রোদ শুভ্রর প্রেমকথন
পর্ব ১৬
#writer: নৌশিন আহমেদ রোদেলা
হাতে ওমন জবরদস্ত চোট পাওয়ার পর আমি আর শুভ্র ভাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াই নি সেদিন । দাঁড়াতামই বা কি করে? হাতে এত্তো ব্যাথা তারওপর বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলাম তখন, কান্না আটকাতে পারলে তো? রুমে দরজা দিয়ে কান্না আটকাতেই ব্যস্ত ছিলাম সেদিন আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম এই লোকটার যেনো কখনো বিয়ে না হয়। কখনো না। হা হা হা। আমার সেই দোয়া কবুল হয়েছে কিনা জানি না তবে পরের দিন বিকেল বেলা আবারও মুখোমুখি হলাম দুজনে।
আমার ভাগ্যটা এতোটাই খারাপ ছিলো যে, সেদিনই মা আমার ম্যাথের দুর্বলতা নিয়ে আলাপ করার উৎসাহ খুঁজে পেলেন। শুভ্র ভাইয়া বাসায় আসতেই আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে ম্যাথে আমার দুর্বলতা এবং আপু আর শুভ্র ভাইয়ের প্রখরতা ব্যাখা করতে লাগলেন উনি। সেদিন ইচ্ছে করছিলো, মরে যাই। এই মুহূর্তে মরে যাই। এই অপমান কি সহ্য হয় কারো? এদিকে আমার ম্যাথের রেজাল্টও ছিলো মারাত্মক খারাপ। যেখানে শুভ্র ভাইয়া ম্যাথে অলওয়েজ ৯৮% মার্কস পান সেখানে আমি মাত্র ৪৫/৫৫%।
এই রেজাল্টকে চোখ বন্ধ করে টিটিপি অর্থাৎ “টাইনাটুইনা পাস” বলা যেতে পারে। আমার এই অযোগ্যতাটা শুভ্র ভাইয়ার জন্য ছিলো একটা সুবর্ণ সুযোগ। আর আমার জন্য সেটা প্রথম যুদ্ধে হেরে যাওয়ার প্রধান কারণ। সেই মুহূর্তে রাগে গা টা রি রি করছিলো আমার। মনে মনে স্কুলের ম্যাথের ম্যামকে ইচ্ছেমতো গালি দিয়ে আল্লাহর কাছে কোনো ম্যাজিকের জন্য দোয়া করছিলাম। যে ম্যাজিকে এই শুভ্র নামক সাদা বিলাইটা ম্যাথে ফেইল মারবে আর আমার খাতা ভরে যাবে শুধু নাম্বারে। আহা! ভাবতেই কতো শান্তি লাগছিলো তখন।
কিন্তু এবারও আমার মতো বাচ্চা মেয়েটার দোয়া কবুল হলো না, উল্টো যা হলো তা আমি জীবনে কল্পনাও করতে পারি নি। আমার ভাষ্য মতে এই “মারাত্মক অসভ্য” ছেলেটাকে আমার ম্যাথ টিচার নিযুক্ত করা হলো। সেই মুহূর্তে ইচ্ছে করছিলো দশটাকা রিক্সাভাড়া দিয়ে পাশের রেললাইনে গিয়ে শুয়ে পড়ি। এই পৃথিবীতে কি আমার কোনো প্রয়োজন আছে? নেই! একদম নেই! থাকলে নিশ্চয় মা আমার সাথে এতো বড় অন্যায়টা করতে পারতো না।
আম্মুর সাথে আমার চেহারার মিল না থাকলে সেদিন আমি বিশ্বাসই করে নিতাম যে মা আমায় নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে এনেছেন নয়তো নিজের আদরের ভাতিজার গুণ কীর্তন করে আমার মতো ছোট্ট মেয়েটাকে এই বদমাশটার হাতে তুলে দিতে পারতো?সেদিন সুইসাইড করা নিয়ে কতো জল্পনা-কল্পনায় না করেছিলাম। ভাবছিলাম মরেই যাই। এ জীবন রেখে আর কি হবে? কেউ ভালোবাসে না আমায়। আজকাল বেস্টুকেও দেখি পাশের ব্রেঞ্চের মেয়েটার সাথে কি ভাব। বাবাও কতো বকে এখন…..
এ জীবন আর রাখবোই না। কিছুতেই না। হা হা হা, শেষ পর্যন্ত সব জল্পনাগুলোকে জলে ভাসিয়ে বই নিয়ে বসতে হলো শুভ্র ভাইয়ের ঠিক সামনের চেয়ারটাতে। আপু তখন ইন্টারের স্টুডেন্ট, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সে থাকে কোচিং ক্লাসে। রুম তখন একদম ফাঁকা। সেই ফাঁকা রুমটা শুভ্র ভাইয়ার জন্য ছিলো এক্সট্রা সুযোগ। এনিওয়ে, গল্পে ফেরা যাক। প্রথমদিন উনার কাছে পড়তে বসতেই একটা গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললেন,
— কি রে? শুনলাম তোর ম্যাথের খাতায় গোল গোল ডিম ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। তো এতো ডিম দিয়ে করিস টা কি তুই? চাইলে কিন্তু ব্যবসা শুরু করতে পারিস…প্রতি পিস ডিমের দাম সাড়ে সাত টাকা।
এমনিতেই মেজাজ ছিলো জলন্ত চুলো। উনার কথাটা শুনেই সেই চুলোই পড়লো এক ড্রাম ঘি। রাগে জ্বলতে জ্বলতে নাক-মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। ইচ্ছে তো করছিলো এই ফাজিলটার মাথাটায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলি। উফফ! অসহ্য! আমার রাগী মুখ দেখে শুভ্র ভাইয়া যেনো আরো উৎসাহ পেলেন। আরোকটা গা জ্বলানো হাসি দিয়ে বললেন,
— নাইন থেকে টেনে যে উঠেছিস প্রোগ্রেস রিপোর্ট কই? দেখা দেখি।
আমি এবারও চুপচাপ শক্ত হয়ে বসে রইলাম। আর মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে ফেললাম “এ জীবন গেলেও প্রোগ্রেস রিপোর্ট উনাকে দিবো না। কিছুতেই না।” কিন্তু আমার এই প্রতীজ্ঞাও বেশিক্ষণ টিকলো না। উনার রাম ধমকে ঝটপট রেজাল্ট শীট বের করে উনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। উনি মুচকি হেসে রেজাল্ট শীটটা হাতে নিলেন। কিছুক্ষণ রেজাল্ট শীটের দিকে তাকিয়ে থেকে কপাল কুঁচকে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলেন-
— ইংলিশে নাইনটি এইট পার্সেন্ট নাম্বার। জিওগ্রাফিতে এইট্টিফাইভ প্লাস, হিস্ট্রিতেও এইট্টি প্লাস। সবকটাতেই তো ভালো মার্কস পেয়েছিস তাহলে ম্যাথে মাত্র চুয়ান্ন কেন?
— এক্চুয়েলি, আমাদের স্কুলের ম্যাথ টিচারটা এতো ড্যাশিং যে আমি তিনঘন্টার মাঝে দুইঘন্টা উনার দিকে “হা” করে তাকিয়ে থেকেই কাটিয়ে দিয়েছি তাই…. ওভারঅল লাড্ডু!
আমার কথায় সেদিন উনি খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন। টেবিলের কোণা থেকে একটা কাঠের স্কেল হাতে নিয়ে গণিত বইটা বের করে বিশ বিশটা ম্যাথ সল্ভ করতে দিয়ে বলেছিলেন,
— প্রতিটার সলুউশনের জন্য তোর কাছে জাস্ট পাঁচ মিনিট করে আছে। একটি ভুল হলে পাঁচটা করে মাইর। নির্দিষ্ট টাইমের বাইরে প্রতি মিনিটের জন্য দশটা করে মাইর। ইউর টাইম স্টার্টস নাও!
উনি আমাকে মোট বিশটা অঙ্ক করতে দিয়েছিলেন। সবকটায় ছিলো সরল অঙ্ক। আমার পক্ষে এতো বড় বড় সরল পাঁচ মিনিটে করা সম্ভব ছিলো না। ব্যাপারটা আমার কাছে অসম্ভবের কাছাকাছিই ছিলো।আমার হাতে ছিলো ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট। তার মাঝে দশমিনিট উনার দিকে “হা” করে তাকিয়ে থেকেই পাড় করে দিয়েছিলাম আমি। তখন বুঝি নি বাট এখন বুঝি কাজটা উনার ইচ্ছেকৃত ছিলো। ম্যাথ টিচারকে ড্যাশিন বলায় জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছিলেন উনি। অথচ উনি জানতেনই না আমার স্কুলের ম্যাথ টিচার ছিলেন একজন মেয়ে!
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
(এরপর কি হয়েছিলো তা অন্যকোনোদিন সময় করে লিখতে বসবো। আজ আর নই।)