রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২৬
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
১৪.
সন্ধ্যা সাতটা কি আটটা। বিছানায় গোল হয়ে বসে আছি। মিথিলা আপু লাজুক লাজুক চাহনী নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। চারপাশ থেকে লজ্জাদায়ক কথার ফুলঝুরিতে অনেকটাই ক্লান্ত সে। বেশ কিছুক্ষণ হলো ছেলেপক্ষ এসে পৌঁছেছে। ড্রয়িংরুমে বসে দেনমোহরের টাকা নিয়ে আলাপচারিতা চলছে। কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে কাবিন পর্ব। আম্মুসহ অন্যান্য রমনীরা রান্নায় মেতেছেন।
ভাইয়ারা ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে।এরই মধ্যে হুট করে মেয়েদের রুমে ঢুকলেন শুভ্র ভাই। গায়ে খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি আর কালো জিন্স। পায়ে সাধারণ স্লিপার। সিল্কি চুলগুলো সমান্তরাল ভঙ্গিতে পড়ে আছে কপালে। হাতে আধ কাঁচা পেয়ারা। তাতে কামড় বসাতে বসাতেই খাটের পাশে এসে দাঁড়ালেন উনি। মিথি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—” পাশের রুমে দুটো সুন্দরী ললনাকে দেখলাম। তোর ননদ নাকি রে?”
মিথি আপু মাথাটা আরেকটু নুইয়ে নিয়ে বললো,
—” হ্যাঁ।”
শুভ্র ভাই আবারও কামড় বসালেন পেয়ারায়। মুখ ভেঙিয়ে বললেন,
—” বাহ্! বিয়ের আগেই ননদ বলে বলে অস্থির করে ফেলছিস। একা একা অস্থির না হয়ে আমাদের দিকেও তাকা। ভাইদের একটা হক আছে না? সেই হকটা আদায় না করেই এভাবে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করতে পারবি তুই?”
মেথি আপু এবার মাথা তুলে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
—” মানে?”
শুভ্র ভাই তার ফর্সা গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
—” মানে, সিম্পল। তোর ননদ হলো আমাদের বেয়াইন। তো বেয়াইনদের আপ্যায়ন করা লাগবে না? আর আপ্যায়ন করার জন্য ফোন নাম্বার দরকার। ফোন নাম্বার দে সাথে ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ হেনতেন যা আছে সব দে। আই মিন দিতে পারিস। আমি মাইন্ড করবো না।”
মিথি আপু যেন এবার আকাশ থেকে পড়লো। চোখ বড় বড় করে বললো,
—” তোর ফোন নাম্বার চাই শুভ্র? সত্যিই?”
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” এমন রিয়েক্ট মারছিস কেন? নাম্বার দিতে বলছি নাম্বার দে। ব্যস!”
রাফিয়া দুঃখী দুঃখী গলায় বলে উঠলো,
—” শুভ্র ভাই? ওই মেয়ে দুটো কি আমার চেয়ে সুন্দর?”
শুভ্র ভাই অমায়িক হেসে বললেন,
—” বোন, আমি এখানে লাক্স সুন্দরী নির্বাচন করছি না। তাছাড়া, শুভ্রর বোন বলতেই পরী। সেই হিসেবে তুমিও পরীই হলে, তাই না? শুভ্রর ছোট বোন বলে কথা। এই মিথি? নাম্বার দিবি নাকি তোর জামাইরে ধরে বাঁধবো।”
আমি আড়চোখে তাকালাম। উনি আবারও তাড়া দিতেই মুখ খুললো রাফিয়া। মৃদু গলায় বললো,
—” দুইটার নাম্বার দিয়ে কি করবেন শুভ্র ভাই? বিয়ে করলে তো একটাকেই করবেন। তো একটাই সিলেক্ট করুন। আমরাও ভাবি ডাকার অভ্যাস করে ফেলি। দুইটার সাথে ট্রাই মারলে আমরা কনফিউজড হয়ে যাবো না?”
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
—” তুমি না বড্ড বেশি কথা বলো রাফিয়া। তোমার ভাবিকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না তোমায়। তাকে নিয়ে কনফিউজড হওয়ার চান্স নাই। এখন আপাতত চুপ থাকো। মিথি নাম্বার দে তো… জলদি দে।”
মেয়েদুটোর একটি বরের ছোটবোন আর অন্যটি বরের কাকাতো বোন। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ওদের সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিলো মিথি আপুর। বেশ সুন্দরীও বটে। শুভ্রর চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত নাম্বারটা দিয়েই দিলেন মিথি আপু। শুভ্র ভাই নাম্বার নিয়ে রুম থেকে বেরুতেই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের মধ্যে চাপা হুল্লোড় পড়ে গেলো। রাফিয়া মন খারাপ করে একবার দরজার দিকে তাকিয়েই চাপা আর্তনাদ করে বললো,
—” রোদু রে?আমার ক্রাশ প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। এতো সুন্দরী আমি বসে থাকতে ওই দুই কালনাগিনীর নাম্বার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে? হে খোদা!”
আমি রাফিয়ার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকালাম। রাফিয়ার কষ্টের চাপে নিজের কষ্টটাই ভুলে গেলাম। সত্যিই তো, বেচারীর ক্রাশের সে কি দুর্দশা!
আটটা/ সাড়ে আটটার দিকে কাবিন শেষ হলো। কাবিন শেষে সবাই যখন খাওয়া দাওয়াত নিয়ে ব্যস্ত তখন দেখা দিলো আরেক ঝামেলা। লেবু শেষ! সকাল বেলা বাজারের লিস্ট থেকে যে কিভাবে লেবুর নামটা কেটে গেছে কে জানে? তাই মা আমায় পাঠালেন ছাঁদে। ছাঁদের কোণে ছোট্ট একটা লেবু গাছে ৫/৬ টা লেবু ধরেছে। আপাতত সেগুলো দিয়ে কাজ চালালেই রক্ষে। রাফিয়াকে সাথে যেতে বলতেই সে বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকালো। তাই বাধ্য হয়ে একাই চললাম ছাঁদে। ছাঁদের মেজেতে পাটি বিছিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো ভাইয়াসহ কাজিন ভাইয়ারা সবাই। আমি ছাঁদে পা রাখতেই একপলক তাকালো সবাই। আমি কিছু না বলে ডানদিকের কোণের দিকে এগিয়ে যেতেই কথা ছুড়লো ভাইয়া,
—” রোদ? এখানে কি?”
আমি সামনে এগুতে এগুতেই বললাম,
—” লেবু নিতে এসেছি ভাইয়া।”
তারপর সব চুপ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার শুরু হলো ফিসফিস। ফিসফিসানি শেষ হলে শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি। এই ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে শুভ্র ভাইয়ার হাসির শব্দ কানে এলো। উনি হাসতে হাসতেই বললেন,
—” মাইর খাওয়াতে চাস? ডিরেক্ট খুন করে ফেলবে আমায় । ভাইকে বল।”
তারপর আবারও ফিসফিস শব্দ। আমি দুটো লেবু তুলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। এদের মধ্যে কি চলছে বুঝতে না পারলেও গভীর কিছু যে চলছে তা স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে ওদেরকে দেখে নিয়ে আবারও লেবু তোলায় মনোযোগ দিলাম। লেবু তুলে শেষ করে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই সবাই মিলে ঠেলেঠুলে দাঁড় করিয়ে দিলো শুভ্রকে। আমি সচেতন চোখে তাকালাম। আশেপাশে কোথায় ভাইয়াকে দেখা যাচ্ছে না। এই হাঁদারামটা দরকারী সময়গুলোতেই হাওয়া হয়ে যায় কেনো কে জানে? আমি দ্রুত সিঁড়ি ঘরের দিকে এগুতেই সটান সামনে দাঁড়ালেন শুভ্র। চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই মৃদু হাসলেন উনি। উনার হাসিকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটাতেই ডানহাতটা চেপে ধরলেন উনি। পেছন থেকে বললেন,
—” হেল্প দরকার ছিলো। একটু…প্লিজ।”
আমি বা উনি আরো কিছু বলবো তার আগেই দরজায় আম্মু এসে দাঁড়ালেন। আলিফ ভাইয়াদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
—” রোদ কি চলে গেছে রে?”
আলিফ ভাইয়া মাথা নেড়ে বললেন,
—” না মামি, ওই তো। শুভ্রর সাথে লেবু তুলছে।”
আম্মুর কন্ঠ কানে যেতেই দু’হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। এতো দেরি হওয়ার জন্য এক গাদা বকে দিয়ে আমাকে নিয়ে নিচে চললেন আম্মু। আম্মু পেছন ফিরতেই আমার ডান হাতে দু’খানা কাগজ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—” ওই মেয়েদুটোর জন্য। দিয়ে দিস প্লিজ….”
উনার কথাটা শুনেই মেজাজ চটে গেলো আমার। কত বড় সাহস! আমাকে দিয়ে প্রেম পত্র বিলি করা? আমাকে দিয়ে? রাগে ভেতরে ভেতরে গর্জাতে গর্জাতে আরো দু’পা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে বলে উঠলেন তুষার ভাইয়া,
—“কাজটা কিন্তু করে দিয়েন রোদ ভাবি।”
তুষার ভাইয়ার কথাটা কানে যেতেই আমার সাথে সাথে আম্মুও থেমে গেলেন। আমি চোখ বড়বড় করে তাকালেও আম্মু ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
—” রোদ তোমার ভাবি কিভাবে হয় তুষার?”
তুষার ভাইয়াও থতমত খেয়ে গেলেন এবার। এই ছোট্ট কথাটাও যে আম্মুর কানে চলে যাবে ভাবতেও পারে নি বেচারা। তাছাড়া আমি নিজেও অবাক। তুষার ভাই আমাকে ভাবি ডাকছে কোন দুঃখে? তুষার ভাইয়াকে চুপ থাকতে দেখে আম্মু অধৈর্য ভঙ্গিতে আবারও প্রশ্ন করলেন। আম্মুকে এভাবে ভুলানো যাবে না দেখে এগিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। বেআক্কল হাসি দিয়ে বললেন,
—” ফুপ্পি? রোদ তো ওর বোনের মতোই তাই না? আর…বোনের বর তো এজ ইউজাল ওর দুলাভাইই লাগবে তাই না?”
আম্মু মাথা নাড়লেন। শুভ্র ভাই মৃদু হেসে বললেন,
—” এখন কি দুলাভাইকে কেউ দুলাভাই ডাকে? সবাই তো ভাইই ডাকে। তো সেই হিসেবে রোদ ওর ভাইয়ের বউ হলো না? আর ভাইয়ের বউ তো ভাবিই হলো ফুপ্পি।”
আমি আর আম্মু দু’জনেই হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কপাল কুঁচকে বলে উঠলেন আম্মু,
—” ওই? আমাকে তোর পাগল মনে হয়? দিবো এক চড়।”
শুভ্র ভাই ইনোসেন্ট গলায় বললেন,
—” এইতো বিশ্বাস করলে না। আরে বাবা…এটা নিউ জেনারেশন। এই জেনারেশনে সব চলে। এইযে তুমিই ভাবো… বন্ধুদের যে আমরা অহরহ মামা মামা বলে ডাকতেছি তাই বলে কি আমাদের বন্ধুরা আমাদের মায়ের ভাই হয়ে যাচ্ছে?”
আম্মু কনফিউজড হয়ে বললেন,
—” এই? তুইও কি রোদকে ভাবি ডাকিস নাকি?”
পেছন থেকে আলিফ ভাইয়া ফিক করে হেসে দিয়ে আবারও চুপ হয়ে গেলেন। শুভ্র ভাইয়া ভঙ্গ হৃদয় নিয়ে বললেন,
—” ও কি আমার ভাবি হয় যে আমি ওকে ভাবি ডাকবো।”
আম্মু যুক্তি দিয়ে বললেন,
—” তুষারের ভাবি হলে তোর কেন হবে না? তোর তো আরও বেশি করে হবে।”
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
—” তুমি আমার বাপের বোন বলে কি রোদের বাপেরও বোন?”
আম্মু বুঝতে না পেরে বললেন,
—” মানে?”
আলিফ ভাইয়া পেছন থেকে বললেন,
—” মানেটা হলো লেবু, মামি। আপনার না লেবু নিয়ে যাওয়ার কথা?”
আলিফ ভাইয়ার কথায় যেন টনক নড়লো আম্মুর । আমার হাত থেকে লেবুগুলো একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়েই নিচে নেমে গেলেন। শুভ্র ভাই যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলেন। জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে তুষার ভাইয়ার দিকে তেড়ে গেলেন। ধুমধাম করে চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
—” ভাবি না?তোর তো দেখি ভাবি ডাকার বহুত শখ। শালা…ভাবি ডাকবি ভালো কথা কিন্তু নাম ধরে ডাকলি কেন? এখনই কেইস খাইতাম। বলদ একটা।”
আমি কয়েক সেকেন্ড তাদের ধাক্কাধাক্কি, মারামারি দেখে মুচকি হেসে নিচে নেমে এলাম। সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়েই হাতে থাকা চিঠি দুটোর কথা মনে পড়লো। মুহূর্তেই রাগটা বেড়ে গিয়ে অসীমে গিয়ে ঠেকলো। প্রেমপত্র! এই প্রেমপত্রই গুলে খাওয়াবো তাকে। বেয়াদপ!
#রোদবালিকা..
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/