#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধ্রুব বাড়িতে যখন পৌঁছেছে তখন প্রায় দুপুর বারোটা বাজে। এলোমেলো ধ্রুব একপ্রকার ঢুলতে ঢুলতে বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকছিল; ড্রয়িং রুমে নিজের সৎ মা আর বাবাকে দেখে ধ্রুব সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। ধ্রুবর ফুরফুরে মেজাজ যা ছিলো সেটা মুহূর্তের মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল, ধ্রুব দাঁতে দাঁত পিষে ঘরে ঢুকলো। সৌরভ সৌরভ ইয়ামিন ছেলের রাগান্বিত মুখটা দেখে তৃণার দিকে তাকালেন। তৃণা দুজন বাবা-ছেলের মুহুর্তকার দন্ধ দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উঠে চলে গেল পাশের রুমে। ওরা বাবা-ছেলে এখন প্রতিবারের মতো অসভ্যদের ঊর্ধ্বে যত খারাপ ভাষা আছে সেগুলো নিয়ে তর্ক করবে। তৃণা সম্ব্রাম্ত পরিবারের মেয়ে, এসব কাচা ভাষা কখনো শুনে অভ্যস্ত নয়। অথচ এই একটা পরিবারে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আজ অব্দি কোনো গা/লি বা কাচা ভাষা নেই; যেসব ও শুনেনি। ধ্রুবকে শুরুতে নিজের আদর-ভালোবাসা বোঝাতেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই বেয়াদব-একরোখা ছেলে বুঝেনি ওকে। বরং একবার সবার সামনে চরম অ/পমান করার পর; তৃণা লজ্জায় আর এই ছেলের সামনে যায়না।
মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে ওর-ও, ডিভোর্স দিতে মন চায় সৌরভকে। কিন্তু শেষ অব্দি সৌরভের মুখের দিকে চেয়ে পারেনা। বুড়ো হচ্ছেন; ছেলে একটা থেকেও নেই। সেখান থেকে তৃণা চলে গেলে; সৌরভ পাগল হয়ে যাবেন একাকিত্বে। তাই এখন-ও মুখটা বুজে ও রয়ে গেছে!
তৃণার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো ধ্রুব। সৌরভ কফি খেতে খেতে পেপার হাতে তুলে নিয়েছেন। তৃণা এ বাড়িতে আসা উনার জন্যে স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও; ধ্রুবর জন্যে সেটা বিষ সমতুল্য। এই বাড়িটা ওর মায়ের হাতে সাজানো; সেখানে আরেকটা নারী এসে রাজত্ব চালাচ্ছে; ধ্রুব সেটা একদমই কেন যেন সহ্য করতে পারেনা।
ধ্রুব কুর্তার হাতা ফোল্ড করে; এগুতে এগুতে বললো——-‘ওই মহিলা আমার মায়ের বাড়িতে আজ কি করছে?’
ধ্রুব গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সৌরভের মুখোমুখি; জবাব চাইলো তার তথাকথিত ‘বায়োলজিকার ফাদারের’ কাছে। ওর চোখ-দুটো রাগান্বিত!
সৌরভ পেপার হাত থেকে না নামিয়েই; জবাব দিলেন—-‘ও মহিলা না, তোমার ওকে ছোট মা বলা উচিত; অন্তত যতদিন আমি জীবিত আছি।’
ধ্রুব শব্দ করে হেসে ফেলে; যেন ভীষণ মজার কথা শুনে ফেলেছে ও। সোফায় বসে কুশন কোলে নিয়ে সেটায় হাত ঠেসে বসে। হেসে হেসেই বলল—-‘তোমাকেই বাবা মানি না; সেখানে আর ওই মহিলা? জোকস অফ দ্য ইয়ার।’
ধ্রুবর হাসি যেন সৌরভের সামনে ভীষণ চুড়ান্ত বেয়াদবি লাগল। সৌরভ পেপার নামলেন; ধ্রুবর ওই হাসিহাসি মুখের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললেন———‘যাকে তুমি বাবা হিসেবে মানো না; তার টাকা-পয়সার উপরেই তোমার এই ফুর্তিগুলা চলছে। বাবা না মানার সঙ্গে সেগুলো অস্বীকার করা উচিত তোমার, রাইট?’
ধ্রুব আবারও হাসল; তারপর হাসি থামিয়ে বললো——-‘আমি অস্বীকার করছি। ইট’স লাইক আ… গিভ এন্ড টেইক। আমি তোমার কাজে আসছি; তুমি আমাকে পয়সা দিচ্ছ। এন্ড তুমি নিজেও জানো ধ্রুব নেই; তো তুমিও ফিনিশড!’
ধ্রুব নিজের গলার দিকে আঙ্গুল তুলে ইশারা করলো; ওর চোখ-দুটো হাসছে! যেন সৌরভকে চোখে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলছে— দেখ; নিজের ছেলে আজ তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার দেখাচ্ছে। মানুষ করতে পারলে না ছেলেকে।
সৌরভের বুকটা ভার হয়ে আসছে। কিন্তু ধ্রুবকে সেটা বুঝতে দিলেন না। কাকে বোঝাবেন নিজের ব্যথাগুলো? এ মানুষ নয়, হা/য়না একটা। দয়া-মায়া নেই! না আছে কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ!
সৌরভ আবারও পেপার হাতে তুলেন; পেপার পড়তে পড়তে বললেন——‘কিছু বলতে এসেছো?’
ধ্রুবর মুখ এবার গম্ভীর হয়ে আসে।ও পকেট থেকে কতগুলো ছবি বের করে টেবিলের উপর ছড়িয়ে ফেলে দিলো। পেপার থেকে চোখ সরিয়ে সৌরভ ছবি-গুলোর দিকে তাকালেন। ছবির লোকজনের গতরাতের খবর উনার কানেও এসেছে। তবে তিনি সেটা জানেন;এসব ধ্রুবকে বুঝতে দিলেন না।
ধ্রুব ছবি-গুলোর দিকে দাঁতে-দাঁত পিষে তাকিয়ে আছে; বললো——-‘এই ছেলেগুলোকে আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমার সামনে চাই; একসম ফিটফাট অবস্থায়; বাকিটা আমি দেখে নিব।’
সৌরভ ছবিগুলো হাতে নিলেন। ধ্রুব সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। সৌরভ ছবির ছেলেগুলোকে দেখে নিয়ে বললেন—-‘এরা তো এমপি কামরুলের ছেলেপেলে। সেদিন আমার ফ্যাক্টরিতে ঝামেলা করেছিলো।’
কথাটা কানে আসা মাত্রই ধ্রুবর রাগের পারদ হুট করে যেন চিরিক দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। ও হঠাৎ সৌরভের দিকে ঝুঁকে এসে হিসহিসিয়ে উঠলো—-‘হ্যাঁ; আজ তোমার জন্যে আমি একটা পুরো রাত সাফার করেছি। এখন তুমি এটার প্রায়শ্চিত্ত করবে। তোমার ঘেউঘেউ দলকে বলে এগুলারে এনে দাও। বলে দাও যে; সন্ধ্যার পর আমি ধ্রুব ইয়ামিন ওদের সঙ্গে হকি খেলতে চাইছি।’
ধ্রুবর চোখ থেকে যেন লাভা ঝরছে। ওর কথা বলার ধরন শুনে মনে হচ্ছে: যেন সৌরভই অদিতির কিডন্যাপের পেছনে দায়ী।
সৌরভ বাঁকা চোখে তাকালেন; ছেলের চোখে চোখ মিলিয়ে বললেন——‘তুমি চাইলে নিজে এই কাজ এক্ষুনি করে ফেলতে পারো; এখান আমাকে কেন লাগবে?’
ধ্রুব এবার হেলান দিয়ে বসলো সোফায়; বললো—–‘পারি; বাট নাও আ’ম টায়ার্ড! এখন একটা ঘুম দেবো; সন্ধ্যার জন্যে এনার্জি দরকার।’
সৌরভ সেক্রেটারি রাহুলকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন। রাহুল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ছবিগুলো হাতে তুলে নিল। ধ্রুব কুশন ফেলে উঠে গেল সোফা থেকে। সৌরভ বললেন—-‘ ছেলেগুলোকে মেরে ফেলিওনা। সামনে ইলেকশন আছে। হাত নোংরা করলে বিপদ!’
ধ্রুব সৌরভের দিকে তাকালো; ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রহস্য করে বললো——‘মারা লাগবে না। না মেরেই এমন অবস্থা করবো যে বাঁচতে ইচ্ছে করবে না আর।’
সৌরভ তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ধ্রুবর এমন আচরণের পেছনে মূল হোতা তো উনি নিজেই! তাই ধ্রুবর এমন কথা তাঁকে খুব একটা অবাক করতে পারলো না। আর যেখানে বিষয়টা অদিতিকে ঘিরে; সেখানে এসব কিছু ভীষণ স্বাভাবিক ব্যাপার।
ধ্রুব সিঁড়ির সামনে গেলে; পেছন থেকে সৌরভ প্রশ্ন করলেন——-‘সেই মেয়েটা কি এখন ঠিক আছে?’
ধ্রুব থেমে গেল; কিন্তু পেছনে ফিরে তাকাল না। ওর চোখে ভেসে এল অদিতির ওই সরল;ভয়ার্ত মুখটা! ধ্রুব চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো; সেভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো-—‘এখন থেকে ঠিক থাকবে।’
কথাটা বলে ধ্রুব বড়বড় পা ফেলে সিড়ি দিয়ে উঠে গেল। সৌরভ রাহুলের দিকে তাকালেন; রাহুল স্যারের তাকানোর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে চশমার আগা নাকের উপরে উঠিয়ে জবাব দিলেন—-‘আজ প্রপোজ করেছেন ধ্রুব স্যার ওই মেয়েকে।’
সৌরভ ছেলের যাওয়ার দিকে চেয়ে থেজে জবাব দিলেন—-‘নজরে রাখো। মেয়েটা আজ তোমার নজরে থাকা অবিস্থাত কিডন্যাপ কি করে হয়ে গেল, আমি তো সেটা চিন্তা করেই অস্থির! ঘোড়ার ঘাস কাটছিলে তুমি তখন?’
রাহুল আইপ্যাড হাতে কাচুমাচু গলায় জবাবি দিল—-‘আপনি বলেছিলেন ওরা দুজন একসঙ্গে থাককে নজর রাখতে। স্যার ওইদিন চলে এসেছেন; তাই আমিও —-‘
‘রা/স্কেল!’ ——-সৌরভ ধমকে উঠলেন।
রাহুল কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। সৌরভ টেবিল থেকে মোবাইল হাতে নিলেন। রুমে যাওয়ার আগে রাহুলের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বলে গেলেন——‘সামনে ইলেকশন; মেয়েটার উপর নজর রাখো। আরেকবার যদি ওই মেয়ে কিডন্যাপ হয়েছে; মনে রেখো ধ্রুব তাণ্ডব চালাবে বাড়িতে। একরাতেই ও ওই মেয়ের জন্যে আগামী বছরগুলোতে কি করবে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে; আমি কোনো রিস্ক নেব না।’
‘জী স্যার।’—- রাহুল দ্রুত সায় দিল!
_____________
অদিতি চা কেটলি থেকে কাপে ঢালছিলো। চায়ের কাপ থেকে চা উপচে পরছে; ওর এতে মন নেই। মন তো দিয়ে বসেছে অন্য কাউকে।বারবার ধ্রুবর বলা —-‘ অ্যাই লাভ ইউ অদিতি।’ কানে সানাইর মতো বেজেই চলেছে ক্রমাগত। হাতে ওর কাজ উঠে না;পড়াশানা ভালো লাগে না। সারাক্ষণ চোখের সামনে বখাটে ধ্রুব এলোমেলো কুর্তা গায়ে হেঁটে বেড়ায়; তার ওই মদ্যক ওই চোখের চাওয়া; অদিতির ব্যান্ডেজে তার আঙ্গুলের ছোঁয়া! এসব কিছু অদিতির রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। ধীরে ধীরে অদিতি এলোমেলো হয়ে পরছে। ছন্যছাড়া-বাধনহারা মনের বিবাদে ও ক্লান্ত ভীষণ! ওর অবস্থা করুন! একদিকে ওর পরিবার, অন্যদিকে প্রেম। দু-দিকের দন্ধে অদিতি মাঝখানে পিষে যাচ্ছে।
‘অ্যাই অদিতি; চা পরে যাচ্ছে তো।’ —-তানিয়া অদিতিকে ধাক্কা দিয়ে উঠলো!
ভাবনার মধ্যেও চমকে উঠলো অদিতি। দ্রুত হাত থেকে কেটলি রেখে দিল। পুরো চা-য়ে ভেসে যাচ্ছে টেবিল। অদিতি দ্রুত কাপড় এনে জায়গা পরিষ্কার করে ফেলল। তানিয়া এসব দেখছিল; ও বললো——‘তোর ইদানিং কি হয়েছে? এমন খুইয়ে-খুইয়ে টাইপ হয়ে গেছিস কেন?’
অদিতি হাসার চেষ্টা করে চায়ের কাপ হাতে নিলো; বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো——‘ কই? তেমন কিছুই না।’
তানিয়া ওর বেডে বসে অদিতিকে দেখে যাচ্ছে। চা খেতে খেতেও মেয়েটা অন্যমনস্ক! তানিয়া হঠাৎ ঠোঁট টেনে হেসে বললো—-‘ তুই প্রেমে পরেছিস নাকি রে? ধ্রুব ভাই জানে?’
অদিতি চমকে উঠে দ্রুততার সাথে জবাব দিলো—-‘না, না! আমি ওমন মেয়ে নই।’
তানিয়া ভ্রু বাঁকালো; বললো—-‘ওমন মেয়ে মানে? প্রেম করা পা/প নাকি?’
অদিতি ঠান্ডা গলায় জবাব দিল——‘আমি যে জায়গা থেকে এসেছি; সেই জায়গায় প্রেম শুধু পা/প না বরং মহাপা/প! তুমি আমাদের বাড়িতে গেলে বুঝবে।’
তানিয়া অবাক হয়ে তাকাল অদিতির দিকে। এই যুগে এসেও এমন গ্রাম হয় নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার! পরপর ও হঠাৎ ধ্রুবর কথা মনে পরায় গা-ছেড়ে বেডে হেলান দিল ফোন হাতে; একপ্রকার অদিতির কথা উড়িয়ে দিয়ে বললো—-‘তোর ধ্রুব ভাই আছে; তোর আবার কিসের চিন্তা! নিশ্চিন্তে থাক।’
তানিয়া ফোন দেখছে। অদিতি তানিয়ার দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল—-‘তা..তাকে নিয়েই সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার; তুমি যদি জানতে।’
তানিয়া ফোন দেখছিল! হঠাৎ ও একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বসলো। অদিতির দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখালো——-‘এই অদিতি; দ্যাখ! দ্যাখ।’
অদিতি ফোনের দিকে ঝুঁকে লেখা-গুলো পড়ছে—— ‘এমপি কামরুলের দলের চারজন ছেলে নিখোঁজ; খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দুদিন ধরে।’
ক্যাপশনের নিচে ছেলেগুলোর ছবি দেওয়া।ছবির লোকগুলোকে দেখে অদিতি চমকে উঠে। এরা তো ওকে সেদিন কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছিলো।
তানিয়া চোখ-মুখ উজ্জল করে; স্বস্থির শ্বাস ফেলে বললো——‘দারুণ হয়েছে।এগুলো নির্ঘাত ধ্রুব ভাইর কাজ! তোকে নিয়ে একরাতেই যা করেছে; এরপর উনার আর রিস্ক নেওয়ার কথা না।’
তানিয়ার হেসে হেসে কথা-গুলো বললেও অদিতির বুক কাঁপতে লাগল! ও জিজ্ঞেস কর—-‘ ওরা কি বেঁচে থাকবে? নাকি..’
তানিয়া গা-ছাড়া ভাবে বেডে শুয়ে পরলো; জবাব দিল——‘মনে তো হচ্ছে না। ভাইকে যেভাবে নাচিয়েছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে টপকে গেছে।’
অদিতির গা হিম হয়ে এলো! ওর জন্যে কিছু ছেলেকে ধ্রুব খু/ন করেছে?. আইন হাতে তুলে নিয়েছে? ধ্রুবর বাবা মন্ত্রী; চাইলেও ওদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া সম্ভব ওদের মতো মানুষদের কাছে। কিন্তু ধ্রুব নিজে…
অদিতির হয়রান লাগতে শুরু করলো! ও যা-যা দেখছে; এসবকিছু ওর হজম হচ্ছে না। ও দ্রুত টেবিলে থেকে পানির গ্লাস তুলে নিলো। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতে অদিতির কি করা উচিত? এ কোন পাগল প্রেমিকের খপ্পরে পরলো ও?
_____
তারপর কেটে গেছে কটাদিন! অদিতি এখন বেশ সুস্থ! নিয়মিত ভার্সিটি আসা-যাওয়া করছে। তবে ধ্রুবকে এড়িয়ে চলছে নিয়মিত। অদিতি চায়না; সেদিনের ঘটনার পর ধ্রুবর মুখোমুখি হতে!
ধ্রুবর কাছে হয়তো কাউকে খু/ন করা তার কোনো বড় ব্যাপার নয়। তবে অদিতির কাছে এটা মারাত্মক ভয়ের একটা ব্যাপার! ও চায়না; ওর জন্যে ধ্রুব নতুন ভাবে কোনো পাগলামি বা অপরাধে জড়িয়ে পড়ুক! আর সে দায় নিক অদিতি!
তাই ও প্রতিবার ধ্রুবর আড্ডার জায়গা এড়িয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে। ধ্রুব সেদিন ওকে পুরো ভার্সিটি খুঁজেছে! লোক পাঠিয়েছে ডিপার্টমেন্টে; অদিতিকে পাওয়া যায়নি।
অদিতির হঠাৎ করে শুরু করা এমন আচরণে হতভম্ব ধ্রুব! ও তাই খুঁজে বের করেছে; অদিতির হোস্টেলে ফেরার রাস্তা! আজ এখানেই বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে ধ্রুব ইয়ামিন! উদ্দেশ্য; অদিতি হায়াতকে জন্মের শিক্ষা দেওয়া! জানিয়ে দেওয়া; তার এসব উদ্ভট কাজ-গুলো ধ্রুবকে যেন আর
না দেখায়।
অদিতি আজো এই অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল! হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে ওর চোখ গেল; ওই রাস্তার মোড়ে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে! ওর চোখ-দুটো অন্যরকম ভীষণ; যেন এক্ষুনি খেয়ে ফেলবে অদিতিকে!
ধ্রুবকে দেখেই সঙ্গেসঙ্গে অদিতির পা থেমে গেল। ধ্রুব বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে! ওর রাগী চোখ-গুলো ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে! মনে হচ্ছে, কতো কোটি বছর হয়ে গেছে: ও দেখে না অদিতিকে! মেয়েটা শুকিয়ে গেছে অনেক! আজও সবসময়ের মতো ঢিলে সেলোয়ার-কামিজ পড়নে! ধ্রুব বারবার এই এক মেয়ের প্রতিই এত মুগ্ধ হয় কেন?
অদিতি নিজেকে সামলাতে পারছে না। পা বলছে; উল্টো দৌড়ে চলে যেতে। অথচ হৃদয় বলছে—- ধ্রুব কি আগের থেকে আরও সুদর্শন হয়েছে? এই ময়লা টিশার্ট; এলোমেলো চুল কি আগেও এতো ভালো লাগত?
দুটি তৃষ্ণার্থ চোখ একে অপরের দিকে চেয়ে রয়েছে! কেটে যায় কয়েক পল; দুজনের খবর নেই। ডুবে আছে ওরা; একজন আরেকজনের মাঝে।
ধ্রুব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অদিতির বুকটা আবারও থেমেছে; খানিক থেমেই শুরু করেছে লাফানো। ধ্রুব ধীর পায়ে এগিয়ে এসে অদিতির সামনে দাঁড়ালো.। ওর চোখ গেল অদিতির কপালের ব্যান্ডেজে! ধ্রুব ছুঁতে চাইল হাত উঠিয়ে। কিন্তু অদৃশ্য অনধিকারবোধ ওকে আটকে দিল। ধ্রুব হাতটা আবারও নামিয়ে ফেলল। অদিতির চোখটার দিকে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো—-‘অবশেষে আপনার দেখা মিলে গেল; আমার তো উচিত এবার সিন্নি করানো; রাইট?’
ধ্রুব টিটকারি করে বললো এল। অদিতি চোখ নামিয়ে নিলো। ধ্রুবর কণ্ঠ এবার কঠিন হলো; কড়া গলায় শোধালো—-‘আমার থেকে পালাচ্ছিলে কেন? আমি তোমাকে কিছু জানিয়েছি; জবাব চেয়েছিলাম। হ্যাঁ বা না। অথচ তুমি আমাকে এ কটাদিন ভীষণ খাটিয়েছো অদিতি। হুয়াই?’
অদিতি অপরাধবোধে ডুবে গেল! চোখটা নামিয়ে ফেলল; ধীর গলায় জবাব দিল——‘আপনি—‘
‘হু, আমি?’ — ধ্রুব ধৈর্য্য নিয়ে শুনছে যেমন।
অদিতি একটু থামে। খানিক থেমে, জোরে শ্বাস টেনে বলে—-‘আমাদের যায়না; আপনি আরো ভালো কাউকে ডি..ডিজার্ভ করেন। আমি প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে নই।’
ধ্রুবকে হতাশ হতে দেখা গেল। এতদিনের অপেক্ষায় এই উত্তর ও আশা করেনি। ধ্রুব অন্যদিকে চেয়ে নিজের এই হতাশা আড়াল করার চেষ্টা চালালো। পরপর অদিতির নিচু হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে নিজের মুখ ঝুঁকে এনে ঠান্ডা গলায় শুধু এটুকু বলে গেল—–‘ফার্স্ট, আনসার ম্যাই কোশ্চেন; অদিতি! তুমি কি একবারের জন্যে আমার কথা এই কয়েকদিনে ভাবো নি? আমি কি একবারের জন্যে তোমার কল্পনায় আসিনি? শুরু থেকে এই সবকিছুতে কি আমি একাই ছিলাম? তুমি ছিলে না?’
‘ন..না।’ —- অদিতি মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। ধ্রুবর চোখে-চোখ রেখে মিথ্যা বলার সাধ্য ওর নেই।
ধ্রুব অদিতির ঘুরিয়ে ফেলা মুখটার থুতনি চেপে ধরে আবার ওকে নিজের মুখোমুখি আনে। অদিতি মাথাটা নামিয়ে ফেলল। ধ্রুব অধৈর্য্যের মতো করে অস্থির গলায় বললো—-‘ডোন্ট লাই টু মি, অদিতি। তুমি চেয়ে থাকতে আমার দিকে; যখনই আমি তোমার সামনে এসেছি। আমি তোমার চোখে আমার জন্যে দরদ দেখেছি; তুমি আমাকে কেন মিথ্যা শোনাচ্ছো? আমি জানি তুমি কি ফিল করো আমার জন্যে।’
ধ্রুব থামে; জোরে শ্বাস টেনে অদিতির হাত টেনে ওকে নিজের দিকে এগিয়ে আনে। হাত ছেড়ে: চোখের কোনে আঙুল ছুঁয়ে কাতর গলায় বললো——‘তোমার চোখ যে কথা বলে তোমার ঠোঁট কেন সেটা বলতে চায়না; অদিতি। কিসের ভয় তোমার, আমি আছি তোমার সাথে।’
অদিতি চোখ টলমল করছে।ধ্রুবর আঙ্গুল তখনও ওর গাল ছুঁয়ে; চোখের কোণ ছুঁয়ে আছে। ধ্রুবকে ও কিভাবে বোঝাবে আর? কি ভাবে বোঝালে ধ্রুব কষ্ট পাবে না? অদিতি শ্বাস আটকে পিছিয়ে গেল। ধ্রুবর হাত নেমে গেল নিচে। ধ্রুব হতাশ হয়ে তাকালো। অদিতির চোখ গড়িয়ে দু-ফোঁটা পানি পরলো; ও দুহাতে চোখ মুছে থেমে থেমে বললো—-‘আমি ভালোবাসতে জানিনা; আমাকে ভালোবেসে আপনি শুধুই কষ্ট পাবেন; আর কিচ্ছু না।’
ধ্রুব জবাবে বললো—‘আমি শিখিয়ে দেবো তোমায়। কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকেও কষ্ট দিচ্ছো?’
‘আমি কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না; বরং কষ্ট পাওয়া থেকে বাঁচাচ্ছি। আপনি চলে যান; আমার সামনে আর আসবেন না। আমার হৃদয় এত বড় নয়; বারবার আপনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার মধ্যে আর নেই।’——-অদিতি কথাগুলো বলে দুহাতে চোখ মুছে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো!
ধ্রুব পেছনে ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো! অদিতির চোখের পানি ওকে আজ এলোমেলো করে দিয়েছে। ধ্রুব অনেকক্ষণ লাগলো পুরো ব্যপার হজম করতে। অদিতি ততক্ষণে চলে গিয়েছে।
ধ্রুব একসময় বুকের বা-পাশে হাত রেখে; ঘাড়টা সামান্য কাত করে ফিচেল গলায় বলে উঠলো——‘তুমি পালাতে থাকো অদিতি; আমি পাকড়াও করতে থাকব। তুমি হারিয়ে যেতে থাকবে; আমি অন্ধকার-দিন একসঙ্গে তোমার পায়ে হাজির করে যাবো। তুমি ভয় পেতে থাকো; আমি ধ্রুব তোমার ভয়-গুলো নিজের হাতে পিষে ফেলতে থাকব! যেই প্রান্তে তুমি থাকবে; ধ্রুবকে তোমার সঙ্গে পাবে।’
#চলবে