#পিশাচ দেবী
.
৫ম এবং শেষ পর্ব
.
সেই সময়েই ঘনকালো একটা মেঘের টুকরো সূর্যকে ঢেকে দিল। অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। আকলা চিৎকার থামাচ্ছে না। তার কন্ঠস্বর যেন প্রতিধ্বনিতো হয়ে বারবার ফিরে আসছে গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে। হারমা! হারমা! তার ওপর আবার হঠাৎ করেই এই আধার। সবাই আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়লো। মানজা বু এর শরীরও কেঁপে উঠলো সামান্য। যে লোকটা মশাল হাতে এগিয়ে আসছিল তার হাত থেকে মশাল পরে গিয়ে আগুন নিভে গেলো। মানজা বু হঠাৎ কান খাড়া করতেই আৎকে উঠলেন। বুঝতে পারলেন শুধু আকলা নয়। গোষ্ঠীর আরো অনেকেই নিজের অজান্তে বিড়বিড় করে বলছে ” হারমা, হারমা , হারমা ” !
কণ্ঠের সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বললেন মানজা বু। বৃদ্ধকে এত উত্তেজিত এর আগে কেউ দেখেনি। সবাই থতমত খেয়ে গেল। এখন আর গোষ্ঠীর লোকদের ভেতর থেকে কোনো গুঞ্জন আসছে না। আকলা যদিও তখনো চিৎকার করে দেবী হারমাকে স্মরণ করতে লাগলো। মানজা বু কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মশাল বহনকারী লোকটাকে তার কাজ করতে বলতেই লোকটা পুনরায় মশালে আগুন ধরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত-পা নিয়ে আকলার সামনে হাজির হলো।
আকলা চোখ বন্ধ করে এক মনে হারমাকে ডেকে চলেছে। এমন সময় চঞ্চলতা শুরু হলো গোষ্ঠীর মানুষদের ভেতর। তারাও কেউ কেউ চেঁচিয়ে উঠছে , এ হতে পারে না! এ অন্যায় ! যুগ পাল্টেছে , এখন সেই পুরোনো নিষ্ঠুর নিয়মে মানুষকে পুড়িয়ে মারা ঠিক না! বু , ভুল করছেন! নিজেরা সামনে বাড়তে চাইলো। লাঠিয়াল বাহিনী তাদের থামানোর চেষ্টা করতেই তারা ক্ষেপে উঠলো আরো বেশি। তলোয়ার দিয়ে যুবকের ঘাড় চেপে রাখা এক লাঠিয়ালকে হঠাৎ অন্যমনস্ক পেয়ে উরুসন্ধিতে ঘুষি মেরে দিল যুবক। চাইলো সরে যেতে। লাঠিয়াল আর্তনাদ তুলে আর এক মুহূর্ত চিন্তা না করেই তলোয়ার চালিয়ে দিল যুবকের গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতেই লুটিয়ে পরলো যুবক মাটিতে। সবাই হতভম্ব হয়ে গেল এবার!
এবার গোষ্ঠীর বাকি সবাই পুরো ক্ষেপে গেল। এক লোক বড় একটা পাথর ছুঁড়ে দিল লাঠিয়াল লোকটার মাথা বরাবর। ঠিক জায়গায় লেগে সাথে সাথেই মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেল লাঠিয়ালের। মারা গেল সে। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত।
শুরু হলো এবার আঘাত-প্রতিঘাত । গোষ্ঠীর লোকেরা যে এত ক্ষেপে যাবে তা কল্পনাও করেনি বু বা তার লোকেরা। বা এমন খুন খারাবি হবে। তাদের মানুষিক ভাবে খেপিয়ে তোলার জন্য যে পিশাচ হারমা এর হাত আছে তা আন্দাজ করতে পারে মানজা বু। নাহলে হঠাৎ করেই এত নিষ্ঠুর, বর্বর হয়ে উঠলো কেন ওরা!
গোষ্ঠীর লোকেরা যে যা পাচ্ছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো লাঠিয়াল বাহিনীর ওপর। একটা কুঠার এর ডগা বিদ্ধ করলো এক লাঠিয়ালের বুক। আরেক লাঠিয়াল সুনিপুন ভাবে তলোয়ার চালিয়ে গোষ্ঠীর নিরস্ত্র ৩ যুবককে সাথে সাথেই খুন করে ফেলল।
কখন মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার শরীরে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে গোষ্ঠীর দুই তরুণ তা খেয়ালই করার সুযোগ পেলো না মানজা বু। আকলা মুক্ত হয়ে কোথায় চলে গেল তারও খোঁজ রাখলো না কেউ। ভয়ঙ্কর মারামারি শুরু হয়ে গেল , একের পর এক নির্মম চিৎকার , মানুষের শরীর ছিন্নভিন্ন করার পর উল্লাস, চোখ উপরে ফেলার দৃশ্য, লাঠি, কোদাল , তলোয়ারের আঘাত খেয়ে মৃত্যুর আগ মুহূর্তের আর্তনাদ , মেয়ে- বাচ্চা এর কান্নার শব্দ , আর্তনাদ মুহূর্তেই আরো ভয়ঙ্কর করে তুললো পরিবেশ। আকাশে জমা মেঘের মতো অন্ধকার করে দিল গত দুই যুগ ধরে বহন করা গোষ্ঠীর সংস্কার, শান্তি।
হতবিহ্বল হয়ে চারপাশে তাকাতে লাগলেন মানজা বু। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছেন তিনি। এ কী ঘটছে ! তিনি স্বপ্ন দেখছেন নাকি ! মৃত লাঠিয়ালের তলোয়ার তুলে নিয়ে একজন যুবক যখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার ঠিক কাঁদ বরাবর কোপ দেওয়ার জন্য তলোয়ার উঁচু করলো তখন তার হুস ফিরলো। আঘাতটা যদিও তার শরীরে পড়ার আগেই ছিমন এসে এক কোপে ছেলেটার ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলল। রক্তে মুখ লেপ্টে গেল মানজা বু এর। ছিমন বলল , বু আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। সবাই ক্ষেপে গেছে আপনার ওপর।
কেউই ধারণা করতে পারেনি এই তাণ্ডবের পেছনে পিশাচটা দায়ী। তবে এমন ঘটনা ঘটতে পূর্বেও দেখেছে বু। মানজা বু ছিমনকে হুকুম দিলেন , পবিত্র ঘর থেকে পবিত্র পাথর আর ঢোলটা নিয়ে আসো। দ্রুত! এখনো দেরি হয়ে যায়নি !
ছিমন এর অর্থ বুঝলো। আরেক লাঠিয়ালকে বু এর পাশে রেখে এক ছুটে গিয়ে পবিত্র ঘর থেকে পাথর আর ঢোল নিয়ে এলো। এই পাথরের সাহায্যে ঢোলে আঘাত করতে হবে। ভয়ংকর শব্দ সৃষ্টি হবে তাতে। অবশ্যই সেই শব্দ পবিত্র। এই শব্দ যত দূর যাবে কোনো পিশাচ তার মায়ার প্রভাব খাটাতে পারবে না ততদূর।
ছিমন , বু এর আদেশে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পাথরটা আঘাত করতে লাগলো বড় ঢোলটার দু-পাশে , তালতালে। বিশাল ঘুরুম , ঘুরুম শব্দে কেঁপে উঠলো যেন চারপাশ। নেমে এলো অদৃশ্য আশীর্বাদ। কালো মেঘ ভেসে গেলো। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে চারপাশ। গোষ্ঠীর সবাই তাদের জ্ঞান ফিরে পেলো। চারপাশে এত লাশ , মানুষের শরীরের অংশ আর নিজেদের রক্তে ভেজা শরীর দেখে তারাই যেন শিউরে উঠলো। হতভম্ব হয়ে ফেলে দিল যার যার হাতের অস্ত্র। নিজেরা কী করেছে বুঝতে পেরে হাটু মুড়ে বসে পড়লো মাটিতে। দুই হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো।
ঢোলের শব্দ আরো বাড়তে লাগলো। পুরোপুরি ক্ষেপে গেছে ছিমন। পাগলের মতো পাথরটা দিয়ে আঘাত করছে ঢোলটায়। কান ফাটিয়ে পিশাচ টাকে মারাই যেন তার উদ্দেশ্য! মানজা বু আবার ভয়ে ভয়ে আতঙ্কে চারপাশে তাকালেন । তারা হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করেছে দেখেও শান্তি পেলেন না। ভয়ঙ্কর এক শিহরণে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি । এ কী হলো ! কত মানুষ মারা গেল এই এক মুহূর্তে! অথচ সে কিছুই করতে পারলো না! পিশাচটাই জিতে গেলো ! এই গোষ্ঠীর নিরাপত্তার দায়িত্ব তার , সেই তো বু ! একজন ব্যর্থ বু। তার পূর্বপুরুষের কাছে মুখ দেখাবে কী করে সে! লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে তার!
আর কোনো বিপদ নেই বুঝতে পেরে এক লাঠিয়ালের সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে ফিরে গেলেন মানজা বু। ছিমন তখনো উন্মাদের মতো ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় শেষ বেলায় মানজা বু নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন। তারপাশে এক সেবাকারী। ঘরের বাইরে দুজন লাঠিয়াল। ছিমন ঘরে ঢুকতেই সেবাকারী মেয়ে টা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছিমন কন্ঠে বিনয় আর শ্রদ্ধা মিশিয়ে মানজা বু কে বলল:
সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে বু। কবর খোঁড়া হয়েছে । লাশগুলোকে কলাপাতা দিয়ে আবৃত করে গোরস্থানে নেওয়া হয়েছে। যারা মারা গিয়েছে তাদের আত্মীয়দের শোক অবশ্য কাটেনি। আপনার অনুমতি পেলে কবর দেওয়া শুরু করবো বু।
কথা বলতে গিয়ে মানজা বু অনুভব করলেন গলা দিয়ে আগের মতো শব্দ বের হচ্ছে না। হাত ইশারায় ছিমনকে কাছে ডাকতে গিয়ে আরো মুষড়ে পড়লেন। হাত নড়ানোর শক্তি নেই, পুরো দেহ অবশ হয়ে গেছে। তবে বু এর ছটফটানি দেখে ছিমন তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মাথার পাশে হাটু মুড়ে বসলো। মানজা বু বিড়বিড় করে বললেন :
আকলাকে খুঁজে পেয়েছ ?
না, বু। সেরম করে খোঁজার সময় পায়নি। তবে গোষ্ঠীর অনেকেই খুঁজছে। যারা ওকে পুড়ানোর প্রতিবাদ করেছিল তারাও তার ওপর রেগে আছে আর সব কিছুর পেছনে তাকেই দায়ী মনে করছে। ওকে খুঁজে পেলে এবার পোড়ানোর আগে আপনার অনুমতিও চাইবে না তারা।
আমি আকলাকে ক্ষমা করলাম।
বু!
যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। এই পিশাচের পাল্লা থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা পেতে হবে। আজ যে হত্যাযজ্ঞ হলো , তাতো কেবল শুরু। আরো অনেক প্রাণ যাবে। পিশাচটার বিশ্বস্ত কেউই পারে আমাদের রক্ষা করতে।
দীর্ঘ বাক্য বলার পর গলাটা আবার লেগে এলো মানজা বু এর। চিচি শব্দ করে কিছুক্ষণ , আবার শুরু করলেন।
এখন এই পিশাচের কবল থেকে আকলাই আমাদের রক্ষা করতে পারবে। যেভাবেই পারো ওকে খুঁজে আনো এখানে। জঙ্গলেই গেছে ও। ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। ওকে নিয়ে এসো। আর নতুন পুরোহিতকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও। মৃতরা যাতে কষ্ট না পায় ছিমন। পবিত্র মাটিতে শুইয়ে দাও ওদের। আমার দায়িত্ব আজ তুমি পালন করো। দেখতেই তো পাচ্ছ আমার অবস্থা।
ছিমন মাথা নুইয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘুরে দরজার দিকে এগোতেই মানজা বু চি চি করে বললেন , গভীর রাতের আগে ওই ঢোলের শব্দ বন্ধ করো না । সে যাতে কিছুতেই ফিরে আসতে না পারে।
সেই সময় ঘুরুম করে শব্দ ভেসে এলো ঢোলের। ছিমন আশ্বস্ত করলো শব্দ বন্ধ হয়নি, দেখতেই পাচ্ছেন।
এরপরে কঠিন কাজে নেমে গেল ছিমন। গোষ্ঠীর ১৭ জন মানুষ মারা গেছে আজ। তার বাহিনীর ৬ জন সহ। সবাইকে লাঠিয়াল বাহিনী আর গোষ্ঠীর লোকের সাহায্যে পবিত্র গোরস্থানে শুইয়ে দিল। কবর দেওয়ার পর তার লোকজন জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে আকলাকে খুঁজে বের করলো। গোষ্ঠীর সবাই তাকে দেখেই ক্ষেপে উঠলো। কিন্তু মানজা বু এর আদেশে , নিরাপদে , সম্মানের সাথেই বু এর ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। গোষ্ঠীর লোকেরা মানজা বু আকলাকে ক্ষমা করে দিয়েছে শুনতে পেরে বেশ বিস্মিত হয়েছে। তাছাড়া ছিমনকে সবাই ভয় আর শ্রদ্ধা করে। তাই তার বিপক্ষে গিয়ে কেউ আর আকলার ওপর হামলা করলো না।
প্রায় অচেতন হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন মানজা বু। আকলা ঘরে ঢুকেই বু এর পায়ের কাছে গিয়ে পড়লো।
আমাকে শাস্তি দিন বু! আমার জন্যই এইসব খুন-খারাবি , রক্তপাত হলো। আমাকে পুড়িয়ে মারার হুকুম দিন আবার! আমিই সব নষ্টের মূল।
মানজা বু চোখ মেলে তাকিয়ে ইশারা করতেই ছিমন সহ ঘরের সবাই বাইরে চলে গেল। ঘরের ভেতর দুটো হারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় বৃদ্ধ আকলার মুখের দিকে তাকালেন। চিচি করতেই আকলা তার মাথার কাছে চলে গেল। বু বললেন :
তোমায় আরো বড় শাস্তি দেব মা। আমার মৃত্যুর পর এই গোষ্ঠীর দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে।
না , বু! অমন কথা বলবেন না!
এই গোষ্ঠীকে পিশাচদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে তোমাকেই। নিজের মৃত্যু পর্যন্ত খেয়াল রাখবে কেউ যাতে পিশাচ সাধনার অধীনে না যায়। আমি কি না করেছি গোষ্ঠীর লোকদের জন্য , যাতে তাদের অভাব না দেখা দেয় আর আশ্রয় না নিতে হয় অলৌকিক শক্তির। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি!
আমি আপনাকে ব্যর্থ করেছি বু!
তোমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিজেকে আমি নির্দোষ বানাতে পারবো না মা আকলা। এখন শোনো ওই পিশাচটাকে আজ রাতের মধ্যেই দুনিয়া ছাড়া করতে হবে!
কিন্তু সেতো অমর!
ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ অমর নয় মা। আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। তারাও আমাদের মতো এমন পিশাচের পাল্লায় পড়ে গোষ্ঠীর ধ্বংস হতে দেখেছেন। তাই তারা পিশাচ হত্যা করার নানান পথ আবিস্কার করেছেন। তুমি সাহায্য করবে বলো ?
জান দিয়ে দিব বু।
তাহলে শোনো। ঢোলের শব্দ থেমে গেছে দেখতেই পাচ্ছ। পিশাচটা আবার জঙ্গলে ফিরে আসছে। এখন যদি কেউ একটা মৃত শরীর বয়ে নিয়ে যায় জঙ্গলে তাহলে পিশাচটা তার আহ্বানে সাড়া দেবে। নতুন পুরোহিতকে আমি সেই পবিত্র প্রাণীর রক্ত জোগাড় করতে বলেছি যে রক্তের স্পর্শে শূন্যে মিলিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় দুনিয়ার সমস্ত পিশাচ। সেই রক্ত রাজ বংশের একজন লোককে পান করতে হবে। তখন তার শরীরও পবিত্র রক্তে ভরে যাবে! এবং লোকটা অচেতন হয়ে যাবে। সেই লোকটাকে জঙ্গলে বয়ে নিয়ে গিয়ে পিশাচটার সামনে হাজির করতেই পিশাচটা যখন তার শরীরে কামড় দেবে। তার শরীরের রক্ত পিশাচটার মুখ স্পর্শ করবে সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে সে।
চিচি করে , ছাড়া ছাড়া ভাবে কথাগুলো বু বললেও প্রতিটা কথা বুঝতে পারলো আকলা। ভয়ে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
পিশাচটার সাথে তো তাহলে রাজ রক্ত বহন করা লোকটাও মারা যাবে বু!
একটা প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা পাবে পুরো গোষ্ঠী।
কে পান করবে পবিত্র রক্ত ?
আমি।
না, বু! এ কিছুতেই হতে পারে না! পাপ করেছি আমি। আমার শরীরেও বু এর রক্ত বইছে। আমি প্রাণ দেব!
জিদ করো না মা আকলা! তাহলে এই গোষ্ঠী , দেখবে কে? আমি আর কদিন বাঁচবো ! আমার অচেতন শরীর নিয়ে তুমিই জঙ্গলে যাবে পিশাচটাকে বধ করতে।
কিন্তু বু, সেতো অন্তর্যামী !
অন্তর্যামী তাই জানতে পারে যা আমরা জানাতে চাই! তোমার মনে যা তাই অন্তর্যামী শোনে আর বিশ্বাস করে। তুমি যদি এই পরিকল্পনার কথা মনে না আনো এক মনে , মনের সমস্ত জোর দিয়ে শুধু পিশাচটার কথা চিন্তা করো তাহলে সে কিছুই টের পাবে না।
আমি আপনাকে হারাতে চাই না , বু!
আর কোনো উপায় নেই মা! দেরি করো না । আর শুনো সেদিন হয়তো সত্যিই ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলে তুমি । পিশাচটা দেবী পরিচয়ে তোমাকে রক্ষা করে। কিন্তু মনে রেখ , প্রকৃত দেবী সাহায্যের পরে কোনো বিনিময় চায় না। তারা ভক্তের ভক্তিতেই সন্তুষ্ট হয়।
জ্বী , বু।
আর তোমার স্বামী হিসেবে ছিমন কে তুমি বাছাই করতে পারো আমার মৃত্যুর পর। সেই সবচেয়ে দায়িত্ববান পুরুষ এই গোষ্ঠীর। তাছাড়া তুমি নিজের পছন্দমত কাউকে বেঁচে নিতে পারো।
মানজা বু এবার ছিমনকে ডাক দিলেন। তার ইশারায় পবিত্র মন্ত্র পড়া , পবিত্র প্রাণীর রক্ত নিয়ে পুরোহিত ঢুকলেন ঘরে। মানজা বু এর ওঠার শক্তি নেই। পুরোহিত মন্ত্র পড়তে পড়তে রক্তটুকু ঢেলে দিলেন বু এর মুখে। খুকখুক করে কেশে অজ্ঞান হয়ে গেলেন বু।
মানজা বু আগেই ছিমনকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জঙ্গলের পাশে পর্যন্ত বু এর অচেতন দেহ পৌঁছে দিল লাঠিয়াল বাহিনী। আকলা ভয়ে কাঁপছে। যার শুরু সে করেছিল তার শেষ সে করতে পারবে তো! ধরা পড়ে যাবে না তো ! বু এর প্রানের মূল্য দিতে পারবে তো ! এই গোষ্ঠীর ভবিষ্যত এখন তার হাতে।
একটা পাটিতে করে বেঁধে বু এর শরীর টেনে নিয়ে যাচ্ছে আকলা। এক হাতে হারিকেন, ওপর হাতে পাটির মাথায় বাধা দড়ি। একমনে পিশাচ দেবী হারমার নাম নিতে নিতে এগোচ্ছে আকলা। প্রায় আধ-ঘন্টা হাটার পর হারিকেনের আলোতে গুহা মুখ দেখতে পেল আকলা। তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে হারমা । ভয়ঙ্কর কুৎসিত একটা নগ্ন শরীর বেরিয়ে এলো গুহার ভেতর থেকে। হিসহিস করে বলল:
আমাকে ভুলে যাসনি! মাথা নুয়া। আমি তোর দেবী!
হাটু গেড়ে বসলো আকলা। এক মনে হারমার নাম জপে যাচ্ছে । ধীরে ধীরে লাশটার দিকে এগিয়ে এলো হারমা। উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো । বিনিময়! লাফিয়ে উঠে পাটি সরিয়ে কামড় বসালো মানজা বু এর হৃদপিণ্ড বরাবর। এক কামড়ে ছিড়ে মুখে নিল খণ্ডটি। মুখ রক্তে ভরে গেল তার। পরমুহূর্তেই গগনবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো পিশাচটার গলা থেকে! বুঝতে পারলো কিছু একটা বেঠিক ঘটেছে।কঠিন চোখে আকলার দিকে তাকিয়ে বললো:
আমি অমর , অবিনশ্বর । আমি আবার ফিরে আসবো এখানে ! আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না! তোর আর তোর বংশ ধরের মৃত্যু হবে আমার হাতে!
শূন্যে মিলিয়ে গেল সে!
• * * * * * সমাপ্ত * * * * *
লেখা: #Masud_Rana
[ গল্প যতক্ষন লেখি ততক্ষণ গল্পে ডুবে থাকি। লেখা শেষ হলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে মনে। গল্পটা পড়ে পাঠকরা কী অনুভূতি প্রকাশ করবে তা জানতে মন উসখুস করে। পাঠকদের জন্যই তো গল্প । তাদের গঠনমূলক মন্তব্যই তো অনুপ্রেরণা দেয় লেখার। যারা প্রথম পর্ব থেকে এই পর্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়েছেন সবার জন্য ভালোবাসা। ]