ফ্রিজ পর্ব ১০
সময় কেমন করে যে চলে যায়! ঘোড়ার মতো দৌড়ে শেষ হয়ে গেছে দুই মাস! আর কয়েকদিন পরে কুরবানির ইদ। এই ইদটা আমার মোটেই ভালো লাগে না! এ সময় আমরা খুব একটা বাইরে বের হই না। মানুষজনের সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস “করে তোরা গরু কিনেছিস?”
আমার খুব লজ্জা লাগে! আমি কিছু বলি না। শুধু একটু হেসে মাথা দুলিয়ে সরে যাই। তাই এ সময় বাইরে বের না হওয়াই ভালো।
আপাও আমার মতো বের হয় না।
হঠাৎ আমাদের বাড়িতে টুম্পা হাজির। ওকে দেখে আমার একটু খারাপ লাগল। মনে হয় গরু কিনার গল্প করতে এসেছে। টুম্পা মাঝেসাঝে আমাদের বাড়ি আসে। ও কে আমার ভালোই লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ওর মা কে। ওদের বাড়ি যখন প্রথম গেলাম। একদিন জোর করে টুম্পা নিয়ে গেল। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে “তোমার বাবা কী করে?”
তারপর যখন শুনে আমার বাবা সামান্য একজন গার্ড। তখন তাদের ব্যবহার কেমন পরিবর্তন হয়ে যায়! আমার খুব খারাপ লাগে সে সময়টাতে। তাই কারো বাসায় যাই না। কিন্তু টুম্পার মা একবারও বাবা কী করে জানতে চায়নি। আমার সাথে অন্যদের মতোই ব্যবহার করে। তবুও ওদের বাড়িতে আমার ভালো লাগে না! কী সব দামি দামি জিনিসপত্র ওদের বাড়িতে। গেলেই মনে হয় ভিন্ন এক জগতে চলে এসেছি। আমি এই জগতের মানুষ না।
টুম্পা হাসি মুখে আমাদের ঘরে ঢুকল। মা কে দেখে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছে আন্টি?”
মা একটু হাসি দিয়ে বলল,” ভালো। তা তুমি কেমন আছ মা?”
“খুব ভালো আছি আন্টি।”
আমি টুম্পার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ও মা কে বলল, “আন্টি রুনু কে আমাদের বাড়িতে একটু নিয়ে যাই?”
মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,” ঠিক আছে যা। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি কিন্তু। “
টুম্পার সাথে ওদের বাড়ি এলাম। আমাকে দেখে টুম্পার মা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “কেমন রুনু?”
আমিও একটু হাসি দিয়ে বললাম, ” ভালো আন্টি।”
“তোমাকে খুব একটা দেখা যায় না। আমি টুম্পা কে পাঠালাম তোমাকে নিয়ে আসতে। তা তোমরা একটু খেলো কেমন আমি চট করে একটু ঘুরে আসি।”
উনি হালকা সবুজ রংয়ের একটা শাড়ি পরেছেন। দেখতে বেশ ভালো লাগছে! যাওয়ার আগে টুম্পা কে ডেকে বলে গেলেন।” টেবিলে খাবার রাখা আছে রুনু মা কে নিয়ে খাইস।”
টুম্পার ঘরে গেলাম। ওর জন্য আলাদা একটা ঘর আছে। কী সুন্দর একটা খাট! পাশেই একটা টেবিল, একটা লম্বা ডিজাইন করা আয়না লাগান ড্রেসিং টেবিল। খাটের ওপরটা কী নরম! আমি চেয়ার বসে বললাম, “তুই ও বই পড়িস নাকি রে?” টেবিলে একটা বই আধা খুলা অবস্থায় পড়ে আছে।
“হ্যাঁ, পড়ি তো। তুই পড়িস না? “
“না রে। আমার আপু খুব বই পড়ে।”
“পড়িস না কেন? খুব মজা এ সব বই পড়তে!
আমি কিছু বললাম না। ওর সাথে ওদের ড্রয়িং রুমে আসলাম। এ ঘরটা দেখে আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল! কত বড়ো একটা টিভি দেয়ালে লাগান! ওদের কত টাকা! আমার বাবার একটা ফ্রিজ কেনার টাকা নেই!
“টুম্পা বলল, “চল টিভি দেখি।”
বলেই একটা রিমোট নিয়ে টিভিটা ছাড়ল টুম্পা। ইয়া বড়ো বড়ো কার্টুন চলছে। টুম্পা হা হি করে হাসছে। দেখতে আমারও ভালো লাগছে!
“পুডিং খাবি রুনু?”
মাথা ঝাকিয়ে না বললাম। তবুও ছুটল টুম্পা। সুন্দর ফুল করা পিরিচে পুডিং নিয়ে হাজির। হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “খেয়ে দেখ দারুণ স্বাদ! মা যা ভালো পুডিং বানায় না।”
নিজের পিরিচ থেকে ছোটো চামচ দিয়ে টুকরো করা পুডিং মুখে পুড়ল টুম্পা। চোখমুখ কেমন বন্ধ করে আঃ! করল।
আমিও একট টুকরো মুখে নিলাম। না, ভালোই লাগছে খেতে! আবার একটু খারাপ লাগছে!
আবার শুরু হলো কার্টুন দেখা। কী সব হাসির কার্টুন চালাচ্ছে টুম্পা। না হেসে থাকাই যায় না।
একটু পর ছুটছে আর এটা-সেটা নিয়ে হাজির হচ্ছে। না চাইলেও খেতে হচ্ছে। এত জোর করে টুম্পা না বলা যায় না।
দুপুরের সময় ফিরে এলো আন্টি। এসেই ঝটপট খেতে দিলো আমাদের। নিজেও বসে পড়ল। গরুর মাংস, ডাল ভুনা, মাছ ভাজা, আরও দুই পদের বাজি! এত সব এক বেলায় খায় টুম্পরা? নাকি আজ আমি আসব বলে করেছে, কে জানে?
আরেকদফা চা নাস্তা করে ফিরতে হলো ওদের বাড়ি থেকে। একবারও আন্টি জিজ্ঞেস করল না আমরা গরু কিনেছে কিনা? বা ওনাদের গরু কিনার কথা। এমনকি টুম্পাও এ সব কিছু বলল না। হয়ত ওদেরটা কিনেছে বা ইদের আগের রাতে কিনবে। আসার সময় আন্টি বললেন, “ইদের দিন চলে এসো মা।”
আমি একটু হাসি দিলাম। এ হাসির মানে কি আমি আসব? তা আমিও জানি না।
বাবার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা এখন বাসায় আছে। বিকালে আনোয়ার চাচা এসে বলল,” রুনু তোর বাবা কোথায় রে মা?”
বাবা ঘরেই ছিলেন। আমি বললাম ভিতরে আসেন চাচা। চাচা আমাদের ঘরে ঢুকলেন। আমার আর আপার ঘরে এসে চেয়ারে বসলেন। আনোয়ার চাচার কথা শুনেই বাবা উঠে এসেছেন। “কেমন আছেন ভাইজান? “
আনোয়ারা চাচা একটু হাসি দিয়ে বলল, “আল্লাহ ভালোই রাখছে।”
বাবার ইশারায় আমি ছুটলাম মায়ের কাছে চা করার কথা বলতে। আপা মায়ের পাশে বসে আছে। আমি মা কে বললাম, “মা চা বানাও তো আনোয়ার চাচা এসেছেন। “
মা একটা পাতিলে গরম পানি বসাল। আপা বলল, “মা তোমার ফ্রিজ কিনার কী হলো?”
মা একটু হাসি দিয়ে বলল। “খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।”
আপার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠল।” তারমানে তুমি টাকা জমিয়ে ফেলেছ! এত খুব ভালো খবর মা।”
আমারও খুব ভালো লাগছে! আমাদের বাসায় ফ্রিজ আসবে। যখন ইচ্ছে টুপ করে খুলে ঠান্ডা পানি খাব। মাঝে মাঝে আইসক্রিমও বানান যাবে।
আপা চা আর বিস্কুট নিয়ে এলো। চাচার সামনে রেখে বলল, “নেন চাচা চা খান।”
“তোরা আবার এ সব ঝামেলা করতে কেন গেলি!”
আনোয়ার চাচা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আলত করে চুমুক দিয়ে বলল,” তাহলে ভাইজান আগামীকাল আমার সাথে যেতে হবে কিন্তু। আপনারা ছাড়া আমার কে আছে! মেয়ে একটা থেকেও তো নেই!”
আনোয়ার চাচা কুরবানির গরু কিনবেন। তাই বাবা কে সাথে যেতে বলে গেলেন। প্রতি বছর আনোয়ার চাচা একটা গরু কুরবানি দেন। গরু সাধারণত ইদের আগের রাতে কেনা হয়।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ