বন্ধু পর্ব ৪
তৃষ্ণার চোখটা লেগে এসেছিলো, ঠিক সেই সময় মনে হলো ড্রয়িং রুম থেকে যথেষ্ট জোরে অরুণের গলা শোনা গেলো। তৃষ্ণা ধুম করে বিছানায় উঠে বসলো। কিছু একটা হয়েছে? আজ কি যে শুরু হয়েছে! আর ভালো লাগছে না, অরুণের বন্ধুরা আসার পর থেকে অরুন একবারের জন্যও তাদের বেড রুমে আসে নাই।
এদিকে বাসায় একজন নতুন গেস্ট এসেছে, হউক সে অরুণের বন্ধু, তাতে কি? তৃষ্ণার তো একটা দায়িত্ব আছে? সে উঠে ড্রয়িং রুমে গিয়ে থ হয়ে গেছে, রিফাত ভাই শাহিন নামের মহিলাটার নাকে রুমাল ধরে আছে, রক্তে মহিলার পরনের ওড়না ভিজে গেছে, তৃষ্ণা ভয় পেয়ে গেছে।
তৃষ্ণা তখন অরুনকে বলল,
– অরুণ ওনার কি হয়েছে?
ঠিক এই সময় শাহিন হাতের ইশারায় তৃষ্ণাকে ডাকলো, তৃষ্ণা কাছে যেতেই দেখলো শাহিনের ঠোঁটের কোন দিয়ে রক্ত চুয়িয়ে পড়ছে। তখন শাহিন কিছু বলার আগেই, রিফাত কোন রকমে বলল,
তৃষ্ণা কিছু আনো, শাহিনের ব্লিডিং শুরু হয়েছে।
রিফাত বুঝতে পেরেছিলো এখনই শাহিনের নাকের সাথে, সাথে মুখ দিয়েও বিল্ডিং শুরু হবে।
এত রক্ত দেখে সবাই অস্হীর হলেও রিফাত ঠিক আছে, সে বুঝতে পেরেছে শাহিন সিক, সম্ভবত শাহিনের লিভার ফুটা হয়ে গেছে। বা লিভার সিরোসিস হয়েছে।
রিফাত শাহিনকে ব্লাড বন্ধ হওয়ার একটা ইনজেকশন দিলো, তারপর জিয়াকে বলল,
জিয়া গাড়ি বের কর, শাহিনকে কোন হসপিটালে নিতে হবে এখনই, ওর অবস্থা ভালো না। আর কিছুক্ষন এভাবে ব্লিডিং হলে বিপদ হবে।
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
তৃষ্ণা তোমার কোন সমস্যা না হলে তুমি আমাদের সাথে হসপিটালে চলো, আর তোরা কি সবাই যাবি?
এবার অরুণ আর তৃষ্ণা প্রায় একই সময়ে বলল,
– কোন সমস্যা নাই,
তৃষ্ণা তাড়াতাড়ি করে ছোট একটা ব্যাগে কিছু জরুরী জিনিস নিয়ে নিলো।
রিফাত তরুণকে বলল,
-অরুণ তুই আর তৃষ্ণা শাহিনকে নিয়ে আমার গাড়িতে বসবি তোর গাড়ি নেওয়ার দরকার নাই। বাবু আর জিয়া তোরা তোদের মতো করে আয়।
শাহিন একদম নেতিয়ে পড়েছে ও কোন রকমে বলল,রিফাত আমার ব্যাগে আমার সব মেডিক্যাল রিপোর্ট আছে ।
গাড়িতে, শাহিনকে একরকম জড়িয়ে ধরে বসে আছে তৃষ্ণা, অরুণও শাহিনের একটা হাত ধরে রেখেছে আর বারবার বলছে,
– শাহিন মনে সাহস রাখ, তোর কিছু হয় নাই, আমরা সবাই আছি তোর সাথে, আর আমাদের রিফাত তো নিজেই ডাক্তার, তোর কোন ভয় নাই।
শাহিনের চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে, পানি রক্ত সব মিশে যাচ্ছে। তৃষ্ণা এত রক্ত দেখে মনে মনে ভাবছে, আর কিছুক্ষন ব্লিডিং হলে তো শাহিনকে বাচানোই অসম্ভব হয়ে যাবে।
শাহিনকে নিয়ে ওরা হসপিটালের এমারজেন্সিতে নিয়ে আসার সাথে সাথে ওকে ভর্তি করে নিলো, রিফাত ইতিমধ্যেই শাহিনের, প্রেসকিপশন আর মেডিক্যাল রিপোর্ট সব দেখে ফেলেছিলো। রিফাত ডাক্তারদেরকে
শাহিনের সব কিছু বুঝিয়ে বলল,তাতে করে চটকরে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
রিফাত এখনো বুঝতে পারছে না, শাহিন কেন এত অসুস্থ অবস্থায় একা-একা চলা ফেরা করছে, ও কেন ওদের কাছে এসেছে?
বাবু আর জিয়া অরুনকে বলল,
অরুণ তোরা শাহিনের সাথে থাক, কখন কি লাগে বলা তো যায় না, আমরা একটা বুথ থেকে ঘুরে আসি।
অরুণ বলল,আমি তো কিছু টাকা নিয়ে এসেছি সেটা দিয়ে আপাতত চলবে, সকাল হউক তারপর দেখা যাবে।
বাবু এবার বলল,নারে রিস্ক নেওয়া যাবে না টাকা হাতে রাখতে হবে।
জিয়া আর বাবু এটিএম বুথ থেকে টাকা নিয়ে হসপিটালের ওয়েটিং রুমে এসে দেখে, রিফাত,তৃষ্ণা আর অরুণ কথা বলছে।
এবার রিফাত বাবু আর জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,শোন শাহিনকে নিয়ে কথা বলছিলাম জিয়া তোর ব্লাডগ্রুপ এ পজিটিভ তাই না?
-হ্যা, রক্ত দিতে হবে?
– এখনই লাগবে, অন্তত তোর ব্লাডের ক্রস মেচিং হয়ে গেলে এক ব্যাগ দিতে দিতে আরো পাঁচ ব্যাগ রেডি করে ফেলতে হবে।
– কি বলিস এত ব্লাড লাগবে?
– শাহিনের ব্লিডিং টা মনে হয় কয়েকদিন থেকে হচ্ছে, এর আগে মনে হয় স্টুলের সাথে যাচ্ছিল, হয়তো-বা শাহিন বুঝতে পারে নাই, ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছিল।
বাবু বলল,
শাহিনের কি হয়েছে? ক্যান্সার?
– শাহিনের লিভার সিরোসিস হয়েছে তবে পর্যায়টা কেমন আগামীকাল সব টেস্টের রিপোর্ট আসলে বলতে পারবো, ওর সিরোসিস ধরা পড়েছে ছয় মাস আগে। ওর ব্যগে প্রেসকিপশন ছিলো, তার মানে শাহিন ওর অসুখের কথা জানে।
একটু পরেই শাহিনের হিমোগ্লোবিনের রিপোর্ট চলে আসবে, সেই অনুযায়ী কত ব্যাগ, ব্লাড লাগবে তা বলা যাবে। বেশি করে জোগাড় করে রাখলে তো কোন সমস্যা নাই, আমি চাচ্ছি না কোন রকম রিস্ক নিতে।
কথা শেষ করেই রিফাত, জিয়াকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো ব্লাডের ক্রস-ম্যাচিং- এর জন্য।
তৃষ্ণা এবার অরুণকে বলল,
-অরুন ওনার বাসায় খবর দিতে হবে।
– তৃষ্ণা কি হবে এত রাতে, ওনাদের খবর দিয়ে?হয়তো আসতে পারবে না শুধু শুধু টেনশন করবে।আর আমরা তো কেউ শাহিন কোথায় থাকে? কেন এসেছে, কিছুই জানি না, আর ওর পরিবারের কারো সাথে আমাদের তো এখন কোন যোগাযোগ নাই। ওর যখন বিয়ে হয় তখন এত ফেসবুক আর মোবাইল ছিলো না, হাতে হাতে।
বাবু বলল,
– দেখ, শাহিন যখন একা-একা তোর বাসায় চলে এসেছে তা হলে কোন ঘটনা আছে, বাদ দে, শাহিন একটু সুস্থ হউক, আগামীকাল সকালে শাহিনের সাথে কথা বলে তারপর ওর বাসায় জানানো যাবে।
আসলে তৃষ্ণার খুবই ভয় হচ্ছে, মনে হচ্ছে যদি শাহিনের কিছু হয়ে যায় রাতের মধ্যে, তা হলে কি হবে?তৃষ্ণা এবার বলল,
– অরুণ আমার ভয় করছে, যদি ওনার কিছু হয়ে যায় তা হলে ওনার পরিবারকে কি বলবে? ওরা হয়তো তোমাদের দোষারোপ করবে।
বাবু আর অরুণ অবাক হয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে! ওদের তাকানো দেখে তৃষ্ণা তাড়াতাড়ি করে বলল,
– না,না আমি ঠিক এটা বলতে চাই নাই, উনি ভালো হয়ে যাবে।
সারারাতের জেগে থাকা আর হসপিটালের ধকলে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেছে, সবার কর্মক্ষেত্র আছে, তৃষ্ণার ও অফিস আছে, ওরা সবাই হসপিটালের ক্যান্টিনে নাস্তা খেতে বসেছে, আর এখানে ওরা আলোচনা করছে শাহিনকে নিয়ে কি করা যায়? শাহিনের এখন যে অবস্থা তাতে করে হসপিটালে একজন এটেনডেন্স থাকতে হবে সব সময় ।
ওরা আলোচনা করে ঠিক করে, শাহিনের সাথে রিফাত কথা বলবে, তারপর শাহিনের হাসবেন্ডকে কল দিয়ে বিস্তারিত বলবে, রিফাত, জিয়া আর বাবুর বাসায় তৃষ্ণা শাহিনের বিষয়টা খুলে বলবে, কারণ এখন সবার সহযোগিতা লাগবে।
শাহিনের হাসবেন্ডকে তৃষ্ণা কল দিয়ে,তার পরিচয় দেয় শাহিনের বান্ধবী হিসাবে, আর বলে, শাহিন তার বাসায় বেড়াতে এসে সিক হয়ে গেছে। এখন হসপিটালে আছে।
এই কথা শুনে শাহিনের হাসবেন্ড যা বলল,তাতে তৃষ্ণা একটু লজ্জা পেয়ে গেলো।
– কিছু মনে করবেন না, আমি যতটুকু জানি, শাহিন তো ওর কোন বান্ধবীর বাসায় যায় নাই। ও গিয়েছে ওর অরুণ নামের একজন বন্ধুর বাসায়। আর আমি নিজে ওকে দেখেছি অরুণের সাথে বাসার ভেতরে যেতে।
তখন তাড়াতাড়ি করে তৃষ্ণা বলে,
– জি, অরুণ আমার হাসবেন্ড, আসলে রাতে বেলাই শাহিন আপা সিক হয়ে গেছে তো তাই তারাহুরো করে ওনাকে হসপিটালে নিতে গিয়ে আপনাকে জানানো হয় নাই।
তখন শাহিনের হাসবেন্ড বলল,
– কিন্তু আমি তো গতকাল রাতের ট্রেনেই চিটাগং চলে এসেছি, আর আজ আমার একটা খুবই জরুরী কাজ আছে আমি তো ঢাকা যেতে পারবো না।
ওকে কোন হসপিটালে ভর্তি করেছেন?
তৃষ্ণা যখন হসপিটালের নাম বলল,তখন উনি একটু ঠান্ডা গলায় বললেন,
-ওখানে তো অনেক খরচ, কোন সরকারি হসপিটালে নিয়ে গেলেই হতো!
এই কথা শোনার পরে তৃষ্ণা বুঝতে পারছিলো না কি বলবে,তৃষ্ণা তখন তাড়াতাড়ি করে বলল,
– ভাই প্লিজ, আপনি টাকা নিয়ে কোন টেনশন করবেন না, আমরা সবাই তো আছি, আপনি চেষ্টা করেন আগামীকাল চলে আসতে।
তৃষ্ণার মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে, শাহিনের হাসবেন্ডের সাথে কথা বলে, ও এখন বুঝতে পারছে শাহিন যে কারণেই তাদের এখানে আসুক না কেন, তা শাহনের হাসবেন্ড জানে।
তৃষ্ণা একে একে অরুণের সব বন্ধুর বাসায় তৃষ্ণার বিষয়টা জানায় কারণ, একটু আগে রিফাত এসে বলে গেছে শাহিনের অবস্থা খুবই খারাপ ওকে এখনই আই সি, ইউ তে নিতে হবে, শাহিনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। এই অবস্থায় শাহিনকে হসপিটালে রেখে ওদের পক্ষে বসায় বা অফিস কোথাও যাওয়া সম্ভব না।
তৃষ্ণার ওদেরকে বলল, শাহিনের হাসবেন্ডের সাথে কি কথা হয়েছে তা।
বাবু তখন রেগে গিয়ে বলল,
একজন মানুষ মরে যাচ্ছে শালা বলে কিনা তার মিটিং আছে, আবার টাকার কথা।
এবার জিয়া রেগে গিয়ে বাবুকে বলে, বাবু একজন ক্যান্সার পেসেন্ট বা লিভার সিরোসিসের চিকিৎসার কত খরচ হয় জানিস? যার পরিবারে এই রকম একজন পেসেন্ট আছে সেই শুধু জানে টাকা কত বড় বিষয়।
বাবু এবার লজ্জা পেয়ে যায় কারণ জিয়ার বাবা মারা গেছে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে।
তৃষ্ণা জিয়াকে বলতে পারলো না,শাহিনের হাসবেন্ড আসলে কতটা আবেগশূন্য গলায় কথা গুলো বলছিলো, কোন লোকের নাম স্ত্রীর প্রতি সামন্যতম ভালোবসা থাকলে এমন করে বলা যায় না। শাহিনের হাসবেন্ডের সাথে কথা বলার পর থেকে তৃষ্ণার শাহিনের আলাদা একটা মমতা কাজ করছে, এখন তার কাছে খুবই ভালো লাগছে শাহিনের প্রতি তার হাসবেন্ড আর তার বন্ধুদের এত উৎকন্ঠা দেখে।
অরুণ তখন বলে,আচ্ছা এই সব আলাপ এখন একদম বাদ, আমাদের কাছে যখন শাহিন আছে, তখন শাহিনের চিকিৎসা টাকার অভাবে বন্ধ হবে না।
সবাই তরুনের কথায় এক সাথে বলে অবশ্যই।
এদিকে তৃষ্ণার কল পেয়ে, জিয়া,বাবু,আর রিফাতের বউ হসপিটালে চলে আস,তারপর তৃষ্ণা সবাই কে মোটাসোটা ভাবে শাহিন কি ভাবে আসলো আর টুকটাক ওদের কাছ থেকে শাহিন সম্পর্কে যা শুনেছে তা বুঝিয়ে বলেছে, আর এও বলেছে, প্লিজ তেমরা কেউ এখন ওদের কিছু বলো না বাসায় না বলে আসার জন্য। ওরা সবাই খুবই আপসেট হয়ে আছে। তারপর যখন শাহিনের হাসবেন্ডের কথা বলল তখন নেহা বলল,এই শাহিন মহিলা ভালো হলে বলতে হবে ওর হাসবেন্ডকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে।
তখন তৃষ্ণা বলল,
– নেহা, শাহিনের লিভার সিরোসিস এখন ক্যান্সারের দিকে চলে গেছে একটু আগে আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছি, কিন্তু ওদের কিছু বলি নাই।
রিফাত, জিয়া,অরুণ আর বাবু সবাই শাহিনের বেডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, সবার চোখে পানি, একটু পরে শাহিনকে আই. সি. ইউ তে নেওয়া হবে।
তৃষ্ণার মধ্যে শাহিনকে নিয়ে কত কৌতূহল ছিলো এখন তৃষ্ণার কাছে মনে হচ্ছে শাহিন নামের মেয়েটা সংসার জীবন কেমন ছিলো? সুখের, না দুঃখের সে জানে না, তারপর মেয়েটার এত বড় একটা অসুখ হয়েছে হয়তো বেশি দিন বাঁচবে না, কিন্তু মেয়েটার একটা ভগ্য ভালো, তা হলো ওর বন্ধু ভাগ্য।
পরের সাতটা দিন কি ভাবে যে কেটেছে সবার, তরুণরা চার বন্ধু, বন্ধুর বউরা সবাই মনে হলো পন করেছিলো শাহিনকে তারা যমের কাছ থেকে কেড়ে আনবেই।সবাই পালাকরে হসপিটালের ডিউটি করতো এর মধ্যে তরুনদের চার বন্ধুর মুখে শুধু তাদের পুরাতন কথা, তাদের জানের বন্ধু শাহিনের কথা, শাহিন ওদের জন্য কত মার খেয়েছে বাসায় সেই সব গল্প।
অরুনের বন্ধুদের বউরা কেউ শাহিন নামের মেয়েটাকে নিয়ে এমন কোন কথা ভুলেও বলে নাই যা শুনে তাদের হাসবেন্ডরা কষ্ট পাবে।
চলবে…