বন্ধুরা মিলে আজ একজনের ক্লাসমেটের বার্থডে সেলিব্রেট করেছিল। শহরের ওই ছেলেপেলেগুলো যেভাবে সেলিব্রেশন করে, ওভাবেই ঘটল সব। ওরা কেক খেলো না, বরং একে অপরের মুখে লাগিয়ে দিতে থাকল। অদিতি এসব চেনে না, ও বারবার মানা করার পরও তানিয়া দৌড়ে এসে, হেসে মজার ছলে কেক হাতের থাবায় নিয়ে মাখিয়ে দিল অদিতির মুখে, উল্লাসে মেতে উঠল পুরো ক্লাসরুম।
অদিতি বোকার মতো ওদের এসব কাজ দেখছে, ওর মুখটা তৈলাক্ত হয়ে গেছে কেকের ক্রিমে। অদিতিকে এমন চেহারা করতে দেখে তানিয়ে হেসে বললো—‘কি রে? এমন করে তাকাচ্ছিস কেন? তোকে কেক অবস্থায় সুন্দর লাগছে,সাদা ভূত।
তানিয়া হেসে হেসে অদিতির কাধ জড়িয়ে ওর গায়ে লুটিয়ে পড়লো। বলতে লাগল। অদিতি হাসার চেষ্টা করলো ওর দিকে চেয়ে। এমন একটা অবস্থায় কি রিয়েকশন দিতে হয় অদিতি জানে না। তবুও ও কাউকে কষ্ট দিতে চায়না। বলা যায় না- ও কচু বলে উঠলেই ওরা মজা ভুলে ফুসে উঠবে অদিতির উপর। সে জন্যে সবাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমে তখন আগে থেকেই ধ্রুব দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। অদিতির চোখে-মুখে ক্রিম লেগে থাকায় ও ধ্রুবকে লক্ষ্য করেনি।
অদিতি বেসিনে মুখ ঝুঁকিয়ে মুখে পানি ছেটাতে থাকে, মুখ ঘষতে ঘষতে মুখের তৈলাক্ত ভাব যাচ্ছেই না। অদিতির সুন্দর-গোলগাল মুখটা এত ঘষা সহ্য করলো না, রক্তিম হয়ে গেল! অদিতি হাল ছেড়ে আয়নার দিকে তাকালো! দেখতে পেল, ওর পেছনে একটা ছেলে! হাতে সিগারেট,ওর দিকে কিছু একটা বাড়িয়ে আছে। অদিতি আঁতকে উঠে পেছনে তাকালো!
‘টিস্যু ইউজ করো, চলে যাবে।’
পাশ থেকে ওই ছেলেটা হাতে টিস্যু দলাই-মলাই করে এগিয়ে দিল অদিতির দিকে। অদিতি বাঁকা চোখে আশেপাশে তাকাল! একা ওয়াশরুমে ধ্রুবকে দেখে ভয়ে সেঁটিয়ে আশেপাশে তাকাল। কেউই নেই, শুধু ওরা দুজন- ওরা, একটা ছেলে-একটা মেয়ে! অদিতি বুক ধ্বক করে উঠল। ও টিস্যু নিল না। শুকনো মুখে অস্ফুট স্বরে শুধু বলল-‘লাগবে না।’
বলে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ওয়াশরুম থেকে। পেছনে ধ্রুব টিস্যু হাতে ভুরু কুচকে ওর দিকে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। টয়লেট থেকে সুমন বেরিয়ে এলো, ধ্রুব দরজার দিকে ঠাঁই চেয়ে আছে দেখে ও হাত ধুত ধুতে জিজ্ঞেস করলো -‘কি ররে? কাকে দেখিস খালি দরজার দিকে তাকিয়ে?’
ধ্রুব টিস্যু মেঝেতে ফেলে দিল, পা দিয়ে ওগুলো পিষে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল –
‘একটা মেয়ে ছিলো।’
________
সেদিন একজন দেখে অদিতির সঙ্গে ধ্রুবকে একা ওয়াশরমে দেখে ফেলেছে। সেইমুহূর্তে ধ্রুব ভীষণ কাছাকাছি ছিলো অদিতির। যেহেতু ধ্রুব ভার্সিটির ফেইমাস ছেলে, মুহূর্তেই পাঁচ কান হয়ে গেল কথাটা। ওরা ভেবেই নিয়েছে- দুজনের মধ্যে কিছু আছে।
হয়তো যে প্রথম দেখেছে ও সবাইকে বলেছে- দুজনের মধ্যে প্রেম হচ্ছে মনেহয়। কিন্তু বাকিরা যারা এ কথা ছড়াচ্ছে, ওরা এক্সট্রা মশলা মিশিয়ে বলে বসেছে-ধ্রুবর বিছানায় শুয়ে পড়েছে অদিতি।
এখন ভার্সিটির অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজা নিতে গিয়ে, ধ্রুবর বন্ধুরাও অদিতিকে দেখলে ভাবি-ভাবি বলে চেঁচায়।
অদিতি আজকাল টিএসসির ওদিকে যেতেই পারেনা, ওর বন্ধুরা দেখলেই ক্ষেপায় ওকে। অদিতি লজ্জায়-অপমানে কদিন ভার্সিটিই গেল না।
তারপর একদিন! অদিতিদের ভরা ক্লাসরুমে ধ্রুবর একজন জুনিয়র ভক্ত ঈশান সবার সামনে অদিতিকে জিজ্ঞেস করে বসে -‘এই অদিতি, ধ্রুবভাই এত হ্যান্ডসাম, এত রাগী বাপরে। তুই উনারে কেমনে পটাইলি ভাই বল। টিপস দে আমাদের, আমরাও মেয়ে পটাইতে কাজে লাগাবো।’
অদিতি চোখ রাঙিয়ে তাকাল ঈশানের দিকে। ঈশান হাসে, ওর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসছে বাকিরাও। ঢাকা শহরে সবাই ভার্সিটিতে প্রেম, এসব জিনিস ভীষণ স্বাভাবিক হিসেবেই দেখে।এসব টুকটাক এ-ওর সঙ্গে নাম মেলানো, এসব ভীষণ কমন এখানে। কেউ তো আর অদিতি নয়। যে এই মজার ছলে করা প্রশ্নটায়ও ভয়ে কেপে উঠবে। আতকে উঠবে, যদি কোনোভাবে বাবা জেনে যায় এগুলো? কি হবে অদিতির?
অদিতি ঈশানকে এবার চোখ রাঙিয়ে , বললো—‘আমার তার সঙ্গে কিছুই নেই, ঈশান। অযথা প্লিজ উনার সঙ্গে আমার নাম মেলাস না।’
‘ধুর, তুই ঢপ মারছিস।’ ঈশান বড্ড বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল!
অদিতি জোরে একটা শ্বাস ফেলল! এরা কেই অদিতির কথা বিশ্বাস করছেই না। না; আজ এর একটা বিহিত করতে হবে! অদিতি দ্রুত ব্যাগ হাতে বিয়ে বেরিয়ে এলো ক্লাসরুম থেকে। উদ্দেশ্য ধ্রুবদের আড্ডাখানায় যাবে।
অদিতি দেখে- ওই যে ধ্রুব বসে আছে সবার সঙ্গে! ওর একটা হাত কাঁধ ধরে রেখেছে আরেকটা ছেলের। অপর হাতে নিজের কোমর ধরে গল্প করছে বাকিদের সঙ্গে। আজও ব্ল্যাক শার্ট পড়েছে, যার উপরের দুটো বোতাম খুলে নির্লজ্জের মতো বুকটা দেখিয়ে বেড়ানো। অদিতি ভয় পাচ্ছে ওতগুলো ছেলের সামনে যেতে। ও কখনোই এসবে জড়ায় নি, প্রয়োজন পড়েইনি কোনোদিন।
অদিতিকে হঠাৎ ধ্রুবর বন্ধু সুমন দেখতে পেল। সঙ্গেসঙ্গে সুমন চেঁচিয়ে উঠল-‘আরে ভাবি নাকি? আসেন, আসেন ভাবি।ভাই এখানেই আছে।’
সুমনের সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও একসঙ্গে ডাকতে লাগল অদিতিকে।হইচই লেগে গেল ওই জায়গা জুড়ে। ওই লোকটা এবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তীক্ষ্ম চোখে অদিতিকে দেখে যাচ্ছে। অদিতি জোরে শ্বাস টানল, আতঙ্কে ওর রূহ অব্দি কাঁপছে!
অদিতি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। প্রথমবারের মতো অদিতির ধ্রুবর দিকে এগিয়ে যাওয়ায়, ধ্রুবর বন্ধুরাও এবার অবাক হলো। যে মেয়ে সবসময় ভাবি ডাক শুনলেই চোখে-মুখ ঢেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়, আজ এই মেয়েই ওদের সামনে চোখ-মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত! সুমন বাঁকা চোখে অদিতিকে দেখল একবার, আরেকবার ধ্রুবকে। ভেবেছিল ধ্রুব নিজেও অবাক হবে, কিন্তু ও স্বাভাবিক। শুধু দেখেই যাচ্ছে সামনে পা কাঁপিয়ে দাড়িয়ে থাকা ভীতু অদিতিকে।
অদিতি সোজা ধ্রুবর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ধ্রুব এবার পকেট থেকে হাত বের করে সোজা হয়ে দাড়ালো। অদিতি জোরে শ্বাস টানল। তারপর থেমে থেমে বললো—
-‘এ-একটা ক-কথা বলতে এসেছি আমি।’
সুমন পাশ থেকে টিটকারি দিয়ে বললো-‘ কথা বলবেন, সমস্যা কি? কিন্তু ভাবি আপনি তোতলাচ্ছেন কেন? ভাই কিন্তু আপনার উপর এতটাও রাগ দেখাবে না,ভয় পাবেন না।’
ধ্রুব সুমনের দিকে তাকাল, ধ্রুবর ওই স্বাভাবিক, নির্বিকার চাওনি দেখে সুমন চুপ হয়ে গেলো মুহুর্তেও, মুখে কিছুই বলা লাগলো না ধ্রুবর। ধ্রুবর ওই দু-চোখ যেন কাউকে শাসানোর জন্যে যথেষ্ট।
অদিতি ধ্রুবর চোখে চোখ রাখছে না। মাথাটা নিচু করে অস্বস্তিতে কাধের ব্যাগের ফিতে চেপে রেখেছে। ধ্রুব এবার অদিতির নিচু করে রাখা মুখটার দিকে একটু ঝুঁকে মেয়েটাকে দেখল, তারপর অদিতির থরথর করে কেপে উঠা ঠোঁটের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
‘চোখে চোখ রেখে কথা বলো, আমি শুনছি।’
#চলবে
গল্পের নাম- আমার প্রেমিক ধ্রুব সূচনা পর্ব
লেখনীতে- #অবন্তিকা_তৃপ্তি