রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩২
#লেখিকা- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
____________________
চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। পা আর চেয়ারের ঘর্ষনের ফলে ক্ষনে ক্ষনেই বেজে উঠছে নুপুর। আমার ডানদিকের একটি চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছেন শুভ্র ভাই। দৃষ্টি আমার বইয়ের পাতায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ পাতা উল্টে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন উনি। গমগমে গলায় প্রশ্ন করলেন,
—” ক’মাস ধরে পড়তে বসিস না রোদু?”
আমি জবাব দিলাম না। কাল থেকেই শরীরটা খুব জ্বালা করছে আমার। হুটহাট ভীষণ জ্বরে কাবু হচ্ছি তো আবার ঘামে অস্থির হচ্ছি। শুভ্র ভাই কয়েক সেকেন্ড উত্তরের অপেক্ষায় থেকে সন্দেহী গলায় প্রশ্ন করলেন,
—” ইংলিশ সেকেন্ড পেপারে তোদের কয়টা আইটেমের ওপর পরিক্ষা হয় বল তো।”
আমি একবার চোখ তুলে উনার দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলাম। সব কটা আইটেম আমার মনে আছে কি না তাই মনে মনে আওড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। চার/ পাঁচটা আইটেমের বাইরে আর কিছুই মনে পড়লো না আমার। শুভ্র ভাই চোখ-মুখ লাল করে তাকালেন।
—” এই পাঁচ মাসে একটাবার বই স্পর্শ করেছিলি তুই? পরীক্ষা নিলে তো নির্ঘাত ফেইল করবি। কি ভেবেছিস? ফেইল করবি, বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে আর জামাইয়ের ঘাড়ে বসে শান্তিতে খাবার চিবোবি? বর তো থাকবেই, পড়ালেখা করে আর কি লাভ, তাই না? থাপড়াইয়া কান লাল করে ফেলবো বেয়াদব।”
আমি প্রত্যিত্তরে কিছুই বললাম না। উনি ইংলিশ টেস্ট পেপারটা আমার সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,
—” সবগুলো বোর্ড শেষ করে তারপর উঠবি। লাই পেতে পেতে মাথায় উঠে নাচছিস। এভাবে পড়াশোনা করলে রিক্সাওয়ালা ছাড়া আর বর জুটবে না। ফুপা তো বলেই দিয়েছে পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ করলেই কোনো আর্মি-পুলিশ দেখে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোর জন্য ওটাই বেস্ট হবে।”
এমনিতেই মেজাজ চটে ছিলো। শরীর খারাপের দোহাই নিয়ে দু’দিন ধরেই অল্পতে রেগে যাচ্ছিলাম। উনার এসব কথায় বিরক্ত হয়ে মেজাজ দেখিয়ে বললাম,
—” সেটাই, আমিও তাই বলি। আমিও এবার ডিসিশন নিয়েছি যে আমি ফেইল করবো। শুধু এবার না বারবার ফেইল করে আদু ভাইয়ের ফিমেল ভার্সন হবো। খবরের কাগজে আমার নাম উঠবে। তাছাড়া, আপনিও কিন্তু মন্দ বলেন নি। বিয়ে করা যেতেই পারে। আর্মি-পুলিশ তো খারাপ কিছু নয়। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকবে আর আমি শান্তিতে ঘুমোনোর এক মহাসুযোগ পাবো। এক-দুই বছরে একটা দুইটা বাচ্চার মা হয়ে বিন্দাস সংসার করবো। সমস্যা তো নাই। আমার বিয়েতে আপনি বিশেষ অতিথি হবেন শুভ্র ভাই। আপনাকে বিশেষভাবে দাওয়াত দেওয়া হবে। ইন-শা- আল্লাহ।”
শুভ্র ভাই রাগে কটমট করে আমার দিকে তাকালেন। ডান চোখের ভ্রু হালকা উঁচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি উনার দৃষ্টিটাকে আরো একটু তীক্ষ্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বললাম,
—” বুঝলেন শুভ্র ভাই? ভাবছি বাবাকে তীব্রর কথাটা বলবো। বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে আংকেল টাইপ কাউকে না করে ছোকরা টাইপ কাউকে করাটাই ভালো। এমনিতেও সবসময় আগেপিছে ঘুরতে…”
আমার কথার মাঝেই শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন শুভ্র ভাই,
—” তীব্র কে?”
আমি উনার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম,
—” আপনাকে বলা যাবে না।”
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকালেন। অবাক হয়ে বললেন,
—” কেন?”
আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,
—” আপনাকে বললে, আপনি ওকে মারবেন।”
—” আমি কেন মারতে যাবো?”
—” সিফাত নামের ছেলেটার সাথে আপনি যা করেছেন তা এখনও মনে আছে আমার। বেচারা ভয়ে পুরো দু’মাস কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো। শুধু তাই নয় আমি যে যে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তাম ভয়ে ওইসব স্যারের কাছেও পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো বেচারা। কি বিশ্রী অবস্থা।”
শুভ্র ভাই আরেক দফা অবাক হয়ে বললেন,
—” আমি কি ওকে মেরেছি নাকি?”
—” মারেন নি তবে ভয় তো দেখিয়েছেন। আপনাকে দেখলে তো ভয় পায়-ই আপনার বন্ধুদের দেখলেও বেচারার কাঁদ কাঁদ অবস্থা হয়ে যায়।”
শুভ্র ভাই হালকা কেশে নড়েচড়ে বসলেন। ইতস্তত করে বললেন,
—” ও ভয় পেলে ওটা ওর সমস্যা। আমার তাতে কি? তবে ওকে মারা উচিত ছিলো। মেয়েদের পেছন পেছন বাসার গেইট পর্যন্ত চলে আসার অপরাধে ওর পা দুটো ভেঙে ফেলা উচিত ছিলো। বেয়াদব একটা! এবার চুপচাপ পড়া কমপ্লিট কর…. ”
আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। দরজার পাশ থেকে আম্মুর কড়া চাহনী দেখে কথা বাড়ানোর সাহসই পেলাম না। গ্রামারটিক্যাল করতে গিয়ে প্রথম দফায় খাতা ভর্তি ভুল করলাম। শুভ্র ভাই বিরক্ত হলেন। কিছুক্ষণ রাগ দেখিয়ে শান্ত গলায় বুঝাতে লাগলেন। উনার বুঝানোর পদ্ধতিটা অন্যরকম।
উনি সারাদিন বুঝানোর খাতিরে বকবক করে গেলেও আমার মতো অধৈর্য ছাত্রীরও এক তিল পরিমান অমনোযোগী হতে মন চাইবে না। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনার পর মনোযোগটা আরো গাঢ় হয়ে এলো আমার। তবে এবারের মনোযোগটা পড়ায় নয় উনার চোখে-মুখে স্থির। কথা বলার সাথে সাথে উনার মুখের সংকোচন প্রসারণ খুব মন দিয়ে খেয়াল করছিলাম আমি। হঠাৎই উনি কথা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
—” ওই? তুই কি আদৌ কিছু শুনছিস? কি দেখছিস এভাবে?”
আমি ফট করেই বলে ফেললাম,
—” কথা বলার সময় আপনাকে অনেক কিউট লাগে।”
উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বইটা ঠেলে দিয়ে বললেন,
—” যতটুকু বুঝেছিস তার ওপর ভিত্তি করেই কর। দেখি কয়টা হয়। তাড়াতাড়ি।”
আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে অলস ভঙ্গিতে বই-খাতা টেনে নিয়ে লিখতে বসলাম। কয়েক মিনিট পরেই লেখা থামিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনি ফোন স্ক্রল করছিলেন। আমাকে উনার দিকে তাকাতে দেখে চোখ না তুলেই বললেন,
—” আবার কি হলো?”
আমার কপাল কুঁচকে এলো। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললাম,
—” আপনি টিউশনি করান….”
—“তো?”
আমি কলমটা খাতার উপর রেখে বললাম,
—” কিছু না। আমি এখন পড়বো না। ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো। এইটুকুই!”
কথাটা বলে উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বিছানায় সটান শুয়ে পড়লাম। উনি ফোন থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
—“ফ্রেন্ডদের আড্ডা ছেড়ে আমি এখানে বসে আছি শুধুমাত্র তোকে পড়াবো বলে। আর তুই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছিস? ওঠে পড়তে বস বলছি।”
উনার কথায় আমার মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। ডানহাতে নিজের কপাল চেপে ধরে বললেন,
—” আমি মেয়েদের পড়াই না। সো, হা করে তাকিয়ে থেকে আমার কথা গেলার সুযোগ তাদের নেই। প্রেমে পড়ার সুযোগও নেই। এবার দয়া করে এসে পড়তে বস। ফুপি তোকে শুয়ে থাকতে দেখলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না। আসবি নাকি থাপ্পড় লাগাবো?”
আমি মাথাটা একটু উঁচু করে উনার দিকে তাকালাম। উনাকে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ে ভয়ে ওঠে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। উনার চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভয়ানক রেগে আছেন উনি। কিন্তু এতো রাগের কারণটা কি? আমি তো এতোটা রেগে যাওয়ার মতো কিছু করি নি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে উনি কিছু বলার আগেই আবারও পড়ায় মনোযোগ দিলাম আমি। দশ পনেরো মিনিট পর, চুপচাপ আমার খাতার উপর নিজের ফোনটা রাখলেন উনি। আমি লিখছিলাম। লেখার মাঝে হঠাৎ এভাবে ফোন রাখায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবারও ফোনের দিকে তাকালাম। উনি শান্ত গলায় বললেন,
—” চয়ন ভাইয়ের বোনকে আমার নাম্বারটা কি তুই দিয়েছিস?”
আমি বোবার মতো একবার উনার দিকে তাকিয়ে আবারও ফোনে মনোযোগ দিলাম। সুস্মিতা আপুর দেওয়া একের পর এক লম্বা লম্বা ম্যাসেজ দেখে বিস্মিত হলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন শুভ্র ভাই,
—” ফোনে ম্যাসেজ, কল তো আছেই। হোয়াটস্অ্যাপেও মিনিটে মিনিটে ম্যাসেজ দিয়ে চলেছে । এফবি আইডি ডিয়েক্টিভ থাকায় আইডিটা বেঁচে গেছে মনে হয়। আমি সিউর, আমার আনইউজড আইডিটাকেও ম্যাসেজের বন্যায় বসিয়েছে এই মেয়ে। উফ! কি বিরক্তিকর!”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বোকার মতো প্রশ্ন করলাম,
—” আপনাকে কেন ম্যাসেজ দেয়?”
উনি উত্তর দিলেন না। আমি এবার লাস্ট ম্যাসেজটাতে চোখ বুলালাম,
—” এটা কেমন বিহেভিয়ার বলুন? আমি এতোদিন ধরে ম্যাসেজ দিচ্ছি এটলিস্ট একটা আন্সার তো আপনি দিতে পারেন। আমার দুটো নাম্বারই ব্লক লিস্টে রেখেছেন। এর কারণটা কি? আমি জানি আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে কিন্তু বিয়ে তো আর হয়ে যায় নি। আর সে কি আপনাকে কসম দিয়েছে যে অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে পারবেন না আপনি। আমি আপনাকে ব্রেকআপও করতে বলছি না।
আমি শুধু আপনার সাথে ভালো ফ্রেন্ডশিপ করতে চাইছি। আপনি এটলিস্ট এক সপ্তাহ আমার সাথে কথা বলুন। তারপরও যদি আপনার মনে না হয় যে আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড থেকে বেটার না তাহলে আমি আর ডিসটার্ব করবো না। আমি সত্যিই অনেক পছন্দ করি আপনাকে। আমার এতো পাগলামো দেখেও কি বুঝতে পারছেন না? প্লিজ একটা রিপ্লাই দিন… প্লিজ!! ”
ম্যাসেজটা দেখে বিস্ফারিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন। উনার রাগ দেখে আমার রাগের সিস্টেমটা অটোমেটিক অফ হয়ে গেলো। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,
—” পপপছন্দ করে আপনাকে।”
শুভ্র ভাই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—” তোর কি ধারনা? আমি বাংলা পড়তে জানি না?”
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইলাম। উনি ফোনটা নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করে লাউড স্পিকারে দিয়ে আবারও আগের জায়গায় রেখে দিলেন। আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
—” আজকের পর যদি এই মেয়ে আমায় ডিস্টার্ব করে তাহলে থাপড়াইয়া তোর দাঁত ফেলে দিবো।”
উনার কথায় আমার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁলো। ওই মেয়ের ফোন দেওয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক বুঝতে না পেরে বললাম,
—” আমার কি দোষ? আপ…”
এটুকু বলতেই ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো। শুভ্র ভাই চোখের ইশারায় কথা বলতে বলে নিজে চুপ করে বসে রইলেন। আমি ইতস্তত কন্ঠে বললাম,
—” হ্যালো?”
—” আপনি কে? এটা শুভ্রর নাম্বার না?”
—” জ্বি এটা উনারই নাম্বার।”
—” এটা ওর নাম্বার হলে আপনি কে?”
এবার আমি থতমত খেয়ে উনার দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই রাগী চোখে আমার দিকে তাকাতেই থেমে থেমে বলে উঠলাম,
—” আপনার কি মনে হয়? কে আমি?”
—” শুভ্রর গার্লফ্রেন্ড? আপনি শুভ্রর গার্লফ্রেন্ড হলেও বা আমাকে ফোন কেন দিয়েছেন?”
—” আপনি জানেন আমি কেন ফোন দিয়েছি। এতোকিছু জানার পরও আপনি কিভাবে একটা ছেলেকে দিনরাত ডিস্টার্ব করতে পারেন? আপনার কি আত্মসম্মান বোধ নেই? আমার তো মনে হয়, আপনি জন্মগতভাবেই এমন। আজ অবিবাহিত ছেলেকে ফোর্স করছেন তো কাল দুই-তিন বাচ্চার বাবাকেও ফোর্স করতে শুরু করবেন। আপনাদের ক্যাটাগরিটাই এরকম তাই না?”
—” আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।”
—” থেংক গড বুঝতে পেরেছেন যে আমি আপনাকে অপমান করছি। আচ্ছা? আপনার মধ্যে কি সত্যিই অপমানবোধ নামক কিছু আছে?”
—” আমার কি আছে আর কি নেই তা আপনার দেখার বিষয় নয়। এমন একটা ভাব করছেন যেন শুভ্রর বিয়ে করা বউ। আপনিও তো সেই রাস্তার মেয়েই। বিয়ের আগে প্রেম করে বেড়ানো মেয়েদেরকে কি বলে জানেন? না জানলে জেনে নিবেন। ব্লাডি বিচ।”
সুস্মিতা আপুর কথায় রাগে সারা শরীর জ্বলে উঠলো আমার। দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। টলমলে চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—” কয়েকটা গালি শিখিয়ে দেন তো। এই মহিলাকে গালি দিতে ইচ্ছে করছে। অসভ্য মেয়ে! বেয়াদব… ”
শুভ্র ভাই দুই সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে হাসলেন। ফোনটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন,
—” হ্যালো?”
ওপাশ থেকে তাড়াহুড়ো করে উত্তর এলো,
—” শুভ্র? দেখুন না, আপনার গার্লফ্রেন্ড কতোটা বাজে বিহেভ করছে আমার সাথে।”
শুভ্র ভাই ছোট্ট করে শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,
—” সুস্মিতা? ওর সবচেয়ে বড় সমস্যাটা কি জানো? ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ও তোমার মতো থার্ডক্লাস বিহেভ করতে পারে না । আমাদের সমাজে মেয়েদের আলাদা একটা রেসপেক্ট থাকে। আর সেই রেসপেক্টটা মেয়েদের বজায় রেখেই চলতে হয়। আজ যে কথাটা তুমি ওকে বললে সেই কথাটা যদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে তাহলে হয়তো মেয়ে হিসেবে যে রেসপেক্টটা তোমার প্রাপ্য তা তোমায় দিতে পারতাম না। পুচকিকে কিছু বলার আগে দশবার চিন্তা করবে সুস্মিতা। নয়তো, আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। দেখো, তোমাকে আমি এর আগেও বলেছি আমি এনগেজড। তবু কেন এমন পাগলামো করছো? তুমি যে বারবার হাত কেটে ফেলবে বলে ধমকি দিয়ে চলেছো তাতে কি বিন্দুমাত্র চিন্তিত হচ্ছি আমি?
একদমই না বরং বিরক্ত হচ্ছি। কারণ তোমার বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া কোনটাই আমার কাছে ম্যাটার করে না। তুমি বেঁচে থাকলেও আমি যেভাবে চলাচল করবো তুমি মারা গেলেও সেভাবেই চলাচল করবো। ও কাঁদলে আমার যে অস্থিরতাটা হয়, তুমি মারা গেলে তার চারভাগের একভাগও অস্থিরতা হবে না আমার। যা যাওয়ার সব তোমার ফ্যামিলিরই যাবে। যার কাছে তোমার গুরুত্বই নেই তাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা না করে যারা তোমাকে ভালোবাসে তাদের আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করো। তুমি অনেক ভালো মেয়ে। আমার থেকেও অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করো তুমি। বুঝার চেষ্টা করো আর এসব পাগলামো বন্ধ করো।”
—” কিন্তু….”
এবার আমি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলাম,
—” কিন্তু মাই ফুট। আবার যদি এভাবে ডিস্টার্ব করেন তাহলে আপনার ম্যাসেজের স্ক্রিনশট, কল রেকর্ডিংস সব আপনার ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেবো। আপনার ভাইয়ের নাম তো চয়ন মাহমুদ। আর বাসা তো আনন্দমোহনের পাশে তাই না?”
ওপাশ থেকে ইতস্তত কন্ঠে বললো,
—” আপনি ভাইয়াকে চিনেন?”
—” জ্বি চিনি। আর বেশি হাংকিপাংকি করলে আপনার আসল রূপটাও তাকে চেনাবো। মাইন্ড ইট!”
কথাটা বলে ফোনটা কেটে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। শুভ্র ভাই ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে মৃদু হেসে বললেন,
—” বাহ্ বাচ্চাটা বড় হয়ে যাচ্ছে।”
আমি কিছু বললাম না। উনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বইটা টেনে নিয়ে বললেন,
—” কিছু বোর্ড মার্ক করে দিয়েছি। ওগুলো কমপ্লিট করে নিস। তুষার বার বার কল করছে আমায় একটু বেরুতে হবে। আর ফুপ্পিকে বলিস আমি বেরিয়ে গেছি অন্য একদিন খাবো।”
উনি তাড়াহুড়ো করে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও থেমে গেলেন। পেছন ফিরে বললেন,
—” শোন? খাওয়ার পর মনে করে মেডিসিন নিস। রাত জেগে পড়ার দরকার নেই।”
এটুকু বলে আবারও দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। আমি উদাস মনে বসে রইলাম। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুদিন যাবৎ হুটহাটই মন খারাপ হচ্ছে। মাঝে মাঝেই নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুঃখী মনে হচ্ছে। ভালো কথাতেও বিরক্তি আর রাগে শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। তার সাথে প্রচন্ড কান্নাও পাচ্ছে। কেন পাচ্ছে? কে জানে?
___________________
রাত প্রায় দশটা। আকাশে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে। চারপাশে হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস। আমি ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছি। সময়ের সাথে সাথে মন খারাপ ভাবটা যেন চক্রবৃদ্ধি আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারসাথে বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস। আমার এই দীর্ঘশ্বাসের মাঝেই ব্যস্ত পায়ে ছাঁদে এলেন শুভ্র ভাই। উনার হাতে পাখির খাঁচা। আমাকে দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেজ নিয়ে বললেন,
—” রাত দুপুরে একা ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা কেমন স্বভাব?”
আমি উনার হাতের খাঁচার দিকে তাকিয়ে উৎসাহী গলায় বললাম,
—” এটা কি?”
উনি মৃদু হেসে বললেন,,
—” আমিতুমি”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
—” মানে কি? দেখুন, একদম মজা করবেন না।”
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন,
—” আরে বাবা, মজা করবো কেন? ওদের নাম আমি এবং তুমি। এই নীল পাখিটা হলো আমি আর হলুদটা হলো তুমি।”
উনার কথায় বেশ মজা পেলাম আমি। নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে বললাম,
—” সত্যিই ওদের নাম আমি তুমি? নামগুলো ভীষণ অদ্ভুত শুভ্র ভাই।”
শুভ্র ভাই খাঁচাটা রেলিঙের ওপর রেখে হাসিমুখে বললেন,
—” কিছু কিছু বিষয় অদ্ভুত হতে হয় রোদপাখি। কারণ, কিছু কিছু বিষয় অদ্ভুত বলেই আমরা ভালোবাসি।”
এটুকু বলে উনি খাঁচার ভেতর পাখিদের দিকে তাকালেন। আদুরে গলায় বললেন,
—” এইযে আমি-তুমি? তোরাও পাখি আর এইযে এই মেয়েটাকে দেখছিস এটাও পাখি। ওর নাম রোদপাখি। তবে, এই পাখিটা শুধু শুভ্রর বুঝলি? রোদপাখির সবসময় মন খারাপ থাকে। রোদপাখির মন ভালো রাখার মহান দায়িত্ব কিন্তু এবার তোদের মাথায়। যদি শুনি তোরা থাকতেও রোদপাখি মন খারাপ করে বসে আছে, তাহলে ‘আমি’ কে কেড়ে নিয়ে ‘তুমি’ কে একদম একা করে দিবো। ঝিম মেরে বসে থাকলে চলবে না বুঝলি? কাজ করতে হবে। মন খারাপ তাড়ানোর কাজ।”
নীল পাখিটা উদাস চোখে উনার দিকে তাকালেন। ছাঁদের মৃদু আলোয় পাখিটার কালো ছোট্ট চোখটা কেমন চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে, চোখদুটো যেন উপচে আছে জলে। আমি একরাশ হাসি নিয়ে খাঁচায় হাত রাখলাম। শুভ ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—” সারাদিন মন খারাপ করে থেকে তোর বাপের বিপিটা না বাড়িয়ে একটু হাসতে শিখ। ছোট্ট একটা মেয়ে তার আবার কি গম্ভীর মেজাজ। এই আমি-তুমি? এর গাম্ভীর্যকে একদম পাত্তা দিবি না বুঝলি? বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমায় জানাবি। আমি কতো শতো কাজে ব্যস্ত থাকি। তাই তোদের এই মহান দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি। মহারানীর মন খারাপ হলে কিন্তু তোদের রক্ষে নেই।”
উনি একের পর এক উপদেশ দিয়ে চলেছে “আমি” “তুমি” কে। পাখিরাও পিটপিট করে তাকিয়ে তাদের মনোযোগীতার স্বাক্ষর দিচ্ছে। আমি ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি ঝুলিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে নিঃশব্দতা ছাপিয়ে আওয়াজ করে হেসে উঠছি। ছাঁদের লালটে আলো আর চাঁদের আলো মিলে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে উনার মুখে। সত্যিই, কিছু কিছু সৌন্দর্য অদ্ভুত বলেই আমরা ভালোবাসি।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/