বিয়ের চাপ ১০ম ও শেষ পর্ব
——————————————-
বাসায় যখন পৌছলাম,তখন রাত প্রায় চারটা।বাসায় ঢুকেই আমি আর দুলাভাই অবাক হয়ে গেলাম।দেখলাম বাসা ভরা মানুষ।মামা-খালা-ফুফুরা সব উপস্থিত।সেই সাথে সব কাজিনরাও এসেছে।আমরা ঘরে ঢুকতেই খালা আমাদের দুজনকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলেন।খালা আমাকে মালা পরানোর সময় বললেন,
-আমাদের বংশে পেহলিবার কিসিনে জেল খাইটা আসছে।আমরা সব বহুত খুশ।ইস্কে লিয়ে তোকে মুবারকবাদ।
-খালা তোমার সমস্যা কি ? তোমার এই সিনেমাটিক চিন্তাধারা কি কখনো যাবে না ? শোনো,আমরা জেলে যাইনি।আমরা মাত্র কয়েক ঘন্টা থানায় ছিলাম।
-ও একই বাত হে।যো লাউ ওহি কদু।
-আসলে তোমারে বুঝায়ে কোনো লাভ নাই।আচ্ছা তুমি আর মলি কোথায় ছিলা বলোতো ?
-সে এক বিরাট ইতিহাস।ও বাদ মে শুনলেনা।পেহলে তু তেরা বাবার কাছে যা।তেরা বাপ তেরে লিয়ে অপেক্ষায় আছে।
বাবা ড্রইংরুমে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন।দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ।কিন্তু আসলে তিনি সুস্থ নন।তিনি আমাকে বললেন,
-আমার পাশে এসে বস।
আমি বাবার পাশে যেয়ে বসলাম।উপস্থিত সবাই আমাদের ঘিরে রইলেন।বাবা আদেশের সুরে বললেন,
-আমি এখন যা বলব,সেটা আমার সিদ্ধান্ত,মতামত না।গত কিছুদিন তোমার বিয়ে নিয়ে অনেক কিছু ঘটে গেছে।বিষয়গুলো আমার কাছে ভালো লাগেনি।পুরো বিষয়টা সমাজ,আত্মীয়-স্বজন সবার কাছেই হাস্যকর ঠেকেছে।আমি আশা করব,এখন আমি যা বলব,তা তুমি বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে।কোনো প্রকার ভেজাল করবে না।তুমি অলরেডি আমাকে অসুস্থ করে বিছানায় ফেলে দিয়েছ, আমি চাইনা তুমি এমন কিছু কর,যাতে আমি বিছানা থেকে কবরে চলে যাই।
আমি লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে বললাম,
-বাবা আমি সরি।আমি আর তোমার কথার অবাধ্য হবো না।তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব।তুমি যেটা বলবে আমি সেটাই করব।তুমি যদি বলো আগুনে ঝাঁপ দিতে,আমি তাই দেব।
-সিনেমার মতো ডায়লগ বলবে না।জীবনটা সিনেমা না।শোনো আজ এখনই আমি তোমার বিবাহ দেব।
-এখন ?
-হ্যা এখন।যে জন্য আমি আমাদের সকল নিকট আত্মীয়দের খবর দিয়ে নিয়ে এসেছি।তুমি হয়ত খেয়াল করেছ,তোমার মামা ছাড়া মোটামুটি সবাই উপস্থিত হয়েছেন।তোমার মামা আসেনি কারণ সে পর পর দুবার তোমার বিয়েতে এসে বিয়ে খেতে পারেনি বলে বিরক্ত হয়ে বলেছে,সে আর তোমার বিয়েতে আসবে না।তুমি জানতে চাও না কার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে ?
আমি কোন কথা না বলে চুপ করে রইলাম।বাবা বললেন,
-তোমার সঙ্গে তানিয়ার বিয়ে হচ্ছে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম।এরা কি শুরু করছে আমারে নিয়ে। তানিয়া আমার ফুফাতো বোন।উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।পিচ্চি একটা মেয়ে।মেয়ে সুন্দর,তাতে কি ? আমি তো কখনো তাকে সে উদ্দেশ্যে দেখিনি।
-শোনো,তুমি যেসব ঘটনা ঘটিয়েছ, কোনো ভদ্রপরিবারের মেয়ে তোমাকে আর বিবাহ করবে না।আমি আমার বোন আর বোনের জামাই এর কাছে কতৃজ্ঞ যে,তারা তাদের মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন।আমি আশা করব, তুমি তানিয়াকে সঠিক মর্যাদা দিয়ে বিবাহ করবে।আমাকে আমার বোনের কাছে ছোট করবে না।যাও তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হয়ে এসো।
বাবার কথা শেষ হবার পর আমি ধীর পদক্ষেপে ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে আমার রুমে চলে এলাম।আমার পিছন পিছন দুলাভাইও এলেন।
-দিপু এখন কি করবা ?
-কি করব মানে ? তানিয়াকে বিয়ে করব।
-শোনো,তানিয়াকে আমার মোটেই পছন্দ না।মেয়েটা সারাক্ষণ কেবল রূপচর্চা আর টিকটক নিয়ে থাকে।পড়ালেখায় কোনো মনোযোগ নেই।তুমি যে ধরণের মানুষ, তোমার জন্য মলিই ছিল বেস্ট।
-দুলাভাই শোনেন,মলির কথা বলে আর কোনো লাভ নাই।ও এখন জয় সাহেবের সাথে বাসর ঘরে।ওর কাছে আমি একজন নো বডি।আর তাছাড়া বাবা যেহেতু বলেছে, সে কারণে আমি অবশ্যই তানিয়াকে বিয়ে করব।বাবাকে কষ্ট দেওয়া আর সম্ভব না।
-ঠিক আছে তাহলে আর কি করবা,বিবাহ করে ফেল।তবে টেনশনের কিছু নাই।আমি ঠিক করেছি কুট-কৌশল করে মলির সংসার ভেঙে দেব।এদিকে বিয়ের কিছুদিন পর তুমিও তানিয়াকে ডিভোর্স দিবে।তারপর তোমার আর মলির বিয়ে।
-দুলাভাই আপনি এসব কি বলছেন ? আসলে গত কয়েক ঘন্টা আপনার উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপ্টা গিয়েছে, তার উপর আবার সারারাত না ঘুমিয়ে আছেন।যার কারণে আপনি এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন।
-আমি উল্টাপাল্টা কি বললাম ?
-আপনি তানিয়াকে ডিভোর্স দিতে বলছেন।আমি কেন তানিয়া কে ডিভোর্স দিয়ে তাকে অপমান করব ? ওর কি দোষ ?
-তুমি কি তাহলে দুই বউ নিয়ে সংসার করতে চাও ? সমস্যা নাই তাও করতে পার।
-দুলাভাই শোনেন,মেয়েরা কোনো খেলনা না।আপনি চাইলেন একজনকে বিয়ে করলেন,আবার চাইলেন তাকে তালাক দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করলেন।শোনেন এটা ক্রাইম।আপনি প্লিজ এসব উল্টা-পাল্টা বুদ্ধি আমাকে দিয়েন না।আর মলিকে মলির মতো সংসার করতে দেন।ও এখন অন্যের স্ত্রী।ওকে নিয়ে কথা বলাটা আমাদের জন্য ধর্মীয়ভাবে বলেন আর সামাজিকভাবে বলেন সমীচীন নয়।
-তুমি কি তানিয়াকে বিয়ে করে সুখী হবে ?
-জানিনা।
-দিপু এককাজ করো,তুমি বরং পালায় যাও।আমি ব্যবস্থা করি।
-দুলাভাই,আমি জানি আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন।আমার জন্য আপনার কষ্ট হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছি।তবে আপনাকে আমি একটা সোজা-সাপ্টা কথা বলি।আমি বাবার মতের বাহিরে আর যাব না।তাই আমি তানিয়াকেই বিবাহ করছি।
ঠিক তখনই মামা হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে ঢুকলেন।দুলাভাই মামাকে দেখে বললেন,
-মামা আপনি এসেছেন ? আপনি না বলেছিলেন দিপুর বিয়েতে আর কখনই আসবেন না।
-বলেছিলাম।তারপরও আমার বোনের কথা ভেবে এলাম।এখন আমি দিপুর কাছে জানতে চাই বিয়ে কি হচ্ছে,না আবার ভেঙে যাবে ? যদি হয় তাহলে আছি। আর যদি না হয় তাও আমারে বলো।তাহলে আর সময় নষ্ট না করে আমি চলে যাই।
আমি কিছু বললাম না। দুলাভাই উত্তর দিলেন।
-মামা বিয়ে অবশ্যই হবে।আজ তানিয়ার সাথে হবে।আর কয়েকদিন পর মলির সাথে আবার হবে।
-জামাই তুমি কি আমার সাথে ফাজলামি করার চেষ্টা করছ?
-না মামা ফাজলামি করব কেন ? আমি সঠিক বলছি।আপনি সম্ভবত আমার কথা বিশ্বাস করছেন না,তাই না ?সেক্ষেত্রে কবির ভাষায় আপনাকে বলতে হয়,
আমরা তো বানজারান
দেখাব নাচ গান
রূপের ঝলকে রাঙি মন
ছান ছানা ছন বাজে পায়েল ছান ছানা ছন,
ছান ছানা ছন বাজে পায়েল ছন ছন ছন ছন উুঁ
মামা মুখ হা করে,ভুরু কুঁচকে দুলাভাই এর দিকে তাকিয়ে রইলেন।দুলাভাই বিষয়টিকে উপেক্ষা করে মামাকে বললেন,
-আচ্ছা মামা শাবানা আপার এই গানে কি ছান ছানা ছন হবে ,নাকি ঝান ঝানা ঝন হবে ?
-হারামজাদা পাগলের গুষ্টি পাগল।আমার বোন যে কেন তোর মত এক পাগলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, সেটা আজও আমার মাথায় ঢোকে না।
বলেই মামা মাথা নাড়তে নাড়তে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।দুলাভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-দেখছ,মামাকে কেমন শিক্ষা দিলাম ? আমার শালার বিয়া নিয়া উনি ফাজলামি করবেন,আর আমি চুপচাপ বসে দেখব ?
একথা বলেই দুলাভাই হো হো করে হাসতে লাগলেন।
একটু আগে ফজর নামাজের পর পরই আমার বিবাহ হয়ে গেছে।ভেবেছিলাম বিবাহের আগে একবার তানিয়ার সাথে কথা বলে বিয়েতে ওর মতামত আছে কিনা জেনে নেব।কিন্তু তানিয়ার সাথে দেখা করার কোনো সুযোগই আমি পাইনি।
আমাদের বাসার ছাদে সুন্দর একটি রুম আছে।ঐ রুমে আমাদের বাসর রাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।আমি ধীর পদক্ষেপে বাসর ঘরে ঢুকলাম।এখন সকাল প্রায় ছয়টা বাজে।সে কারণে এটাকে বাসর রাত না বলে বাসর দিন বলতে হবে।
আমি বাসর ঘরে ঢুকতেই আমার সেল ফোনে একটা কল এলো।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি মলির ফোন।দেখেই আনন্দে মনটা লাফিয়ে উঠল।কিন্তু ফোনটা রিসিভ করতে যেয়েও করলাম না।কেন জানি মনে হলো এখন মলির সাথে কথা বলাটা অন্যায় হবে।কারণ আমরা দুজনেই এখন বিবাহিত।আর বিবাহের পর এসব যোগাযোগ করার মানে হবে, জীবন সঙ্গীর সাথে এক ধরণের প্রতারণা করা।কিন্তু মলি অনবরত কল করেই যাচ্ছে।হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা আবার কোনো বিপদে পড়ল নাতো ? না হলে এই ভোরে কেন এতবার ফোন করবে ? তানিয়া ঘোমটার নিচ থেকে বলল,
-ভাইয়া ফোন ধরছো না কেন ? কার ফোন ?
-মলির ফোন।
-ফোন ধরো।আর আমার সামনে কথা বলতে সমস্যা হলে, রুমের বাইরে যেয়ে কথা বলে আসো।
-না থাক।
-দিপু ভাই,তুমি জানো আমি এতটা ব্যাকডেটেড না।যাও কথা বলে আসো।হতে পারে মলি আপুর কোনো সমস্যা হয়েছে।
আমি রুমের বাইরে এলাম।সব দ্বিধা ছুঁড়ে ফেলে কল রিসিভ করলাম।কল রিসিভ করতেই মলি চিৎকার করে বলল,
-আপনি ফোন ধরছেন না কেন ? সমস্যা কি আপনার ?
-আমার কোনো সমস্যা নাই।আপনি কি ঠিক আছেন ? কোনো সমস্যা বা বিপদে পড়েননি তো ?
-থাক এত ঢং করে মায়া দেখাতে হবে না।আমার কোনো সমস্যা নাই।আসলে আপনাকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছি।অভিনন্দন আপনাকে। আপনার দাম্পত্য জীবন সুখের হোক।
-ধন্যবাদ।আর আপনাকেও আপনার বিবাহিত জীবনের জন্য অভিনন্দন।খোদা হাফেজ।
-খোদা হাফেজ কেন ? আর একটু কথা বলি।
-না মানে আমার স্ত্রী আমার জন্য বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে।
মলি খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
-মানে কি, আপনি কি এখন এই দিনের বেলা বাসর ঘর করবেন ? আপনার তো দেখি শরম লজ্জা কিছুই নাই।
বলেই মলি আবার হাসতে লাগল।
-আপনি হাসছেন ? এতকিছু হয়ে গেল আর আপনি হাসছেন ? আচ্ছা একটা প্রশ্ন করতে পারি ?
-করেন।
-খালা আর আপনার কি হয়েছিল ? কোথায় ছিলেন আপনারা ?
-সরি।আমার জন্য আপনাদেরকে থানা পর্যন্ত যেতে হলো।
-ইটস ওকে।এখন বলেন কোথায় ছিলেন আপনারা ?
-আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম ?
-আমাদের বাসায় মানে ! কেন ?
-আপনারা ফুচকা আনতে গেলেন,সে সময় খালা বললেন, আপনার বাবা নাকি খুবই অসুস্থ।যার কারণে উনি আমার বিয়েতে আসেননি।খালা বললেন,বিয়ের আগে যেন আপনার বাবাকে একটু দেখে আসি।আমরা আপনাদের দেরি দেখে,আপনাদের রেখেই রওয়ানা দিলাম।একটু পর আপনার ফোন এলো।আপনার সাথে কথা বলার পর পরই খালা আমার আর উনার ফোন দুটো বন্ধ করে ফেললেন।আমি অবাক হলেও খালাকে কিছু বললাম না।আপনাদের বাসায় যাবার পর দেখলাম বাবা মন খারাপ করে শুয়ে আছেন।আমাকে দেখে তিনি অবাক হলেন, আবার খুশিও হলেন।খালা আমাকে আর বাবাকে আপনার লেখা ডায়েরি পড়ে শুনালেন।
-বলেন কি ? খালা আমার ডায়রিতে হাত দিয়েছেন ?
-জানেন,আপনি যে প্রতিদিন ডায়রি লেখেন সেটা কিন্তু আপনাকে দেখলে বোঝা যায় না।
-আসলে এটা আমার ছোটবেলার অভ্যেস।আমি আমার না বলা কথাগুলো ডায়রিতে লিখে মনটাকে হাল্কা করি।
-ডায়েরিতে লেখা আমার প্রতি আপনার ভালোবাসার কথা আর আপনার কষ্টের কথাগুলো শুনেই আমার চোখ দুটো ভিজে গেল।আমি চোখ মুছে বাবাকে বললাম,আপনার ছেলেটা এতো পঁচা কেন ? ওর ভাব দেখে তো মনে হয় না, ওর জীবনে আমাকে প্রয়োজন আছে ? আমি তো ওর অবহেলা দেখেই জয়কে বিবাহ করতে রাজি হয়েছি।
বাবা কিছুই বললেন না।কথা বললেন খালা,
-ঐ গাধাটা হিমু হয়েছে।মর যায়েগা কিন্তু কুছ নেহি বলেগা।
-এখন আমি কি করব ?
-কিছু করতে হবে না।তুম চুপচাপ ইধার মে বইঠে রহো।তুমি যে ইধার মে হো,সেটা কেউ কল্পনা করতে পারবে না।সব মিলকে তুমকো খোজাখুজি করবে।এই করতে করতে বিয়ের টাইম নিকাল যায়ে গা।রাগ করকে দুলহা এক সময় ঘরমে চল যায় গা।
-কিন্তু বাবা-মা তো আমার জন্য চিন্তা করবে।যদি টেনশনে বাবা-মার হার্ট এ্যাটাক হয়ে যায় ?
-কুছ নেহি হোগা।মেইনে দিপুর মা আর বোনকে সব কুছ সামঝা দিয়া।ওরা তোমার বাবা-মা কো সামাল লেগা।মেরা প্লান কখনো ফেল নেহি করেগা।
আমি ফোনে মলির কথা শুনছি।আর অবাক হচ্ছি। বেশি অবাক হচ্ছি আমার খালার কথা ভেবে।এ মহিলা হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে জীবনটাকেও কেমন নাটকীয় বানিয়ে ফেলেছে।
-জানেন সবই ঠিক প্লান মতো হচ্ছিল।কিন্তু জয় পুলিশ কল করেই সমস্যা সৃষ্টি করল।পুলিশ যখন আপনাদের ধরে নিয়ে গেল।তখন আমি খালাকে বললাম,খালা আর চুপ করে থাকা সম্ভব না।পুলিশ দিপুকে মেরে অবস্থা খারাপ করে দেবে।এরপর আমি আমার বাবা-মাকে ফোন করলাম।আমার কথা শুনে তারা রেগে আগুন হয়ে গেলেন।
বললেন,তোমার জন্য বারবার আমরা অপমানিত হবো,এটা হতে পারে না।তুমি যা খুশি করো।আজকের পর থেকে তোমার ব্যাপারে আমরা নাই।বলেই তারা ফোন কেটে দিলেন।এরপর আমি জয়কে ফোন করে সব বললাম।প্রথমে ও খুব রেগে গিয়েছিল।পরে ওকে বুঝিয়ে বললাম। বললাম,”আমি দিপুকে ভালোবেসে ফেলেছি।আমার পক্ষে তোমাকে ঠকানো সম্ভব না।আমি একজনকে ভালোবেসে অন্যকে বিবাহ করে প্রতারণা করতে পারব না।যে কারণ কমিউনিটি সেন্টারে না গিয়ে লুকিয়ে রয়েছি।তুমি প্লিজ দিপুকে আর দুলাভাইকে ছাড়িয়ে আনো।উনাদের কোনো দোষ নেই।ওরা এসবের কিছুই জানেনা।”এরপর জয় আপনাদের ছাড়াতে থানায় যায়।
-তারমানে আপনি জয় সাহেবকে বিয়ে করেননি।কিন্তু জয় সাহেব তো বলল,আপনারা বিয়ে করেছেন।
-উনি আপনাকে মিথ্যা বলেছেন।
-সবই বুঝলাম,কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না।তাহলে বাবা আমাকে আপনার সাথে বিয়ে না দিয়ে,জোর করে তানিয়ার সাথে বিয়ে দিলেন কেন ?
-কারণ আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হইনি,তাই।
-রাজি হননি কেন ? আমাকে যদি বিয়েই না করবেন, তাহলে নিজের বিয়ে ভাঙলেন কেন ?
-বললাম না জয় এর সাথে প্রতারণা করতে চাইনি বলে জয়কে বিয়ে করিনি।আর আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি কারণ আপনি একবার আমাকে ফেলে পালিয়েছেন।এরপর ফিরে এসে একবারও বলেননি যে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান।আমি তো এতো হ্যাংলা না,যে আগ বাড়িয়ে বিয়ের কথা বলব।
-আপনি তো আমার ডায়রির লেখা শুনেই আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন।পারেননি ?
-পেরেছি।তবে লেখা আর সরাসরি বলা তো এক জিনিস না,তাই না ? আমারও তো একটা আত্মসম্মান আছে।
-এখন তো আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে।আমার কারণে আপনি বিয়ে করলেন না।অথচ আমি বিয়ে করে ফেললাম !
-অবশ্যই আপনি অপরাধী।আপনি স্বার্থপর।ওকে বাই, আপনার সাথে এখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। যান নতুন বউকে সময় দিন।ও একটা প্রশ্ন,হানিমুনে তানিয়াকে নিয়ে কোথায় যাবেন ?
-জানিনা।
-আমি যেই চার জায়গার নাম বলেছিলাম সেখানে যান। প্রত্যেক জায়গায় সাত দিন করে থাকবেন।
বলেই মলি ফোন কেটে দিল।
নিজেকে এখন আসলেই অপরাধী মনে হচ্ছে।আমি একসাথে তিনটি জীবন নষ্ট করলাম।আমার কারণে মলি বিয়ে করল না।আবার আমি তানিয়াকে বিয়ে করলেও তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছি না।হয়ত সারাজীবনেও পারব না।মনে হলো ছেলেখেলা করতে করতে তিনটা জীবন এলোমেলো করে ফেললাম।
বাসর ঘরে আর ঢুকতে ইচ্ছে করছে না।ছাদেই দাঁড়িয়ে রইলাম।তাকিয়ে রইলাম দূর আকাশের দিকে।চোখ দুটো ভিজে উঠল।না তাকিয়েই বুঝলাম লম্বা ঘোমটা দিয়ে তানিয়া আমার ডান পাশে এসে দাঁড়াল।ঠিক সেই সময়ে লম্বা ঘোমটা দিয়ে বাম পাশে এসে আরেকজন দাঁড়াল।আমি তাকাতেই দুজনেই একসাথে ঘোমটা খুলে ফেলল।আমি ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম।বউ সাজে দুজনই হাসতে লাগল।তানিয়া হাসতে হাসতে বলল,
-ভাইয়া তুমি আমার ভালো নাম জানো ?
-না।
-তুমি মলি আপুর ভালো নাম জানো ?
-না।
-তুমি যে কারে বিয়া করলা,সেটাই তো তুমি বলতে পারবে না।হি হি হি।
-এসবের মানে কি !
-শোনো পুরো স্ক্রিপ্ট খালার সাজানো।আমরা সবাই শুধু অভিনয় করলাম।আমার সাথে তোমার আসলে বিয়ে হয়নি।তুমি আমাদের আসল নাম জানলে বুঝতে পারতে কাকে তুমি বিয়ে করতেছ।নাও এই যে তোমার আসল বউ।
এসময় বাবা ছাড়া বাসার সবাই হই হই করতে করতে ছাদে উঠে এলো।সম্ভবত সবাই এতক্ষণ সিঁড়িতে লুকিয়ে ছিল।আমি অবাক হয়ে বললাম,
-এসব কি হচ্ছে ?
সবাই হাসছে আর লাফাচ্ছে।খালা সবাইকে হাত তুলে থামতে ইশারা করলেন।সবাই চুপ করার পর খালা বললেন
-পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে বেটে।মে তুঝে বোলা থা না,আমি তোরে কাঁদতে দেব না।আমি বেঁচে থাকতে আমার বাচ্চা কাঁদবে,সেটা তো হতে পারে না।
আমি খালাকে জড়িয়ে ধরলাম।কান্না জড়িত কন্ঠে বললাম,
-খালা তুমি এত ভালো কেন ? আমার আনন্দের জন্য তুমি এতো কষ্ট করলে ?
-আরে বোকা আমার কোনো সন্তান নাই।তুই তো আমার সন্তান।তোর মা তো তোকে শুধু পেটে ধরেছে।তোকে তো ছোট থেকে আমিই বড় করেছি।
খালা মলির হাতটা আমার হাতে তুলে দিয়ে মলিকে বললেন,
-আমার এই পাগলটাকে দেখে রাখিস মা।
বলেই খালা চোখ মুছলেন।এরপর খালা আমাকে বললেন,
-নিচে গাড়ি দাঁড়ানো আছে।তোরা এখনই হানিমুনে রওয়ানা দে।মলি আমাকে বলেছে ও হাতীবান্ধা, গাইবান্ধা, ভেড়ামারা,আর ঘোড়াশাল যেতে চায়।যা প্রত্যেক জায়গায় সাতদিন করে থাকবি।আর তোর দুলাভাইরে সাথে করে নিয়ে যা।কারণ ও ছাড়া তুই অচল।
-খালা কি ব্যাপার,তুমি যে আর হিন্দি বলছ না ?
-কেন তোর মনে নেই,আমি বলেছিলাম তোর আর মলির বিয়ে হলে হিন্দি বলা ছেড়ে দেব।তাই এখন থেকে নো মোর হিন্দি।
আমাদের নিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে।মলি আমার হাত মুঠোয় ধরে কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে।দুলাভাই ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে গুনগুন করে গান গাইছেন।হঠাৎ করেই মলি দুলাভাইকে বলল,
-দুলাভাই কবিতা শুনতে ইচ্ছে করছে।একটা কবিতা বলেন তো ?
-কবিতা শুনবা ?
-জি।রোমান্টিক কবিতা।
দুলাভাই দুবার খুক খুক করে কাশলেন।তারপর সুর করে বললেন,
“বাসমতি চাল লম্বা,
পঁচা মাছে বসে আছে মাছি।
সাগর কলা খেতে মজা,
পানিতে ভাসছে মরা গরু।
ইলিশ মাছের মাথায় অনেক কাটা,
তাতে কি ?
আকাশে তো একটুও মেঘ নাই।
আমি বিচি কলা খাইনা,
তাই আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
দুলাভাই এর উদ্ভট কবিতা শুনে ড্রাইভার হুট করে গাড়ি থামিয়ে দিলেন।তারপর ড্রাইভার সাহেব অবাক হয়ে দুলাভাই এর দিকে তাকিয়ে রইলেন।দুলাভাই ড্রাইভারের দিকে একটু তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন।দেখলেন মলি আর দিপু দুজনেই ভুরু কুঁচকে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
(শেষ)
বি.দ্রষ্টব্যঃ
এতোদিন “বিয়ের চাপ”এর সাথে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।এই গল্পে শিক্ষণীয় কিছুই ছিল না।শুধুমাত্র ফান করার জন্যই এই লেখা।জানিনা আপনাদের কেমন লেগেছে।চাইলে মন্তব্য করে জানাতে পারেন।
অন্যরকম বউ গল্পের লিংক