- পিশাচ পুরুষ ১ম পর্ব।
- প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য গল্প।
- ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প।
- বিখ্যাত ভূতের গল্প।
- বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভূতের গল্প।
- বিদেশি ভূতের গল্প।
১.পিশাচ পুরুষ ১ম পর্ব
( প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠকদের জন্য, দূর্বল হৃদয়ের পাঠকদের জন্য নয়)
#পিশাচ পুরুষ ১ম পর্ব
মেয়েটা যখন বলল এক মাস তাকে বন্ধি রেখে একটা দানব আকৃতি পিশাচ তার সাথে জোরপূর্বক শারীরিক অত্যাচার করেছে তখন কেউই ওকে পাত্তা দিল না, সবাই হাসলো। কিন্তু তার এক মাস পরেই যখন আবিষ্কৃত হলো মেয়েটার গর্ভে সন্তান এসেছে তখন সকলেই হতবাক হয়ে গেল। অনেকেই তাকে বলল গর্ভপাত করিয়ে ফেলতে। মেয়েটা বার বার কেঁদে কেঁদে শুধু বলল, বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হলে পিশাচটা এই গ্রামের সব মানুষদের খুন করে ফেলবে। গ্রামের সবাই একেবারেই বিস্মিত হয়ে গেল যখন ৯ মাস পর মেয়েটা গর্ভ থেকে একটা চার পায়া পশু প্রসব করলো।
চারপায়া অদ্ভুত জন্তুটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গুঞ্জন ঝুরে দিল প্রসবঘরের সবাই। এমন অদ্ভুত দবদবে সাদা জন্তু তারা জীবনে কখনো দেখেনি। মেয়েটা প্রসব করার পরেই অচেতন হয়ে গিয়েছিল। আচমকা চোখ খুলে উঠে বসলো। জন্তুটাও এবার নড়ে উঠে বসলো। চোখ খুলে একবার তাকালো লোকজনের দিকে। নাক কুঁচকে গন্ধ খুঁজল কিছুর। এরপর এক লাফে মা মেয়েটার কোলে গিয়ে উঠল, আচল সরিয়ে স্তনে মুখ দিল। দাই মহিলাটি ভয় পেয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। তাকে অনুসরণ করে বাকিরাও বাইরে বের হয়ে গেল। মেয়েটা একটা জন্তু প্রসব করেছে শুনে এরমধ্যেই বাড়িতে প্রচুর ভিড় হচ্ছে। পুরো গ্রামে উত্তেজনা।
হঠাৎ মেয়েটা পাগলের মতো চেচাতে চেচাতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। কোলে অদ্ভুত সেই সাদা জন্তু। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, খবরদার! আমাদের সন্তানের যে ক্ষতি করতে আসবে তার পুরো বংশ নির্বংশ করে দেবে ওর বাবা। আমি এখন আর তোমাদের সাথে একসঙ্গে থাকতে পারবো না। আমি এখন থেকে জঙ্গলে থাকবো। কেউ আমায় খুঁজবে বা বিরক্ত করবে না। করলেই সর্বনাশ!
এই বলেই জন্তুটাকে কোলে নিয়ে গ্রামের পাশের এক ঘন জঙ্গলের দিকে ছুট লাগলো মেয়েটি। অনেকেই তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলো। মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! হবেই বা না কেন, এমন জন্তু জন্ম দেওয়া কার পক্ষে সম্ভব! মেয়েটার গায়ে এত শক্তি হলো কী করে। একদম ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগলো সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এই জঙ্গলটা নিয়ে অনেক আতংক আছে গ্রামবাসীর ভেতর। তাই তারা কেউই ভেতরে যাওয়ার সাহস পেল না।
এরপর থেকে সেই গ্রামে মেয়েটাকে আর কেউ দেখতে পায়নি। জঙ্গলের ভেতরে কাঠ আনতে, পাখি ধরতে অনেকেই দল বেঁধে যেত। তাদের কেউও ওখানে কোনোদিন মেয়েটাকে দেখেনি। জঙ্গল যত পুব দিকে গেছে তত আর গভীর , ঘন হয়েছে। সেদিকে কেউই যায় না। তাই সেদিকের খবর কেউ রাখে না। মেয়েটার কোনো আপনজনও নেই যে তার খোঁজ করবে। এক সময় গ্রামের মানুষ গুলো মেয়েটাকে প্রায় ভুলেই গেল।
এক বছর পর হঠাৎ এক অমাবস্যার রাতে জঙ্গল থেকে ভয়ানক একটা জন্তুর হুংকার বেরিয়ে এলো। শব্দটা এতই বিকট ছিল যে অর্ধেক গ্রামের লোক সেটা শুনতে পেয়েছিল। যে ই শব্দটা শুনলো তারই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো আতঙ্কে। কোনো এক ভয়ানক জন্তু রাগে যেন ফুঁসছে। এরপর থেকে জঙ্গলের পাশে গড়ে ওঠা বাড়িগুলোর মানুষ প্রায় রাতেই রক্তহীম করা সেই ভয়ানক হুংকার শুনতে পেত। যেটার উৎস সেই জঙ্গল। সন্ধ্যার পর জঙ্গলের আশেপাশে কেউ যেত না তাই। দিনে আতংক কিছুটা কম ছিল।
জঙ্গলের খুব কাছেই রইস আলীর বাড়ি। গভীর রাতে। স্ত্রী কন্যা নিয়ে শুয়ে ছিল সে। হঠাৎ গোয়াল ঘর থেকে পোষা গরু-ছাগলের ভয়ানক আর্তনাদের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। দ্রুত একটা দা হাতে ছুটে যায় সেখানে। গিয়ে দেখতে পায় একটা গাভী উঠানে ছটফট করছে মাটিতে লুটিয়ে, গলার পাশ থেকে বের হওয়া রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠান।
বাঘ বা শিয়াল! না, এমন সময় গোয়াল ঘর থেকে অদ্ভুত দর্শন বৃহৎ একটা চারপায়া সাদা জন্তু বেরিয়ে এলো, আকারে গাভীটির দ্বিগুন, জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চোখ, নিঃশ্বাসের ফুসফুস আওয়াজ, চাঁদের আলোয় চারপাশ কাঁপিয়ে ভয়ানক এক হুংকার ছাড়লো ওটা ওর দিকে তাকিয়ে! ওটার মুখ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত। হাত থেকে দা টা পরে গেল রইস আলীর। আতঙ্কিত হয়ে পেছাতে গিয়ে পায়ের সংঘর্ষে উঠানে পরে গেল সে।
অদ্ভুত ভয়ানক জন্তুটা লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রইস আলী বুঝল তার বাঁচার আশা শেষ। এই অঞ্চলে বাঘ আসে না, এমন মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। এটা কী জন্তু! জন্তুটা লাফ দিল কিন্তু রইসের উদ্দেশ্যে নয়। গাভিটার ধর চেপে ধরেছে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে উঁচু করে ফেলল ওটাকে। ওটাকে মুখে আটকে ঘুরে ছুট লাগলো জঙ্গলের দিকে। এরমধ্যেই গোয়াল ঘরে থাকা বাকি পশুগুলো গগনবিদারী চিৎকার জুড়ে দিল ভয়ে। আশেপাশের সব বাড়ির লোক ছুটে এলো এদিকে।
উঠানে রক্ত দেখে সবাই ভড়কে গেল। রইস মিয়া দৃশ্যটা ব্যাখ্যা করলো সবাইকে। আতঙ্কে তার শরীর বার বার কেঁপে উঠছে জন্তুটার শরীরের বর্ণনা দিতে দিতে। গ্রামের সবাই বুঝতে পারলো ভয়ানক এক জন্তুর প্রবেশ ঘটেছে জঙ্গলে। প্রায় রাতে ওটার হুংকার শুনেই আতঙ্কে থাকতো সবাই, এখন আবার ওটা শিকারে বের হতে শুরু করেছে!
এরপর থেকে এমন বীভৎস ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগলো। জঙ্গল থেকে ভেসে আসে ভয়ানক হুঙ্কার। মাঝেমধ্যে মাঝরাতে বাড়ির গোয়ালঘর থেকে বোবা প্রাণীর আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির মালিক উকি দিয়ে ভয়ানক দর্শন সাদা হিংস্র জন্তুটাকে দেখতে পায়। উন্মাদের মতো কামড়ে ছিড়ে খাচ্ছে একটা পশুকে, বাকিগুলো ভয়ে চেঁচাচ্ছে।কোনো কিছু করে বাধা দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না সে। কখনো বা কারো বাড়ি হতে একটা পশুকে হত্যা করে মুখে করে নিয়ে ছুট লাগায় জঙ্গলের দিকে।
ওটার আকৃতি দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে। মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি এখন পর্যন্ত। অবশ্য ওটা রোজ রাতে শিকারে বের হয় না, হঠাৎ হঠাৎ ১০-১৫ দিন পর পর এক রাতে ওটা হুংকার ছাড়তে ছাড়তে শিকারের কাছে আসে। গ্রামের মানুষের আতঙ্কের সীমা রইলো না, প্রতিকারের উপায়ও খুঁজে পেল না। দল বেঁধে ওটাকে হামলা করে না জানি চটিয়ে দেওয়া হয়, এরপর হয়তো মানুষের উপর হামলা চালাবে রাগে ওটা। অন্তত ওটাকে মারার ক্ষমতা যে তাদের নেই তা তারা বেশ বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ এই ভয়ানক বিভীষিকাময় জন্তুর এই কর্মকাণ্ডে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে।
একদিন ভোর ৫টা। গ্রামের ষাট উর্ধ বৃদ্ধা পরীমনি সকালে হাটতে হাটতে হাজির হলেন জঙ্গলের কাছে। আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত আভা আশেপাশের পরিবেশ হালকা আলোকিত করে ফেলেছে। বৃদ্ধার উদ্দেশ্য জঙ্গলের কিনারায় একটা কামরাঙা গাছ , সকালে ওটার নীচে ফল পরে থাকতে পারে। সেখানে পৌঁছে দেখল গাছের নিচু একটা ডালে একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে। বৃদ্ধার চোখের কোনো সমস্যা না থাকায় বুঝতে পারলো ছেলেটার পরনে কোনো কাপড় নেই। এত সুন্দর পুরুষ! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।
এক লাফে যুবকটা বৃদ্ধার কাছে এসে দাড়ালো। তার থেকে চোখ ফেরাতে পারে না বৃদ্ধা। কী মায়াবী মুখ, ঝাকড়া চুল, কালো চোখ জোড়া কিসের এক নেশায় জ্বলছে। যুবককে এভাবে নগ্ন দেখে বৃদ্ধা কিছুটা কুন্ঠিত বোধ করলো। যুবক ধীরে ধীরে তার মুখোমুখি এসে দাড়ালো। আলতো করে তার চিবুক স্পর্শ করলো। বৃদ্ধার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো উন্মাদনায়। হঠাৎ বৃদ্ধা খেয়াল করলো নিজের শরীরের কুঁচকে যাওয়া চামড়া গুলো সব সমান, কোমল আকৃতি ধারণ করছে, পাকা চুলগুলো কালো হয়ে যাচ্ছে, কোমরের যে ব্যথার কারণে গুঁজ হয়ে চলতো তা উধাও হয়ে গিয়েছে, শরীরে পূর্ণাঙ্গ যৌবন ফিরে আসছে। বিস্ময়ের ধাক্কা খেল সে।
অবাক হয়ে সে নিজের দিকে তাকালো। পঁচিশ বছরের এক যুবতী নারী যেন সে। যুবক এবার উল্টো হয়ে ঘুরে জঙ্গলের দিকে হাটতে লাগলো। পুরো শরীরে ভয়ানক এক কাম উত্তেজনা অনুভব করছে পরী। ধীরে ধীরে আচ্ছন্নের মতো সেও অনুসরণ করতে লাগলো যুবকটিকে। প্রবেশ করলো জঙ্গলের ভেতর। জীবনে প্রথম এই জঙ্গলে ঢুকেছে সে। তবে তার বিস্মিত চোখ জোড়া এখনো আটকে আছে যুবকের শরীরের দিকে।
এত সুন্দর কোনো মানুষ হতে পারে! ওকি! যুবকের সারা শরীর ভেদ করে বেরিয়ে আসছে যেন সাদা লোম। কোমরের নিচ থেকে গজাচ্ছে লেজ, নখগুলো হয়ে উঠছে তীক্ষ্ণ সুচালো! দেখতে দেখতে একটা সাদা অদ্ভুত জন্তুতে রূপান্তরিত হলো ওটা। পরীর কাছে মনে হচ্ছে ওটার সৌন্দর্য তবুও একটু কমে যায়নি। নেশাগ্রস্ত যুবতীর ন্যায় সে অনুসরণ করেই চলতে থাকে। চলে যাচ্ছে জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরে।
সেদিনের পর থেকে গ্রামের কেউই বৃদ্ধা পরীমনিকে আর খুঁজে পেল না। জানতেও পারলো না সে কোথায় গেল, কী পরিণতি হয়েছিল তার!
গ্রামীন সাধারণ জীবনের মধ্যে একটা মেয়ের চারপায়া অদ্ভুত এক জন্তুকে জন্ম দেয়া, মেয়েটার জন্তু সহ জঙ্গলে উধাও হয়ে যাওয়া, এর এক বছর পর সেই জঙ্গল থেকে একটা ভয়ানক মাংসাশী জন্তুর আগমন, গ্রামে বেশ আতঙ্কের আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছে। প্রত্যেকেই দিন-রাত থাকে এখন আতঙ্কের মাঝে। এরমধ্যেই হঠাৎ করে একদিন পরী নামের এক বৃদ্ধাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না আর। বৃদ্ধার নিরুদ্দেশের পেছনে যে সেই সাদা জন্তুটার সম্পর্ক থাকতে পারে তা কেউ ধারণা করতে পারে নি। তাহলে তাদের আতংক সীমা ছাড়িয়ে যেত এবং এটারই প্রয়োজন ছিল।
এরমধ্যেই গ্রামে একরাতে ঘটে গেল ব্যতিক্রম এক ঘটনা। গ্রামের মাতবর লিয়াকত ব্যাপারীর এক নাতি শহরে থাকে। সে গ্রামে বেড়াতে আসার সময় তার দাদার জন্য একটা বিদেশি বড় আকারের কুকুর উপহার নিয়ে এসেছে। জঙ্গলের পাশে হওয়ায় শুধু এই গ্রামে নয় আশেপাশের দশ গ্রামের ভেতর কোনো কুকুর-বিড়াল ছিল না। লিয়াকত আলী খুব আগ্রহ নিয়েই কুকুরটাকে পোষ মানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
অদ্ভুত এক জন্তুর এই জঙ্গলে আগমন, গ্রামের পোষা প্রাণী শিকারের কথা লিয়াকত ব্যাপারীর কাছে তার নাতি শুনেছিল। কিন্তু যে কয়দিন সে গ্রামে ছিল ওটার কোনো আওয়াজ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া জঙ্গলের পাশের অঞ্চলে বন্য প্রাণীর আক্রমণের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি তার কাছে। ছুটি শেষ হলে সে আবার শহরে চলে যায়।
এরপর একদিন মধ্যরাতে গ্রামের অর্ধেক মানুষ জঙ্গল থেকে ভেসে আসা সেই সাদা জন্তুটির হুঙ্কারের আওয়াজ পেল। সবাই আতংক নিয়ে যার যার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলো। না জানি আজ কার বাড়ির গোয়ালে হামলা চালাবে!
লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়ি গ্রামের মাঝামাঝি হওয়ায় এখন পর্যন্ত জন্তুটার হামলার শিকার হয়নি তার গোয়ালের পশুগুলো। লিয়াকত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল, তার পাশে তার স্ত্রী। তাদের বাড়ির অদূরেই আরেকটা বাড়ি আছে যেটায় তার মেয়ে, মেয়ের জামাই আর দুই নাতি-নাতনি থাকে।
হঠাৎই খুব কাছে বিকট এক হুঙ্কারের আওয়াজে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে বাড়ির সকলে। পরমুহূর্তেই শুনতে পায় গোয়ালের গরুগুলোর ভয়ানক আর্তনাদের শব্দ। কারো বুঝতে বাকি থাকে না , কী ঘটছে। জন্তুটা আজ এখানে হামলা চালাচ্ছে।
লিয়াকত ব্যাপারীর মেয়ের জামাই বকুল ভয়ে ভয়ে জানলার খিলি সরিয়ে বাইরে তাকাল। সোলার লাইটে আলোকিত উঠানের একপাশে গোয়াল ঘরটা জানলা বরাবর হওয়াতে ওটার দিকেই চোখ আটকে গেল তার। শরীর শিরশির করে উঠলো হঠাৎ। ঐতো একটা বড় গাভীর ধর কামড়ে টেনে-হিঁচড়ে গোয়াল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে ভয়ানক সেই জন্তুটা। মুখ দিয়ে বের হচ্ছে গোঙানি। চুইয়ে ঝরছে রক্ত। গাভিটাও এখনো মরেনি, ওটার গলা দিয়েও গড়গড় শব্দ বের হচ্ছে।………………………….
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponnaslink/pichas/
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য গল্প
গন্ধ
(রহস্য গল্প)
রাজীব উল আহসান
আমাকে লাশবাহি গাড়িতে তোলা হলো। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি আমি। তবু কেন যেন আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না। আমার আরাম আরাম বোধ হচ্ছে। তবে এই প্রথম আমার মনে হলো আমি মারা গেছি।
আমাকে এম্বুল্যান্সে তোলার সময় বাসার গেটে দেখলাম পুলিশের গাড়ি। সবাই বলাবলি করছিলো
– মেয়েটা আত্মহত্যা করলো কেন? কি এমন কষ্ট ছিলো মেয়েটার?
আমি নিজেও বুঝতে পারছি না! কেনইবা আত্মহত্যা করলাম আমি?
অবশ্য আত্মহত্যা করে আমার যে তেমন খারাপ কিছু লাগছে তা নয়। বরং কেমন এক ভাললাগা কাজ করছে। সে যাই হোক, আমি আর কিছু ভাবতে চাচ্ছি না। এম্বুল্যন্স এর হীম বাতাসের প্রশান্তিটা থাকুক না কিছুক্ষণ! তবুও চিন্তাটা কেন যে ঘুরে ফিরে আসছে মাথায়। কেন আত্মহত্যা করলাম আমি?
আমার মাথাটা যেন ভোঁতা হয়ে আছে। মৃত্যুর পর সবার এমন হয় কিনা কে জানে? আমার মৃত্যুর সময়টার কথা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। তবে মৃত্যুর পরের ঘটনাগুলো আমি কিছুটা মনে করতে পারছি। এই যেমন একটু আগে আমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় সিলিং ফ্যান থেকে কয়েকজন মিলে নামালো। এদের মধ্যে তিন জনকে আমি চিনি না।
তবে একজনকে চিনি। আমার বড়খালু। বড়খালু সপ্তাহ খানেক আগে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন মনিকাকে দেখতে। মনিকা আমার খালাতো বোন। মনিকা আমাদের বাসায় থেকে লেখাপড়া করছে।
বড় খালুর কথা মনে পড়তেই একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি হলো শরীরটায়। বছর দশেক আগে আমি এস এস সি পরীক্ষার পর বড় খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় খালা আমার খালাতো বোন মনিকাকে নিয়ে মার্কেটে গেলেন। একটু জ্বর জ্বর লাগছিলো বলে আমি যাই নি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি খালু আমার বুকে হাত দিয়ে পাশে শুয়ে আছে। আমি হুরমুড়িয়ে উঠি।
— খালু আপনি এখানে কি করছেন?
লজ্জাহীন লোকটা একটুও লজ্জা পেলো না।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, — শুনলাম তোমার জ্বর তাই জ্বর মাপতে চাইছিলাম।
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে তিনি থার্মোমিটারটি আমার জামার ভেতর দিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। আমি বাধা দেয়া সত্ত্বেও পশুর শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার উপর। বিছানায় আমি পাথরের মত শুয়ে ছিলাম।
খালা আসার আগেই আমি বার বার সাবান দিয়ে গোসল দিলাম। কিন্তু নাক থেকে সেই পশুর গন্ধ দূর হলো না।
আজ যখন ফ্যান থেকে আমাকে নামানো হলো আমি সেই পশুর গন্ধ পেলাম। বুঝলাম বড় খালু আমাকে নামিয়েছেন। আবারও ঘিনঘিন করে উঠলো শরীরটা।
এম্বুল্যান্সটি হঠাৎ ব্রেক কষে হাসপাতালের পার্কিং এ থামাতে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো।
আমাকে প্রথমে আনা হলো হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার আমাকে দেখলেন। ডাক্তার সাহেব ঘোষণা দিলেন..
— শি ইজ ডেড।
মানে আমি মারা গেছি। আসলে আরো ঘণ্টা দুয়েক আগেই আমি মারা গেছি।
ডাক্তার সাহেব আমার গলায় দড়ির দাগ পরীক্ষা করে দেখলেন। তিনি বললেন
— মেয়েটা কি গলায় দড়ি দিয়েছিল?আহারে, সুইসাইড করা আজকালকার জামানায় ট্রেন্ড হয়ে গেছে। সামান্য কিছুতেই সুইসাইড।
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে আমার খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে। তবে তার গা থেকে ভুরভুর করে ফিনাইলের গন্ধ আসছে। আহা কি মিষ্টি গন্ধ! আমি বুক ভরে ফিনাইলের গন্ধ নিলাম।
কিছুক্ষণ পর দুইজন পুলিশ এলো। কালো বেটে মতন পুলিশটা আমার দিকে বিশ্রী ভাবে তাকালো। তার মনের কথা আমি পড়তে পারলাম। বেঁচে থাকলে ওর গালে আমি দুটো থাপ্পড় বসাতাম। যেমনটা দিয়েছিলাম আমার বড় খালুর গালে।
পুলিশ দুজন খুটিয়ে খুটিয়ে কি কি সব তথ্য নিয়ে গেলো। আমার কিছু ছবিও তুলে নিলো। আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।
ছবি তোলা আমার খুব শখের কাজ। জীবনে কত ছবি তুলেছি। কিন্তু হাসপাতালের ময়লা ট্রলিতে শুয়ে ছবি তুলতে হবে তা কখনো ভাবিনি আমি।
যাহোক, এর কিছুক্ষণ পর আমাকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে আসা হলো। একটা বড় ট্রেতে তুলে আমাকে বড় একটা ডিপফ্রিজে রাখা হলো।
লাশকাটা ঘরে ঢুকেই আমার বমি পেলো। মাংস পঁচা গন্ধ। মানুষের মাংস! আমি নিজেকে বোঝালাম। আমি এখন মৃত। তাই আমি মৃত মানুষদের সাথে মৃত পরিবেশে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম।
তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম মৃত্যুর পর আমার নাক খুব স্পর্শকাতর হয়েছে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আমার নাক সবচেয়ে সাড়া দিচ্ছে।
সব ভালো মন্দ গন্ধই আমি টের পাচ্ছি। এত গন্ধের মাঝেও বড়খালুর সেই গন্ধটা নাক থেকে কিছুতেই সরাতে পারছি না।
লাশকাটা ঘরের ডিপফ্রিজে শুয়ে আমার মাথাটা আবার কাজ করা শুরু করেছে। একটা বিষয় আমার খুব খটকা লাগছে। আমি আত্মহত্যা করলাম কেন? আমার স্বামী আছে সন্তান আছে। হ্যা, সংসারে মান অভিমান তো আছেই। আমার স্বামী শিমুলের সাথে গত পরশুইতো ঝগড়া হয়েছিলো! এরকম ঝগড়াঝাটি তো সব ফ্যামিলিতেই হয়। আমি তো কিছু মনে রাখিনি! সবকিছুইতো স্বাভাবিক ছিলো।
তবে আত্মহত্যা কেন করবো আমি? না আমি জোর দিয়ে বলতে পারি- আমি আত্মহত্যা করি নি। সিলিং ফেন এর সাথে ঝুলেও পড়ি নি! কিন্তু সবাই যে বললো আমি আত্মহত্যা করেছি?
আমার মাথা আবার গোলমাল পাকাচ্ছে। ধুর, সব চিন্তা বাদ দিলাম। মৃত মানুষের আবার ভালো মন্দ কিসের?
লাশকাটা ঘরের প্রচন্ড গন্ধে আমার পান খেতে ইচ্ছে করছে। ছোটবেলায় আম্মা মুখে পান চিবিয়ে একটুখানি পান বের করে দিতো। আম্মার লালা মাখা পান যেন অমৃত ছিলো। আহা সেই আঁধা চিবানো পান যদি এখন মুখে দিতে পারতাম?
পানের কথা চিন্তা করতেই কিভাবে যে আমি আম্মার কাছে চলে এলাম, আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
মরে যাবার পর অনেক সুবিধা হয়েছে দেখলাম। এখন আমি মন চাইলেই নিমিষেই যেখানে ইচ্ছে যেতে পারছি।
আমি গ্রামে এসে দেখি আম্মা কাঁদছে। কয়েকজন মহিলা আম্মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমার বড় ভাবী কোরান তেলোয়াত করছেন। তার মানে আমার মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছেন।
বাড়িতে ঢুকেই আমি কিসের একটা গন্ধ পেলাম। একটু নাক পাততেই পরিচিত চ্যাপা শুটকির গন্ধ আমার নাকে এলো। উফ কি সুঘ্রাণ।
আমি পানের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। আম্মাকে বললাম, — আম্মা তাড়াতাড়ি ভাত দেন।
কিন্তু আম্মা আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না। আমি রান্না ঘরে চলে এলাম। এসে দেখি রান্না ঘর এলোমেলো। বোঝা যাচ্ছে শুটকি রান্নার প্রস্তুতি চলছিলো। তখনি বোধহয় আমার মৃত্যুর খবরটা আসে। যে যার মত চলে যায়। হুলো বিড়ালটা পাতিল থেকে শুটকি মাছ খাচ্ছে। রাগে আমার গা জ্বলে গেলো।
আর তখন আমার কানে আসে ছোট ভাই টুটনের কান্না ভেজা কণ্ঠ।
টুটন কাঁদছে।
আহারে, আমার আট বছরের আদরের ছোট ভাই,আমার জন্য কাঁদছে!
টুটনের কান্না শুনে আমার ছেলে মন্টির কথা মনে পড়ে গেলো।
আমি যেন চমকে উঠলাম! এতক্ষণ আমার মন্টির কথা মনে পড়লো না কেন? আমার মন্টি কই? মন্টি তো স্কুলে গেছে। হুম, সকালে আমি নিজ হাতে ওকে স্কুল ড্রেস পরিয়ে দিয়েছি। তারপর ওর জন্য ডিম ভাজি করেছিলাম। সে জেদ ধরেছিলো ডিম ভাজি খাবে না। ডিম সেদ্ধ খাবে।
আমি বললাম,
— বাবা ডিম সেদ্ধ হতে দেরি হবে। তোমার স্কুল বাস চলে যাবে।
আমি বুঝিয়ে ছিলাম, বাবা আজ ডিম ভাজি খাও। কাল তোমাকে ডিম সেদ্ধ করে দিবো। আমার মন্টি ডিম ভাজি খেয়ে স্কুলে চলে গেলো।
হায়রে, আমার ছেলের শেষ আবদার আমি মেটাতে পারলাম না!
এখন টুটনের কান্না শুনে মন্টির চিন্তায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে আমার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মন্টির স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। আমি মন্টির খোঁজে এক নিমিষেই আমার রাজারবাগের বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে মন্টিকে পেলাম না। দুইজন পুলিশ বাসার সামনে বসা। আমি অনেক কাঁদলাম। পুলিশ ভাইকে বললাম,
— আমার দুই বাচ্চা মন্টি আর রাইমা কই? ওদের যে দেখছি না?
কেও আমার কথা শুনলো না। আমি কেঁদেই চলছি।
তখন আমি আমার স্বামী শিমুলকে খুঁজে পেলাম। নিচ থেকে দেখলাম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন পুলিশের সাথে কি নিয়ে আলাপ করছে সে।
আমি শিমুলের কাছে যেতে চাইতেই হেঁচকা টানে লাশকাটা হীম ঘরের ট্রেটা বের করে আনলো কে যেন। আমার প্রাণহীন দেহ দুলে উঠলো আবার। লাশকাটা ঘরের সেই মাংশপচা গন্ধ আবার আমার নাকে এসে লাগলো।
দুজন ডোম রুস্তম আর ঘনশ্যাম আমাকে চ্যাংদোলা করে তুলে আনলো টেবিলের উপর। টেবিলের উপরে হাজার ভোল্টের লাইট জ্বলছে।
ঘনশ্যাম আমার পেটে ছুরি চালালো। ইলিশ মাছের পেট ফাঁক করে যেভাবে আমরা মাছের ডিম বের করে আনি সেভাবে আমার নাড়িভুড়ি বের করে আনছে।
তবে আমার কোন ব্যথা হচ্ছে না। কিন্তু আমি তীব্র এলকোহলের গন্ধ পাচ্ছি। ডোম দুজনের মুখ থেকে ভরভর করে মদের গন্ধ বের হচ্ছে। তবে এলকোহলের গন্ধটা মন্দ লাগছে না আমার।
হঠাৎ রুস্তম ডোম আমার ডান স্তনে হাত দিলো। শয়তানটা আমার স্তনে অমানুষের মত চাপ দিতে লাগলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার স্তন থেকে দু ফোঁটা দুধ গড়িয়ে পড়লো। দুধ দেখে রাইমার কথা মনে পড়ে গেলো আমার।
আমি চেঁচিয়ে বললাম,
— তোমরা কি আমার রাইমা মা কে দেখেছো? আমার দেড় বছরের বাচ্চা মেয়ে। মাথায় ঝুটি করা! নাকটা একটু বোঁচা। তোমরা দেখেছো আমার রাইমাকে?
কিন্তু ওরা দুজন নিশ্চুপ থাকলো।
আমি কান্না জুড়ে দিলাম।
— আমার দেড় বছরের মেয়েটার কোন খোঁজ দিচ্ছ না কেন? দয়াকরে তোমরা আমার রাইমা সোনাকে আমার কাছে এনে দাও। ওর এখন ক্ষিদে পেয়েছে। আমি ওকে দুধ দিতে চাই।
ওরা আমার কথা শুনতে পেলো না। এবার ওরা আমার গলায় হাত দিলো। আমার আত্মহত্যার দাগ পরীক্ষা করতে লাগলো আর বাংলা হিন্দি মিশিয়ে কথা বলতে থাকলো।
রুস্তম ডোম বললো,
— এ লাড়কি খুব সুরত থি। উসকি গোলে পার যো দাগ হ্যায় উসনে ফাছ কি নেহি হো।
(এই মেয়ে খুব সুন্দর ছিল।এর গলায় যে দাগ তা ফাঁসের নয়)
রুস্তমেরে কথা শুনে এগিয়ে আসে ঘনশ্যাম। চেচিয়ে উঠে ঘনশ্যাম,
— মুজছ্যে ভি দেখনে দো।(আমাকেও দেখতে দাও)
দুজন মিলে আমার গলা পরীক্ষা করতে থাকে।
এবার ঘনশ্যাম বলে ওঠে
— এ কয়ি মামুলি কেস নিহি হে রে রুস্তম। এ দাগ আত্মহাত্যাকো নেহি হে। কয়ি উসনে মার ডালা।( এটা কোন সাধারণ কেস নয়। এই দাগ অত্নহনেনের নয়। কেও একে খুন করেছে)
–বিলকুল সহি কাহা তুমনে। কয়ি উসকো গলে দাবানে মারা।( একদম ঠিক বলেছো। কেও অকে গালা টিপে মেরেছে)
রুস্তম একমত হয় ঘনশ্যামের সাথে।
ওদের কথা শুনে আমার মাথাটা আবার ভোঁতা হয়ে গেলো। আর তখনি আমার আবছা আবছা কিছু সময় মনে পড়ে গেল। হুম, আমি মনে করতে পারছি। কে যেন দু হাত দিয়ে আমার গলায় চেপে ধরেছিলো?
আমি মন্টিকে বিদায় দিয়ে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে। তখনি পেছন থেকে কেও এসে আমার গলা টিপে ধরলো।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে। আমি কত চিৎকার করলাম। কিন্তু কেও এলো না।
শুধু দেখলাম মনিকা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বারান্দা থেকে সবকিছু দেখতে পেয়েছে।
মনিকার চোখগুলো পাথরের মত মনে হচ্ছিলো। আমি ভাবলাম আমার বোন মনিকা আমাকে বাঁচাবে। কিন্তু মনিকা এলো না। মনে হলো ভয়ে পাথরের মত জমে গিয়েছিলো সে!
আচ্ছা মনিকাকে খুনি দেখে ফেলেনি তো?
হায় আল্লাহ।
তুমি মনিকাকে রক্ষা করো।
মনিকাই আমার খুনের চাক্ষুস স্বাক্ষী।
আচ্ছা তাহলে কে আমাকে গলা টিপে ধরলো? আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম?
উত্তর পেলাম না।
আমি তো দেখতে পাইনি। ইস কত চেষ্টা করলাম ছাড়িয়ে নিতে। পারলাম না। দেখতেও পেলাম না সেই নিষ্ঠুর খুনিটাকে?
তবে হ্যাঁ, খুনির গায়ে একটা গন্ধ ছিলো। কি যেন এক সুগন্ধি মেখেছিলো সে। খুব কড়া। নেশার মত লাগছিলো আমার। এখনো আমার নাকে লেগে আছে গন্ধটা।
এরপর কারা যে আমাকে শাড়ি পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিলো!
আহারে আমার স্বামী শিমুল তখন বাথরুমে ছিলো। শেভ করে গোসল করছিলো। অফিসে যাবে সে।
আমি কত ডাকলাম। তবু সে শুনতে পেলো না। চিন্তায় আমার সব কিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে আবার।
রুস্তম আর ঘনশ্যাম আমাকে আবার হিম ট্রেতে ঢুকিয়ে দিলো। হিম ট্রেতে ঢুকে আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। শুয়ে শুয়ে শিমুলের কথা মনে পড়ে গেলো।
আহা বেচারা। আমাকে হারিয়ে না জানি কত ভেঙে পড়েছে সে। আমার খুব শিমুলকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু আমার শরীরে এখন আর বেশি শক্তি নেই। এখন চাইলেই আগের মত এদিক সেদিক যেতে পারছি না। তবু মনের জোরে আবার বাসায় গেলাম। কাওকে পেলাম না। সেখানেই শুনতে পেলাম বড় খালুকে নাকি পুলিশ গ্রফেতার করেছে। তাহলে বড় খালু কি সেই থাপ্পড়ের কথা এখনো ভুলেন নি?
থাপ্পড়ের বদলে খুন?
কিন্তু মনিকা? মনিকাকে পুলিশ ধরেছে কেন? মনিকা কি ওর বাবাকে সাহায্য করেছে?
আমার মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না। এই পুলিশের লোকগুলোর না কোন কান্ডজ্ঞান নেই। মনিকা আমার বোন। ও কেন আমাকে খুন করবে?
আমার শক্তি একেবারে শেষ হয়ে গেছে। আমি আর বাইরে থাকতে পারছি না। আমি আবার হিমঘরে ঢুকে গেলাম।
একটু পর হিমঘর থেকে আমাকে বের করা হলো। আমাকে গোসল দেয়া হলো। কাফনের কাপড় পড়ানো হলো। এখন আমাকে আমার গ্রামের বাড়িতে নেয়া হচ্ছে। গ্রামে পৌঁছালাম মাগরিবের পরপর।
গ্রামের সবাই আমাকে দেখতে এসেছে। আমার সকল স্বজন আমাকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছে।
কিন্তু আমি আমার দুই সন্তানকে খুঁজছি। ভীড়ের কারণে ওদের আর খুঁজে পেলাম না। আমি অনবরত কেঁদেই যাচ্ছি। আম্মার কাছে মিনতি করছি। আব্বার পায়ে ধরছি। কেও আমার সন্তান দুটোকে বুকে এনে দাও প্লিজ। শুধু একবার আমি ওদের বুকে জড়িয়ে আদর দিতে চাই। শুধু একবার এনে দাও ওদের!
এমন সময় কেও একজন আমার কফিনের সামনে থেকে সবাইকে সরে যেতে বললো। সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো।
মন্টি আর রাইমাকে আমার কফিনের সামনে আনা হয়েছে। আমার দুই কলিজার টুকরাকে দেখে আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
দেখলাম আমার ছেলেটা কাঁদছে। ছেলেটার গায়ে এখনো স্কুল ড্রেস। কেও কি ছিলো না ওর ড্রেসটা বদলে দিতে?
আহারে ছেলেটা নানা বাড়ি আসার জন্য কতই না বায়না করতো? অথচ আজ এলো মায়ের লাশ নিয়ে।
এমন সময় কে যেন মন্টিকে আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মন্টিকে ডেকেই যাচ্ছি।
বাবা দাঁড়া। আর একবার দেখি তোকে। কিন্তু মন্টি চলে গেলো। আহারে আমার ছেলেটাকে আর দেখতে পাবো না কোনদিন।
আমার কান্না না কমতেই দেখি আমার ছোট মেয়েটা এসেছে আমাকে শেষ দেখা দেখতে। রাইমা আমার বোন শিউলি আপার কোলে।
আমি কত করে ডাকলাম, শিউলি আপা ওকে একটু আমার কোলে দাও। আমি ওকে আদর করবো। তোমার দোহাই লাগে শিউলি আপা। তোমার দোহাই লাগে। শিউলি আপা আমার কথা শুনলোই না।
আমি আবার বললাম, শিউলি আপা, আমার বুকটা টনটন করছে। দুধে ফেটে যাচ্ছে বুক। আমার মামনিটা সকাল থেকে দুধ খায়নি। দাও না আপা। আমার জান পাখিটাকে আমি শেষ বারের মত দুধ দিবো আপা!
শিউলি আপা আমার কথা শুনলেন না।কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন রাইমাকে নিয়ে।
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখ খুলে রাখতে পারছি না। শরীরে আর এতটুকু শক্তি নেই। বুঝলাম এবার আমার বিদায়ের পালা।
আর তখনি সেই ঘটনাটা ঘটলো। আবার সেই গন্ধটা আমার নাকে এসে জানান দিলো। আমার খুনের সময় যে গন্ধটা পেয়েছিলাম। সেই গন্ধ! আমার খুনি তাহলে এখানেই আছে!
প্রচন্ড ভীরের মধ্যে আমি খঁজছি সেই গন্ধটার উৎস। কিন্তু পাচ্ছি না।
এদিকে আমার শক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো আমার।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর গন্ধটা আরো গাঢ় হলো। হুম সেই গন্ধ। আমি ভুল করতে পারি না। আমি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলাম। তবু দেখতে পারছি না। কিন্তু আমাকে চোখ খুলতেই হবে। দেখতে হবে এ গন্ধ কার? কে আমার খুনি?
আমি অনেক কষ্টে চোখ খুললাম। আমি ভীষণ চমকে গেলাম।
দেখি আমার স্বামী শিমুল। আমার কফিনে ঝুকে আছে। আমার গালে চুমু দিয়ে পাগলের মত কাঁদছে। শিমুলের শরীর থেকেই গন্ধটা আসছে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম!
শিমুল তুমি???
তুমি আমাকে হত্যা করলে! তুমি না আমাকে কত ভালোবাসতে?
তবে কি বড় আপার কথাই ঠিক ছিলো? মনিকার সাথে তোমার বোঝাপড়াটা কি মিথ্যে ছিলো না তাহলে? মনিকার সেই পাথর দৃষ্টির অর্থ আমি বুঝতে পারছি এতক্ষণে। কেন মনিকা আমাকে মরতে দেখে টু শব্দটিও করে নি।
হঠাৎ দেখলাম শিমুলের পাশে দুজন পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশ এসে বললো, শিমুল সাহেব আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।
পুলিশ গাড়িতে করে শিমুলকে নিয়ে গেলো।
শিমুল চলে গেল। সাথে সেই গন্ধটাও।
=====
গন্ধ
রাজীব উল আহসান
3.ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প
[শর্ট-থ্রিলার]
-মোবাইলের স্ক্রীণের দিকে দু’চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে নিজাম। এই কোড মেসেজটা ব্রেক করতে না পারলে পুরো মিশনটাই ফেইল হয়ে যাবে! কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারছে না!
রীতিমত ঘামিয়ে গেছে ও। এর থেকে জটিল দুর্বোধ্য কোড ব্রেক করা তার বা হাতের খেল! আর আজ শেষ মোমেন্টে এসে এভাবে আঁটকে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না মোটেও! জগলু নামের এক ছোটখাটো আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনের থেকে কোডটা এসেছে। ওদের মিশনে সব কিছু কোড আর মেসেজের মাধ্যমে হয়, কথা বলার কোন নিয়ম নেই। জগলুর সাথে এটাই নিজামের প্রথম এসাইনমেন্ট!
অন্ধকার রাস্তার এক পাশের ঢালে উপুর হয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে নিজাম। সামনে একটা গাড়ি দাঁড় করানো। একজন পুরুষ আর একজন অল্পবয়স্ক মেয়ে নেমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে কয়েকবার ‘আলী’ নামে ডাকলো মেয়েটা। দুজনে সামনে এক বিল্ডিংয়ের গেইটের দিকে এগুচ্ছে।
ওরা ওই গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকবে মাত্র ঠিক ওই মুহূর্তে কোডটা সম্পূর্ন ক্লিয়ার হয়ে গেলো নিজামের কাছে।
লোকটা গেটের ঠিক সামনে যেতেই ডিরেক্ট মাথায় গুলি করলো নিজাম। একদম হেডশট! মিশন ডান!
পরদিন…
নিজামের সামনে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জগলু!
আর্তনাদ করে উঠলো প্রায়,
“তুই এইডা কি করসোস! আমার মাফিয়া জীবনের প্রথম বিগ মিশন! আর তুই এইডা করলিডা কি!? তোর প্রশংসা শুনে তোর উপর ভরসা করলাম আর তুই! “
“আপনি যা বলছেন ঠিক তাই করছি!” মরিয়া গলায় উত্তর দিলো নিজাম!
“আমি কি কইসি? আমি তোরে কি কইসি ক?”
“আপনার কোডেই ছিলো, গেইটের ঠিক পাশে মায়া মায়া চেহারার আলী নামের যে লোকটা থাকবে সেই আমার টার্গেট! এমনকি তারে গালিও দিসিলেন ‘চু’ না কি জানি একটা বলে! তার পশ্চাৎদেশ বরাবর গুলি করতে বলেছিলেন! কিন্তু পা**য় গুলি করলে তো মরার চান্স কম তাই মাথায় করছিলাম! যদি বারকয়েক ‘পাছার মায়া’ বলে যে কি বলতে চাইছিলেন সেইটা বুঝি নাই! কিন্তু আমি তো মিশন শেষ করেই ফিরছি!” নিজামের করুণ উত্তর।
মাথায় যেন একসাথে ৭ টা বজ্রপাত পড়েছে এমনভাবে নিজামের দিকে তাকালো জগলু! রাগে তোতলাতে তোতলাতে নিজের মোবাইলটা বের করে নিজামকে বললো,
“‘ক্…ক্কিসের মায়া? মা…ম্মানে কি! তো…ত্ত..ত্তোরে আমি কি মেসেজ দিসিলাম? হ্যাঁহ? দেখ আমি পড়ে শোনাই, কান খুইলা শোন! তরে পাঠাইছিলাম এইটা…” নিজের মোবাইল থেকে পাঠানো কোড মেসেজটা পড়া শুরু করলো জগলু,
”-আজকের টার্গেট মোটেও যেনতেন কেউ নয়। গাড়ি থেকে যে দুজন নামবে তাদের একজন কিন্তু মন্ত্রীর ভাই, সে একজন সুদানী ব্যাবসায়ি নাম আলী। ওনার পাশে যে মেয়েটা থাকবে সেই তোমার টার্গেট। আলী ভাইয়ের যাতে কিছু না হয়।
আই রিপীট আলী ভাইয়ের ভুলেও যাতে কিছু না হয়। কিল আলী ভাইয়ের পাশের মেয়ে”
…এই পর্যন্ত পড়ে আগুন চোখে নিজামের দিকে তাকালো জগলু, “আর তুই কি করলি এইডা? এখন পুলিশ গোয়েন্দা সংস্থা সব আসলে বলে! শেষ সব! ফাঁসি! যাবজ্জীবন! সব শেষ!!”
জগলুর চিল্লাচিল্লিতে কান দেয়ার অবস্হায় নেই নিজাম। নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে জগলুর পাঠানো কোড মেসেজের দিকে বজ্রাহত হয়ে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলো ও!
এতক্ষণ যেটা পড়ে শোনাল জগলু সেই মেসেজটাই নিজের মোবাইলে বারবার পড়ছে নিজাম… জগলুর পাঠানো মেসেজটা ছিলো…
“Agkarr tergat mutao janu tanu kau noe. Gare teka ga dugon namba tadar akgon kanto montrer bae, sa akgon sudane babsae nam ALI. Onar pasay ge maya ta takba saai tumar tergat. ALI baer gate kacu na hoe.
I ripit ALI bae er bulao Gate kesu naa hoe, kil ALI baer PASAR MAYA!”
বাইরে তুমুল হইচই, গোলাগুলি। ইনটেলিজেন্সের এজেন্টরা চলে এসেছে সম্ভবত! নিজাম তখনো কোড ব্রেকের ব্যার্থ চেষ্টা করেই চলেছে!
“দ্য কোড ব্রেকার”
সাজ্জাদ সিয়াম’স ডাইমেনশন