পর্ব : তিন
টিক টিক টিক…
রাত ১২টা পাঁচ মিনিট।
অন্ধকার ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। উইন্ডচাম দোলার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। আর একটা-একটা মৃদু কণ্ঠ বাতাসে ভেসে আসছে। একটা অতি কোমল নারীকণ্ঠ। কণ্ঠটা মিয়ানো গলায় বলছে, “ভুলে গেলেন আমাকে? এত সহজেই ভুলে গেলেন?”
সব মিলিয়ে বিকট আতঙ্কে ঘেরা বাড়িতে বন্দি আমি। চারপাশের পরিবেশ কী ভয়ঙ্কর, কী ভীতিজনক তা কেবলমাত্র আমিই জানি। এমনিতেই শরীর থরথর করে কাঁপছে। তার উপর পিঠের চামড়া দিয়ে উপর থেকে ক্রমাগত নিচের দিকে নামতে থাকা একফোঁটা ঘাম আরো কাঁপিয়ে তুলছে। কিছুক্ষণ পরপর উইন্ডচাম দোলার শব্দটা বাড়ছে। দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ… তারপর একসময় একনাগাড়ে বেজেই চলল, টুংটাং-টুংটাং-টুংটাং…
আমি কানে হাত দিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে রইলাম। যখন শব্দটা পুরোপুরি থেমে গেল তখন দৃষ্টি উঁচু করলাম। এখন শুধু দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ।
১২টা সতেরো মিনিট।
চোখের সামনে একটা ছায়া ভেসে এল। ছায়া বললে ভুল হবে। ওটা একটা মানুষ। না, ঠিক মানুষও নয়। ভূত কিংবা প্রেতাত্মা এরকম কিছু একটা হবে। তবে সেটা একটা মেয়ে। এবং সেই মেয়েটাকেও আমি চিনি। তার নাম অমিশা। এর বাইরে তার ব্যাপারে আর কিছু জানি বলে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
“সত্যিই ভুলে গেছেন আমাকে?” আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল। আমি নিরুত্তর বসে রইলাম। সে আমার মাথায় আলতো করে হাত রাখল। আর তখনই আমি কী যেন দেখতে পেলাম। বহু বছর আগের কোনো এক পুরনো স্মৃতি বোধহয় আমার চোখের সামনে ভেসে এল। কিন্তু এক পলকে কী দেখেছি আমি?
“মনে করার চেষ্টা করুন।” মেয়েটা বলল। তার এমন কণ্ঠ শুনে আমি বেশ অবাকই হলাম। এতকাল যত প্রেতাত্মা, অশরীরীর গল্প শুনেছি সবখানেই বলা হয়েছে প্রেতাত্মারা উগ্র টাইপের হয়। তাদের কণ্ঠস্বর খুবই ভয়ানক। যা শুনলেই লোকে ভয়ে প্যান্ট পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়। অথচ এই মেয়েটার গলার আওয়াজ খুব মিহি। অন্ধকারে ভয় লাগছে ঠিকই। তবে তার কণ্ঠের জন্য নয়। ব্যাপারটা যেমন গোলমেলে তেমনি বিস্ময়কর।
মেয়েটা আবার আমার মাথায় হাত রাখল। আবারো চোখের সামনে সেই একই দৃশ্য দেখেছি। একটা মেয়ে। একটা ছোট্ট ফ্রক পরা মেয়ে। না না, ছোটো নয়। একদম ছোটো বলা যায় না। মেয়েটার বয়স পনেরো কি ষোলো হবে। তবে ফ্রক পরেছে বলে একটু ছোটো লাগছে। একটা ছাতা বগলে নিয়ে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক। লোকটাকে বোধহয় আমি চিনতাম। এখন ঠিক মনে পড়ছে না।
“কে সেই ফ্রক পরা মেয়ে? তার পাশের লোকটাই বা কে?” অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেললাম। আমার সামনে বসে থাকা মেয়েটা আরো একটু এগিয়ে এল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “আমি আর আমার খুনি।” বলেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এরপর আমার মনে যে পরিমাণ প্রশ্নের ঝড় বইল তার হিসেব বোধহয় এক জীবনে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটুকু তো পরিষ্কার যে এই মৃত মেয়েটাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। হয়তো তার খুনিকেও চিনি। আপাতত মনে পড়ছে না।
বসে থাকতে থাকতে পা দু’টো অবশ হয়ে আসছিল। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এখনও পুরোপুরি ঘোর কাটেনি। তবে আগের মতো অতোটা ঘোরগ্রস্ত নই। হাঁটুর উপর ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিতেই লাইটার পেয়ে গেলাম। লোকে বলে চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। মৃত মেয়েটা অর্থাৎ অমিশা চলে যাবার পর মনে পড়েছে লাইটার আর কোথাও নয় আমার পকেটেই ছিল। মোমবাতিতে আগুন দিতেই একটা প্রশ্ন মাথায় এল। অমিশা কি সত্যি সত্যি চলে গেছে?
বিষয়টা লক্ষ্য করার জন্য জানালার কাছে গেলাম। ব্যাপারটা আত্মঘাতী হতে পারে। তবে কখনো কখনো মানুষ এতটাই কৌতূহলী হয়ে পড়ে যে নিজের মৃত্যু অবধি পরোয়া করে না। আমার বর্তমান অবস্থা অনেকটা সেরকমই। তবে জানালায় উঁকি দেওয়ার আগে একবার দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলাম। রাত ১টা চার মিনিট। এবার জানালার পরদা একটু সরিয়ে দিতেই যা দেখলাম; হার্টের প্যাশেন্ট হলে বোধহয় সঙ্গে সঙ্গে অঘটন ঘটে যেত। কাচের জানালার অপাশে শূন্যে ভেসে আছে এক ঘন কালো অন্ধকার ছায়া। আমাকে দেখা মাত্রই ছায়াটা আস্তে আস্তে মাটিতে নেমে গেল। এরপর পা টেনে টেনে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আর আমি ধীরে ধীরে মেঝেতে পড়ে গেলাম।
আলো।
এক অপ্রত্যাশিত ভোর।
অমিশা ভিলার গোলকধাঁধায় ফেঁসে যাবার পর আবারো আমার জীবনে ভোর হবে তা কল্পনাতীত ছিল। সকাল ৯টা। অমিশা ভিলা’র মালকিন রেবা বেগম মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি কেবল প্রাতস্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়েছিলেন। তখনই আমি এসেছি। যার ফলে তার চুল শুকানোর কাজটা আর হয়ে উঠেনি। ভেজা চুল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল টপটপ করে পড়ছে। তাকে দেখে এখন আর মাঝবয়েসী ডিভোর্সি ভদ্রমহিলা বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কিশোরী। এদিকে তার শোবার ঘর থেকে কিছুক্ষণ পরপর একজন লোক হাঁক দিচ্ছেন, “এই, তোমার হলো? আমি একটু বেরোব।” রেবা বেগম ভদ্রলোকের কথার জবাব দিলেন না। তার কথাগুলো শুনতে পাননি এমন ভঙ্গি করে বসে রইলেন। লোকটা হয়তো এই ভদ্রমহিলার প্রেমিক। যাহোক, ওসব নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করাই ভালো।
অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর ভদ্রমহিলা মাথা নিচু রেখেই বললেন, “ভুল হয়ে গেছে। ওই অভিশপ্ত বাড়িতে আপনাকে থাকতে দেওয়ার আগে এর পেছনের সব ঘটনা আপনাকে বলা উচিৎ ছিল। আমি খুবই দুঃখিত।” বলতে বলতে তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। শোবার ঘর থেকে আরো একবার ভদ্রলোকের কণ্ঠ ভেসে এল, “এতক্ষণ লাগে গোসল করতে? আমি বেরোব তো!” বলতে বলতে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদেরকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “এতক্ষণ ধরে চেঁচাচ্ছি জবাব দিচ্ছো না কেন? আর উনি কে?”
রেবা বেগম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, “উনি আরজু আহমেদ। অমিশা ভিলার ভাড়াটিয়া।”
কথাটা শুনে ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি আড়ালে আড়ালে বারকয়েক ঢুক গিললেন। কাঁপা হাতে কপালের অদৃশ্য ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “ও!” তারপর বাইরে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। আমার একটু খটকা লাগল। লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি। এই ভদ্রলোকের চেহারা অনেকটা…
হ্যাঁ, উনার চেহারা অনেকটা সেই লোকের সাথে মিলে যায় যাকে আমি কাল রাতে দেখেছিলাম। অমিশা যখন আমার গায়ে হাত রেখেছিল তখন এক ঝটকায় একটি দৃশ্য দেখেছিলাম। একটা ফ্রক পরা মেয়ে। আর একজন ভদ্রলোক। আরে! উনিইতো সেই ভদ্রলোক! অমিশা বলেছিল এই লোকটাই অমিশার খুনি। তার মানে!
রেবা বেগম এগিয়ে এসে আমার হাতের উপর হাত রাখলেন। বললেন, “গত দু’দিনে আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত। আপনি যে ক’টা দিন দেশে আছেন আমাদের এই বাড়িটায় থাকতে পারেন। ভাড়া লাগবে না।”
“থ্যাংক ইউ। বাট আমি ওই বাড়িতেই থাকব।” কথাটা বলতেই রেবা বেগম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “ওই বাড়িতে! ওই অভিশপ্ত বাড়িতে! কিন্তু কেন?”
মৃদু হেসে দায়সারাভাবে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ আগেও যে বাড়ির ভয়ঙ্কর থাবা থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম এখন স্বেচ্ছায় সেই বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি। কারণ অমিশা ভিলা, অমিশা, রেবা বেগম এবং সেই ভদ্রলোক এই সবকিছু নিয়ে যে ধাঁধা তৈরি হয়েছে সেটা আমাকে প্রতিনিয়ত কৌতূহলী করে তুলছে। আমি ধীরে ধীরে এতটাই কৌতূহলী হয়ে পড়ছি যে মৃত্যুভয় পর্যন্ত আমাকে স্পর্শ করতে পারছে না।
লম্বা সময় কিছু খাওয়া হয়নি। বাসায় ফিরে নিজ হাতে খাবার রেঁধে সেগুলো গপাগপ পেটে চালান করে লম্বা ঘুম দিলাম। চোখ খুলে দেখি ৯টা বেজে গেছে। রাত ৯টা। মুখে এক ঝাপটা পানি মেরে টেলিভিশনের সামনে বসে পড়লাম। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে এগিয়ে চলছে। রাত বাড়ছে৷ আর আমি অপেক্ষা করছি। গভীর রাতে যখন এ-বাড়ির সবগুলো বাতি নিভিয়ে দেব ঠিক তখন পা টেনে টেনে এগিয়ে আসবে সে। আর তারপর…