ভাবীর সংসার
১৬ তম পর্ব
গত দুই দিন আরেকজনের বাটি দিয়ে কোন রকম দিন পার করলো পলি। কারণ আগে তরকারি না আনলে ভালো কিছু পাওয়া যায়না হলের ডাইনিং এ, এদিকে তাদের বাটি নেই। তরকারি আনতে বাটি প্রয়োজন।
জাহিদ দুই দিন পর আসার কথা সে আজ এখনো আসেনি, হয়তো টাকার যোগাড় করতে পারেনি।
কলি বললো কেন যে বিস্কুট-মুড়ি কিনে আনলি আপা! নয়তো ঠিকই মার্কেটে গিয়ে দুটি বাটি কিনে আনতে পারতাম।
– গত কাল রাতেই তো মুলার তরকারি দিয়ে ভাত খেতে পারিস নি, বিস্কুট খেয়ে ঘুমিয়েছিস।
– আজ তো দেখলে, রুপা মুখের উপর বলে দিল, তার বাটি সে দিতে পারবে না।
– ভাবছি আজ বিকেলে ভাবীদের বাসায় গিয়ে দুটি বাটি নিয়ে আসবো।
– আরেক দিন অপেক্ষা কর, মেজ ভাই আসবে।
– আর যদি কাল না আসে?
– তাহলে তুমি যাও, আমি যেতে পারবো না, ওই বাসায়।
– আচ্ছা, আমি নিয়ে আসবো।
– হেঁটে হেঁটে যাবে?
– আছে আর চল্লিশ টাকা, এটা তো রাখতে হবে, কখন কোন প্রয়োজন আসে। আর কি উপায় আছে।
পলি অর্ধেক রাস্তা হেঁটে যাওয়ার পর দেখলো শারমিনের খালা রিতা রিকশা করে যাচ্ছেন শারমিন দের বাসায়। তিনি রিকশা থামিয়ে বললেন, এই পলি কোথায় যাচ্ছ?
– ভাবীদের বাসায়।
– চলে আসো, আমিও যাচ্ছি।
– জি খালা।
– তা, এতো রাস্তা কি হেঁটেই যাচ্ছিলে?
– রিকশা পাইনি খালা, তাই হাঁটছি।
পলি ইচ্ছে করেই মিথ্যে বললো তাদের আর্থিক অবস্থার কথা সবাইকে জানিয়ে কি হবে! তার ভাইজানের সম্মান যাবে।
পলি ভাবীকে গিয়ে আস্তে করে বললো ভাবী, মেজ ভাই দুই/তিন দিনের মধ্যে চলে আসবে। তুমি আমাকে দুটি বাটি দিতে পারবে! আসলে, মার্কেট অনেক দূরে, এজন্য একা যেতে চাচ্চিনা।
– দুই বোন মিলে যেতে।
– আমরা কি আর সব চিনি ভাবী।
– আচ্ছা, বসো আমি নিয়ে আসছি।
– ভাবী, প্লিজ রিতা খালার সামনে বলবে না, আমি যে বাটি নিতে আসছি। খুব লজ্জা লাগছে।
– লজ্জা আমার ও করছে পলি, সামান্য বাটি না নিয়ে হলে উঠে গিয়েছ, আমারই তো ননদ বাটি কিনতে সমস্যা লজ্জা টা আমার, আমি কেন খালাকে বলতে যাবো।
একটা কাগজের প্যাকেটে শারমিন পলিকে বাটি দিয়ে বললেন, সুন্দর করে দিয়েছি, হলে যেয়ে খুএ দেখিও।
– ধন্যবাদ ভাবী, জিহান কে আদর দেই একটা, যাই এখন।
আসার সময় রিতা, পলিকে রিকশা করে তার কলেজের গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন এবং বললেন, তোমাদের খারাপ লাগলেই খালার বাসায় চলে আসবে, মাত্র দশ মিনিট লাগবে। খুব খুশি হবো আসলে।
সাহেদা বেগমের বোন রিতা, একদমই বিশ্বাস হয় না। কত আন্তরিক এই মানুষ টি! যেন সম্পূর্ণ আলাদা।
পলি রুমে ঢুকতেই বললো, সরি রে আপা, তোকে এভাবে একা যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি। মন খুব খচখচ করছিল, তুই যাওয়ার পর। শুধু মাত্র ভাবীর বাসার মানুষের কথার ভয়ে যেতে ইচ্ছা হয়না। অনেক কষ্ট হয়েছে না, কত দূর হেঁটে যেতে হয়েছে।
– না, রিতা খালা কে পেয়ে তার সাথে চলে গিয়েছি।
– যাক, শান্তি লাগলো। বাটি দিয়েছে।
– দেখ, এই কাগজের ব্যাগে দিয়েছে। আমি টয়লেটে যাই, এসে দেখছি।
– আচ্ছা।
কলির ব্যাগ খুলেই মন খারাপ হয়ে গেল, পুরোনো দুটি বাটি, নিচের দিকে কালির দাগ, কিছুটা বাঁকা হয়ে গিয়েছে, সম্ভবত এগুলো পরিত্যক্ত বাটি ছিল। এর মধ্যে স্টিলের বাটি।
কলির মনে হচ্ছে এগুলো এখন ফেলে দিতে, ভাবীর কি একবার ও রুচিতে বাঁধলো না, এই বাটি দিতে! থাক পলি আপার সামনে এই নিয়ে কথা বললে হয়তো মন খারাপ করবে, বলার দরকার নেই। কিন্তু কলিং বাটি দেখে মন খারাপ হলো।
টয়লেট থেকে এসে টেবিলের উপরে বাটি দুটি দেখে পলি হা করে তাকিয়ে আছে, কেমনে পারলেন ভাবী এমন একটা কালি মাখা, বাঁকা বাটি দিতে। পলির মনে হচ্ছে কেন যে বাটি আনতে সে গেল, না গেলেই হতো!
দুদিন পর জাহিদ হলে তাদের সব জিনিসপত্র নিয়ে আসলো, তাদের বই-খাতা, কাপড়, বাসনের মধ্যে আনলো,দুটি ধবধবে সাদা কাঁচের বাটি, দুটি মেলামাইনের বাটি, চামচ, দুটি মগ, দুটি কাঁচের গ্লাস, সব বাসন নতুন কিনে এনেছে জাহিদ।
পলি বললো মেজ ভাই কেন নতুন জিনিস কিনতে গেলে? ঘর থেকে নিয়ে আসতে!
– আর এই কয়েক টা জিনিস বতুন আনলে কি হয়? আর হলে থাকবি, দশজন দেখবে, ভালো জিনিস নিয়ে থাকবি না?
-হুম
পলি তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, বোনেদের সম্মানের কথা কত চিন্তা করে, অথচ ভাবী কি ধরনের বাটি দিলেন! জগত খুবই রহস্যময়।
পলি বললো, কাঁচের বাটির কি দরকার?
– রাখ কাজে লাগবে, আর এই তিনশো টাকা রাখ, পাঁচ তারিখ হতে আর সাত/আট দিন আছে। আমি টিউশনির বেতন পেয়েই টাকা পাঠাচ্ছি, ভাবীর নামে।
কলি বললো কেন ভাবীর নামে কেন?
– ভাইজান আমাদের গুরুজন, উনি বলেছেন কথা টা রাখা উচিত, যতই হোক উনি আমাদের এক সময় করেছেন।
– নিজের ব্যবস্থা করে, তবেই করেছেন।
– থাক, এসব বলিস না। আমি আজ যাই, তোরা খুব ভালো করে পড়বি, খুব ভালো করে।
দুই বোন কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের যাওয়া দেখছে। জাহিদ চলে যাওয়ায় মন টা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে দুজনের।
রুমে আসার পর রূপা বললো তোমাদের দেখি অনেকগুলি বাসন-কোসন আসছে!
কলি বললো হুট করে উঠায়, আগে আনতে পারিনি, তোমার লাগলে নিও।
– হুম।
পলি বললো কিরে তুই ওকে খোঁচা দিলি কেন?
– খোঁচা দেইনি, তাকে সত্যিই ব্যবহার করতে বলেছি, দুই দিন আগে ঠিকই তো না করেছিল, আমরা ছোট লোক নই, বুঝিয়ে দিলাম।
– থাক, বাদ দেয়।
– না রে, সব সময় বাদ দিলে, অনেকেই মাথার উপর নাচা শুরু করে দেয়। ভাবীর মতো আর এদের নামানো যায়না।
– হইছে, বাদ দেয় বললাম তো!
– হুম, বাদ দিলাম।
দুই দিন পর বাড়ী থেকে হলে চিঠি আসলো, কলি চিঠি নিয়ে এসে বললো আপা খারাপ কিছু নয়তো?
– আগে পড়, দেখি কি লেখা।
প্রিয়,
পলি-কলি,
আজ আমাদের অতিশয় খুশির দিন নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। বাড়ীতে এসেই চিঠি পেলাম, এবং নতুন দুটি ভালো টিউশনি পেয়েছে, তারা চলতে পারছে, এখন ঠিক ঠাক মতো। যেখানে ভালো সাবজেক্ট পাবে, ভর্তি হয়ে যাবে। এরচেয়ে আনন্দের খবর আর কি হতে পারে। আরেকটি সু খবর হলো ভাইজানের নতুন অফিসের সহকর্মী, জুনিয়র অফিসার পলিকে আগামী শুক্রবার দেখতে আসবে, আমি ও আসবো সব ধরনের খরচ পাতি নিয়ে। দুইজন তোরা এক রাতের ছুটি নিয়ে ভাবীর বাসায় চলে যাবি। পলি, আল্লাহ হয়তো তোর জন্য উত্তম জিনিসই রেখেছেন,তুই চিন্তা করিস না। মা ভালো আছেব, তোরা ভালো থাকিস, আর পড়তে থাকিস।
ইতি,
জাহিদ।
কলি আর পলি ভাইয়ের চান্স পাওয়ার খবরে হাত ধরাধরি করে ঘুরছে খুশিতে। তাদের মনে হচ্ছে আজকে তাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন।
কলি বললো, আপা, দেখেছিস তোর ভাগ্য কত ভালো, কত ভালো আছি বিয়ের প্রস্থান এসেছে।
পলি বিয়ের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। কেমন যেন লজ্জা লাগছে তার!
দুই বোন এখন, অধীর আগ্রহ করে আগামী শুরবারের অপেক্ষা করছে…..
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী।
১২/১২/২০২১