রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৪২
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
মাথার উপর বিশাল আকাশটা মিটিমিটি তারায় ছেঁয়ে আছে। তাদের মধ্য থেকেই ছোট্ট একটা তারা খসে পড়লো ওই একটু আগে। সত্যিই কি খসে পড়লো? নাকি আমার দৃষ্টির ভুল? আমি উদ্বেগ মাখা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিশাল এই তারার ভূবনে সেই ছোট্ট তারাটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে পাশের বারান্দার দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই এখনও ফোনে কথা বলছেন। প্রায় অাধাঘন্টা যাবৎ চলছে উনার এই উচ্ছল ফোনালাপ। উনার এই দীর্ঘ ফোনালাপে আমার রাগ লাগার কথা কিন্তু অদ্ভুত এক কারণে রাগ লাগছে না। মাথার ভেতর ভোঁতা এক অনুভূতি হচ্ছে। পুরো পৃথিবীটাকে মিউট করে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র ভাইদের এই বাসায় মোট চারটা শোবার ঘর আছে।
সেই চারটি শোবার ঘরের মাঝে একটি ঘর আমার জন্য বরাদ্দকৃত। এই ঘরটিতে অন্য কারো কতৃত্ব নেই। অলিখিত নীতির মতো এই ঘরটিতে আমার অলিখিত মালিকানা। শোবার ঘরের মতো খাবার টেবিলের একটি চেয়ারও আমার জন্য বরাদ্দ করা আছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সেই চেয়ারটা এখন শুধুই আমার। ঘন্টাখানেক আগে সেই চেয়ারটাতে বসেই রাতের খাবার খেয়েছেন তাসনিম আপু। মামানি আর আমার কাজিনদের সাথে হাসিমুখে গল্প করেছেন। আমি রাগ করি নি। শুধু খাবার রেখে উঠে এসেছিলাম, বাড়ি ফিরবো বলে।
কিন্তু মামানির জন্য বাড়ি ফেরাটাও হয়ে উঠে নি। আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সেই অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার মানুষগুলোকে হুট করে ‘না’ বলা যায় না। মামানিও ঠিক সেরকম একজন মানুষ। উনাকে আমি ‘না’ করতে পারি না। আমি অন্ধকার বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরলাম। চারপাশের বাতাসটা বিষাক্ত লাগছে আজ। মন, মেজাজ সবই যেন তীব্র কোনো বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ঘন ঘন শ্বাস নেওয়ার পরও ভারী বুকটাতে অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না। বুকের কাছে দলা বেঁধে ভারী থেকে ভীষণ রকম ভারী হয়ে উঠছে। চোখ দুটো জ্বলছে কিন্তু বৃষ্টি ঝরছে না। বিছানায় গা এলিয়ে, চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আমার দীর্ঘশ্বাসের করুণ শব্দ নিস্তব্ধ দেয়ালে আঘাত হেনে আমার কানেই ফিরে এলো বরংবার।
ভীষণ অভিমানে চোখ জোড়া বন্ধ করতেই ভেসে এলো ঘন্টাখানেক আগের সেই দৃশ্য, শুভ্র ভাই এবং তাসনিম আপুর একসাথে পথ চলার দৃশ্য। বন্ধ চোখের কোল ঘেঁষে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। আমি হঠাৎ করেই অনুভব করলাম, এই গোপন অশ্রু বিসর্জনটুকু প্রয়োজন ছিলো। এই অশ্রু বিসর্জন ব্যতীত দীর্ঘ বিষাক্ত রাতটা কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না। কিছুতেই না।
পরের দিন সকালে, হেমন্তের নরম রোদ যখন আমার কপাল ছুঁলো তখন প্রায় আটটা বাজে। আমি ডানহাতটা বাড়িয়ে কপালের ওপর হাত রাখলাম। চোখ পিটপিট করে সামনের খোলা জানালাটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে বসলাম। জানালার কাঁচে একটি লাল-কালো পাখি ঠুকরা- ঠুকরি করছে। কেন করছে, তা হয়তো তার নিজেরই অজানা। আমি হাতটা হালকা নাড়িয়ে দুর্বল গলায় বললাম, ‘ হুঁশ! যা।’ পাখিটা আমার দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় ভুগে নতুন উদ্যমে ঠুকরা-ঠুকরি শুরু করল। আমি বিরক্ত হলাম। চোখ-মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। মামানি কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নার কাজ করছেন। আমাকে হেলেদুলে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মৃদু হেসে বললেন,
—-” রোদু রাণির ঘুম ভাঙলো তবে?”
আমি হাসলাম। মামানি চুলোর আঁচ কমিয়ে দিয়ে আঁচলে হাত মুছলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—–” চুলোর পাশে একটু দাঁড়া তো মা। ভাজি বসিয়েছি নাড়াচাড়া না করলেই পুড়া ধরে যাবে। তোর মামু ডাকছে, আমি যাব আর আসব।”
আমি চুলগুলোকে দু’হাতে মুঠো করে হাত খোঁপা করলাম। চুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম,
—–” তুমি যাও। আমি আছি এখানে।”
মামানি স্নিগ্ধ হাসলেন। মামানি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ল্যাপটপ হাতে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। ল্যাপটপটা টি-টেবিলে রেখে রান্না ঘরের দিকে উঁকি দিলেন। রান্নাঘরে শুধু আমার উপস্থিতি দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন। শার্টের খোলে রাখা বাকি চারটা বোতাম লাগালেন দ্রুত হাতে। ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
—–” কফি বানাতে পারিস? একদম কড়া কফি?”
আমি কফি বানাতে পারি না। এই বস্তুটি কখনোই আমার পছন্দের তালিকায় পড়ে না। জীবনটা যেখানে এমনিতেই পুড়ে আঙ্গার সেখানে পোড়া গন্ধযুক্ত কোনো খাবার কেন থাকবে জীবন তালিকায়? থাকবে না। আমি রাখিও না। এই সহজ কথাটা উনাকে বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা করে জবাব না পেয়ে আরো খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন উনি।
স্বাভাবিক কোনো সময় হলে ধমক টমক দিয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে ফেলতেন কিন্তু আজ তেমন কিছুই করছেন না। আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে আমাদের দু’জনের মাঝের পরিবেশটা এই মুহুর্তে স্বাভাবিক না। উনি পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। অফ হোয়াইট থ্রী-কোয়াটার প্যান্টটা হাঁটুর খানিকটা ওপর পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। বাকি পা’টুকু দীর্ঘ পুরুষালী লোমে ঢেকে আছে। আমি উনার পা থেকে চোখ সরিয়ে খুন্তি নাড়ায় মনোযোগ দিলাম। উনি খানিক্ষন মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,
—–” তুই ঠিক আছিস? না, মানে চোখ-মুখ কেমন যেন লাগছে।”
আমি শান্ত চোখজোড়া তুলে উনার দিকে তাকালাম। তারপর মামুর ঘরের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় ডাকলাম,
—–” মামানি? ভাজি হয়ে গিয়েছে। চুলো বন্ধ করে দেব?”
আমার প্রশ্নের জবাবে ঘর থেকে সশরীরে বেরিয়ে এলেন মামানি। তাড়াহুড়ো করে রান্না ঘরে এসে বললেন,
—–” এইতো এসে গিয়েছি। তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, বাকিটা আমি করছি।”
আমি চুলোর পাশ থেকে সরে দাঁড়ালাম। মামানির কথামতো ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছন থেকে মামানির কন্ঠ কানে এলো,
—–” কিরে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কিছু চায়? কফি বানিয়ে দেব?”
শুভ্র ভাই তেজ নিয়ে বললেন,
—–” আমি যা চাই তা কখনোই পাই না আম্মু। লাগবে না আমার কফি। বিরক্তিকর।”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। ততক্ষণে ল্যাপটপ হাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গিয়েছেন শুভ্র ভাই। মামানি কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে ডেকে উঠলেন,
—-” শুভি? এই শুভি? হলোটা কি আবার? সকাল সকাল এতো রাগারাগি ভালো লাগে না আমার।”
আমার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। শুভ্র ভাইয়ের সাথে আবারও দেখা হলো খাবার টেবিলে। সেটাকে বলা যায় দু’মিনিটের সাক্ষাৎ। উনি যখন টেবিলে খেতে বসেছেন তখন আমি নিজের ঘরে দোর আটকে বসে আছি। হঠাৎ করেই উনার সামনে যেতে ইচ্ছে করছিল না। মামানির অনেক ডাকাডাকির পর যখন বেরিয়েছি তখন শুভ্র ভাইয়ের খাওয়া শেষ প্রায়। আমি চেয়ার টেনে বসতেই উনি চোখ তুলে তাকালেন। ঠিক সেই সময়টিতেই উনার ফোন বাজলো। তুষার ভাইয়ার ফোন। উনি ছোট্ট করে বললেন,
—-” নিচে আছিস? আচ্ছা, আসছি।”
কল কেটে খাবারের প্লেটটা ঠেলে দিয়ে মামানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—-” আম্মু? সার্কিট হাউজের মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছি। ফিরতে ফিরতে দুপুর হবে।”
মামানি ব্যস্ত হয়ে বললেন,
—-” খাবার শেষ করে যা বলছি। কাল রাতেও তো খাস নি।”
শুভ্র ভাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
—-” ইচ্ছে করছে না।”
মামানি আর কিছু বললেন না। জানেন, বলেই লাভ নেই। উনার ইচ্ছে করছে না মানে উনি খাবেন না। পৃথিবী উল্টে গেলেও সে ‘না’ ‘হ্যাঁ’ হবে না। আমি আর মামানি দু’জনেই গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শুভ্র ভাই বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা দুই পর আমিও রওনা দিলাম বান্ধবীর বাসার উদ্দেশ্যে। স্পৃহার বাসা সার্কিট হাউসের অপজিটে সরু রাস্তাটির পাশেই। আমি স্পৃহার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। স্পৃহার থেকে নোট নিয়ে, কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলাম পার্কে যাব। দুই বান্ধবী মিলে নদীর পাড়ে বসে চা খাবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্কের গেইট পেরোনোর পর পরই বিশাল এক ধাক্কা খেলাম আমি। আমার স্তব্ধ দৃষ্টিজোড়া মুহূর্তেই বিস্ময়ের চাদরে ঢাকা পড়লো। স্পৃহা ফিসফিস করে বলল,
—–” এই? এটা তোর কাজিন শুভ্র ভাইয়া না? সাথে ওইটা কে? গার্লফ্রেন্ড?”
আমি জবাব দিলাম না। স্পৃহা নিজের মনেই বিরবির করতে লাগলো,
—–” নতুন রিলেশন নাকি রে দোস্ত? এর আগে তো
কখনো কোনো মেয়ের সাথে চোখে পড়ে নি।”
আমি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। এটাই কি তবে উনার ক্রিকেট ম্যাচ? এই ফুচকা গিলার জন্যই কি বাসার খাবার মুখে রুচে না? বাহ্ গুড চেঞ্জ। কাল পর্যন্ত যে ছেলে ফুসকার নামে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলতো সে আজ নব প্রেমিকার সাথে বসে ফুসকা গিলছে। নব? নাহ্ নতুন তো নয়। তাসনিম আপু তো পুরাতন, হয়তো একমাত্রও! আমার এবার কান্না পাচ্ছে। আকস্মিক এই আঘাতটা হজম করে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তিটা মন বা মস্তিষ্ক কেউই সরবরাহ করতে চাইছে না। আমি নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
—–” আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজ চা খাওয়া ক্যান্সেল। ফুচকা খাবো।”
—–” কিন্তু… ”
—–” বাংলা সিরিয়ালের মতো কিন্তু কিন্তু করা বন্ধ কর। ফুসকা খাবো মানে ফুসকা খাবো, এখানে আবার কিন্তু আসছে কোথাকে?”
এটুকু বলে থামলাম আমি। কিছুক্ষণ উনাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলাম। স্পৃহার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
—–” আমরা শুভ্র ভাইদের পাশের স্টলটাতে ফুসকা খাবো। তোর কাজ হলো পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের কাপল পিক তুলা। তবে, চুপিচুপি।”
কথাটা বলেই স্টলের দিকে হাঁটা দিলাম আমি। স্পৃহা আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে অসহায় গলায় বলল,
—–” দোস্ত? ছবি তুললে শব্দ হবে।”
—–” তোর মাথা হবে। ছবি তোল তুই।”
—–” শব্দ হবে তো।”
ওর সাথে বাকবিতন্ডা করতে করতেই নির্দিষ্ট স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। পাশে রাখা ব্রেঞ্চটাতে বসে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম,
—–” তুই যে উচ্চ শ্রেণীর গাধা তা কি তুই জানিস? এতো বছর ধরে পার্কের অপজিটে থেকে আসছো অথচ একটা ছবি তুলতে পারো না? তোর তো এখানে থাকাটাই বৃথা। তোর আসলে ময়মনসিংহ থাকার যোগ্যতায় নাই। তুই যোগ্যতাহীন মানুষ।”
স্পৃহা কিছু বলবে তার আগেই উঠে গিয়ে শুভ্র ভাইদের কাছাকাছি ব্রেঞ্চটাতে গিয়ে বসলাম। শুভ্র ভাই বা তাসনিম আপু কেউই এখনও খেয়াল করে নি আমায়। ব্রেঞ্চে বসেই অবচেতন মনে ওদের দিকে কান খাঁড়া করলাম আমি। শুভ্র ভাই কথা বলছিলেন,
—–” আমার উচিত তোমার কথাগুলো নিয়ে ভাবা। এতে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। তাছাড়া আই মাস্ট ছে ইউ আর আ স্মার্ট এন্ড ইন্টেলিজেন্ট গার্ল। সো,….”
শুভ্র ভাইয়ের কথার মাঝে আমার পাশে এসে ধপ করে বসে পড়লো স্পৃহা। ফুসকার দোকানদারকে ভীষণ ঝাল দিয়ে দু’প্লেট ফুসকা দিতে বলল। আমাদের চিল্লাপাল্লায় শুভ্র ভাইদের কথার সুর কেটে গিয়েছে ততক্ষণে। দু’জনেই আমাদের দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন। আমি তাকাতেই তাসনিম আপু বললেন,
—–” আরে রোদেলা? এখানে?”
আমি জোরপূর্বক হেসে শুষ্ক গলায় বললাম,
—–” এইতো ফুসকা খেতে এলাম। আপনারাও ফুসকা খেতে এসেছেন বুঝি? নাকি ঘুরতে?”
তাসনিম আপু উত্তর দেওয়ার পূর্বেই ফুসকা এলো। তাসনিম আপু বললেন,
—–” অনেক দিন ফুসকা খাওয়া হয় না। তাই ভাবলাম ,আজ যেহেতু শুভ্র রাজি তো ট্রিট মিস করা চলে না।”
আমি দূর্বোধ্য হাসলাম। নিজের রাগ কমাতে একের পর এক ফুসকা মুখে পুরতে লাগলাম। অতিরিক্ত ঝালে চোখ-মুখ লাল হয়ে এলো মুহুর্তেই। পাঁচ মিনিটের মাথায় সবগুলো ফুসকা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। স্পৃহার প্লেটে এখনও অধিকাংশ ফুসকায় পড়ে আছে। সে অবাক চোখে আমার কর্মকান্ড দেখছে। অতিরিক্ত ঝাঁঝে আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে তখন। সেই ঝাঁঝ মাখা অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে স্পৃহার প্লেটটা ছিনিয়ে নিলাম। মামাকে ফুসকাগুলো প্যাক করে দিতে বলে স্পৃহার দিকে তাকালাম। স্পৃহা তখনও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি নরম গলায় বললাম,
—–” বাসায় গিয়ে খাস দোস্ত। আমাকে এই মুহুর্তে বাসায় ফিরতে হবে, আর্জেন্ট।”
স্পৃহার বিস্ময়মাখা দৃষ্টিটা খানিক নরম হলো। বলল,
—–” হঠাৎ…”
—–” প্লিজ!”
স্পৃহা আর কথা বাড়ালো না। ফুসকার বিল মিটিয়ে নিয়ে শুভ্র ভাই আর তাসনিম আপুর দিকে তাকালাম। কাঠ কাঠ গলায় বললাম,
—–” আপনারা থাকুন৷ আসি তাহলে।”
তাসনিম আপু মৃদু হাসলেন। শুভ্র ভাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা কথাও বললেন না। উনার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনি কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি স্পৃহাকে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসেও থমকে দাঁড়ালাম। কি মনে করে, ভয়ানক একটি কাজ করে বসলাম। দীর্ঘ তিন বছর দশ মাস যাবৎ পরে থাকা নুপুরটা খুলে ফেললাম। উনার দীর্ঘ আবেগের স্মৃতিচিন্হটাকে উনার সামনে ধরে বললাম,
—–” এটা একটু মামানিকে দিয়ে দিবেন, শুভ্র ভাই? আসলে এখন আমি আমাদের বাসায় যাবো। আবার মামানিকে এটা ফিরিয়ে দেওয়াটাও জরুরি।”
শুভ্র ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, হাত বাড়ালেন না। একটা কথাও বললেন না। আমি বেশ কয়েকবার বলার পরও যখন হাত এগোলেন না তখন তাসনিম আপুর হাতের মুঠোয় নুপুরটা ধরিয়ে দিলাম আমি। মৃদু হেসে বললাম,
—–” যাবার সময় মনে করে নুপুরটা শুভ্র ভাইকে দিয়ে দিবেন আপু। চাইলে নিজের কাছেও রেখে দিতে পারেন। আমার একটু তাড়া আছে। আসছি!”
কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালাম। নুপুরহীন পা’টা হালকা লাগার কথা কিন্তু কেন জানি বড্ড ভারী লাগছে। পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। এই দীর্ঘ অভ্যাসটাকে অন্যের হাতে ফেলে এসে চাপা কান্নায় ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। যে নুপুরটা কয়েক মিনিটের জন্য চোখের আড়াল হলেও কেঁদে কেটে চোখ ফুলিয়েছি একসময়। সেই নুপুরটা অন্য কারো হাতে দিয়ে কিভাবে এতো নিশ্চিন্তে হাঁটছি আজ? এতোটা শক্ত কবে হয়ে গেলাম আমি? কিন্তু, আমারই বা কি করার ছিল? উনাকে শাস্তি দেওয়াটাও তো প্রয়োজন ছিলো।
উনাকে বুঝানো প্রয়োজন ছিলো, উনার আমাকে ছেড়ে দেওয়া মানেই আমার ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া নয়। তাছাড়া, এটা উনার শাস্তিরও অংশ। প্রাক্তনের সাথে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়ানোর অপরাধে এই ভয়ঙ্কর শাস্তিটা উনার প্রাপ্য! আমি ক্লান্ত শ্বাস নিলাম। কাঁপা হাতে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে কাঁপা গলায় বললাম,
—–” আমায় একটা রিকশা ডেকে দিবি স্পৃহা? আমি হাঁটতে পারছি না।”
স্পৃহা আমার দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠে বলল,
—–” রোদু? কি হয়েছে তোর? এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেন তোকে? তোর কি কোনো অসুখ করেছে?”
আমি মৃদু গলায় বললাম,
—–” হ্যাঁ, করেছে অসুখ। প্লিজ একটা রিকশা ডেকে দে। মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি স্পৃহা। জলদি বাসায় ফিরতে হবে আমায়। জলদি।”
স্পৃহার মুখটা মুহূর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। আমার ডান বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
—–” শুভ্র ভাইকে ডাকবো?”
—–” তুই রিকশা ডেকে দে। কাউকে ডাকতে হবে না। তুই না পারলে , আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি।”
স্পৃহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশা ডাকলো। আমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে নিজেও সাথে আসতে চাইলো। আমি ওকে সাথে না নিয়েই বাসায় ফিরলাম। এই মুহূর্তে একা থাকাটা খুব প্রয়োজন আমার। খুব প্রয়োজন।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/